২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

জনমনে অশান্তি! শান্তি বহু দূরে

- ফাইল ছবি

‘শান্তি দিবস’ পালন মানেই মনের শান্তি নয়
প্রতি বছর ২১ সেপ্টেম্বর পালিত হয় ‘আন্তর্জাতিক শান্তি দিবস’ তথা ইন্টারন্যাশনাল ডে অব পিস। বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে প্রায় ৩০০ দিনই বিভিন্ন প্রকার আন্তর্জাতিক ও জাতীয় দিবস আমাদের দেশে পালিত হয়ে থাকে। জাতীয় ইতিহাস, জাতীয় সংস্কৃতি ও জনমানুষের আবেগের সাথে যেসব দিবস জড়িত সেগুলো পালিত হয় গভীরভাবে, নিবিড়ভাবে ও ব্যাপকভাবে। আন্তর্জাতিক দিবসগুলো পালিত হয় অনেকটা আনুষ্ঠানিকতার আবরণে এবং ঢাকাকেন্দ্রিক। অতএব, ২১ সেপ্টেম্বর তারিখটিতে ‘আন্তর্জাতিক শান্তি দিবস’ অনেক ব্যাপকভাবে পালিত না হওয়ার কথা; এবং অতীতেও তা হয়নি। তবে এই দিবসটির শিরোনামের সাথে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের হৃদয় এবং আবেগ জড়িত। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশে দেশে যেসব হানাহানি-সঙ্ঘাত বিদ্যমান, সেগুলো নিরসন করার জন্য আন্তর্জাতিক মহলই চেষ্টা করে। এই চেষ্টার আনুষ্ঠানিক উদ্যোক্তা হলো জাতিসঙ্ঘ তথা ইউনাইটেড নেশনস অর্গানাইজেশন।

জাতিসঙ্ঘের উদ্যোগে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে, সঙ্ঘাতরত পক্ষগুলোর মধ্যে শান্তি স্থাপনের জন্য, শান্তি রক্ষা বাহিনী মোতায়েন করা হয়। ইংরেজি পরিভাষায় বলা হয় ‘ইন্টারন্যাশনাল পিস কিপিং ফোর্স’। বাংলাদেশ জাতিসঙ্ঘের আহ্বানে সাড়া দিয়ে অনেক স্থানে শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ করে আসছে। বস্তুত, গত দু’চার-পাঁচ বছর ধরে আন্তর্জাতিক পিস কিপিং মিশনে সৈন্য জোগানদাতা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ শীর্ষস্থানে অবস্থান করছে। অতএব, শান্তি নামক শব্দের সাথে, শান্তি নামক অনুভূতির সাথে এবং শান্তি স্থাপনের প্রক্রিয়ার সাথে বাংলাদেশের মানুষের সুপরিচয় আছে। কিন্তু আসলেই কি বাংলাদেশের মানুষের মনে শান্তি আছে? উত্তর হলো, মানুষের মনে শান্তি নেই। কেন নেই, সেই আলোচনা পরবর্তী কয়েকটি অনুচ্ছেদে করছি।

পারস্পরিক সহনশীলতা
আমাদের সমাজে অস্থিরতা বৃদ্ধি পেয়ে এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ কমতে কমতে শেষপর্যায়ে চলে এসেছে। আমাদের সমাজে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে ও বড়-ছোট সব বলয়ে অশান্তি বিদ্যমান। প্রথমে সহনশীলতা নিয়ে লিখছি। আমরা যদি সহনশীল হই, তাহলে অন্যের মতকে সহ্য করতে পারব; আমার মতের সাথে দ্বিমত পোষণকারী ব্যক্তিদের মতকে সহ্য করতে পারব। যদি সহনশীল হই, আমার সমালোচককে সহ্য করতে পারব। যদি সহনশীল হই অন্যের ভুলত্রুটিকে সহ্য করতে পারব তথা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভুলের জন্য উত্তেজিত হব না এবং চরম শাস্তি দেবো না। আমি যদি সহনশীল হই, তাহলে আমার অভাবটাকে প্রকটভাবে দেখব না; ধৈর্যের সাথে মোকাবেলা করব। আমার অভাবটা কোন কোন আঙ্গিকে হতে পারে?

সাংসারিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য টাকার সঙ্কট থাকতে পারে; বুদ্ধিমান সহনশীল বন্ধু-বান্ধবের অভাব থাকতে পারে; আমার কোনো কাজে উপদেশ ও পরামর্শ দেয়ার জন্য গুরুজন বা মুরব্বির অভাব থাকতে পারে; কোনো একটি কাজ সুষ্ঠুভাবে করার জন্য সময়ের অভাব হতে পারে। অনেকসময় আমার সময় থাকলেও, আমার বন্ধু-বান্ধব থাকলেও বা আমার গুরুজন থাকলেও, আমার সহকর্মীদের বা আমার অনুসারীদের বা আমার কনিষ্ঠদের এই জিনিসগুলোর অভাব থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রেই আমাকে সহনশীল হতে হবে। অন্যের অভাবটিকে অসামাজিকভাবে, উৎকটভাবে ও নেতিবাচকভাবে কিংবা বিদ্রƒপাত্মকভাবে কোনো সময় যেন উপস্থাপন না করি, সে জন্য আমাকে সচেষ্ট থাকতে হবে।

দেশে দেশে শ্রদ্ধাবোধের ধরন
শ্রদ্ধাবোধ এমন একটি জিনিস, যেটি আমাদের সামাজিক সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। ছোট্ট দু’টি উদাহরণ দেবো। ১৯৮২ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৮৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ১৩ মাস ইংল্যান্ডে ছিলাম সরকারি সামরিক বৃত্তি নিয়ে সামরিক বিষয়ে লেখাপড়ার জন্য। সেখানে অবস্থান সপরিবারে ছিল। আমার ছেলেমেয়েরা তখন নিতান্তই ছোট। লন্ডন মহানগরী থেকে ৪০-৪৫ মাইল দক্ষিণে, সাররে কাউন্টিতে অতি ক্ষুদ্র দু’টি সামরিক স্থাপনা ছিল। একটি রয়েল মিলিটারি একাডেমি স্যান্ডহারস্ট এবং অপরটি দি রয়েল স্টাফ কলেজ ক্যাম্বারলি। আমি ছিলাম স্টাফ কলেজের ছাত্র। আমার মতো যারা বিদেশী, তাদের স্থানীয় পরিবেশ-পরিস্থিতি, সামাজিক রীতিনীতি ইত্যাদির সাথে সহজে খাপ খাওয়াতে একটা ব্যবস্থা চালু ছিল। স্থানীয় অনেক পরিবার, একটি করে বিদেশী পরিবারকে স্পন্সর করত এক বছর সময়ের জন্য। তাদের কোনো আর্থিক ব্যয় ছিল না। তাদের ছিল সামাজিক দায়িত্ব।

সময়-মনোযোগ এবং কিছুটা শ্রম ব্যয় করত তারা বিদেশী পরিবারগুলোর জন্য। আমি এবং আমার পরিবারের জন্য যে পরিবারটি সিভিলিয়ন স্পন্সর হিসেবে ভলেন্টিয়ার করেছিল, সে পরিবারের ভদ্রলোকটির নাম ছিল পিটার এবং তার স্ত্রী ছিলেন ডায়না। তাদেরও দু’টি শিশু কন্যাসন্তান ছিল, যথাক্রমে সায়রা এবং রেবেকা। ভদ্রলোক এবং ভদ্রমহিলা অত্যন্ত আন্তরিক ছিলেন। তারা আমাদের দুই শিশুসন্তানকে ওই রূপ সন্তানতুল্য স্নেহে দেখেছিলেন। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেটি উল্লেখ করতে চাচ্ছি সেটি নিম্নরূপ। আমার কন্যা এবং আমার ছেলে উভয়েই পিটারকে ডাকত আঙ্কেল এবং ডায়নাকে ডাকত আন্টি। কারণ, বাংলাদেশী ছেলেমেয়েরা তাদের বাপ-মায়ের সমবয়সীদের বা তাদের বড়দের আঙ্কেল ডাকতে অভ্যস্ত। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে কনিষ্ঠরা সচরাচর জ্যেষ্ঠ কোনো ব্যক্তিকে নাম ধরে ডাকে না, এটিই আমাদের দেশের বা আমাদের সমাজের রেওয়াজ। যদি অনেক বেশি বয়স্ক ব্যক্তি হন, তাহলে যারা অনেক কনিষ্ঠ, তারা দাদু বা নানু বলে সম্বোধন করে অথবা বয়সের তারতম্য যদি অল্প হয় তাহলে আপা বা ভাইয়া বলে সম্বোধন করে থাকে। কিন্তু সেই ইংল্যান্ডে, পিটার এবং ডায়নার সন্তানদ্বয় আমাকে ডাকত মিস্টার ইবরাহিম এবং আমার স্ত্রীকে ডাকত শুধু নাম ধরে, ফোরকান। প্রথম সাক্ষাতের প্রথম পাঁচ মিনিট আমার লেগেছিল এই নতুন প্রক্রিয়ার সাথে ধাতস্থ হতে। ওইটিই সে দেশের জন্য স্বাভাবিক। শ্রদ্ধাবোধ আমাদের দেশে আমাদের সংস্কৃতিতে গভীর ও নিবিড়ভাবে প্রোথিত ছিল; সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ ক্ষেত্রে শিথিলতা দেখা গেছে।

দেশে শ্রদ্ধাবোধের অবনতি
আমাদের দেশ তথা আমাদের সমাজ অত্যন্ত বিখ্যাত ছিল শ্রদ্ধাবোধের আঙ্গিকে, আদবের আঙ্গিকে। বাংলায় প্রচলিত একটি কথা, শিক্ষক পিতৃতুল্য। আমরা ছোটবেলায় সেটি মনে করেই বড় হয়েছি। আমাদের সামাজিক সংস্কৃতিতে ছোটরা বড়দের সালাম দেবে, নমস্কার জানাবে, এটিই অতি বহুল প্রচলিত অভ্যাস। কিন্তু বিগত দশ-পনেরো-বিশ বছরকে যদি আমরা চারণক্ষেত্র মনে করি, তাহলে দেখবÑ শ্রদ্ধাবোধ কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশের সমাজে বিশেষত মুসলিম সমাজে, পিতামাতার স্থান ছিল প্রশ্নের ঊর্ধ্বে। মহান আল্লাহ এই শিক্ষা ও হুকুম দিয়েছেন। কিন্তু অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণে এখন পরিবারগুলো ছোট হচ্ছে এবং মহাদেশে মহাদেশে বিক্ষিপ্ত হয়ে যাচ্ছে। পিতামাতাকে খেদমত করার সুযোগ অনেকেই নষ্ট করছে, অনেকে পাচ্ছে না। আমাদের দেশে অনেক বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। ছোটকালে আমরা শিখেছিলাম কোনো বৃদ্ধ মানুষকে বাসে দণ্ডায়মান দেখলে, তরুণ যাত্রী নিজের সিট ছেড়ে দিয়ে বৃদ্ধ মানুষকে বসতে দেবে। ছোটবেলায় আমরা শিখেছিলাম, সর্বাবস্থায় মহিলাকে সম্মান করবে যে বয়সেরই হোন না কেন; এখন সেটি উঠে গেছে।

মানুষ দুর্নীতি করে এবং এ সংবাদ দেশব্যাপী ছড়িয়ে যায়। ফলে মানুষের মন থেকে অন্যের জন্য শ্রদ্ধাবোধ কমে যাচ্ছে। (আলোচনার জন্যই মাত্র এই অনুপাতটি দিলাম।) শিক্ষক সমাজের মধ্যে হাজারে একজন চুরি-চামারিতে ব্যস্ত বা ছাত্র ও ছাত্রীর সাথে অনৈতিক সম্পর্কে সম্পৃক্ত; ফলে দেশের লাখ লাখ শিক্ষকের প্রতি কোটি কোটি ছাত্রছাত্রীর ও কোটি কোটি অভিভাবকের শ্রদ্ধাবোধ কমে যাচ্ছে। পার্লামেন্টে জ্যেষ্ঠ বা কনিষ্ঠ, বর্ষীয়ান বা নবীন সদস্যরা বিপরীত মেরুর বড়-ছোট নেতাদেরকে নিয়ে যখন অশোভন কথা বলেন, অসামাজিক বিশ্রী কথা বলেন, তখন যারা বললেন, তাদের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা কমে যায়; বলতে গেলে- পার্লামেন্টের প্রতি শ্রদ্ধা কমে যায়; বলতে গেলে, সব রাজনৈতিক নেতার প্রতি শ্রদ্ধা কমে যায়। আমি বা আপনি সামরিক বাহিনীর মতো হুকুম দিলে বা পুলিশবাহিনীর মতো আইন প্রয়োগ করলে বা বিচার বিভাগের মতো শাস্তি দিলে, মানুষের মনে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ পুনরায় জাগ্রত হবে না। সমাজের মধ্যে যদি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ আনতেই হয়, তাহলে জ্যেষ্ঠ বর্ষীয়ান ব্যক্তিদের, প্রকাশ্যে যারা সমাজের কাছে দৃশ্যমান, তাদের এই আচরণ করে দেখাতে হবে। উদাহরণ দিচ্ছি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যদি সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে সম্মান না করেন, তাহলে আগামী দিনে আরেকজন প্রধানমন্ত্রী আজকের প্রধানমন্ত্রীকে হয়তো সম্মান করবেন না।

অশান্তির পরিচিত কিছু উৎস
অশান্তির অনেক উৎসের মধ্যে একটি হচ্ছে জঙ্গিবাদ বা উগ্রবাদ। অনেকে বলেন, জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদ উৎপত্তি হয় অশান্তি থেকে। অশান্তি দূর করে শান্তি স্থাপন একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া। শান্তি অনেক আঙ্গিকে তথা অনেক স্তরে হতে পারে যথা ব্যক্তিগত পর্যায়ে, পারিবারিক পর্যায়ে, ক্ষুদ্র সামাজিক গণ্ডিতে, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর গণ্ডিতে এবং দেশ বা জাতির পর্যায়ে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ের কথা তো অবশ্যই উল্লেখযোগ্য; আজ তা নিয়ে আলোচনা করব না। গত ১০-১২ বা ১৫-২০ দিনের সংবাদপত্রের শিরোনামগুলো অথবা টেলিভিশন সংবাদের শিরোনামগুলো যদি স্মৃতি থেকে এই মুহূর্তে টেনে সামনে আনেন, তাহলে কত প্রকারের অশান্তির খবর যে আপনাকে গুনতে হবে সেটি নিজেও কল্পনা করতে পারবেন না; আমিও পারছি না।

সাধারণত যেসব খবর আমাদের মনে অশান্তি সৃষ্টি করত, সেগুলোর কিছু উদাহরণ দিচ্ছি : সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর খবর, নিরাপত্তাবাহিনীর ওপর বিদ্রোহী গোষ্ঠীর আক্রমণের কারণে মৃত্যুর খবর, পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের ওপর স্থানীয় সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর আক্রমণের খবর, মসজিদের ভেতরে বা বাইরে আত্মঘাতী বোমা হামলায় মৃত্যুর খবর, প্লেন দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার খবর, ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর খবর ইত্যাদি। স্বামী এবং স্ত্রী পরস্পরকে হত্যা করছে, পিতা-মাতা সন্তানকে হত্যা করছে, সন্তানেরা পিতা-মাতাকে হত্যা করছে, ভাই ভাইকে হত্যা করছে, কেউ বা প্রতিবেশীকে হত্যা করছে, কথিত বন্দুকযুদ্ধে কথিত অপরাধী নিহত হচ্ছে; এগুলো হলো মৃত্যুর বিভিন্ন রূপ। সবই হলো অশান্তির ফসল। কোনো ব্যক্তি যদি তার অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান নিয়ে বিক্ষুব্ধ থাকে তাহলে সে মানসিক অশান্তিতে ভোগে। কোনো পরিবার যদি তার প্রতিবেশী পরিবারের আর্থসামাজিক অবস্থানকে হিংসা করে, তাহলে পারিবারিকভাবে তারা থাকে অশান্তিতে। পরিবারের অভ্যন্তরেই যদি একজন আরেকজনকে সন্দেহ বা অবিশ্বাস করে, তাহলে সেখানে অশান্তি থাকে। কোনো একজন ছাত্র যদি বিনা পরিশ্রমে ভালো ফল করতে চায় কিন্তু পেরে ওঠে না, তখন সে অশান্তিতে ভোগে। আরো অনেক উদাহরণ দেয়া যায়।

অতি সাম্প্রতিক অশান্তির কারণ
‘সাম্প্রতিক’ বলতে গত আট-দশ বছরকে বুঝাচ্ছি। অতি সাম্প্রতিক বলতে গত পাঁচ-সাত মাসকে বুঝাচ্ছি। ২০১১ সালে যে সময় মৌখিক বা সংক্ষিপ্ত রায়ের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের সংবিধানকে সংশোধন করা হয়েছিল, সে দিন থেকে এ দেশে রাজনৈতিক অশান্তি শুরু। মৌখিক রায় প্রকাশের ষোলো মাস পর লিখিত রায় প্রকাশ করার পর দেখা গেল, মৌখিক ও লিখিত রায়ের মধ্যে অতি ক্ষুদ্র কিন্তু অতীব গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক কিছু পার্থক্য আছে। সম্মানিত বিচারপতিরা এভাবে একটি অশান্তির বীজ বপন করলেন। তারপর এলো ২০১৪ সালের নির্বাচন। মিডিয়ার মারফত মানুষ দেখল, নির্বাচন কেন্দ্রগুলো করছে খাঁখাঁ। একটি কেন্দ্রে একটি কুকুর শূন্য ময়দানে দাঁড়িয়ে অলস সময় পার করছিল। এরূপ একটি ছবি পৃথিবীর বিবেককে নাড়া দিলেও, ক্ষমতাসীন সরকারের রাজনৈতিক বিবেককে নাড়া দিতে পারেনি। তারপর এলো ২০১৫ সাল। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি কর্তৃক আহূত অবরোধ এবং সরকারপক্ষ থেকে দমননীতি। অনেক মানুষ মারা গেল বিভিন্নভাবে। সমাজের অস্থিরতা একটা রূপ পেয়ে গেল; মানুষের মনে ভয় ঢুকে গেল।

দমননীতি পেয়ে গেল প্রাতিষ্ঠানিকতা। তারপর এলো ২০১৮ সালের নির্বাচন। এতে মানুষ ভোট দিতে পারল না। আক্ষরিক অর্থে চোখের সামনে নয়, কারণ রাতে তো চোখে দেখা যায় না। ভোটকেন্দ্র খোলা হলো, ব্যালট পেপারে সিল মারা হলো, ভোটের বাক্স ভরা হলো এবং দিনে প্রকাশ্যে ফলাফল ঘোষণা করা হলো। শতাধিক কেন্দ্রে ‘একশত ভাগ’ বৈধ ভোট পড়েছে। সেসব কেন্দ্রের মৃত ও প্রবাসী ব্যক্তিরা কিভাবে ভোট দিলেন, জানি না। যা হোক, অসংগঠিত বিরোধী দলের অসমন্বিত প্রতিবাদ রাজনৈতিক সরকার এবং তাদের আন্তর্জাতিক বন্ধুদের চিন্তাভাবনায় গভীর আঁচড় কাটতে পারল না; হালকা আঁচড় কাটল। দেশের ভৌতকাঠামো-ভিত্তিক উন্নয়ন দেখে মানুষ যত না খুশি, তার চেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন যে, এই উন্নয়নকে দেখিয়ে দেখিয়ে কত গুণ বেশি টাকা লুটপাট হয়ে যাচ্ছে, সেই দুশ্চিন্তায়। যত বিদেশী ঋণ আনা হচ্ছে, সেগুলো তো শোধ করতে হবে এ দেশের মানুষকেই। দেশের মানুষের মনে গভীর রেখাপাত করছে যে, রাজনীতিবিদেরা দেশ চালাচ্ছেন না; আমলাতন্ত্র দেশ চালাচ্ছে, পুলিশতন্ত্র দেশ চালাচ্ছে। দেশের মানুষের মনে গভীর রেখাপাত করেছে যে, মানুষের জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই, ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের কোনো নিরাপত্তা নেই, কিশোর-কিশোরীদের কোনো নিরাপত্তা নেই।

এরূপ পরিস্থিতিতে সব অঘটনের জন্য বিরোধী দলকে দোষারোপ করার যে সংস্কৃতি, সেটিতে মানুষ অত্যন্ত বিরক্ত। মানুষ বলাবলি করছে, ডেঙ্গু মহামারীর জন্যও সরকার এখন বিএনপি-জামায়াতকে অভিযুক্ত করবে। কারণ, বিএনপি-জামায়াতকে যদি শত্রু হিসেবে খাড়া না করা হয়, তাহলে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল তাদের অপশাসন ও অদক্ষতার জন্য আর কোনো অজুহাত খুঁজে পাবে না। সাম্প্রতিক ডেঙ্গু মহামারী এবং সেটির চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় সরকারের প্রকট অদক্ষতা, প্রকট অসমন্বয় দৃষ্টিকটুভাবে মানুষের চোখে পড়েছে। মানুষের মনে অশান্তি ছাড়া অন্য কিছু নেই।

উপসংহার
বিভিন্ন ইস্যুতে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে খারাপ থেকে আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে। এখন প্রতিটি পরিবারে ডেঙ্গু আতঙ্ক কাজ করছে। ডেঙ্গু রোগী এত বেশি যে, হাসপাতালে জায়গা হচ্ছে না। ইতোমধ্যে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে এবং বেশ কয়েকজন মৃত্যুবরণ করেছে। ডেঙ্গু মহামারীতে রূপ নিয়েছে। অথচ শুরুতে এই ডেঙ্গুকে ‘গুজব’ বলে মন্তব্য করা হয়েছিল সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের মুখ থেকে। সিটি করপোরেশনের মেয়রের হাস্যকর বক্তব্য, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর টিটকারিমূলক মন্তব্য মানুষের মনে দাগ কেটে আছে। এর মধ্যেই পাশের দেশ ভারত, বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়, ভারত-বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সীমান্তরেখার কাছে, বাংলাদেশের আখাউড়া রেলশহরের কাছে, বাংলাদেশের জমি ব্যবহারের আবেদনের প্রসঙ্গটিও আলোচনায় এসেছে।

সে প্রসঙ্গে আজ লিখছি না, তবে লেখার সম্ভাবনা আছে। এখন বাংলাদেশের তরুণসমাজকে দেশ নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে। তরুণেরাই একটি দেশের প্রাণশক্তি। সেই তরুণ শক্তি যদি দেশের সঙ্কটে নীরব থাকে, তাহলে সার্বিকভাবেই দেশের অস্তিত্ব বিপন্ন হতে পারে। কোরবানির ঈদের আর মাত্র চার দিন বাকি; মেহেরবানি করে ঈদুল আজহার শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন। আগামী দু’টি বুধবার যথাক্রমে ১৪ এবং ২১ আগস্ট আমার লেখা কলাম পাবেন না; ইনশা আল্লাহ ২৮ আগস্ট আবার এই পাতায় দেখা হবে।
লেখক : মেজর জেনারেল (অব:); চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.generalibrahim.com.bd


আরো সংবাদ



premium cement