২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

এরশাদের জীবন-মৃত্যুর পূর্বাপর রহস্য!

- ফাইল ছবি

রাষ্ট্রপতি এরশাদকে আমার খুব ঘন ঘন দেখার সুযোগ হতো আশির দশকের শুরুর দিকে, যখন তিনি প্রায়ই হেলিকপ্টারে করে আটরশির পীরের বাড়িতে যেতেন। ফরিদপুর জেলার যে স্থানটিতে আটরশি গ্রামটি অবস্থিত, সেখান থেকে মাত্র ১০ মিনিটের হাঁটার দূরত্বে আমার গ্রাম শ্যামপুরের অবস্থান। আমরা যে দিন আকাশে হেলিকপ্টার দেখতাম বা শব্দ শুনতে পেতাম, সে দিন বুঝতাম যে এরশাদ সাহেব তার পীরের বাড়িতে এই এলেন বুঝি। আমরা অনেকেই দৌড়ে গিয়ে হেলিকপ্টার ল্যান্ডিংয়ের আগেই ঘটনাস্থলে পৌঁছে যেতাম প্রধানত দু’টি কারণে। প্রথম কারণ ছিল হেলিকপ্টারের পাখার ঘূর্ণনে সৃষ্ট বাতাস-ধূলিঝড়ের ধাক্কায় উতলা হওয়ার বাসনা এবং দ্বিতীয় কারণ ছিল এরশাদ দর্শন। এরশাদের ফটোজেনিক চেহারা এত ভালো নয়। কিন্তু বাস্তবে তিনি ছিলেন অতিশয় সুন্দর ও সৌম্য দর্শন। কাজেই তার শ্বেতশুভ্র প্রতিচ্ছবি, হাস্যোজ্জ্বল চলাফেরা এবং অভিব্যক্তি আমাদের ভালো লাগত। অধিকন্তু রাজদর্শনের আকাক্সক্ষা থেকেও অনেকে সেখানে ভিড় করত।

জেনারেল এরশাদ আটরশি পীরের মুরিদ হওয়ার পর পীর সাহেব হাসমত উল্লাহর খ্যাতি, যশ, অর্থবিত্ত ও ক্ষমতা তুঙ্গে পৌঁছে যায়। পীরের সন্তানসন্ততি, আত্মীয়স্বজন এবং খাদেমরাও হঠাৎ করে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। এরশাদের মুরিদত্ব লাভের আগে আটরশির পীরের খ্যাতি ছিল খুবই সীমিত। স্থানীয় লোকজনের বিরাট অংশ পীর হাসমত উল্লাহকে পছন্দ করতেন না এবং তার সম্পর্কে সুযোগ পেলেই অশ্রাব্য কথাবার্তা বলতেন। এ অবস্থায় বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতাবান মানুষ তার বাড়িতে নিয়মিত হেলিকপ্টারে করে আগমন করায় আটরশিতে রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অন্যান্য কর্মের একটি নির্ভরযোগ্য কেন্দ্র গড়ে ওঠে। বুদ্ধিমান পীর হাসমত উল্লাহ রাষ্ট্রক্ষমতার সেই অবারিত সুযোগ নিয়ে মিল-কারখানা, সংবাদপত্র, অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ-মাদরাসা এবং অট্টালিকার জৌলুশ দিয়ে সবাইকে চমকে দিতে থাকেন।

এরশাদ সহেবের সাথে আমার দ্বিতীয় দফায় সাক্ষাৎ ঘটে ১৯৮৯ সালের সম্ভবত জানুয়ারি অথবা ফেব্রুয়ারি মাসে তার সরকারি কার্যালয়ে, যা এখন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় বলে পরিচিত। একজন সাংবাদিক হিসেবে আমি সে দিন যে ঐতিহাসিক ঘটনা দেখেছিলাম তা বিস্তারিতভাবে নামধাম সহকারে কোনো দিন বলতে পারব না। ঘটনার দিন তিনি টোপ দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক নামকরা ছাত্রনেতাদের গোপন বৈঠকের জন্য তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ে ডেকে নিয়েছিলেন সন্ধ্যার পর। বিটিভির এক সময়ের সাড়া জাগানো অনুষ্ঠান আইন-আদালতের উপস্থাপক রেজাউর রহমানকে দিয়ে তিনি বৈঠকটির আয়োজন করেছিলেন, তার নেপথ্যে মদদদাতা ছিল রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। এরশাদ খুব করে চাইছিলেন তার দলের বিলুপ্ত ছাত্রসংগঠন জাতীয় ছাত্র সমাজকে নতুন করে চালু করার জন্য। তার পরিকল্পনা ছিল ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের জনপ্রিয় এবং সাহসী ক্যাডারদের একাংশকে নিজ দলে ভেড়ানো এবং অপর অংশকে অর্থ দিয়ে বশ করে তার তাঁবেদার বানিয়ে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদল পরিচালনা করা।

তৎকালীন প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ের সান্ধ্যকালীন সেই বৈঠকটি গোপন থাকার প্রতিশ্রুতি থাকলেও শেষ অবধি গোপন থাকেনি। সরকারি লোকজন কিছু সাংবাদিককে দাওয়াত করে নিয়ে গিয়েছিলেন। ফলে রাত ৮টার মধ্যে সারা দেশে সেই গোপন বৈঠকের খবর চাউর হয়ে যায়। এ অবস্থায় এরশাদের নিমন্ত্রণে লোভাতুর হয়ে যেসব ছাত্রনেতা তথায় গিয়েছিলেন, তারা খুবই বিপদে পড়েন। আমি নিজে স্যার এফ রহমান হলের এক শীর্ষ নেতাকে গণপিটুনি থেকে বাঁচিয়ে হলের পেছনের দেয়াল টপকিয়ে মোস্তফা মোহসিন মন্টুর বাসায় পাঠিয়ে দিই আপাতত রক্ষার জন্য। পরে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের সাথে বহু দেনদরবার করে সেই নেতাকে পুনরায় হলে তোলার ব্যবস্থা করি।

প্রেসিডেন্ট এরশাদের সাথে আমার তৃতীয় দফায় সাক্ষাৎ ঘটে ২০০৯ সালের জুন মাসে জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনের সময়। অধিবেশনে যখন মাগরিবের বিরতি চলছিল, তখন আমি নামাজ শেষে যেই না লবিতে ঢুকতে যাবো, ঠিক তখন জাতীয় পার্টির তৎকালীন মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন। তিনি জানালেন, এরশাদ সাহেব আমাকে সালাম জানিয়েছেন। আমি খানিকটা অবাক হয়ে রুহুল আমিন হাওলাদারের সাথে এরশাদের সংসদ ভবনস্থ অফিসে গিয়ে দেখলাম, জাতীয় পার্টির সিনিয়র নেতা ও এমপিদের নিয়ে এরশাদ লিচু খাচ্ছেন। জাতীয় পার্টির এমপি হাফিজ উদ্দিন এরশাদের জন্য দিনাজপুর থেকে উৎকৃষ্ট মানের যে লিচু এনেছেন, তা তিনি সবাইকে নিয়ে খাচ্ছিলেন। আমি পৌঁছা মাত্র তিনি আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন এবং সহাস্যে বললেন- তোমাকে নিয়ে লিচু খাবো বলে বসে আছি।

উল্লিখিত ঘটনার পর প্রেসিডেন্ট এরশাদের সাথে আমার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল তার জীবনের সুস্থতার শেষ দিন পর্যন্ত। বিভিন্ন সভা-সমিতি, সামাজিক অনুষ্ঠানাদি ইত্যাদিতে তার সাথে দেখা হতো। মাঝে মধ্যে তিনি দাওয়াত করে তার বাসায় নিয়ে যেতেন। অন্য দিকে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই তিনি ফোন করে পত্রিকায় প্রকাশিত আমার নিবন্ধ সম্পর্কে আলোচনা করতেন এবং নিবন্ধের সাথে একমত হলে ধন্যবাদ দিতেন। আমার জানা মতে, তিনি আমাদের সমাজের অনেকের সাথেই যোগাযোগ রাখতেন- তাদেরকে নিজ বাসায় নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতেন এবং বিভিন্ন উপলক্ষে উপহার দিতেন। তাকে যদি কেউ দাওয়াত করত তবে তিনি শত কষ্ট হলেও দাওয়াত রক্ষা করতেন। তার জীবনাচরণের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল- তিনি বলতেন কম এবং শুনতেন বেশি। তিনি এমন ভাব দেখাতেন, তিনি কিছুই জানেন না। আলাপ-আলোচনার জন্য তিনি কাউকে নিমন্ত্রণ করলে সে দিন অন্য কাউকে সাক্ষাৎ দিতেন না। ফলে তার অতিথিরা সম্মানিত বোধ করতেন। তিনি সব সময়ই জানার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন। ফলে নিজে আলোচনা না করে তিনি একের পর এক প্রশ্ন করে অন্যের মতামত নিয়ে নিতেন।

তিনি নিয়মিত বই পড়তেন। তিনি আমার মতো ক্ষুদ্র লেখকের বেশির ভাগ বই কিংবা পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধ পড়তেন। কোথাও বক্তৃতা দেয়ার প্রয়োজন হলে তিনি যথারীতি প্রস্তুতি নিয়ে যেতেন। বক্তৃতার বিষয়বস্তু যদি গুরুত্বপূর্ণ হতো তবে তিনি কয়েকজনকে অনুরোধ করে স্ক্রিপ্ট লিখিয়ে নিতেন- তারপর সবগুলো সম্পাদনা করে নিজের মতো করে একটি বক্তব্য প্রস্তুত করতেন। তার খাওয়া-দাওয়া, পরিচ্ছন্নতা এবং পোশাক-পরিচ্ছদের ব্যাপারে রুচি-অভিরুচি ছিল অনুসরণ করার মতো। একান্ত আলোচনায় তিনি কারো গিবত করতেন নাÑ কারো বিরুদ্ধে নালিশ জানাতেন না এবং অন্যের ব্যক্তিগত বিষয়ের গোপনীয়তা সম্পর্কে সজাগ থাকতেন।

তিনি শিশুদেরকে খুব বেশি ভালো বাসতেন এবং দরিদ্র ও অসহায়দের জন্য ছিলেন অতিমাত্রায় সংবেদনশীল। তিনি আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখতেন এবং নিজে উদ্যোগী হয়ে সামাজিক সম্পর্কগুলো ধরে রাখতেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত মিতব্যয়ী, খুব হিসাব করে চলতেন এবং হিসাবের বাইরে খরচ করতেন না। তার ব্যয়ের খাতগুলো নির্দিষ্ট ছিল এবং তা নির্বাহের জন্য তিনি সব কিছু হিসাব করে গোছগাছ করে রাখতেন। নিয়মিত গলফ খেলার পাশাপাশি তিনি শরীরচর্চা করতেন এবং সব সময় স্বাস্থ্য বিষয়ে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতেন। ফলে সব দিক থেকেই তিনি ছিলেন ব্যতিক্রমী একজন মানুষ।

সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সম্পর্কে যারা নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন এবং তাকে যাচ্ছেতাই ভাষায় গালাগাল করেন, তাদের সম্পর্কে হলফ করে বলতে পারি, তারা ব্যক্তি এরশাদকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতনে না। অথবা যারা তার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তারা হয়তো ক্ষতির কার্যকারণ সম্পর্কে নিরপেক্ষভাবে চিন্তাভাবনা করেননি। এরশাদের রাজনীতি, তার ক্ষমতারোহণ, ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে বিরোধীদের দমনপীড়ন, সংবাদপত্রের কণ্ঠ রোধ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, গণতন্ত্রহরণ এবং ভোটব্যবস্থার বরোটা বাজানো ইত্যাদি মন্দ কাজগুলো আবহমান বাংলার ঐতিহ্য অনুযায়ীই হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো- বর্তমান জমানা বা এরশাদ-পূর্ববর্তী জমানার মন্দ কাজের পরিবেশ পরিস্থিতির ভয়াবহতা বেশি ছিল, নাকি এরশাদ আমলেরগুলো বেশি ছিল তা বিবেচনা করলে তাকে সাধু-সজ্জন উপাধি না দিয়ে পারা যায় না।

এরশাদের জমানার মন্দ কাজের সাথে পাল্লা দিয়ে অসাধারণ সব ভালো কর্ম হয়েছে। পথঘাট, হাটবাজার, অট্টালিকা ইত্যাদি উন্নয়ন করার জন্য খুব বেশি বুদ্ধিশুদ্ধি বা সভ্যতা-ভব্যতার দরকার পড়ে না। কিন্তু এরশাদ তার শাসনামলে এমন সব মৌলিক বিষয়ের দিকে নজর দিয়েছিলেন এবং এমন সব নিয়মনীতি, আইনকানুন রচনা করেছিলেন, যা বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে আধুনিক, বৈচিত্র্যময় এবং সভ্যতার দিকে টেনে নিয়ে এসেছে। তিনি প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ, শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানো, জাতীয় নিরাপত্তা, বৈদেশিক সম্পর্ক ও বৈদেশিক বাণিজ্যকে সার্বজনিত প্রশংসার স্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন। শিল্প-সাহিত্য, কবিতা-গান, ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতির বিকাশ এবং ধর্মকর্মের ক্ষেত্রে অনুদার রাষ্ট্রীয় সাহায্য সহযোগিতার যে নজির তিনি স্থাপন করে গেছেন, তার দ্বিতীয় নজির বাংলার জমিনে নেই। মন্ত্রিপরিষদে যোগ্যতমদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব বণ্টন এবং সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রে যোগ্য ও মেধাবীদের যে কদর এরশাদ জমানায় ছিল তা বর্তমান প্রেক্ষাপটে কল্পনাও করা যায় না। এরশাদ আমলে আর্মি অফিসার, বিচারকগণ এবং ইলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তারা ঘুষ খাবেন, এমন কথা ইবলিশও চিন্তা করতে পারত না।

এরশাদকে যদি কেউ সত্যিকার অর্থে মূল্যায়ন করতে চান, তবে তার ক্ষমতাকালীন সময় এবং ক্ষমতা হারানোর পর মৃত্যু অবধি জীবনকে দুই ভাগ করে বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে। তিনি যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখন তার সব ভালো কর্ম কিংবা মন্দ কর্মের দায়ভার তারই ওপর বর্তাবে। অন্য দিকে, ১৯৯০-পরবর্তী রাজনীতি, ক্ষমতাসীন দল ও ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছা, রুচি-অরুচি কিংবা কুরুচি দিয়ে বাংলাদেশের আরো অনেক রাজনৈতিক নেতা-দল বা গোষ্ঠীর মতো এরশাদ, তার জাতীয় পার্টি এবং তার আত্মীয়স্বজন ও শুভার্থীকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। আমাদের জাতীয় জীবনের অনেক চরিত্র, মন-মানসিকতা এবং প্রতিবেশ-পরিবেশের কারণে আমাদের দেশের ক্ষমতাসীনেরা একধরনের সুযোগ-সুবিধা যেমন পান তেমনি অহেতুক গালমন্দ, বদনামি এবং ঘৃণার উপলক্ষে পরিণত হন।

অন্য দিকে, ক্ষমতা হারানোর পর রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, ঈর্ষা এবং অস্থির জনমতের কারণে অনেক রাজনীতিবিদকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস-অবিচার ও জুলুম মোকাবেলা করতে হয়। এরশাদের ক্ষেত্রে ক্ষমতাকেন্দ্রিক এবং ক্ষমতা হারানো-কেন্দ্রিক দুঃখ-দুর্দশা সবচেয়ে বেশি পোহাতে হয়েছে। কারণ তিনি যত দিন একক ক্ষমতা ভোগ করেছেন, তত দিন অন্য কেউ এমন সুযোগ পাননি। অন্য দিকে, ক্ষমতা হারানোর পর তিনি ৩০টি বছর বেঁচে ছিলেন, যা অন্য কোনো রাজনীতিবিদদের নসিবে জোটেনি। ব্যক্তি এরশাদের দুর্ভোগ-দুর্দশা কিংবা তার মাধ্যমে অন্যের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে প্রথমেই তার রহস্যময় হাসি, স্বভাবজাত বিনয়-ভদ্রতা-সৌজন্যতা এবং কম কথা বলার অভ্যাসকে দায়ী করা যায়। তার রহস্যময়তার কারণে বেশির ভাগ লোক তার মতিগতি বুঝতে পারতেন না।

তার বিনয় ও ভালো ব্যবহারের কারণে লোকজন তার কাছে থেকে খুব বেশি মাত্রায় আশা করতেন, যা কিনা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তার শক্তি-সামর্থ্যরে বাইরে ছিল। ফলে লোকজন যখন নিজেদের আশা ও প্রাপ্তির মধ্যে সমন্বয় করতে না পারতেন, তখনই এরশাদকে গালমন্দ করতেন। এরশাদের দ্বিতীয় দুর্বলতা ছিল কাউকে না বলার অযোগ্যতা। অর্থাৎ তিনি কাউকেই না বলতে পারতেন না- বিশেষত সুন্দরী নারীদেরকে। এ ব্যাপারে এরশাদ নিজে একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তার চেহারাটা এমন যা দেখলে মেয়েরা প্রেমে পড়ে যায়। কাজেই কোনো প্রেমকাতর রমণী যদি তার কাছে এসে প্রণয়ের প্রস্তাব দিতেন তখন এরশাদের রহস্যময় হাসি, ভদ্রতা ও ইতিবাচক আচরণ অনেক স্ক্যান্ডালের জন্ম দিত।

ব্যক্তি এরশাদের উল্লিখিত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হয়তো তার ব্যক্তিগত সুনাম-বদনাম বা তার সাথে সংশ্লিষ্ট লোকজনের লাভ-ক্ষতি বা আনন্দ-বিষাদের কারণ হয়ে দাঁড়াত। কিন্তু তার ভীরু স্বভাব, অস্থির মন এবং ক্ষেত্রবিশেষে ব্যক্তিস্বার্থের প্রাধান্য ও অর্থলোভ আমাদের জাতীয় জীবন ও জাতীয় রাজনীতির মহাসর্বনাশ করে ছেড়েছে। চারিত্রিক দৃঢ়তা না থাকা এবং সিদ্ধান্তে অটল না থাকার অভ্যাসের পাশাপাশি রাজনৈতিক মিত্র নির্বাচনে তার ভুল সিদ্ধান্তের কারণে জাতীয় পার্টি ও বিএনপি-জামায়াত যেমন বর্তমানে অস্তিত্ব সঙ্কটে ভুগছে, তেমনি আগামী দিনে আওয়ামী লীগ ও তাদের মিত্র ইনু-মেনন গংরাও একই পরিণতি ভোগ করবেন নিশ্চিতভাবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এরশাদীয় সিনড্রম চালু হওয়ার পেছনে এরশাদ-বিএনপি জোট এবং আওয়ামী লীগকে সমভাবে দায়ী করা হয়। কারণ, প্রত্যেকেই রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন অবস্থায় একটি বা একাধিক গৃহপালিত দল সৃষ্টি, রাজনীতিবিদদেরকে ঘুষ প্রদান ও দুর্নীতির জালে ফাঁসানো, বিরোধীদের দমনপীড়ন এবং গৃহপালিত কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী সৃষ্টির দায়ে দায়ী করা যায়।

নিয়তির নির্মম পরিহাসে এরশাদ এবং তার দল যখন গৃহপালিত বিরোধী দল হয়ে পড়েছিল তখন গৃহপালিত প্রাণীদের দুঃখ-দুর্দশা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য এবং অপমানের জাঁতাকলে পড়ে তিনি ক্রমেই দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়েছিলেন। তার সহজাত ভয়, রহস্যময়তা এবং কম কথা বলার অভ্যাস বাড়তে বাড়তে একটা সময় পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করে এবং তিনি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। তার ভীরুতা বাড়তে থাকে এবং ভীরুতাজনিত অন্যান্য মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। তার বৃদ্ধ বয়স এবং সার্বিক দুরবস্থা বিবেচনা না করে তার নিয়ন্ত্রকেরা তার প্রতি ক্রমেই আরো অমানবিক হয়ে উঠতে থাকে।

তার আহার-বিহার, নিদ্রা-জাগরণ, সুস্থতা ও অসুস্থতা অন্যের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। তার হাসি-কান্না, কথাবার্তা এবং সিদ্ধান্তগুলো আপন ইচ্ছা এবং বহিঃশক্তির অঙ্গুলি নির্দেশে প্রতিনিয়ত ক্রিয়া-বিক্রিয়া করতে করতে একসময় কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। তিনি তার কর্তাদের ইচ্ছায় বেশ কয়েকবার অসুস্থ হতে বাধ্য হন- তিনি কর্তাদের ইচ্ছায় পদ-পদবি লাভ এবং নিজ দলের পদ-পদবি কর্তাদের পোষ্যদের মধ্যে বিতরণের পাশাপাশি স্ত্রী বিদিশাকে তালাক ও জেলে প্রেরণে বাধ্য হন। ফলে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তিনি হাঁপিয়ে উঠেছিলেন- হয়তো লম্বা একটা বিশ্রামের স্বপ্নও দেখেছিলেন, যা কিনা নিয়তি তার আপন লীলায় মৃত্যুর মাধ্যমে বাস্তবায়ন করেছে।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য


আরো সংবাদ



premium cement