২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

সরল মনের গরলতা

তিনি বলেছেন, ফৌজদারি আইনে সরল বিশ্বাসে অপরাধ করলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হয় না - ছবি : সংগৃহীত

পৃথিবী পাড়ি দিয়েছে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে পাথর ও ব্রোঞ্জ, হিমযুগ, প্রস্তর, তাম্র, লৌহযুগসহ আরো কত সব যুগ। বর্তমানে প্রযুক্তি আর রোবট যুগের উত্তাপও শেষ হয় হয় অবস্থা। হাইটেকের অনুপ্রবেশ হাই-হ্যালো আর সেলফোনের যুগে। এসব যুগ শেষে মানবজাতি এখন খেলনা যুগের বেলাভূমিতে। এ যুগের বৈশিষ্ট্য- সব কিছু ক্ষণস্থায়ী, ভঙ্গুর আর ঠুনকো। সব কিছুই ‘ওয়ানটাইম’। এ যুগ নিয়ে দুনিয়াজুড়ে চলছে তুমুল আলোচনা। যুগের ধারাবাহিকতায় একসময় মানবজাতির আরাধ্য ছিল সরল মনের সময়। সেই সরল যুগ নিয়ে এ মুহূর্তে দেশে চলছে ব্যাপক আলোচনা।

ঘটনার সূত্রপাত সম্প্রতি ডিসি সম্মেলনের পর দুদক বা দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানের এক বক্তব্য নিয়ে। তিনি বলেছেন, ফৌজদারি আইনে সরল বিশ্বাসে অপরাধ করলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হয় না। তবে তিনি আরো বলেন, ‘সরল বিশ্বাস’ বিষয়টি প্রমাণিত হতে হবে। এই বক্তব্য প্রসঙ্গে পরে একটি সেমিনার শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেছেন, “এ ব্যাপারে আমার উত্তর একেবারেই সহজ। ডিসি সম্মেলনের পরে একটি প্রশ্নের জবাবে যে উত্তরটা দিয়েছি, তার ভিডিও ক্লিপ আপনাদের কাছে আছে। আমি সেখানে ‘দুর্নীতি’র কোনো শব্দ উচ্চারণ করিনি। আপনারা দেখে থাকতে পারেন। দুর্নীতি শব্দ কিভাবে এলো, জানি না। যারা দুর্নীতি শব্দ এনেছেন, এটা তাদের দায়; আমার দায় নয় মোটেও। আমি কোনো ব্যাখ্যা দিতে প্রস্তুত নই।” দুদক চেয়ারম্যানের এই বক্তব্যের পর অনেকেই সরল বিশ্বাসের যুগের বিশেষত্ব বর্ণনায় পঞ্চমুখ। এ কথা শোনার পর থেকে প্রজাতন্ত্রের চাকুরেরা যারপরনাই খুশিতে আটখানা। কেউ কেউ আত্মহারা।

আমরা জানলাম, আইনে আছে- সরল মনে কিছু করলে কোনো দোষই অপরাধের পর্যায়ে পড়ে না। মানে, সব কিছু ‘জায়েজ’। কথায় আছে- ‘সাত খুনও মাফ’! তবে ‘সরল বিশ্বাস’ প্রমাণ করতে হবে। সবার জানা, আইনকানুন সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা যার আছে, তিনি সব সময় আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এই ফাঁকে আমাদের মতো অবুঝরা যদি বুঝদার হয়ে উঠি, আইনের ব্যাপারে সচেতন হই; তাতে দেশ ও দশের কল্যাণ বৈ অকল্যাণ নেই। এ প্রসঙ্গে একটি গল্প মনে পড়ে গেল। গল্পটি এক নাপিত আর পাস করা ডাক্তারের।

বিদ্যাবুদ্ধিহীন নাপিত বিষফোঁড়ার যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল। কোনো কিছুতেই ব্যথার উপশম হচ্ছিল না। এ দিকে গরিব এই নরসুন্দরের ডাক্তার দেখানোরও সামর্থ্য নেই। তাই অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে দাড়ি কামানোর ক্ষুর দিয়ে পাকা ফোঁড়ায় দেয় এক পোঁচ। এতে গলগল করে সব পুঁজ যায় বেরিয়ে। ফলে নাপিতের মেলে রোগমুক্তি। পাড়াগাঁয়ে তখন ডাক্তার না থাকায় এর পর থেকে তার পরিবারের সদস্যদেরও ফোঁড়া-টিউমার সে অবলীলায় ক্ষুর দিয়ে কেটে দিত। এমনি করে দশ গ্রামে ‘ডাক্তার’ হিসেবে তার নামডাক ছড়িয়ে পড়ে। লোকের মুখে মুখে তার ‘নাম ফাটে’। প্রমিত বাংলায় যাকে বলা যায়- ‘প্রসিদ্ধি’। দিন যায়, মাস যায়, বছর গড়ায়। নাপিত নিজের পুরনো পেশা চুল-দাড়ি কামানো বন্ধ করে একদিন বনে যায় মস্তবড় ‘শল্য চিকিৎসক’। তার আত্মীয়স্বজনের ভাষায় ‘গরিবের ডাক্তার’।

অনেক দিন পর ওই এলাকায় সরকারি ডাক্তারখানা খোলা হয়। কিন্তু গাঁয়ের লোক পাস করা ডাক্তারের ওপর বিশ্বাস না রেখে, আস্থা রাখে নিজেদের আপনজন, হাতুড়ে ডাক্তার ওই নাপিতের ওপর। এতে মহাফাঁপরে পড়ে যান সরকারি চিকিৎসক। অনেক ভেবেচিন্তে উপায় একটা বের করেন তিনি। তাতে কাজ হয়। নাপিতকে রুখতে তাকে নিতে হয় ঘুরপথ। তত্ত্বীয় চিকিৎসাবিজ্ঞানের কিছু জ্ঞান নাপিতকে দিতে থাকেন চিকিৎসক। কী করে শল্য চিকিৎসা করতে হয়; তার কৌশল শেখাতে থাকেন। চিকিৎসায় ভুল হলে রোগীর কী ক্ষতি হতে পারে, তা-ও ধৈর্যসহকারে শেখাতে থাকেন। সব কিছু দেখে-শুনে নাপিতের বোধোদয় হলো, এত দিন সে ‘চিকিৎসা’র নামে কী করেছে। কপালগুণে তার রোগীদের ক্ষতি হয়নি বটে; তবে সামনের দিনগুলোতে যে হবে না, সে নিশ্চয়তা কে দেবে? সে চিকিৎসা ছেড়ে দিয়ে সরকারি ডাক্তারের ‘ফুটফরমাশ’ খাটার সহযোগী হয়ে বাঁচে। নাপিতের সৌভাগ্য হলো, ডাক্তারের বদান্যতায় তাকে আর ফিরতে হয়নি পুরনো পেশায়। এভাবেই ডাক্তারও হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন।

গল্পের নাপিতের মতো একইভাবে কেউ আইনি জ্ঞান অর্জন করলে তিনি বেআইনি কাজ ছেড়ে দিতে পারেন বৈকি! তাই তো দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ‘সরল মনে’ অপরাধ করার কথা বলার সাথে সাথে উল্লেখ করেছেন আইনের কথা। সে জন্যই তো দুদক চেয়ারম্যান তার বক্তব্যের শত সমালোচনার পরও অন্য একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘যা বলেছি তা ঠিক আছে।’ তার এই দাবিকে আমরা একদম সহি বলে ধরে নিতে পারি।

অন্য দিকে, বিষয়টি ভিন্ন আঙ্গিকে ভাবলে সত্যিই সব ‘জলবৎ তরলং’ হবে বলে আশা করি। আমাদের সমাজে সরল মনের মানুষকে সবাই পছন্দ করে। ইংরেজিপ্রীতি থাকলে গ্রামে আহ্লাদ করে বলে, ‘মাই ডিয়ার পারসন’। কারো অপছন্দের তালিকায় সরলমনাদের নাম ওঠার প্রশ্নই ওঠে না। তাদের পক্ষে এ কথা বলায় বাঁকা দৃষ্টিতে দেখার কিছু নেই। দিল কালো হলে শুধু শুধু সমালোচনার অভ্যাস জন্মে। সব কিছুতে দোষ খুঁজে বেড়ানো যাদের অভ্যাস, মানে বদ অভ্যাস, তারাই এমন ‘নির্দোষ’ (!) কথার নেতিবাচক অর্থ করে; অথচ সাধারণ মানুষ সরলমনাদের দলভুক্ত না হলেও তাদের মোটেও আফসোস নেই। তারা জানে, অনেকের জন্যই তো ‘সাদা মনের মানুষ’ হওয়ার দুয়ার খোলা। সাদা মনওয়ালা হিসেবে সমাজে-দেশে যারা পরিচিত, তারা যা-ই করুন না কেন- সবই আদৃত (!) আর বৈধ।

তবে পুরনো আরেকটি গল্প মনে পড়ে মনটা একটু চুপসে যায়। গল্পটি এ রকম- এক পাখিপ্রেমী, একই সাথে সংবেদনশীল প্রকৃতিপ্রেমী; তিনি তার পোষা টিয়া পাখির বড় ঠোঁট থাকায় চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তার বিবেচনায় ওপরের লম্বা ঠোঁটের কারণে টিয়াটির খেতে অসুবিধা হচ্ছে। তাই সরল মনে টিয়ার মুশকিল আসানে ধারালো এক ছুরি দিয়ে বাড়তি ঠোঁটটুকু কেটে নিচেরটার সমান করে দেন। এই ‘শল্য চিকিৎসা’য় টিয়াটি স্বাভাবিকতা হারিয়ে খাবার খাওয়ার সক্ষমতাই হারিয়ে ফেলে। ফলে না খেতে পেরে দু-তিন দিন পরে মারা যায়।

গল্পটি জেনে অনেকে প্রশ্ন তুলতে পারেন, কুটিলতাহীন সরল মনে কাজ করলেই পরিণাম যে কারো চূড়ান্ত ক্ষতি বয়ে আনবে না, তার কী গ্যারান্টি আছে? সেই দায় কার? যদি সরল মনের কথা বলে দায়মুক্তি দেয়া হয়? এ ছাড়া অন্য একটি প্রশ্নও ঘুরপাক খায় হৃদয়ে। এর সন্তোষজনক জবাব না পেলে মনে ‘খচখচানি’ রয়ে যায়। মনের কথা জানেন কেবল অন্তর্যামী আর যার মন তিনি। তৃতীয় কারো পক্ষে তা জানা সম্ভব নয়। শিল্পকলার ভাষায় বিদগ্ধ চিত্রশিল্পের সমালোচকেরা যাকে বলেন ‘বিমূর্ত’; অর্থাৎ অবয়বহীন। তাই সরল মনের বিষয়টি আমাদের কাছে দুর্বোধ্যই বটে। সাধারণের অভিযোগ, সরল মনের দোহাই দিয়েই তো ভদ্রজনেরা যার-তার সাথে যা-তা কাণ্ড ঘটাতে দ্বিধা করেন না। সে জন্য আমজনতা মনে করে, সরল মনে মাঝে মধ্যে গরলতাও বাসা বাঁধে। সেই গরলতা রোধ করবে কোন আইন?

camirhamza@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement