২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আমলাতন্ত্র ও দুর্নীতি দমন

-

‘ব্যুরোক্রেটিক ট্র্যাডিশন’ বলে একটা অলিখিত কথা বাজারে চালু আছে। এই ট্র্যাডিশনের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো ‘আমলারা সব কিছুর ঊর্ধ্বে’। তাদের অপরাধ কখনো অপরাধ নয়। বটবৃক্ষ যেমন সবার জন্য শান্তিদায়িনী, ঠিক তেমনিভাবে ‘আমলাতন্ত্র’ আমলাদের জন্য রীতিমতো দুর্গতিনাশিনী, বিশাল এক মহীরুহ; নিরাপদ আশ্রয়স্থল। এমন খুচরা কথা বাতাসে ভাসলেও তা পুরোপুরি বিশ^াস করা কিছুটা হলেও কষ্টসাধ্য ছিল। কারণ, আমলাদের মধ্যে ব্যক্তিত্ব ও মূল্যবোধসম্পন্ন লোকের সংখ্যা নেহাত কম নয়।

অবশ্য একটা ঘটনায় আমার সেই ইতিবাচক ধারণা কিছুটা নেতিবাচক রূপ নিয়েছে। আমার নিজ জেলায় উপজেলা নির্বাহী অফিসার কর্তৃক নিগৃহীত হয়ে একজন শিক্ষক তার প্রতিকার চেয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে একটি আবেদন করেছিলেন। সংশ্লিষ্ট ডেপুটি কমিশনার তা তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছিলেন অভিযুক্ত উপজেলা নির্বাহী অফিসারের ওপর। অভিযুক্ত ও বিচারক একই দফতর হওয়ায় ফলাফল যা হওয়ার হয়েছে।

সঙ্গত কারণেই ভাগ্যহত শিক্ষক তার ভাগ্যবিড়ম্বনা থেকে মুক্তি পাননি। অথচ পরীক্ষায় নকল সরবরাহের অভিযোগে একজন কলেজ শিক্ষককে পিছমোড়া দিয়ে বেঁধে চালান দিয়েছিলেন সেই জেলা প্রশাসক। নির্বাহী অফিসারের বিরুদ্ধে অভিযোগ আরো গুরুতর হলেও সে বিষয়ে তিনি ইতিবাচক পদক্ষেপ নেননি। ডিসি মহোদয়ের সততা, নিষ্ঠা, যোগ্যতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন না থাকলেও তিনি কিন্তু ঐতিহ্যগত বৃত্তের বাইরে যেতে পারেননি। মূলত এটিই হলো ‘ব্যুরোক্রেটিক ট্র্যাডিশন’।

আমার এক শিক্ষক এই ট্র্যাডিশনকে আরো প্রণবন্ত করে তুলেছিলেন একটি রসাল গল্পের মাধ্যমে। তার গল্পের নির্যাস হলো, কোনো এক জেলা প্রশাসক সরকারের কাছে এমন একটি প্রকল্পের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন, তফসিল বর্ণিত জমিতে বৃহদাকার পুকুর খননের ও মাছচাষের মাধ্যমে সরকার প্রভূত লাভবান হতে পারবে। একই সাথে কিছু মানুষের কর্মসংস্থান ও জনস্বাস্থ্যের জন্যও তা হবে ইতিবাচক। ডেপুটি কমিশনারের প্রস্তাব মোতাবেক প্রকল্প পাসও হয়।

কিছু দিন পর প্রকল্প পরিচালক হিসেবে জেলা প্রশাসকের কাছে অনুমোদিত প্রকল্পের উন্নতি-অগ্রগতি, সমস্যা-সম্ভাবনাবিষয়ক একটি প্রতিবেদন চেয়ে পত্র পাঠায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগ। তত দিনে আগের জেলা প্রশাসক অন্যত্র বদলি হয়েছেন। নতুন জেলা প্রশাসক প্রকল্পস্থল সরেজমিন পরিদর্শন করে কথিত প্রকল্পের কোনো চিহ্ন খুঁজে পাননি। সেখানে কোনো পুকুরও খনন করা হয়নি। সমতলে কয়েকটা কলাগাছ ছাড়া আর কিছু ছিল না প্রকল্পস্থলে। এ অবস্থায় নতুন জেলা প্রশাসক সরকারের কাছে নতুন প্রকল্পের প্রস্তাব পাঠিয়ে বললেন, আসলে প্রকল্পস্থল মৎস্যচাষের উপযোগী না হওয়ায় প্রকল্পটি কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হয়নি। তাই গৃহীত প্রকল্প বাতিল ও পুকুর ভরাট করে ফলদবৃক্ষের বাগান বানিয়ে নতুন প্রকল্প অনুমোদন দিলে সরকার প্রভূত লাভবান হতে পারবে এবং স্থানীয় জনগণের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ফলের চাহিদাও পূরণ করা সম্ভব হবে। গাল্পিকের ভাষায় এ প্রকল্পও নাকি অনুমোদন পেয়েছিল।

স্যারের গল্পটা কেউ নির্ভেজাল হাস্যরস ও অতিশয়োক্তি মনে করলেও গণপ্রশাসন সম্পর্কে গল্পকারের এমন নেতিবাচক অনুভূতি এমনিতেই সৃষ্টি হয়নি। মূলত দেশটা এখন দুধেল গাভীতে পরিণত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। মনের মাধুরী মিশিয়ে এই দোহনকার্য চালানো হচ্ছে অবলীলায়।

এ কথা খুব বেশি অত্যুক্তি নয় যে, দেশে জনগণের শাসনের পরিবর্তে আমলাদের রাজত্ব চলছে। আমলাতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হয়েছে বলা যায়। আমলারা অনেকে জনগণের সেবার পরিবর্তে প্রভুর ভূমিকায় অবতীর্ণ। একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন যে গণতান্ত্রিক ছিল না, বরং ছিল আমলাতান্ত্রিক তা ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। এমনিতে গণপ্রশাসন রাষ্ট্রের একটি প্রভাবশালী বিভাগ। অনেক ক্ষেত্রে চলছে রাষ্ট্রযন্ত্রকে আমলাকরণ প্রক্রিয়া। নির্বাচন কমিশনের শীর্ষপদ আগের দিনে প্রধানত বিচারপতিরা অলঙ্কৃত করলেও ২০০৬ সাল থেকে এ ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটেছে। এখন আমলারা ইসির দণ্ডমুণ্ডের কর্তা।

দুর্নীতি দমন কমিশনও আমাদের দেশের অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান, যা দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করার প্রত্যয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রথমে একজন সাবেক সেনাপ্রধান এ পদ অলঙ্কৃত করলেও এখানে এখন আমলাদের আধিপত্য। বর্তমান দুদক চেয়ারম্যান জ্যেষ্ঠ সচিব ছিলেন। সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর আমলাদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ কিংবা সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি কারো অজানা নয়। তাই ‘রাজনীতি এখন রাজনীতিকদের হাতে নেই’ বলে একটা কথা চালু হয়েছে। রাজনীতিতে প্রকৃত ও নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিকেরা এখন কোণঠাসা। ট্র্যাডিশন অনুযায়ী এক দিকে আমলাদের ক্ষমতায়ন করা হচ্ছে, অপর দিকে দায়মুক্তিও দেয়া হচ্ছে। দুদক চেয়ারম্যানের বক্তব্য থেকে সে কথাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দুদক একটি স্বাধীন সত্তা হলেও মাঠপর্যায়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-এর কার্যক্রম দেখভাল করতে জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) দুদক বলেছে। বিষয়টি নিয়ে গভীর উদ্বেগ ও হতাশা প্রকাশ করেছে দেশের সচেতন মানুষ। এর ফলে মাঠপর্যায়ে প্রশাসনিক দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের তদন্ত ও বিচারের আওতায় আনার ক্ষেত্রে দুদকের ওপর অর্পিত আইন বাস্তবায়নে এবং প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব পালনে ব্যাপক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকে।

জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের হাতে দুদকের দেখভালের এখতিয়ার অর্পিত হলে তা ব্যাপক স্বার্থের দ্বন্দ্ব তৈরি করতে পারে। অন্য দিকে এর ফলে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে ও অভিযুক্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের তদন্তের ক্ষেত্রে দুদকের প্রত্যাশিত ভূমিকা পালনের পথ রুদ্ধ হতে পারে।
দুর্নীতি হলো একটি চলমান সমস্যা। এ ছাড়াও আমাদের দেশ ২০০৫ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃক প্রকাশিত তালিকায় সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। ২০১১ এবং ২০১২ সালের তালিকায় আমাদের অবস্থান যথাক্রমে ১২০ ও ১৪৪তম স্থানে, যা এ দেশে দুর্নীতির ব্যাপকতারই প্রমাণ বহন করে। প্রধানত ভোগবাদী মানসিকতা এবং অনেক ক্ষেত্রে অভাব দুর্নীতির পেছনে দায়ী। বস্তুত রাষ্ট্রের কোনো সেক্টরই আমাদের দেশে দুর্নীতিমুক্ত নয়।

মূলত দুর্নীতি কোনো নির্দিষ্ট জাতি-রাষ্ট্রের সমস্যা নয়, বরং এটি একটি বিশ্বজনীন সমস্যা। প্রতিটি রাষ্ট্রেই কমবেশি দুর্নীতি রয়েছে এবং তা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান ও প্রয়োজনীয় আইনও রয়েছে। তাই সেসব রাষ্ট্রে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ হলেও আমাদের দেশে তা প্রায় নিয়ন্ত্রণহীন। এর আগে দেশের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ করার জন্য ‘দুর্নীতি দমন ব্যুরো’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান ছিল; কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির বারবার ব্যর্থতা, স্বেচ্ছাচারিতা ও অনিয়মের কারণে তা ‘দুর্নীতি লালন ব্যুরো’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। ফলে তার স্থলাভিষিক হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদক।

এটি ২০০৪ সালের ৯ মের দুর্নীতি দমন আইন অনুসারে কার্যকর হয়েছে। এ সংস্থার লক্ষ্য হচ্ছে, দেশে দুর্নীতি ও দুর্নীতিমূলক কাজ প্রতিরোধ করা। অনেক প্রত্যাশা নিয়ে এ প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি দমন ব্যুরোর স্থলাভিষিক্ত করা হলেও প্রতিষ্ঠানটি তেমন সাফল্য ও সার্থকতা দেখাতে পারেনি বরং এর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লেজুরবৃত্তির অভিযোগ বেশ জোরালো।

তবে মাঠপর্যায়ে দুদকের নিয়ন্ত্রণ জেলা প্রশাসকদের ওপর ন্যস্ত করা একটি আবেগনির্ভর ও অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ, এতে গণপ্রশাসন ও দুদকের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফলে দুদকের মূল কাজ ব্যাহত হবে এবং প্রতিষ্ঠানটিকে বিলুপ্ত ‘ব্যুরো’র ভাগ্যবরণ করতে হতে পারে।

smmjoy@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement