১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কী হলো এ দেশের!

- ফাইল ছবি

ভালো বা মন্দ ধারণা করার ক্ষমতা মানুষের আছে। ভালো সম্পর্কে আমাদের আকাশছোঁয়া স্বপ্ন আছে। মন্দ বা খারাপ সম্পর্কেও তলানিতে গিয়ে হলেও আমাদের আন্দাজ আছে। কিন্তু বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি আমাদের আন্দাজ, অনুমান ও কল্পনাশক্তিকে হার মানাচ্ছে। বাংলাদেশের উন্নয়নের জোয়ার চলছে। সে দিক দিয়ে আমাদের স্বর্গসুখ অনুভব করার কথা। এখন স্বর্গসুখের পরিবর্তে নরকযন্ত্রণা ভোগ করতে হচ্ছে। অবশ্য কিছু লোকের কাছে নরকযন্ত্রণা তাদের মতো করে সুখের অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারে। মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে- সুখ কাকে বলে? এ সম্পর্কে রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। পৃথিবীতে সুখ বেশি না দুঃখ বেশি? এ বিতর্কের মীমাংসায় না গিয়ে বলা যায়, সুখ একান্তই ব্যক্তিগত। সমাজে কেউ ‘দুধ বেচে মদ খায়, আবার কেউ মদ বেচে দুধ খায়’। হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ করে কি কেউ সুখ অনুভব করতে পারে?

বিদেশী ফিচারে একবার পড়েছিলাম- এক নরপিশাচ কিশোরীদের ধর্ষণ করার পর হত্যা করে আনন্দ পেত। এই উদাহরণের জন্য এখন আর আমাদের বিদেশমুখী হতে হবে না। গত সপ্তাহে এ কলামটি যারা পড়েছেন, তারা ধর্ষণযজ্ঞের এক বিরাট পরিসংখ্যান পেয়ে থাকবেন। এ দেশে ধর্ষণযজ্ঞের সাথে রীতিমতো প্রতিযোগিতা দিয়ে হত্যাযজ্ঞ বাড়ছে। এই প্রতিযোগিতার অংশীদার বাংলাদেশ সরকার। প্রতিদিন সংবাদপত্রে বন্দুকযুদ্ধ, মাদকযুদ্ধ, সন্ত্রাসযুদ্ধ, পুলিশযুদ্ধ (পুলিশি হেফাজত ও নির্যাতনে মৃত্যু) এবং ক্ষমতাসীনদের বিবাদযুদ্ধে মানুষ মৃত্যুবরণ করার খবর আসছে। ক্ষমতাসীন সরকারের বিশ্বস্ত বন্ধু বৃহৎ প্রতিবেশীও বসে নেই। বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশী নাগরিকের মৃত্যু যেন নিত্যদিনের সংবাদ। দেশের অপরাধজগতের লোকদের জন্য এ ধরনের পরিস্থিতি খুবই অনুকূল। খুন, জখম, গুম, ডাকাতি, রাহাজানি এবং লুটপাট পাইকারি হারে চলছে সর্বত্র। চোরচোট্টা, গুণ্ডাপাণ্ডা এবং বাটপাড়-বদমাশে ভরে গেছে দেশ। এদের গ্রেফতারে সর্বোচ্চ কর্তৃত্বের অনুমোদন লাগে।

তার কারণ এরা দাবি করে, ‘আমি তোমাদের লোক’। অন্য ভাষায়, ‘তারা আমাদের লোক’। সুতরাং কাকে কে ধরে বিপদে পড়বে।

প্রচলিত গল্পটি এ রকম, এক যুবক মতিঝিলে ছিনতাই করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়ে। সে বলে আমি তাদের লোক- ১৮ নম্বর ওয়ার্ড কমিটির ১৯ নম্বর সদস্য। ভয় পেয়ে যায় পুলিশ ইন্সপেক্টর। সে ফোন করে থানার ওসিকে। ক্ষমতাধর! এই আসামিকে ধরবে কি না? থানার ওসি সিদ্ধান্ত দিতে পারেন না। পাছে তার সর্বনাশ হয়ে যায়। ওসি ফোন করেন এসপিকে- কী করবেন তিনি।

গল্পের ভাষ্য মোতাবেক এসপি ফোন করেন আইজিকে। আইজি রেগে যান যে, সামান্য ছিনতাইকারী ধরতে তার অনুমতি লাগবে? তখন এসপি সাহেব আইজিকে মনে করিয়ে দেন, অমুক দিন এ ধরনের অমুক আসামি ধরতে গিয়ে নাজেহাল হয়েছিলেন আইজি। আইজি তখন উপায়ান্তর না দেখে দেশের প্রধান কর্তৃত্বশালী ব্যক্তিকে ফোন করেন। তিনি ফোনের অপর প্রান্ত থেকে আদেশ পান লাইনে থাকার। লাইনে থেকে তিনি তার সোনার ছেলেদের দায়িত্বশীল নেতার কাছে জানতে চান যে, সে (ছিনতাইকারী) তাদের লোক কি না? অপর প্রান্ত থেকে যখন ইতিবাচক সংবাদ আসে, তখন তিনি হেসে হেসে বলেন, ‘আরে! পোলাপান মানুষ, ভুল করছে, ছাইড়া দাও, ভুল সংশোধনের সুযোগ দাও।’

গল্পকার প্রধান কর্তৃত্বের নেতিবাচক ভূমিকাও বর্ণনা করেছেন। ধরুন, যদি সে (ছিনতাইকারী) সোনার ছেলে না হয়ে লোহার ছেলে হয়, তাহলে উত্তরটি এ রকম হবে ‘বদমাশ! ভালো করে ধোলাই করে থানায় দিয়ে দাও।’ গল্প তো গল্পই। তবে এতে তিনটি মেসেজ আছে। প্রথমটি সিদ্ধান্তহীনতার দীর্ঘমাত্রা। দ্বিতীয়টি, দুষ্টের লালন এবং তৃতীয়টি, একক কর্তৃত্বের। পাঠকসাধারণ যদি বাংলাদেশের চলতি ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করেন, তাহলে গল্পের অনুকূলে আশপাশে অসংখ্য উদাহরণ পাবেন।

আজকের পত্রিকা থেকেই উদাহরণ নিন। ১৬ জুলাই ২০১৯, মঙ্গলবার। একটি অস্বাভাবিক সংবাদ বিচলিত করবে সবাইকে। প্রধান পত্রিকাগুলো সংবাদটি কাভার করেছে। সংবাদটি এ রকম, ‘কুমিল্লায় আদালত কক্ষে বিচারকের সামনে খুন।’ প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, কুমিল্লায় আদালত কক্ষে বিচারক ফাতেমা ফেরদৌসীর উপস্থিতিতে হত্যা মামলার শুনানি চলাকালে এক আসামি অপর আসামিকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করেছে। ১৫ জুলাই সোমবার দুপুরে অতিরিক্ত তৃতীয় দায়রা জজ আদালতে এ হত্যাকাণ্ড ঘটে। খোদ আদালত কক্ষে ছুরি নিয়ে একজন আসামি কিভাবে প্রবেশ করল তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এজলাসে এমন ঘটনা নাগরিকসাধারণকে শঙ্কিত করে তুলেছে। সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন উত্থাপন করা যায়, তাহলে মানুষ নিরাপদ কোথায়?

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আদালতে আসা শত শত লোকের দেহ তল্লাশি সম্ভব নয়। অপ্রিয় হলেও এটাই বাস্তব। তবে আসল রোগ ‘হেথা নয়, হোথা নয়, অন্য কোথা’। বাংলাদেশের অরাজক রাজনীতি এবং পচনশীল সমাজের এ এক নিকৃষ্ট উদাহরণ। ঘাতক এ খুনের প্রতিহিংসা এবং পরিবেশ কোত্থেকে পায়? সে আসমানে বসবাস করে না। এই জমিনেরই একজন। সে যখন দেখে খুনের শাস্তি হয় না, যদি সে তাদের লোক হয়। সে যখন দেখে স্থানীয় নেতৃত্ব জঘন্য অপরাধ করে পার পেয়ে যায় অথবা দুর্নীতিবাজদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত- তখন সে সব কিছুই সম্ভব মনে করে।

একজন সমাজতত্ত্ববিদ এই সে দিন বলেছেন, ‘আমাদের আত্মায় বাসা বেঁধেছে এক গুরুতর অসুখ’। সমাজে হিংসা-প্রতিহিংসা, লোভ-লালসা ও পাশবিকতা এতটাই বেড়ে গেছে যে, একে নিরাময় অযোগ্য অসুখ-মহামারীর সাথে তুলনা করা যায়। এই মহামারীর প্রধান কারণ সুশাসনের অভাব। যারা সুশাসনকে নিশ্চিত করবে, সেই রাজনীতিকদের মধ্যেই সুশাসনের অভাব সবচেয়ে বেশি। আইনশৃঙ্খলা যাদের হাতে, তাদের হাতে আইন ও শৃঙ্খলা সবচেয়ে অসহায়। লোকে বলে, ‘সরিষায় ভূত থাকলে, ভূত তাড়াবে কে?’ রাজনীতিকদের এরা থোরাই কেয়ার করে। তার কারণ জনসাধারণ এখন আর কিং মেকার নয়। কিং কী করে, মেকারদের সামনে উঁচুগলায় কথা বলবে?

সমাজের চাপে আদালতে খুনের বিষয় নিয়ে হয়তো কিছুকাল উত্তাপ ছড়াবে, ক’দিন পরে সবাই সব ভুলে যাবে। আসলে সমাজের নৈতিক ভিত্তি নাজুক হয়ে এসেছে। একটি নৈতিক সরকার ও নৈতিক সমাজ ছাড়া সুশাসন সম্ভব নয়। আবারো সমাজতাত্ত্বিকের বক্তব্যে ফিরে যাই। তার ভাষায়, ‘শরীরের অসুখ থেকে আরোগ্য পাওয়া যায়, মনের অসুখেরও চিকিৎসা আছে, কিন্তু আত্মার অসুখের? এই অসুখ নিরাময় করতে পারে নৈতিকতা, সুনীতিচর্চা, শুদ্ধাচার এবং নান্দনিক বোধের বিস্তার। কিন্তু যেসব উৎস থেকে সেগুলোর উৎসার এবং বিকাশ, সেগুলো আমরা রুদ্ধ করে দিয়েছি। আমরা বলি বটে, সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে, কিন্তু এটি তো বক্তৃতার কথা, হাঁটু বাঁকানো তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার কথা। শুদ্ধতার উৎসগুলো পাথরচাপা থাকলে সচেতনতা কিভাবে বাড়বে?’

এ প্রশ্ন শিক্ষাবিদ, সমাজতত্ত্ববিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের শুধু নয়, এ প্রশ্ন সব সচেতন নাগরিকের। আমরা যারা পত্রপত্রিকার নিয়মিত পাঠক এবং একটু সংবেদনশীল, তাদের কষ্টে কাটে প্রতিদিন। দেখে দেখে আর ধারণ করতে পারি না। প্রতিদিন মৃত্যু, অন্যায়, অনিয়ম ও দুর্নীতি। কাঁহাতক সহ্য করা যায়। দলন, পীড়ন, হয়রানি, নির্যাতন ও মামলার জাঁতাকলে নিষ্পিষ্ট জীবন। প্রতিদিনের খবর যখন মৃত্যু, শোক ও আহাজারি, তখন হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয় প্রতিদিন। এভাবে আর কতকাল বেঁচে থাকা যায়। তবুও আশায় আশায় বসতি, অপেক্ষা এবং অপেক্ষা। সান্ত¡না দেয়ার ভাষাও হারিয়ে যায় কখনো কখনো। আমার কোনো কোনো বন্ধু পত্রিকার পাতায় চোখ বুলাতে চান না। বাংলাদেশের কোনো চ্যানেলে চোখ রাখেন না। চার দিকে দেখেশুনে তারা ক্লান্ত, শ্রান্ত, অবসন্ন। তাদেরকে বলি ‘চোখ বন্ধ রাখলে কি প্রলয় থেমে যাবে?’ এ দেশ যেন অঘটনের। যাদের চোখ খোলা থাকলে প্রলয় বন্ধ হওয়ার কথা, তারা সুবিধাবাদে আক্রান্ত। আর যাদের সুবিধাজনক ব্যাসার্ধ নেয়ার বুদ্ধি হয়নি, তারা আজ অসুবিধাকে শ্রেয়জ্ঞান করছে। আমাদের বিগত সময়ের ঘটে যাওয়া নিরাপদ সড়ক আন্দোলন এবং কোটা সংস্কার আন্দোলন এর বড় প্রমাণ।

এখন আমাদের দেখেশুনে ক্ষেপে যাওয়ার কথা। নজরুলের ভাষায়, আমাদের সকল বাঁধ ছুটে যাওয়ার কথা। আমাদের প্রশ্ন উত্থাপনের কথা, ‘কি দেখার কথা কি দেখছি?, কি শোনার কথা কি শুনছি? কি ভাবার কথা কি ভাবছি? কি বলার কথা কি বলছি?...’। শিল্পী হায়দার হোসেন তিরিশ বছর পর এ প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন। কিন্তু ইতোমধ্যে প্রায় ৫০ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। আমাদের বোধোদয় ঘটেনি। তাহলে আমাদের বোধোদয় হতে কি অনন্তকাল সময় লাগবে?

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement
মাত্র ২ বলে শেষ পাকিস্তান-নিউজিল্যান্ড প্রথম টি-টোয়েন্টি জেলে কেজরিওয়ালকে হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ দলের ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশের জেরে সাংবাদিকসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা তোকে যদি এরপর হলে দেখি তাহলে খবর আছে, হুমকি ছাত্রলীগ নেতার বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে কোনো রাজনৈতিক মামলা করা হয়নি : প্রধানমন্ত্রী দাওয়াতী ময়দানে সকল নেতাদের ভূমিকা রাখতে হবে : ডা. শফিকুর রহমান চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গেল শ্রমিকদের মাঝে ইসলামের আদর্শের আহ্বান পৌঁছাতে হবে : ডা. শফিকুর রহমান ঢাকা শিশু হাসপাতালের আগুন নিয়ন্ত্রণে বিমানবন্দরের টার্মিনালে ঢুকে গেলো বাস, ইঞ্জিনিয়ার নিহত গোয়ালন্দে প্রবাসীর স্ত্রী-সন্তানকে মারধর, বিচারের দাবিতে মানববন্ধন

সকল