২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`

গাছ লাগাই, বাংলাদেশ বাঁচাই

-

পরিবেশ ও জলবায়ুসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে বহু দিন ধরে আমি কাজ করছি। কয়েকটি বইও রচনা করেছি। সেহেতু পরিবেশ ও অর্থ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন অফিসে আমাকে যেতে হয়েছে। মহাখালী এবং আগারগাঁও অফিসে একাধিকবার যেতে হয়েছে। আমরা অনেকেই জানি না, পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ কী পরিমাণ ক্ষতির মুখোমুখি হবে। যা ভাবলে গা শিহরিত হয়ে উঠবে। সরকারের বন অধিদফতর অফিসে গেলে মনে হবে- সরকারের উদ্যোগ এ ব্যাপারে প্রশংসনীয়। উদ্যোগ এবং বাস্তবায়ন এক জিনিস নয়। কারণ আমরা কথা বলি বেশি, কাজ করি কম। আল্লাহ তায়ালা আমাদের দু’টি কান দিয়েছেন অর্থাৎ শ্রবণশক্তি বাড়িয়ে দিয়েছেন, আর কথা কম বলার জন্য মুখ একটি দিয়েছেন। যাতে আমরা শুনব বেশি কথা বলব কম। আমাদের দেশে প্রকৃতি ও পরিবেশকে নিয়ে শতাধিক সংগঠন গড়ে উঠেছে।

যেমন ধরুন- বাপা, বেলা, তরু পল্লব, প্রকৃতি ও উন্নয়ন, ইপসু, পবা, গ্রিন ভয়েস ওয়ার্ল্ড ফাউন্ডেশন, ক্লাইমেট ফাইন্যান্স গভর্ন্যান্স নেটওয়ার্ক, বাংলাদেশ নদী বাঁচাও আন্দোলন ইত্যাদি নানা ধরনের সংগঠন দেশে কাজ করছে। তারাও নিজ নিজ অবস্থান থেকে কথা বলছে বেশি; কিন্তু কাজ করছে কম। যদি তাই না হয় তাহলে বন কেন উজাড় হচ্ছে। আর নদী কেন দখল হচ্ছে। গাছ কেটে পাহাড় কেটে নদী দখল করে বসতি এবং শিল্পকারখানা গড়ে তোলা হচ্ছে। এতে যে পরিবেশের ভারসাম্য ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে সেদিকে উদ্যোক্তাদের কারো কোনো চিন্তাভাবনা আছে বলে মনে হয় না। এসব সংস্থা আত্মপ্রচারের অসুস্থ প্রতিযোগিতা চালিয়ে নিজের আখের গোছাচ্ছে।

সবুজ বাঁচানোর স্বপ্ন নিয়ে আমরা কাজ করি-কিন্তু সবুজ বাঁচাতে পারছি না কেন। ২০১৪ এবং ২০১৭ সালে সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড গিয়েছিলাম, তাদের দেশে বনায়নের যে প্রতিযোগিতা স্বচোখে দেখলাম, তা নিয়ে লিখলে একটি নিবন্ধে শেষ করা যাবে না। তাদের টুরিস্ট বুলেটিনে দেখলাম, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডে বনের বিস্তার ৪০-৪৫ শতাংশ; অন্য দিকে, আমাদের দেশে কাগজে কলমে ২৫ শতাংশ বললেও বাস্তবে আছে মাত্র ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। জলবায়ু ও বনবিভাগ পরিদফতরের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নিয়ে যে তথ্য তাতে দেখানো হয়েছে, আমাদের দেশে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বনভূমি রয়েছে। আমরা জানি, সুন্দরবন বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ হিসেবে খ্যাতি থাকা সত্ত্বেও তা এখন আর নেই বলে জাতিসঙ্ঘের ইউনেস্কো সংস্থা সাম্প্রতিককালের এক জরিপে জানিয়ে দিয়েছে। ২২ মে ২০১৯ সুন্দরবনের বাঘ জরিপের ফলাফল ঘোষণা এবং সেকেন্ড ফেইজ : স্ট্যাটাস অব টাইগার ইন বাংলাদেশ সুন্দরবন ২০১৮ প্রকাশিত হয় (কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স জুন-২০১৯) ৮০ দশকে এই সুন্দরবনেই প্রায় ছয় শতাধিক বাঘ ছিল। কমতে কমতে এই সংখ্যা এখন ১১৪টিতে দাঁড়িয়েছে।

সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বন নিয়ে যে গল্প লেখা হচ্ছে নিবন্ধ আকারে, সেটা বাস্তবের সাথে মেলে না। সম্প্রতি কক্সবাজার এবং কুয়াকাটায় গিয়ে দেখলাম, আত্মপ্রচারের সাথে বনভূমির ব্যাপক পার্থক্য বিরাজমান। বিভিন্ন বুলেটিন ও স্মারকগ্রন্থে দেখা যাবে পরিবেশ নিয়ে সুন্দর সুন্দর কথা লেখা আছে। যেমন ধরেন- গাছ বাঁচান, পরিবেশ বাঁচান, মানুষ যত বাড়ছে দেশে, থাকবে না গাছ একটিও শেষে, গাছ বাঁচানোর একটিই উপায়, রান্না করুন উন্নত চুলায়, জীবনের সুস্থতার জন্য প্রয়োজন বিশুদ্ধ পানি, বিশুদ্ধ বায়ু, উর্বর ভূমি এবং সবুজ বৃক্ষ, সবুজ নগর, সবুজ দেশ বদলে দেবে বাংলাদেশ। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দিবস পালনকালে আমরা গণমাধ্যমে প্রচার চালাই-চারদিকে প্রাকৃতিক বিপর্যয় নদীভাঙন, নদীর নাব্যতা কমে যাওয়া, জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহার, বহু বন্যপ্রাণীর সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় চলে যাওয়া- সব মিলিয়ে দিবসটি বাড়তি গুরুত্ব বহন করছে।

১ জুলাই ২০১৯ একটি জাতীয় দৈনিকে লিখেছে, সঙ্কটাপন্ন সুন্দরবন। ৬ কিলোমিটারের মধ্যে শিল্পকারখানা স্থাপন করায় ঐতিহ্যের তালিকা থেকে বাদ দিচ্ছে ইউনেস্কো। নিয়ন্ত্রণহীন পর্যটন শিল্প বন্যপ্রাণী নিধন অবাধ গাছকাটা এবং বনের মধ্য দিয়ে ভারী নৌযান চলাচল করায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সুন্দরবন। সুন্দরবনের চার পাশে ১০ কিলোমিটার এলাকাকে সরকার প্রতিবেশগত সঙ্কাটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করলেও সেই এলাকার মধ্যে গড়ে উঠছে বিভিন্ন ধরনের শিল্পপ্রতিষ্ঠান। বিগত ৮-১০ বছরে গড়ে উঠেছে প্রায় ৪০টি ভারী শিল্পকারখানা। এর মধ্যে রয়েছে সিমেন্ট কারখানা, এলপি গ্যাস প্লান্ট, তেল-শোধনাগার, বিটুমিন এবং সামদ্রিক মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা। বনের খুব কাছেই বিশালাকৃতির খাদ্যগুদাম নির্মাণ করেছে খাদ্য বিভাগ। এসব কারণে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সুন্দরবনের ওপর। ১৯৩০ সালে দেশের ১১টি জেলায় বাঘ ছিল। এখন শুধু আছে সুন্দরবনে। ২০০৪ সালে বন বিভাগ এবং জাতিসঙ্ঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) যৌথভাবে জরিপ চালিয়ে ৪৪০টি বাঘ আছে বলে জানায়। বাঘের পায়ের ছাপ গুনে ওই জরিপ হয়।

২০০৬ সালে ব্রিটিশ জুওলজিক্যাল সোসাইটির সহায়তায় বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ মনিরুল খান ক্যামেরায় ছবি তোলার মাধ্যমে একটি জরিপ করেন। তাতে বাঘের সংখ্যা দেখানো হয় ২০০টি। ২০১৪ সালে বন বিভাগ বাঘের সংখ্যা নির্ণয়ে ক্যামেরায় ছবি তোলার মাধ্যমে আরেকটি জরিপ করেছে। ওই জরিপের ফল অনুযায়ী সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ১০৬টি। (তথ্য পরিবেশ সুরক্ষা-প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ-তথ্য মন্ত্রণালয়) মহান আল্লাহ তায়ালা তার পবিত্র গ্রন্থে সূরা নাহলের ১১ আয়াতে বলেছেন, পানি দিয়ে আমি তোমাদের জন্য শস্য, বায়তুল, খেজুর গাছ, আঙ্গুর এবং সর্বপ্রকার ফল উৎপন্ন করি। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল মানুষের জন্য নিদর্শন রয়েছে।

এই পৃথিবী টিকে আছে গাছের জন্য। গাছ নেই অক্সিজেন নেই। গাছ থাকবে না, কার্বন ডাই-অক্সাইড থাকবে। ফলে পৃথিবী বিষাক্ত হবে। মানুষসহ পৃথিবীর সব প্রাণী ধ্বংস হয়ে যাবে। গাছ না থাকলে গাছে গাছে ফুল ফুটবে না। গাছ না থাকলে পৃথিবীতে প্রজাপতি থাকবে না। বন্যপ্রাণী থাকবে না। গাছ না থাকলে পৃথিবীতে বৃষ্টিপাত কমে যাবে। প্রকৃতির আচরণ বদলে যাবে। সে হিংস্র হবে। তাই এক কথায় বলা যায়- গাছ দিয়েই এই বিশ্ব গড়ে তোলা হয়েছে। গাছই পৃথিবীকে বসবাসের উপযোগী করে রেখেছে। বিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবীতে প্রায় এক কোটি প্রজাতির জীব রয়েছে। এর মধ্যে প্রতিদিন গড়ে ১৫০ থেকে ২০০ প্রজাতি বিলীন হয়ে যাচ্ছে। পরিবেশ সংরক্ষণে কর্মরত কয়েকটি সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি ২০ মিনিটে একটি প্রজাতি বিলুপ্তির দিকে ধাবিত হচ্ছে (সূত্র-আলোকিত বাংলাদেশ ২১-০৫-২০১৩)।

আগামী ১০ বছরের মধ্যে পৃথিবীর বর্তমান তাপমাত্রার চেয়ে ৪ ডিগ্রি বেশি বাড়বে। হিমালয়ের হিমবাহ দ্রুতগতিতে গলিত হচ্ছে। তাই সবাই গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য আমাদের হাতটা বাড়িয়ে দিই। সবাইকে গাছ লাগাতে হবে। পানির অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে। বর্জ্য বা প্লাস্টিক পোড়াবেন না। বাংলাদেশে অধিক হারে মানুষ বাড়ছে। সেই সাথে বাড়ছে জমির চাহিদা। সেই চাহিদা পূরণে নির্বিচারে গাছ কাটা হচ্ছে। এ ছাড়া কলকারখানা ও যানবাহনে কয়লা, কেরোসিন, পেট্রল পোড়ানো হচ্ছে। এসব জ্বালানি পোড়ানোর ফলে পরিবেশে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। একই সাথে নতুন নতুন ঘরবাড়ি ও আসবাবপত্র তৈরি করার জন্য গাছপালা কেটে বন উজাড় করায় বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করার মতো পর্যাপ্ত গাছ আর থাকছে না।

এসব কারণে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড বেড়ে যাচ্ছে এবং বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ দ্রুত কমছে। প্রতি বছর ৫ জুন পরিবেশ দিবসে এসব কথাই বলা হচ্ছে। আবারো একই কথা বলতে হয়- গাছ মানবজীবনের জন্য অপরিহার্য। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বিনোদনের মতো মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে বৃক্ষরাজির ভূমিকা অপরিসীম। মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ডের বিরূপ প্রভাবে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ছে। পরিবর্তন ঘটছে জলবায়ুর। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের ফলে বিশ্বের ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। একমাত্র বৃক্ষই পারে জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করে বাংলাদেশকে বসবাসের উপযোগী করে গড়ে তুলতে।

বাংলাদেশের বড় সমস্যা হলো জনসংখ্যা। বিশ্বের সব দেশের আয়তন লোকসংখ্যা অনুপাতে ভারসাম্য থাকলেও বাংলাদেশে সেটা থাকছে না। বিপদটা এখানেই। যেমন অস্ট্রেলিয়া আয়তনে বাংলাদেশের চেয়ে ৬৫ গুণ বড়। তাদের লোকসংখ্যা আমাদের ৮ ভাগের এক ভাগ। আমাদের দেশটা একটা মৌচাকের মতো, এখানে মানুষের ওপর বসে আছে মানুষ। জনসংখ্যা অনুপাতে পৃথিবীতে সব দেশেই একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ বনভূমির প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে বর্তমানে লোকসংখ্যা হিসেবে বনভূমির পরিমাণ খুবই কম। একদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বনভূমি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। মানুষ অবাধে গাছ কেটে বনভূমি ধ্বংস করছে। তাই আমাদের এখনই বনভূমি বাড়ানোর কাজে মনোযোগী হতে হবে। অন্যথায় বিশ্বের মানচিত্রে আমাদের নাম থাকবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়।

লেখক : গবেষক ও গ্রন্থকার
Email: harunar@gmil.com


আরো সংবাদ



premium cement