২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আমাদের পুলকিত হওয়ার কারণ নেই

রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু - ছবি : সংগ্রহ

রোহিঙ্গা সঙ্কট বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুতর বিষয় তাতে সন্দেহ নেই। ১৬ কোটি মানুষের দেশে বাড়তি ১১ লাখের বেশি মানুষকে আশ্রয় দিয়ে বছরের পর বছর ধরে লালন-পালন করার মতো সামর্থ্য এ দেশের নেই। তার চেয়েও বড় কথা, রোহিঙ্গাদের কারণে দেশটির আর্থ-সামাজিক এবং পরিবেশ ও নিরাপত্তার ওপর যে হুমকি তৈরি হচ্ছে, সেটা উপেক্ষা করার মতো নয়। সে কারণে শুরু থেকেই বাংলাদেশ এই সঙ্কট সমাধানের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আসছে, যদিও এখন পর্যন্ত তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি।

রোহিঙ্গা প্রশ্নে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের অভিন্ন বন্ধুরাষ্ট্র ভারত ও চীনের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ মৌখিক আশ্বাস ছাড়া কার্যকর কোনো সমাধান পায়নি। এমনকি, জাতিসঙ্ঘে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে প্রস্তাব গ্রহণের ব্যাপারেও ওই দুই দেশ পিছিয়ে থেকেছে। এর ফলে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিশ্বের যে ধরনের উদ্যোগ কাক্সিক্ষত ছিল সেটা হয়নি।

সম্প্রতি কিছুটা যেন হঠাৎ করেই এই ইস্যুতে নতুন ঘটনাবলি ঘটতে শুরু করেছে। মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলমানদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে গত মাসে দেশটির শীর্ষ চারজন সামরিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে যুক্তরাষ্ট্রে এই কর্মকর্তাদের প্রবেশ করতে দেয়া হবে না। সেই সাথে, যুক্তরাষ্ট্রে যদি তাদের ব্যক্তির মালিকানায় কোনো সম্পদ থাকে সেগুলো জব্দ করা হবে। যুক্তরাষ্ট্র ও এর সংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানের সাথে ব্যবসায়িক লেনদেন করতে পারবেন না তারা। যে চার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে সেনাবাহিনী প্রধান মিন অং লাইংও রয়েছেন। অন্য তিনজন হলেন ডেপুটি কমান্ডার ইন চিফ সো উইন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল থান এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অং অং।

ওই নিষেধাজ্ঞার পর গত ১৩ জুন মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশকে বাংলাদেশের সাথে যুক্ত করার প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে উত্থাপন করেন একজন কংগ্রেস সদস্য। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের দক্ষিণ এশিয়ার জন্য বাজেট-বিষয়ক শুনানিতে এ প্রস্তাব তোলেন কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদের এশিয়া প্রশান্ত-মহাসাগরীয় উপকমিটির চেয়ারম্যান ব্রাড শেরম্যান। তিনি রোহিঙ্গাদের আবাসভূমি, রাখাইন রাজ্যকে বাংলাদেশের সাথে যুক্ত করার বিষয়টি বিবেচনার জন্য পররাষ্ট্র দফতরের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেছেন, সুদান থেকে দক্ষিণ সুদানকে আলাদা করে একটি নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে যুক্তরাষ্ট্র যদি সমর্থন করতে পারে, তাহলে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কেন একই ধরনের পদক্ষেপ নেয়া যাবে না? মিয়ানমারে একটি ‘গণহত্যা’ সংঘটিত হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, মিয়ানমার যদি রাখাইনের রোহিঙ্গা নাগরিকদের দায়িত্ব নিতে না পারে, তাহলে যে দেশ তাদের দায়িত্ব নিয়েছে, সেই বাংলাদেশের সাথে রাখাইনকে জুড়ে দেয়াই তো যৌক্তিক পদক্ষেপ।

ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতিনিধিত্বকারী কূটনীতিকরা অবশ্য কংগ্রেসম্যান শেরম্যানের বক্তব্য সমর্থন বা নাকচ কোনোটিই করেননি বলে জানা গেছে। তবে রাখাইন রাজ্যকে বাংলাদেশের অন্তর্ভুুক্ত করার ব্যাপারে শেরম্যানের প্রস্তাবকে ‘অমূলক’ আখ্যা দিয়েছে মিয়ানমার। কিন্তু ঘটনা সেখানেই থেমে থাকেনি বরং নতুন মোড় নিতে শুরু করেছে।
সম্প্রতি মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ তুরস্কে সফরে গিয়ে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব অথবা তাদের পৃথক রাষ্ট্র দেয়ার দাবি তুলেছেন। তিনি বলেন, মিয়ানমারের সব জাতিগোষ্ঠীকে সে দেশের নাগরিক হিসেবে মর্যাদা দিতে হবে। তা না হলে তাদেরকে তাদের ভূমি দিতে হবে, যেখানে তারা নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে পারবে।
মিয়ানমারের পররাষ্ট্র সচিব মিন্ট থোয়ে-এর নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করছে। এই দলে আসিয়ানের পাঁচজন প্রতিনিধিও আছেন। তারা গত শনি ও রোববার কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে রোহিঙ্গা নেতাদের সাথে আলোচনা করেছেন এবং তাদেরকে নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তারা ‘শর্তসাপেক্ষে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয়ার ব্যাপারে মিয়ানমার সরকার প্রস্তুত’ বলেও জানিয়েছেন। মিন্ট থোয়ে রোহিঙ্গা নেতাদের সাথে আলোচনার পর বলেছেন, রোহিঙ্গাদের আমরা নাগরিকত্ব দিতে প্রস্তুত। তবে নাগরিকত্ব দেয়া হবে মিয়ানমারের ১৯৮২ সালের আইন অনুযায়ী। যারা দাদা, মা ও সন্তান এ তিন প্রজন্মের অবস্থানের প্রমাণ দিতে পারবে, কেবল তাদেরই নাগরিকত্ব দেয়া হবে। ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড (এনভিসি) অনুযায়ী যারা কাগজপত্র দেখাতে পারবে, তাদেরও নাগরিকত্ব দেয়া হবে।
কিন্তু বাস্তবে মিয়ানমারের ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের পূর্ণ নাগরিকত্ব পাওয়া একরকম অসম্ভব। কারণ এতে জন্মগত নাগরিকত্ব পাওয়ার কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। শুধু ‘অবস্থানগত নাগরিক’ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার সুযোগ আছে। আর রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের আদিবাসী গোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের দাবি বরাবরই প্রত্যাখ্যান করে আসছে মিয়ানমার সরকার। যাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে, তারা কিভাবে এখন অবস্থানের প্রমাণ দেখাবেন? যাদেরকে সরকারি চাকরি, শিক্ষা এবং নাগরিক সুবিধা পাওয়ার অধিকারবঞ্চিত রাখা হয়েছে, তারা তিন প্রজন্মের প্রামাণ্য কোনো নথি সংরক্ষণ করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। এনভিসির কাগজপত্র আদৌ রোহিঙ্গাদের দেয়া হয়েছে কি না তা স্পষ্ট নয়। এ পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা নেতারা কী সিদ্ধান্ত নেন, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দফতর রোহিঙ্গাদের স্বার্থ রক্ষায় কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে, সেটাও দেখার বিষয়।

মিয়ানমার প্রতিনিধিদলের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয়ার ঘোষণা কতটা আন্তরিক এবং নেপিডোর নেতৃত্বের রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রতিফলন, আর কতটা আন্তর্জাতিক ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্ট চাপের ফসল, তা বুঝতে সময় লাগবে। তবে রাখাইন অঞ্চলটিকে বাংলাদেশের সাথে মিলিয়ে দেয়ার প্রস্তাব কিন্তু মোটেই নতুন কিছু নয়। পাক-ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতার সময় রোহিঙ্গা নেতাদের একটি অংশ যারা মিয়ানমারের রাজনৈতিক নেতৃত্বের মূল ধারার অংশ ছিলেন, পাকিস্তানের সাথে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। এই প্রস্তাব নিয়ে তারা পাকিস্তানের তদানীন্তন নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে কয়েক দফা সাক্ষাৎ এবং বৈঠক করেন। কিন্তু জিন্নাহ বা ব্রিটিশ কোনো পক্ষই তখন রোহিঙ্গা নেতাদের প্রস্তাবে সাড়া দেননি। এখন মনে হয়, রোহিঙ্গা নেতারা মিয়ানমারের হিংস্র সাম্প্রদায়িক বৌদ্ধ সমাজে নিরাপদে বসবাস করতে পারবেন কি না তা নিয়ে হয়তো তখন থেকেই সন্দিহান ছিলেন। সেই সন্দেহ অমূলক ছিল না; পরবর্তী ইতিহাস তার সাক্ষী। যদি বলা যেত, রোহিঙ্গাদের তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করা হয়েছে, তাহলেও এক ধরনের সান্ত্বনার কারণ থাকত। কিন্তু কার্যত তাদেরকে রাষ্ট্রবিহীন জাতিতে পরিণত করে মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য করা হয়েছে মিয়ানমারে। একটি জাতিগোষ্ঠী হিসেবে তাদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়া হয়েছে। সুতরাং তাদের মধ্যে যেকোনো মূল্যে শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে বসবাসের নিশ্চয়তা পাওয়ার তীব্র আকাক্সক্ষা থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। মার্কিন কংগ্রেসম্যানের উল্লিখিত প্রস্তাব নিয়ে রোহিঙ্গা নেতাদের বক্তব্যে তেমন আভাসই পাওয়া যাচ্ছে।

অনলাইনে সার্চ করে রোহিঙ্গা নেতাদের যেসব বক্তব্য জানা গেল তারই কিছু নমুনা তুলে দিচ্ছি। ফ্রি রোহিঙ্গা কোয়ালিশনের নেতা রো নে সান লুইন বলছেন, মিয়ানমারকে ভাগ করে রাখাইন বাংলাদেশকে দিয়ে দেয়ার প্রস্তাবটি সহজ নয়। তার ভাষায়, ‘আমাদের দাবি-দাওয়া মেনে নেয়ার কোনো ইচ্ছে মিয়ানমারের নেই। তারা আমাদের এমন কোনো নিশ্চয়তা দিতে সক্ষম হয়নি, যার মধ্য দিয়ে আমরা নিজেদের নিরাপদ ভাবতে পারি।’ মার্কিন কংগ্রেসম্যানের প্রস্তাব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা কখনো আলাদা হতে চাইনি। সরকারই আমাদের রাষ্ট্রহীন করে নিজেদের জন্মভূমি থেকে ছিন্ন করেছে। তারা আমাদের অধিকার কেড়ে নিয়েছে। অর্থাৎ সান লুইন মার্কিন কংগ্রেসম্যানের প্রস্তাবকে ইতিবাচকভাবেই এখন দেখছেন। কিন্তু পাঁচ বছর আগে তিনি এ প্রশ্নে সম্পূর্ণ ভিন্নমত দিয়েছিলেন। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের ‘আন্তর্জাতিক নারী ও সাহসী পুরস্কার’ বিজয়ী রোহিঙ্গা নারী নেত্রী রাজিয়া সুলতানা শেরম্যানের প্রস্তাব প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমার মনে হচ্ছে এটা এই অঞ্চলে উত্তেজনা বৃদ্ধির একটি কৌশল। আমরা রোহিঙ্গারা কখনো নিজ দেশ থেকে আলাদা হয়ে অন্য দেশের সাথে যোগ দিয়ে মিয়ানমারের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে ফেলতে চাই না।’

এ বিষয়ে আমরা বলতে চাই, মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশটিকে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব নিয়ে আমাদের উল্লসিত হওয়ার আসলেই কোনো কারণ নেই। এটি মার্কিন অস্ত্র ব্যবসার আরেকটি ফ্রন্ট খোলার কৌশল কি না আমরা জানি না। তবে এ বিষয়ে উৎসাহী হলে প্রতিবেশী মিয়ানমারের সাথে প্রত্যক্ষ সঙ্ঘাতে যেতে হবে বাংলাদেশকে। এতে আমেরিকার মদদ থাকবে হয়তো। কিন্তু এটা তো সবাই জানে, আমেরিকা নগদ লাভ ছাড়া বিশ্বের কোথাও কোনো কাজ করে না। মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশকে কোনো রকম সঙ্ঘাতের দিকে ঠেলে দেয়া হলে সে ক্ষেত্রে আমেরিকার হয়তো ভূরাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধার হবে ঠিকই। কারণ বাংলাদেশ ও মিয়ানমারসহ পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব নিয়ে দেশটির উদ্বেগ আছে। চীনকে মোকাবেলার ক্ষেত্রে ভারত খুব কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না বলেই দৃশ্যত মনে হচ্ছে। তা ছাড়া, শ্রীলঙ্কায় ব্যর্থ হয়েছে ভারত।

এখন বাংলাদেশকে কোনোভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল করে তোলা গেলে দেশটির পক্ষে ‘এক ঢিলে অনেক পাখি শিকারের পথ’ উন্মুক্ত হতে পারে। সম্ভবত সেই হিসাব-নিকাশ থেকেই রাখাইন নিয়ে দাবার নতুন চাল দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
এই মার্কিন গেমপ্ল্যানে বাংলাদেশের জড়িত হওয়া আমরা কোনোভাবেই চাই না। উন্নয়নের সিঁড়িতে সদ্য পা রাখা বাংলাদেশের জন্য দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত নয়, বরং সর্বতোভাবে শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল পরিবেশে এগিয়ে যাওয়ারই সময় এখন। যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কারো উসকানিতে কোনো ধরনের ফাঁদে পা দেয়া আমাদের জন্য কোনোভাবেই উচিত হবে না।
আমাদের সংবিধানের আওতায়ই আমরা পৃথিবীর যেকোনো মুক্তিকামী জনগোষ্ঠীর মুক্তির সংগ্রামে সমর্থন দিতে পারি। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের জন্য স্বতন্ত্র ভূখণ্ডের যে দাবি বর্ষীয়ান রাষ্ট্রনায়ক মাহাথির মোহাম্মদ উত্থাপন করেছেন, তাতে আমাদের অকুণ্ঠ সমর্থন জানাতে কোনো সমস্যা নেই। আমাদের ধারণা, বাংলাদেশকে একটা সময় সেই পথেই এগোতে হবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement