২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

বিচারবহির্ভূত হত্যা কি নরহত্যা?

- ফাইল ছবি

একজন মানুষের বিভিন্নভাবে মৃত্যু হতে পারে। অনেকে জন্ম-পরবর্তী, অনেকে শিশুকালে, অনেকে কিশোর অবস্থায়, অনেকে যুবক অবস্থায়, অনেকে প্রৌঢ় অবস্থায় আবার অনেকে বার্ধক্য পদার্পণ-পরবর্তী সময়ে মারা যায়। বার্ধক্যে পদার্পণ-পরবর্তী মৃত্যু পরিণত বয়সের মৃত্যু এবং এরূপ মৃত্যু স্বাভাবিক। অপর সব মৃত্যু অপরিণত বয়সের মৃত্যু। পরিণত বা অপরিণত বয়সে রোগব্যাধিতে মৃত্যু হলে তা স্বাভাবিক; এর বিপরীতে পরিণত বা অপরিণত বয়সে দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে মৃত্যু হলে সেটি অস্বাভাবিক। দুর্ঘটনা বিভিন্ন ধরনের হতে পারে যেমনÑ সড়ক, রেল, নৌ বা বিমান দুর্ঘটনায়, পানিতে ডুবে, বাড়ির ছাদ বা গাছপালা থেকে পড়ে, অগ্নিদগ্ধ হয়ে, বজ্রপাতে, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস বা বন্যায়, বোমা বা গুলির আঘাতে, সাপের কামড়ে, বন্যপশুর আক্রমণে কিংবা ছুরিকাঘাতে মৃত্যু প্রভৃতি।

এমন অনেক মানুষ আছে, যারা স্বেচ্ছায় আত্মহননের পথ বেছে নেয়। আত্মহননের কাজটি করতে গিয়ে কেউ যদি ব্যর্থ হয়, সে ক্ষেত্রে এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কারণ, কোনো দেশের প্রচলিত আইন বা কোনো ধর্ম কোনো ব্যক্তিকে স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণের অধিকার দেয়নি। তবে একজন মানুষ স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করলে সে ক্ষেত্রে অপরাধটি শাস্তিযোগ্য নয় এ কারণে যে, মৃত্যুর পর কোনো মানুষের বিচার করার সাধ্য আমাদের নেই। বাংলাদেশসহ যেকোনো দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী, কোনো অপরাধী বিচারকার্য চলাকালে মৃত্যুমুখে পতিত হলে তার নাম অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেয়া হয়। এ ক্ষেত্রেও একই যুক্তি : মৃত ব্যক্তির বিচারের অধিকার মানুষের নেই এবং এ বিষয়ে যে বিধান মেনে চলা হয় তা হলো, একজন অপরাধীর মৃত্যুর সাথে সাথে তার অপরাধেরও ‘মৃত্যু’ ঘটে থাকে।

একজন অপরাধীকে অপরাধের বিবেচনায় বিচার-পরবর্তীকালে যদি তা কার্যকর করা হয় মৃত্যুদণ্ডের সাজা দিয়ে, সে ক্ষেত্রে এটিকে ‘বিচারিক হত্যাকাণ্ড’ বলা হয়। বিচারিক হত্যাকাণ্ড যেকোনো দেশের প্রচলিত আইন ও ধর্মীয় অনুশাসন দ্বারা স্বীকৃত ও সমর্থিত। অবশ্য বিগত শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে কোনো কোনো দেশে মৃত্যুদণ্ডের সাজা রহিত করা হয়েছে।

আমাদের দেশের লোকজন কয়েক দশক ধরে ‘ক্রসফায়ারে মৃত্যু’ শব্দটির সাথে পরিচিতি লাভ করেছে। প্রতিটি ক্রসফায়ারে মৃত্যু-পরবর্তী পর্যায়ে শৃঙ্খলা বাহিনী অথবা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা থেকে একই ধরনের বক্তব্য দেয়া হয়। বক্তব্যটি হলো, আটক করার পর পালিয়ে যাওয়ার সময় গুলির কারণে তার মৃত্যু ঘটেছে অথবা আটক ব্যক্তিকে নিয়ে তার দেখানো মতে অস্ত্র উদ্ধারে গেলে তার অনুগত বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ফলে আত্মরক্ষার্থে গুলি ছুড়লে, তার মৃত্যু হয়েছে। এ ধরনের মৃত্যুকে ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’ বলা হয় এবং যেকোনো সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশের জন্য এ ধরনের হত্যাকাণ্ড অবমাননাকর।

নরহত্যা গুরুতর ও নিকৃষ্ট ধরনের অপরাধ। দেশভেদে নরহত্যার সাজা মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। মৃত্যু ঘটানোর অভিপ্রায়ে কোনো কার্য দ্বারা মৃত্যু ঘটানোকে দণ্ডার্হ (Culpable homicide) নরহত্যা বলা হয়। দণ্ডার্হ নরহত্যাকে খুন (Murder) বলে গণ্য করা হয়। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড আইন দ্বারা স্বীকৃত নয় বিধায় এটি মূলত দণ্ডার্হ নরহত্যা অথবা খুন। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে যতক্ষণ পর্যন্ত বিশ্বাস জন্মানো না যাবে, ‘মৃত্যু ঘটানোর অভিপ্রায়ে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়নি,’ ততক্ষণ পর্যন্ত এটা বিশ্বাস করার সঙ্গত কারণ থাকে যে, হত্যাকাণ্ডটি মৃত্যু ঘটানোর অভিপ্রায়ে সংঘটিত হয়েছে।

আমাদের দেশে কমিউনিস্ট নেতা সিরাজ শিকদার পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার হলে পরদিন পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, আটকাবস্থা থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় গুলি করা হলে তার মৃত্যু ঘটে; সে সময়কার পুলিশের বক্তব্যটি দেশবাসীর কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়নি, যদিও তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী সিরাজ শিকদারের মৃত্যু-পরবর্তী সময়ে জাতীয় সংসদে বলেছিলেন- ‘কোথায় সিরাজ শিকদার?’ এই সিরাজ শিকদার বা তার বাহিনী কর্তৃক বিভিন্ন হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়ে থাকলেও এ জন্য বিচার করার আগেই তাকে হত্যা করা হবে, এটি কি আইনের শাসনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ?

২০০১ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতাসীন হলে কোনো অজানা কারণে শৃঙ্খলা বাহিনীর অন্তর্ভ্ক্তু সেনাবাহিনীর মাধ্যমে ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ নামক একটি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছিল। ওই অভিযানে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি উভয় দলের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত, সেই সাথে কথিত সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত এমন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যক্তিকে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা হয়। এ হত্যার পরবর্তী সময়ে অপারেশন ক্লিনহার্ট কার্যক্রমকে দায়মোচন দেয়া হয়, যেমন দায়মোচন দেয়া হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ হত্যাকাণ্ড সংঘটন-পরবর্তীকালে। সেই থেকে যে ক্রসফায়ার নাটকের যাত্রা শুরু, তা অদ্যাবধি অব্যাহত আছে।

আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন অধ্যাদেশ, ১৯৭৯-তে সংশোধনীর মাধ্যমে ২০০৩ সালে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) গঠন করা হয়। র‌্যাবে পুলিশ, সেনা, নৌ, বিমানবাহিনী প্রভৃতির সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। র‌্যাবকে অপরাধ তদন্তের ক্ষমতা দেয়া হলেও মামলা রুজু ও তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের ক্ষেত্রে তাদেরকে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দ্বারস্থ হতে হয়। তা ছাড়া, সংবিধান ও দেশের প্রচলিত আইনে যে বিধান রয়েছে, সে বিধান অনুযায়ী র‌্যাব কর্তৃক গ্রেফতারের পর কোনো কালক্ষেপণ না করে অপরাধীকে পুলিশের নিকট হস্তান্তর করলেই সংবিধান ও প্রচলিত আইন প্রতিপালনে কোনো ব্যত্যয় ঘটে না। কিন্তু কয়টি ক্ষেত্রে এই হস্তান্তর করা হয়, সে বিষয়ে দেশবাসী সন্ধিহান। ক্রসফায়ারে হত্যা করার ব্যাপারে র‌্যাবের বিরুদ্ধে যেরূপ অভিযোগ, অনুরূপ অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধেও রয়েছে।

সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৩(২) এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ৬১-তে সুস্পষ্টরূপে উল্লেখ রয়েছে, গ্রেফতারকৃত একজন ব্যক্তিকে গ্রেফতারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যাত্রার সময় ব্যতিরেকে ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে হাজির করতে হবে। কিন্তু র‌্যাব বা পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার-পরবর্তী যেসব ক্রসফায়ারের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, সে বিষয়ে নিহত ব্যক্তিদের আত্মীয়স্বজন, বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদন এবং পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, সংবিধানের অনুচ্ছেদ নম্বর ৩৩(২) এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা নম্বর ৬১-এর বাধ্যবাধকতা অনুসরণ না করেই অপরাধীদের এ দু’টি বাহিনী গ্রেফতারের সঠিক দিন-তারিখ গোপন রেখে ক্রসফায়ারে মৃত্যু সংঘটনের প্রয়াস চালানো হয়েছিল।

পুলিশ, র‌্যাব, শৃঙ্খলা বাহিনী অথবা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার যেকোনো সদস্য কোনো অপরাধী বা তার অনুগত বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হলে আত্মরক্ষার্থে কতটুকু শক্তি বা বল প্রয়োগ করতে পারবেন, তা আইন দ্বারা নির্ধারিত। এ বিষয়ে দণ্ডবিধির ধারা নম্বর ৯৭-এ মনুষ্যদেহ ক্ষুণœকারী যেকোনো অপরাধের বিরুদ্ধে তার স্বীয় দেহ ও অন্য যেকোনো ব্যক্তির দেহের প্রতিরক্ষার অধিকার দেয়া আছে। তবে সে অধিকারের ব্যাপ্তি এতটুকু বিস্তৃত নয় যে, এ যাবৎকাল ক্রসফায়ারের নামে যে অসংখ্য হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, তাতে একই কাহিনীর বহুবার পুনরাবৃত্তিতে ক্রসফায়ারের যৌক্তিকতা এবং গ্রহণযোগ্যতার অবকাশ সৃষ্টি হয়।

আমাদের সংবিধান অনুযায়ী সেনা, নৌ, বিমানবাহিনী ‘শৃঙ্খলা বাহিনীর’ অন্তর্ভুক্ত এবং এ তিনটি বাহিনী ব্যতীত অন্য কোনো বাহিনীকে আইন দ্বারা ঘোষণার মাধ্যমে শৃঙ্খলা বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করা হলে, সে বাহিনীটিও ‘শৃঙ্খলা বাহিনী’ হবে। অপর দিকে, বিভিন্ন আইনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বলতে পুলিশ বাহিনী, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন, আনসার বাহিনী, ব্যাটালিয়ন আনসার, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, কোস্টগার্ড বাহিনী ও শৃঙ্খলা বাহিনীগুলোকে বুঝানো হয়েছে। উপরি উক্ত ব্যাখ্যা থেকে দেখা যায়, শৃঙ্খলা বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত সেনা, নৌ, বিমানবাহিনী আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অন্তর্ভুক্ত হলেও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা হিসেবে অপরাপর বাহিনী যতক্ষণ পর্যন্ত আইন দ্বারা শৃঙ্খলা বাহিনী হিসেবে ঘোষিত না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত এসব বাহিনী বা এর কোনো একটি শৃঙ্খলা বাহিনী নয়।

আমাদের দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে সচেতন নাগরিকসহ সুশীলসমাজ দীর্ঘ দিন ধরে এর বিরুদ্ধে নিজ বক্তব্য তুলে ধরছে। এ বিষয়ে আমাদের দেশের ও বিশ্বের মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অবস্থানও অভিন্ন। বিগত বছরগুলোর ক্রসফায়ারের ঘটনা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, একই ধরনের ঘটনা বিএনপি, সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন থাকাকালে সংঘটিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপিÑ এ দু’টি দল বিরোধী দলে থাকাবস্থায় একে অপরের শাসনামলে ক্রসফায়ারে মৃত্যুর ব্যাপারে সোচ্চার থাকলেও ক্ষমতাসীন হয়ে তারা কেউ এ ধরনের ঘটনা সংঘটন থেকে নিজেদের নিবৃত্ত রাখতে পারেননি।

দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণসহ সন্ত্রাসী ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পুলিশের ওপর ন্যস্ত। পুলিশ ব্যর্থ হলে অন্যান্য বাহিনীর সহায়তা নেয়ার বিধান থাকলেও তা কখনো পুলিশের মামলা রুজু ও অভিযোগপত্র দায়েরের ক্ষমতাকে খর্ব করে না। পুলিশবাহিনীর সদস্যদের মতো শৃঙ্খলা বাহিনী এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বাহিনীগুলোর প্রত্যেক সদস্যের নিজ সম্পাদিত যেকোনো কর্মের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট জবাবদিহিতা করতে হয়। দৃশ্যত সরকারের প্রশ্রয়ে জবাবদিহিতায় শিথিলতার কারণে একই ব্যাখ্যার পুনরাবৃত্তির পাশাপাশি ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটে চলছে। এতে করে সরকারে থাকাকালে রাজনৈতিক বিরোধীদের অবদমিত করার প্রয়াস নেয়া হলেও তাতে কি পূর্ণ সফলতা পাওয়া যায়? আর পূর্ণ সফলতা পাওয়া গেল কি গেল না সে প্রশ্নে না গিয়ে প্রশ্ন হতে পারে, কেন এ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড? তা ছাড়া, সরকারি দল এবং এর নেতাকর্মীরা ক্ষমতা থেকে বিদায় নিলে একই ঘটনার শিকার যে হবেন না, সে নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারেন কি?

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বিনাবিচারে হত্যাকাণ্ডের সাথে তুল্য। ইসলামসহ কোনো ধর্ম বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ডকে অনুমোদন করে না। ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের বিশ্বাস মতে, শেষ বিচারের দিন আল্লাহ তায়ালা দুই ধরনের পাপ ব্যতীত অন্য সব পাপের ক্ষমা প্রদানের ক্ষমতা নিজের কাছে রেখেছেন। এ দুই ধরনের পাপের সাথে যারা সম্পৃক্ত তারা হলো দেনাদার ও খুনি। উভয় ক্ষেত্রে, পাপের কারণে ক্ষতিগ্রস্তরা মার্জনা করলে পাপ মোচন হবে, অন্যথায় কঠিন সাজা ভোগ করা অবধারিত।

আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পোশাকধারী বা পোশাকবিহীন সদস্য কর্তৃক বাড়ি অথবা যেকোনো স্থান থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করে লাশ গুমের ঘটনা ক্রসফায়ারের সাথে পাল্লা দিয়ে অনেক ঘটেছে। এ ধরনের হত্যাকাণ্ডও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত। ক্রসফায়ারের সাথে এ হত্যাকাণ্ডের পার্থক্য হলো ক্রসফায়ারের ক্ষেত্রে নিহত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজন লাশটি ফিরে পেয়ে ধর্মীয়ভাবে সৎকারের ব্যবস্থা করতে পারেন, যেটি শেষোক্ত ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। এমনকি তুলে নেয়ার পর লাশ ফেরত না পাওয়া গেলে নিহত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজনের দীর্ঘকাল এ ধারণাই বদ্ধমূল থাকে যে, হয়তো বা তুলে নেয়া ব্যক্তি জীবিত রয়েছেন। এ ধরনের ঘটনা যে কত বেশি মর্মবেদনাদায়ক তা ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্য ব্যতীত অপর কেউ অনুধাবন করতে পারবেন না।

একজন ব্যক্তি অপরাধী গণ্য হয়ে যেকোনো আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হেফাজতে থাকাকালে ক্রসফায়ারসহ যেকোনোভাবে মৃত্যুবরণ করলে ওই বাহিনীকে মৃত্যুসংক্রান্ত সন্তোষজনক কারণ দেখাতে না পারলে অবশ্যই তাদের দায় বহন করতে হবে। বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত যার সিদ্ধান্তে ক্রসফায়ার কার্যকর হয়েছে, অধিক দায় নিঃসন্দেহে তার। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলেও, এ দায় থেকে আদেশ পালনকারী ও আদেশ প্রদানকারী কেউই মুক্ত নন।

স্বৈরশাসনের কবলে পড়েছে পৃথিবীর এমন দেশ যেমন- চিলি, আর্জেন্টিনা, লিবিয়া, মিসর, ইরাক, ইরান প্রভৃতির জনসাধারণের ক্রসফায়ার ও তুলে নেয়ার পরবর্তী সময়ে লাশ গুমের ঘটনার সাথে পরিচয় ঘটে থাকলেও সেসব দেশে স্বৈরশাসকদের পরিণতি কী হয়েছিল তা আজ ইতিহাসের পাতায় স্পষ্ট।

কোনো ব্যক্তি যেকোনো অপরাধ ঘটালে তাকে বিচারের মাধ্যমে আইন দ্বারা স্বীকৃত সাজা প্রদান পৃথিবীর সর্বত্র অনুসৃত হয়ে আসছে। এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে বিচারবহির্ভূত প্রক্রিয়ায় সাজা প্রদান বা ক্রসফায়ারের নামে মৃত্যু ঘটানো আইনের অনুসরণে হয়েছে, এমনটি দাবি করার সুযোগ নেই। তাই যে হত্যা আইনসিদ্ধ নয়, তা এক প্রকার নরহত্যা বিধায় এ থেকে নিবৃত্ত থাকা উচিত।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement