২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`
বহমান এই সময়ে

আসামের এনআরসি ন্যায়বিচারের পরিপন্থী

-

আসামের নাগরিকত্ব সমস্যা একটি দীর্ঘদিনের বিতর্ক। এই বিতর্কের পেছনে রয়েছে প্রত্যাবাসন, উপমহাদেশ ভাগ, সাম্প্রদায়িক নানা আন্দোলন, জেনোফোবিয়া (বিদেশী সম্পর্কে অহেতুক ভয়) এবং অন্যদের প্রতি ঘৃণার মনোভাব। এই দ্বন্দ্বের অবসান ঘটবে না আসামের এনআরসি (ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনস) দিয়ে, বরং এটি আরো বিভিন্ন আকার ধারণ করবে যত দিন পর্যন্ত মুসলমানদের প্রতি হিস্টেরিয়া ও প্যারানইয়া জিইয়ে রাখা হবে।

এই ঘৃণার অবসান না ঘটানো হলে ভবিষ্যতে বিভিন্ন ধরনের ইনস্ট্রুমেন্ট নতুন করে উদ্ভাবন করা হবে মুসলমানদের মানবীয় অধিকার ও নাগরিকত্ব হরণ করার জন্য। এটি স্বাভাবিক ন্যায়বিচারের একটি সুস্পষ্ট বিচারবিভ্রম, যখন লাখ লাখ নাগরিককে বলা হয় তাকে এই দেশের নাগরিক হিসেবে প্রমাণ করার জন্য একগাদা দলিলপত্র ও আইনি প্রক্রিয়া সম্পাদন করতে- এমনটিই উপসংহার টানা হয়েছে গত ১৩-১৬ জুন সরেজমিন আসাম সফরের পর ভারতের ‘সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব সোসাইট অ্যান্ড সেক্যুলারিজম’-এর (সিএসএসএস) একটি ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং টিমের সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে।

নাগরিকত্ব হচ্ছে মানুষের একটি মৌল অধিকার। কারণ, এটি মানুষের অধিকারগুলো ধারণ করার একটি অধিকার ছাড়া আর কিছুই নয়। মানুষের এই অমূল্য সম্পদটি ছিনিয়ে নিলে মানুষ হয়ে পড়ে রাষ্ট্রহীন। তার নিজ দেশের মানুষের কাছেই সে হয়ে ওঠে গুরুত্বহীন- এ কথাটি বলেছিলেন বিখ্যাত জুরিস্ট আর্ল ওয়ারেন। তার এই কথাগুলোর মধ্যে যথার্থভাবে সংক্ষেপে উঠে এসেছে আসামে বসবাসকারী লাখ লাখ মুসলমানের বর্তমান বিড়ম্বনা-পরিস্থিতি, যাদের নাম এনআরসির খসড়া তালিকার বাইরে রাখা হয়েছে। এদের ঘোষণা করা হয়েছে ‘ফরেনার’।

৪০ লাখেরও বেশি আসামি মুসলমান এই তালিকায় স্থান পায়নি। এই তালিকা প্রকাশ করা হয় গত বছরের জুলাইয়ে। পাশাপাশি এদের বিচার চলছে ফরেনারস ট্রাইব্যুনালে। যারা নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে, তাদের পাঠানো হচ্ছে ডিটেনশন ক্যাম্পে, যেখানে তারা রাষ্ট্রহীন ফরেনার মানুষ হিসেবে মানবেতর জীবনযাপন করছে। সেখানে অনেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। এই এনআরসি প্রক্রিয়া, এনআরসি ও সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট বিল এবং এই প্রক্রিয়ার শিকার মানুষের ভোগান্তি বিভিন্ন প্রেক্ষাপট জানা-বোঝার জন্য এই ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং টিম কাজ করে সম্প্রতি যে রিপোর্ট প্রকাশ করে তা যেকোনো বিবেকবান মানুষকে উদ্বিগ্ন করে।

এই টিমে ছিলেন গ্রন্থকার, সমাজকর্মী ও সিএসএসএস ডিরেক্টর প্রকৌশলী ইরফান, গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দিলীপ বোড়া, জামেয়া মিল্লিয়ার সেন্টার ফর নর্থ-ইস্ট স্টাডিজ অ্যান্ড পলিসি রিসার্চের চেয়ার প্রফেসর মনিরুল ইসলাম, সমাজকর্মী ও শিক্ষাবিদ হাফিজ আহমেদ, সমাজকর্মী ও স্কলার শাহিউজ জামান এবং সিএসএসএসের ডেপুটি ডিরেক্টর স্নেহা দেভাড়ে। এরা সফর করেছেন গৌহাটি ও গোয়ালপাড়ার বিভন্ন গ্রাম। এরা গেছেন বিভিন্ন ‘হেয়ারিং সেন্টার ফর ক্লেইমস’ ও ‘হেয়ারিং সেন্টর ফর অবজেকশনসে’। কথা বলেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, স্থানীয় রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, সামাজিক সংগঠনের নেতা ও নাগরিকত্ব দাবিদার পরিবারগুলোর সাথে। এর ওপর ভিত্তি করে এরা এই রিপোর্ট তৈরি করেন।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
আসামের এই দ্বন্দ্ব আজ নতুন নয়। এনআরসির সমস্যাটির সূচনা ভারতের স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ে। সমস্যাটি অপরিহার্যভাবে একটি ধর্ম-সম্প্রদায়গত সমস্যা। বাঙালি ও মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা রয়েছে এর মূলে। ব্রিটিশ শাসনামলে আসামে জনবসতি ছিল খুবই কম। এখানে ছিল প্রচুর পাহাড়-জঙ্গল আর অনাবাদি জমি, তবে জমিগুলো ছিল খুবই উর্বর। তা ছাড়া আসাম ছিল প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। ব্রিটিশরা রাজস্ব আয়ে এই রাজ্যকে সম্ভাবনাময় বলে ধরে নেয়।

বাস্তব ও রাজনৈতিক কারণে ব্রিটিশরা বাংলার ঘনবসতি এলাকার মানুষকে উৎসাহিত করে আসামের জমি চাষের ব্যাপারে। তখন বিপুলসংখ্যক বাঙালি ও অন্যান্য চাষি আসামে চলে যায় চাষবাস ও বাগান করার জন্য। এসব প্রত্যাবাসীর মধ্যে প্রচুর মুসলমান ছিল। এসব বাঙালি মুসলমান ও হিন্দু প্রত্যাবাসী মূলত ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় বসবাস গড়ে তোলে। এরা অহমিয়া ভাষায় কথা বলতে শুরু করে এবং সহজেই অহমিয়াদের সাথে মিশে যায়। ১৯৩০-এর দশকে অভিবাসী মুসলমানেরা ঔপনিবেশিক প্রশাসনের কাছে আবেদন জানায়, ১৯৪১ সালের আদমশুমারিতে তাদের অহমিয়া ভাষাভাষী মুসলমান হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে নিতে।

এরপরও আসামের মূল উপজাতি বড়োরা ও আদিবাসী অহমিয়ারা বাঙালি মুসলমান ও হিন্দুদের ফরেনার ভেবে তাদের জন্য হুমকি ভাবে। যেসব বাঙালি মুসলমান ও হিন্দু চাষবাসে দক্ষ ছিল তাদের প্রশাসন জমির মালিকানা দেয়। এরা বিকাশ লাভ করছিল ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি হিসেবেও। আমলা ও গণমাধ্যমেও এরা অংশ নিতে শুরু করে। অহমিয়ারা, বিশেষত অহমিয়া মধ্যবিত্তরা এর তীব্র বিরোধিতা করে। তাদের ভয় ছিল জমি, জাতিসত্তা ও সাংস্কৃতিক পরিচয় হারানোর।

এ নিয়ে বিরোধ দেখা দেয় ১৯২০-এর দশকে। অব্যাহত আন্দোলনের মুখে ব্রিটিশরা আসামে চালু করে লাইন প্রথা। এর মাধ্যমে মুসলমানদের আসাম রাজ্যের সুনির্দিষ্ট কিছু এলাকায় স্থায়ী বসবাসে বাধা সৃষ্টি করা হয়। অভিবাসীরা এই লাইন প্রথাকে বিবেচনা করে এক ধরনের বর্ণবাদ হিসেবে। ফলে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ হলেও লাইন প্রথা থেকে যায়। এভাবেই বাঙালি হিন্দু ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে অহমিয়াদের ঘৃণার সূত্রপাত হয়।

এই দ্বন্দ্ব চলা অবস্থায় দেশ ভাগের সময় তা আরো বেগবান হয়। মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যাপক সাম্প্রায়িক দাঙ্গা চলে। অনেক মুসলমান পরিবার স্থানচ্যুত হয়। হাজার হাজার মুসলমান চলে আসে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও আজকের বংলাদেশে। তবে নেহরু-লিয়াকত চুক্তির পর তাদের অনেকে সুযোগ পায় আসামে ফিরে যেতে। মুসলিমবিরোধী ঘৃণা আরো বেড়ে যায়। ১৯৬০-এর দশকে কয়েক হাজার মুসলমানকে ড্রাকোনিয়ান স্কিম ‘প্রিভেনশন অব ইনফিলট্রেশন ফ্রম পাকিস্তান’ (পিআইপি)-এর আওতায় জোর করে পূর্ব-পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো হয়। সেখানে কোনো আইনি প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়নি। আসাম পুলিশের বর্ডার ইউনিট নীরবে শত শত মুসলমানকে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়।

এরপর ফরেনার প্রশ্নে নানা গুজবকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা ও ফরেনার ভীতি চলতে থাকে। এই অস্থিরতা রক্তাক্ত রূপ নেয় ১৯৮৫ সালে, যখন ‘অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (এএএসইউ) আসাম চুক্তি করে। এরা আন্দোলনের টার্গেট করে বাঙালি হিন্দু ও মুসলমানকে। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে অভিবাসীবিরোধী আন্দোলন রূপ নেয় মূলত বাঙালি মসলমানবিরোধী আন্দোলনে। এ সময় ঘটে নেলি ম্যাসাকার। ফলে হাজার হাজার বাঙালি মুসলমান আসামে নির্বিচার হত্যার শিকার হয়। আসাম চুক্তি অনুসারে আসামের জন্য ১৯৮৩ সালে পাস হয় ‘ইল্লিগ্যাল মাইগ্রেন্টস ডিটেকশন ট্রাইব্যুনাল’ (আইএমডিটি) আইন। লক্ষ্য অবৈধ অভিবাসীদের আসাম থেকে বহিষ্কার করা।

১৯৯৭ সালে নির্বাচন কমিশন চালু করে একটি ভেরিফিকেশন এক্সারসাইজ। এতে ভোটারদের প্রমাণ করতে বলা হয়, সে ১৯৭১ সালের আগে আসামে এসেছিল। যারা তা করতে ব্যর্থ হয়, তাদের ডি-ভোটার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। প্রক্রিয়াটি ছিল একটি অযৌক্তিক স্বেচ্ছাচারী প্রক্রিয়া। অনেক নির্দোষ ভারতীয় ভোটারকেও এলোপাতাড়িভাবে ডি-ভেটার হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং তাদের পাঠানো হয় ফরেনারস’ ট্রাইব্যুনালে।

এদিকে সুপ্রিম কোর্ট ২০১৩ সালে আসাম রাজ্যকে আদেশ দেয় এনআরসি তালিকা হালনাগাদ করতে। এনআরসি-সম্পর্কিত এই দুটি যৌথ প্রক্রিয়া মনিটর করে সুপ্রিম কোর্ট। এই যৌথ প্রক্রিয়ায় ফরেনারস অ্যাক্টের আওতায় আসামে ফরেনারস ট্রাইব্যুনালের আওতায় ফরেনার চিহ্নিত করতে থাকে। এই প্রক্রিয়া দুটি চলে দুটি আলাদা আইনের আওতায় : সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট ১৯৫৫ এবং ফরেনারস অ্যাক্ট ১৯৪৬। যদিও উভয় আইন ভারতের নাগরিকত্ব নির্ধারণ করে, তবু আইন দুটির দৃষ্টিভঙ্গি ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট পুরোপুরি ভিন্ন। ফরেনারস অ্যাক্ট হচ্ছে স্বাধীনতা-পূর্বকালের অবিভক্ত ভারতের একটি আইন। তখনকার ব্রিটিশ ভারতের সীমান্ত আর আজকের স্বাধীন ভারতের সীমান্ত এক নয়।

তখন এটি পাস কারা হয়েছিল বিদেশীদের চিহ্নিত করা ও এবং ভারতে তাদের অবৈধ অবস্থান নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। এই আইনের ওপর ভিত্তি করে আন-ডকুমেন্টেড ফরেনার, যাদের ভাষা, দেহের গঠন ও চেহারা ছিল ভারতীয়দের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা তাদের ফরেনার হিসেবে চিহ্নিত করা হতো এবং অবিভক্ত ভারতে তাদের অবস্থান নিয়ন্ত্রণ করা হতো। তখন অভিযুক্ত ফরেনার ব্যক্তিকেই প্রমাণ করতে হতো, তিনি ফরেনার নন। কিন্তু সিটিজেনশিপ অ্যাক্টে নাগরিকত্ব নির্ধারণের জন্য বিভিন্ন প্রভিশন সংযোজন করা হয়।
দেশ ভাগের পর ১৯৪৬ সালের ফরেনার অ্যাক্টের ওপর ভিত্তি করে আসামের বর্ডার পুলিশ নির্র্দোষ ভিন্ন মতাবলম্বী বাঙালি মুসলমানদের টার্গেট করে অভিযান চালাতে শুরু করে এবং তাদের ফরেনার হিসেবে চিহ্নিত করতে থাকে।

তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয় নিছক তাদের মুসলমান নাম ধারণের কারণে। এসব মামলা ছিল মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। বর্ডার পুলিশের রিপোর্ট ছিল পুরোপুরি বানোয়াট, আর এগুলো তৈরি করা হতো ঘটনাস্থল পরিদর্শন ছাড়াই। অভিযোগের সত্যতা প্রমাণের বা যাচাইয়ের কোনো প্রয়াসই নেয়া হতো না। তা ছাড়া এদের বাংলাদেশী বলে চিহ্নিত করাও মুশকিল ছিল। কারণ, আসামি ও বাঙালিদের চেহারায় তেমন কোনো পার্থক্য নেই। তাদের চেহারা, দেহের গড়ন, ভাষা ও সংস্কৃতিও মোটামুটি একই। এর পরও এলোপাতাড়িভাবে বাঙালি মুসলমানদের ফরেনার চিহ্নিত করা হতে শুরু হয়। এই স্বেচ্ছাচারিতা বেশির ভাগ চলে রাজনৈতিক নেতাদের আদেশ-নির্দেশে। এই প্রক্রিয়া আজো চলমান, বরং আরো জোরালোভাবে।

দ্বিতীয় সমান্তরাল প্রক্রিয়াটি হচ্ছে এনআরসি, যা কোনো না কোনোভাবে নেয়া হয়েছে সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট থেকে। আসামে এনআরসি হালনাগাদ করা হচ্ছে ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চকে একটি কাট-অফ ডেট ধরে নিয়ে। এর অর্থ হচ্ছে, কোনো ব্যক্তি ভারতে এই তারিখের পর অবৈধভাবে ভারতে অভিবাসন করলে এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করলে তাকে বিবেচনা করা হবে অবৈধ অভিবাসী হিসেবে। এখন এনআরসির দাবি হচ্ছে, তালিকাভুক্ত ১৪টি দলিলের মধ্যে দুটি দাখিল করতে হবে- একটি হবে ওই ব্যক্তি এই কাট-অফ ডেটের আগে থেকে তার প্রজন্ম আসামে বসবাস করে আসছিল, সে সংক্রান্ত দলিল। অপরটি হচ্ছে, লিঙ্কেজ ডকুমেন্ট, যেটি দেখাবে রিগেটির (যে মৃত ব্যক্তি সম্পত্তিপ্রাপ্ত হয়) সাথে তার সম্পর্ক।

যদিও এই প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ও দেখাশোনা করছে সুপ্রিম কোর্ট, তবু বিজেপিও এর জন্য বাহবা নিচ্ছে। এটি দুর্ভাগ্যজনক, সুপ্রিম কোর্ট বিজেপিকে সহায়তা করছে এই প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে। বিজেপি সমর্থিত সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট বিলে অগ্রাধিকার দিয়েছে পাকিস্তান, বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দু, খ্রিষ্টান, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ ও পারসিসদের। এরা সহজেই ভারতের নাগরিকত্ব লাভ করতে পারে। কারণ, এই উদ্যোগ বিজেপির অ্যাজেন্ডায় থাকা মেজোরিটারিয়ান ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ গঠনের জন্য সহায়ক হবে।

উল্লিখিত ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং টিমের পাওয়া এই তথ্যগুলো এই জটিল প্রেক্ষাপট, কমিউনাল আন্ডারকারেন্ট ও চেকার্ড হিস্ট্রির আলোকেই বিবেচনা করতে হবে। স্বাধীনতাপূর্ব থেকে আজ পর্যন্ত বিস্তৃত এই নাগরিকত্ববিরোধ ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ও প্রেক্ষাপটে হলেও এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য দাঁড়িয়েছে একটাই। রাজনৈতিক কারণে সৃষ্টি করা এই ঘৃণা ও ফরেনার ভীতির মূল টার্গেট হচ্ছে আসামের মুসলমান।
প্রমাণের দায়িত্ব

এনআরসি সম্পর্কিত সবচেয়ে বিতর্কের বিষয়টি হচ্ছে, অভিযুক্ত ব্যক্তিকেই প্রমাণ করতে হবে যে, তিনি ভারতের নাগরিক। তা করতে ব্যর্থ হলে তিনি ফরেনার। এটি সাধারণ আইন বিজ্ঞানের পরিপন্থী নীতি। আইন বিজ্ঞানের সাধারণ নীতি হচ্ছে, যিনি কোনো ব্যাপারে অভিযোগ করবেন, সে অভিযোগ প্রমাণের দায়িত্ব তার। কিন্তু এই নীতির ব্যতিক্রম হচ্ছে উল্লিখিত এই ফরেনারস অ্যাক্ট। সাংবাদিক গৌরব দাস এই প্রক্রিয়ার কিছু সমস্যার কথা এই ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং টিমকে জানিয়েছেন। তার ব্যাখ্যা মতে, আসামের বেশির ভাগ লোক স্থানান্তরিত, গরিব ও নিরক্ষর।

উপজাতীয়দের প্রচলিত জীবনব্যবস্থায় জমির মালিকানার জন্য দলিলের ধারণা নেই। বন্যা ও নদীর গতিপথ পরিবর্তনের কারণে বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে গেলে তাদের জমিজমার দলিলপত্র তৈরি ও সংরক্ষণ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। নদী তীরবর্তী এলাকায় কোনো হাসপাতাল না থাকায় তাদের জন্ম বা মৃত্যু সনদ পাওয়া হয়ে ওঠে না। অথচ নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে হবে বংশপরম্পরার ফ্যামিলি ট্রি দাখিল করে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, অনেকেই পারিবারিক শত্রুতার জন্য লেগাসি প্রমাণের দলিল দিতে পারেন না। সিনিওর সাংবাদিক অনুপ শর্মা উল্লেখ করেন, প্রয়োজনীয় দলিল তৈরি করার ব্যাপারে সরকার জনগণকে সচেতন করে তুলতে কিছুই করছে না। সরকার সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেয়, কিন্তু পল্লী এলাকার লোকের কাছে তা পৌঁছে না।

আজ পর্যন্ত আসামে ৪০ লাখ লোককে এনআরসি তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া খসড়া তালিকায় আরো এক লাখ দুই হাজার জনের নাম রয়েছে, যা প্রকাশ করা হয় গত জুনে। এ তালিকা থেকে আরো বেশি লোককে বাদ দেয়া হয়েছে। এদের ব্যাপারে ফরেনারস ট্রাইব্যুনালে শুনানি হচ্ছে। আপত্তি জানানোর সর্বশেষ তারিখ ছিল ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর। ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত মাত্র ৭০০ আপত্তি দাখিল করা হয়। তা সত্ত্বেও ৩১ মে পর্যন্ত সময়ে আড়াই লাখ আপত্তি দাখিল করা হয়।

সমাজকর্মী ও পণ্ডিতজনদের মতে, এনআরসি প্রক্রিয়ায় উপজাতীয় লোকেরা বেশ দুর্ভোগে পড়লেও সবচেয়ে বেশি পক্ষপাতমূলক আচরণের শিকার হচ্ছে আসামের মুসলমানেরা। খসড়া তালিকা থেকে বাদ পড়া ৪০ লাখের মধ্যে ১৫ লাখই মুসলমান। পরবর্তী সময়ে যারা আপত্তি দাখিল করেছে, এদের ৭০ শতাংশই মুসলমান।

ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির রিপোর্টে এমন অনেক কিছুই উঠে এসেছে, যা ন্যায়বিচারের পরিপন্থী এবং পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে বেশ কিছু যৌক্তিক প্রশ্নও তুলে ধরা হয়েছে। একটি মাত্র লেখায় এর বিস্তারিতে যাওয়া একেবারেই অসম্ভব। তাই সে দিকে না গিয়ে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং টিমের কিছু সুপারিশ ও রিপোর্টটির উপসংহার সংক্ষেপে তুলে ধরে এ লেখার ইতি টানতে চাই।
টিমের সুপারিশ

এক. শেষ দিনে দাখিল করা আপত্তি, যা স্পষ্টতই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যতাড়িত ও ভিত্তিহীন, আপত্তিকারীর নির্র্বিশেষে বাতিল করতে হবে। যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে আপত্তি দাখিল করা হয়েছে (যেখানে শুনানির দিনে আপত্তিকারী উপস্থিত ছিল না), তাদের নাম আপনা-আপনি এনআরসি চূড়ান্ত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। দুই. নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রবিরোধী এবং এটি একটি ধর্মীয়-সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনের পদক্ষেপ। এটি ইসলামের বিপরীতে অন্যান্য ধর্মকে অগ্রাধিকার দেয় এবং এ রাষ্ট্রের বাইরে রাখা হবে মুসলমানদের। অতএব এই বিল প্রত্যাহার করতে হবে। তিন. নদী অববাহিকার গরিব, শ্রমিক এবং উপজাতি, যাদের জমির ওপর যৌথ মালিকানা রয়েছে, তাদের এনআরসি-সংশ্লিষ্ট দলিলপত্র দাখিলের আওতার বাইরে রাখতে হবে।

কারণ, এদের এ ধরনের দলিলপত্র নেই। এসব এলাকায় সরকার গড়ে তোলেনি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র অথবা স্কুল, যেগুলো দিতে পারে জন্মসনদ বা স্কুল সার্টিফিকেট। চার. কোনো ডিটেনশন ক্যাম্প রাখা চলবে না। তথাকথিত ফরেনারদের তাদের পরিবারের সাথে থাকতে দিতে হবে। দিতে হবে ওয়ার্কপারমিট এবং সুযোগ দিতে হবে স্বাভাবিক জীবনযাপনের। পাঁচ. এনআরসি তালিকা থেকে বাদ পড়ার পর ফরেনারস ট্রাইব্যুনাল হবে একটি আপিল ফোরাম। সেটি চলবে এমন বিধিবিধানে, যা ন্যায়বিচারের সাথে হবে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

উপসংহার
আসামের নাগরিকত্ব সমস্যাটি দীর্ঘ দিনের একটি বিরোধ। এটি আজকের আকার ধারণ করে অভিবাসন, দেশভাগ ও সাম্প্রদায়িক আন্দোলন এবং একে অপরের প্রতি ঘৃণার মনোভাব ও বিদেশীদের ব্যাপারে অহেতুক ভীতির ওপর ভর করে। এই দ্বন্দ্বের অবসান ঘটানো যাবে না এনআরসি দিয়ে। যত দিন মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিস্টেরিয়া ও প্যারানইয়া চলবে, তত দিন এ সমস্যাও চলবে। ভবিষ্যতে তা আসবে ভিন্ন ভিন্ন আকারে। নতুন করে উদ্ভাবন হবে মুসলমানদের ডিহিউম্যানাইজ (মানবীয় অধিকার হরণ) ও ডিসেটিজেনশিপ (নাগরিকত্ব হরণ) করার নানা উপায়।

এটি স্বাভাবিক ন্যায়বিচারের একটি বিভ্রম। স্বাধীনতা-উত্তর সময়ের ভারত পরিচালিত হয় ভারতীয় সংবিধানের মাধ্যমে এবং এটি ধর্মরিপেক্ষ নীতির একটি সংবিধান। এটি এর নাগরিকদের দেশের যেকোনো অংশে বসবাসের অধিকার দেয়। ভারতের ওপর রয়েছে সব নাগরিকের সমান মালিকানা। যতক্ষণ মানুষ সচেতন থাকবে মানুষের স্বায়ত্তশাসন, সত্তা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং আদিবাসীদের জীবনযাপন সম্পর্কে, ততক্ষণ নাগরিকত্ব হরণ বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানোর কোনো প্রয়োজন পড়ে না। এনআরসির মতো প্রক্রিয়ার ভিত্তি হচ্ছে ঘৃণা, কলঙ্ক ও মেজোরিটারিয়ানিজম, যা গণতন্ত্রে দ্বিচারিতা ও অসহিষ্ণুতার জন্ম দেয়।

আরো গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, এই প্রক্রিয়া বহিষ্কার ও বৈষম্যকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মাধ্যমে বিনষ্ট করছে রাজ্যের সামাজিক বুনন। ধর্মের ভিত্তিতে একটি দেশে নাগরিকত্ব নির্ধারণ একটি বিপজ্জনকপূর্ব নিদর্শন, যা দুর্বল করে তোলে একটি ধর্মনিরপেক্ষ বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক দেশের স্বপ্নসৌধকে।


আরো সংবাদ



premium cement
বৃষ্টির জন্য দেশবাসীর প্রতি ইস্তিস্কার নামাজ আদায়ের আহ্বান আমিরে জামায়াতের সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পে চুক্তি স্বাক্ষর করল তুর্কি, ইরাক, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত ঢাকায় ‘হিট স্ট্রোকে এক ব্যক্তির মৃত্যু শ্যামবাজার ঘাটে লঞ্চে আগুন, নিয়ন্ত্রণে ৪ ইউনিট ‘আমার শিশু মেয়েটির যে সর্বনাশ সে করেছে’ বান্দরবানের ৩ উপজেলায় নির্বাচন স্থগিত চুয়াডাঙ্গায় বৃষ্টির জন্য ইস্তিস্কার নামাজে মুসুল্লিদের ঢল বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের চাবিটা মনে হয় পার্শ্ববর্তী দেশকে দিয়েছে সরকার : রিজভী চীনের দক্ষিণাঞ্চলীলের গুয়াংডংয়ে সর্বোচ্চ স্তরের বৃষ্টিপাতের সতর্কতা জারি আজমিরীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান মর্তুজা হাসান গ্রেফতার মুসলিম শ্রমিক হত্যায় হিন্দু নেতারা চুপ কেন : প্রশ্ন হেফাজত নেতা আজিজুল হকের

সকল