২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

জীবন ও স্বপ্ন

-

ধর্মের সাথে রাজনীতির সম্পর্ক বহুল আলোচিত একটি বিষয়। প্রায়ই বলা হয়ে থাকে, মানুষ বাঁচার জন্য নিজেরাই ধর্ম তৈরি করেছে এবং ধর্মের সাথে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই।’ আমরা যদি লক্ষ করি, তাহলে দেখব, প্রতিটি ধর্মÑ তা ইসলাম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান যে ধর্মই হোক না কেন, কিছু নৈতিক মূল্যবোধের কথা বলে থাকে। এসব মূল্যবোধ শাশ্বত। নিজের জীবন দিয়ে এটা উপলব্ধি করেছি। আমার পিএইচডি কমিটিতে একজন ছিলেন খ্রিষ্টান, একজন হিন্দু, একজন ইহুদি। কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন খ্রিষ্টান। তিনি আমাকে কৌতুক করে বলতেন, তুমি তো পিএইচডি পাবে না। কারণ তুমি মুসলমান। আর তোমার মূল্যায়ন কমিটির তিনজন তিন ধর্মের। কিন্তু দেখা গেল ঠিক এ কারণেই আমি ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছিলাম। তারা আমাকে যে ভালোবাসা দিয়েছেন, তাদেরকে নিজের দ্বিতীয় পিতা-মাতার মতো আপন ও দরদী মনে করি।

জীবনে অনেক দেশ ঘুরেছি, অনেক সংস্কৃতির সাথে মিশেছি। সবখানে দেখেছি, একটি বিশ্বজনীন অনুভূতি রয়েছে; ভালোবাসা আছে। এগুলো হলো মানবতার বিশ্বজনীনতা বা ইউনিভার্সিলিটি অব ম্যানকাইন্ড। ইসলামও সে কথাগুলোই বলে। এটা একটি জীবন দর্শন। ‘দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত’ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামী জুরিসপ্রুডেন্স দিকনির্দেশনা দিয়েছে। এটা হলো জীবনের জন্য একটি পরিপূর্ণ প্যাকেজ। এই প্যাকেজ কোনোভাবেই জীবন থেকে বাদ দেয়া সম্ভব নয়। আমাদের রাজনীতিবিদেরা যখন সেকুলারিজমের কথা বলেন, তাদের ভাবনায় কোনো গভীরতা খুঁজে পাই না। কথায় কথায় তারা বলে থাকেন, আমাদের স্বাধীনতার চেতনা নাকি সেকুলার। এই চেতনা কোথা থেকে এসেছে? মনে হয়, তারা ইতিহাস ঠিকমতো পড়েননি। ছয় দফার কোথাও ধর্মের বিরুদ্ধে, ইসলামের বিরুদ্ধে কথা নেই। পাঠকের সুবিধার্থে আমি এখানে ঐতিহাসিক ছয় দফা উল্লেখ করছি-

১. শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রের প্রকৃতি : দেশের শাসনতান্ত্রিক কাঠামো এমনি হতে হবে, যেখানে পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেশনভিত্তিক রাষ্ট্রসঙ্ঘ এবং তার ভিত্তি হবে লাহোর প্রস্তাব। সরকার হবে পার্লামেন্টারি ধরনের। আইন পরিষদের ক্ষমতা হবে সার্বভৌম এবং এই পরিষদও নির্বাচিত হবে সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে জনসাধারণের সরাসরি ভোটে।

২. কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা : কেন্দ্রীয় (ফেডারেল) সরকারের ক্ষমতা কেবল দু’টি ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে যথা, দেশরক্ষা ও বৈদেশিক নীতি। অবশিষ্ট সব বিষয়ে অঙ্গরাষ্ট্রগুলোর ক্ষমতা থাকবে নিরঙ্কুশ।

৩. মুদ্রা বা অর্থসম্বন্ধীয় ক্ষমতা : মুদ্রার ব্যাপারে নিন্মলিখিত দু’টির যেকোনো একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা চলতে পারে (ক) সমগ্র দেশের জন্যে দু’টি পৃথক, অথচ অবাধে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু থাকবে। অথবা (খ) বর্তমান নিয়মে সমগ্র দেশের জন্য কেবল একটি মুদ্রাই চালু থাকতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে শাসনতন্ত্রে এমন ফলপ্রসূ ব্যবস্থা রাখতে হবে, যাতে করে পূর্ব-পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচারের পথ বন্ধ হয়। এ ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক ব্যাংকিং রিজার্ভেরও পত্তন করতে হবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক আর্থিক বা অর্থবিষয়ক নীতি প্রবর্তন করতে হবে।

৪. রাজস্ব, কর, বা শুল্ক সম্বন্ধীয় ক্ষমতা : ফেডারেশনের অঙ্গরাজ্যগুলোর কর বা শুল্ক ধার্যের ব্যাপারে সার্বভৌম ক্ষমতা থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকারের কোনোরূপ কর ধার্যের ক্ষমতা থাকবে না। তবে প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য অঙ্গরাষ্ট্রীয় রাজস্বের একটি অংশ কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাপ্য হবে। অঙ্গরাষ্ট্রগুলোর সব রকম করের শতকরা একই হারে আদায়কৃত অংশ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল গঠিত হবে। ৫. বৈদেশিক বাণিজ্যবিষয়ক ক্ষমতা : (ক) ফেডারেশনভুক্ত প্রতিটি রাজ্যের বহির্বাণিজ্যের পৃথক পৃথক হিসাব রক্ষা করতে হবে; (খ) বহির্বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা অঙ্গরাজ্যগুলোর এখতিয়ারাধীন থাকবে; (গ) কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা সমান হারে অথবা সর্বসম্মত কোনো হারে অঙ্গরাষ্ট্রগুলোই মেটাবে; (ঘ) অঙ্গরাষ্ট্রগুলোর মধ্যে দেশজ দ্রব্য চলাচলের ক্ষেত্রে শুল্ক বা করজাতীয় কোনো রকম বাধানিষেধ থাকবে না; এবং (ঙ) শাসনতন্ত্রে অঙ্গরাষ্ট্রগুলোকে বিদেশে নিজ নিজ বাণিজ্যিক প্রতিনিধি প্রেরণ এবং স্ব-স্বার্থে বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদনের ক্ষমতা দিতে হবে।

৬. আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষমতা : আঞ্চলিক সংহতি ও শাসনতন্ত্র রক্ষার জন্য শাসনতন্ত্রে অঙ্গরাষ্ট্রগুলোকে স্বীয় কর্তৃত্বাধীনে আধা সামরিক বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন ও রাখার ক্ষমতা দিতে হবে।

ছয় দফার কোথাও ‘ইসলামিক স্টেট’ পাকিস্তান রাষ্ট্র বিভাজনের কথা নেই। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে সে রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল। অবশ্য নেশন স্টেট বা জাতিরাষ্ট্রের ধারণা নিয়ে আমারও প্রশ্ন রয়েছে। তবে দ্বিজাতিতত্ত্ব ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য একটি তত্ত্ব এবং এটা মেনে নিয়েই ভারত ও পাকিস্তান নামে আলাদা দু’টি রাষ্ট্র গঠন করা হয়েছিল। অপরদিকে, ছয় দফা আসলে ছিল বণ্টনের ব্যাপার, হিস্যার ব্যাপার। তৎকালীন পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে অর্থনৈতিক বণ্টনটি ঠিকমতো হয়নি। আমাদের টাকা তারা নিয়েছে; আমাদের দেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রার ৭৫ শতাংশ আয় করেছে। কিন্তু সেটা খরচ করা হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ব পাকিস্তানে যথেষ্ট উন্নয়ন হয়নি, উন্নয়ন হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানে। তাই বিকেন্দ্রীকরণ করার দাবি ওঠে।

এ কথা গুনান মিউরডাল ১৯৬০-এর দশকে তার ‘এশিয়ান ড্রামা’ বইতে বলেছিলেন। এই সুইডিশ ইকোনমিস্ট সর্বপ্রথম বলেছিলেন, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে উন্নয়নের এই বৈষম্যের ফলে যে টানাপড়েন তৈরি হচ্ছে, তা সমাজ সহ্য করতে পারবে না। তোমার চোখের সামনে তোমার টাকা নিয়ে আরেক ভাই বড়লোক হয়ে যাচ্ছে, অথচ তুমি খেতে পারছো না। তখন তুমি তো বসে থাকবে না। তুমি ভাইকে যতই ভালোবাস না কেন, যখন দেখবে তুমি খেতে পারছো না আর তোমার সম্পদ নিয়ে তোমার আরেক ভাই গাড়ি-বাড়ি করছে, মার্সিডিজ চালাচ্ছে তখন তুমি কি সহ্য করবে?

ছয় দফার আন্দোলন ওই ষাটের দশকেই হয়েছিল এবং গুনান মিউরডালের ভবিষ্যদ্বাণীর সাথে মিলে যায়। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস ছিল পাট। অবশ্য দুঃখজনকভাবে এখন পাটের অবস্থা খুবই করুণ। তখন পাকিস্তানের ৭৫ ভাগ বৈদেশিক মুদ্রাই আয় হতো পাট থেকে। কিন্তু ওই আয়ের ২৫ ভাগও পূর্ব পাকিস্তানের জন্য খরচ করা হতো না। আমাদের এখানে চন্দ্রঘোনার কর্ণফুলী কারখানায় কাগজ তৈরি হতো। এখানে তা বিক্রি হতো এক টাকায়, অথচ করাচিতে পাওয়া যেত বারো আনায়। কারণ, করাচি ছিল হেডকোয়ার্টার। পাকিস্তান প্লানিং কমিশনে কাজ করার সুবাদে বিষয়গুলোর আমি নিজে প্রত্যক্ষ সাক্ষী। তখনই বিষয়গুলো তুলে ধরে বই লিখে হিসাব কষে দেখিয়েছিলাম যে, প্রকাশ্যে যত কথাই বলা হোক না কেন, পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বৈষম্য প্রকট।’

আসলে আমি পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগ দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট হলেও আমার স্বপ্ন ছিল পিএইচডি করার। কিভাবে পিএইচডি করব, সেই ভাবনা আমাকে সব সময় তাড়িয়ে বেড়াত। সিভিল সার্ভিস থেকে বিদেশে ছয় মাস, ৯ মাসের জন্য প্রশিক্ষণে পাঠানো হতো। আমাকে একবার জাপানে প্রশিক্ষণে পাঠানোর জন্য নির্বাচিত করা হলো। কিন্তু সেখানে যাইনি। কারণ, একবার গেলে পাঁচ বছরের মধ্যে যাওয়ার আর সুযোগ ছিল না। তখন পিএইচডি করার সুযোগ ছিল শুধু প্লানিং কমিশন থেকে। ফলে আমার চিন্তা হলো, কিভাবে আমি প্লানিং কমিশনে যেতে পারি। কিন্তু প্লানিং কমিশনে যোগ দেয়ার মতো যোগ্যতা আমার ছিল না। তাই বই লেখার চিন্তা মাথায় আসে। এটা আমাকে প্লানিং কমিশনে যাওয়ার সুযোগ করে দিতে পারে। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সমস্যা ও পরিকল্পনার ওপর বই (ইকোনমিক প্রবলেম অ্যান্ড প্লানিং ইন পাকিস্তান) লিখতে শুরু করি। আমার বন্ধুবান্ধব ও সহকর্মীরা যখন আনন্দ-ফুর্তিতে সময় কাটাত, তখন আমি সময় ব্যয় করেছি এই বই লেখায়। কারো যদি ভিশন ও পারপাজ থাকে কিভাবে ওপরে ওঠা যায়, তাহলে সে উঠবেই। এর সাক্ষী আমি নিজে।

প্রায় ৪০০ পৃষ্ঠার এই বইয়ে আমি ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য কী হয়েছে, অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সরকার কত বরাদ্দ করেছে আর কত ছাড় করা হয়েছে, তার তুলনামূলক চিত্র বিশ্লেষণ করেছি। বৈষম্যের মূলে ছিল এটাই। এই বৈষম্যের একটি ধারাবাহিক ছক তৈরি করেছিলাম। আমি দেখি, কেন্দ্রীয় সরকারের হিসাবে পূর্ব পাকিস্তানকে ৫৩ শতাংশের মতো বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে, কিন্তু ৩৮ শতাংশের বেশি ছাড় করা হয় না। বছরের পর বছর এ অবস্থা চলছিল। বইটি বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা ফিরোজ সন্স-এর মাধ্যমে প্রকাশ করি। এর জন্য সরকারের কোনো অনুমতিও নেইনি। সরকারি কর্মচারী হয়েও সেই স্বাধীনতা নিয়েছিলাম। তখন ড. আব্দুল ওয়াহিদ ছিলেন ফিরোজ সন্স-এর চেয়ারম্যান ও প্রকাশক। তিনি ছিলেন মহাকবি আল্লামা ইকবালের ছেলে (বিচারপতি) জাভেদ ইকবালের শ্বশুর। তিনি আমাকে ও আমার স্ত্রীকে অনেক ¯েœহ করতেন। তাকে বললাম, আংকেল, আমি তো বইটি লিখেছি, কিন্তু সরকারি চাকরি করি, তাই কাউকে এটি পাঠাতে পারব না। আপনি যদি আপনার স্বাক্ষরে প্রেসিডেন্ট ও সব সেক্রেটারি এবং অন্য সবার কাছে সৌজন্য হিসেবে বইটির কপি পাঠান, তাহলে ভালো হয়। তিনি আমার অনুরোধ মতো কাজটি করলেন।

আমি তখনো অর্থ মন্ত্রণালয়ে অ্যাসিস্ট্যান্ট ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাডভাইজার হিসেবে কাজ করছিলাম। তখন মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন ছিলেন পাকিস্তান পার্লামেন্টে পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যান। তিনি অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে একজন স্মার্ট বাঙালি অফিসারকে লিয়াজোঁ অফিসার হিসেবে খুঁজছিলেন। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে আমাকে নির্বাচন করা হয় লিয়াজোঁ অফিসার হিসেবে। সেই সুবাদে নুরুল আমিনের ঘনিষ্ঠ সঙ্গ লাভ করেছি। তার প্রাইভেট সেক্রেটারি হিসেবে কিছু দিন কাজ করি। একদিন বাইরের কাজ শেষে অফিসে ফিরে দেখি, আমার টেবিলের ওপর একটি খাম। এটি পাঠিয়েছেন প্লানিং সেক্রেটারি কামরুল ইসলাম। তিনি ওল্ড আইসিএস অফিসার, পূর্ব পাকিস্তানের চিফ সেক্রেটারিও ছিলেন। চিঠিতে লেখা ছিল ‘থ্যাংক ইউ ফর সেন্ডিং অ্যা কপি অব দ্য বুক। ইফ ইউ আর ইন্টারেস্টেড টু জয়েন দ্য প্লানিং কমিশন, সি ড. মাহবুবুল হক।’ এই চিঠি পেয়ে তো আমার বাকরুদ্ধকর অবস্থা, খুশিতে আত্মহারা। কোথায় আমি আর কোথায় সেক্রেটারি। ড. মাহবুবুল হক তখন ছিলেন চিফ ইকোনমিস্ট অব প্লানিং কমিশন, সেক্রেটারি। পরে তিনি পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন খুবই নামকরা অর্থনীতিবিদ। এরপর আমি তার সাথে দেখা করতে গেলাম। তখন ইসলামাবাদে সাতটা বড় বড় বিল্ডিং ছিল। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ছিল এগুলোতে। তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি তোমার বইয়ের একটি কপি পেয়েছি। সেক্রেটারির কাছে তোমার কথা শুনেছি। তুমি কি প্লানিং কমিশনে আসতে চাও?’ আমি বললাম, হ্যাঁ। উনি বললেন, ‘তোমাকে তো ডেপুটেশনে আসতে হবে। তুমি ক্যাডার সার্ভিসের লোক।’ কিন্তু ডেপুটেশনে আসা মানে দুই এক বছর থাকার পর ফেরত যাওয়া। এ ছাড়া ডেপুটেশনের জন্য একটা অ্যালাউন্স, আর পে অব দ্য পোস্টের জন্য হয়তো আরো দুই শ’ টাকা পাওয়া যাবে। ভাবলাম, যেহেতু সেক্রেটারি স্বয়ং আমার ব্যাপারে আগ্রহী, তাহলে কেন আমি ডেপুটেশনে আসব? আমি বললাম, ‘অ্যাসিস্ট্যান্ট চিফ হিসেবে আসতে চাই।’ অ্যাসিস্ট্যান্ট চিফ মানে সিনিয়র ক্লাস ওয়ান অফিসার। এটা প্রাদেশিক সরকারের ডেপুটি সেক্রেটারির পদমর্যাদার। ওই পদে যেতে হলে সিভিল সার্ভিসে সাত বা আট বছর থাকতে হবে। আবার আমার প্রয়োজনীয় কোয়ালিফিকেশনও ছিল না। প্রথম কোয়ালিফিকেশন হলো আট বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। ইন্টারনাল হলে তাকে ফার্স্টক্লাস হতে হবে। আমার একটিও ছিল না। তৃতীয়ত, তার গবেষণামূলক প্রকাশনা থাকতে হবে। এটা অবশ্য আমার বইটি কভার করতে পারবে। এ ছাড়াও আমার আরেকটি বই ছিল।

তখন ড. মাহবুবুল হককে বললাম, ‘আমি অ্যাসিস্ট্যান্ট চিফ হিসেবে আসতে চাই।’ তিনি বললেন, ‘তাহলে তো চাকরি ছাড়তে হবে।’ এখানে একটি বিষয় খেয়াল করার মতো : জীবনে যদি ভিশন থাকে তাহলে ছোটখাটো জিনিসগুলোকে ত্যাগ করা শিখতে হবে। আমিও শিখলাম। বললাম, ‘হ্যাঁ, আমি চাকরি ছাড়ব।’ ক্যাডার সার্ভিস মানে এক সময় হয়তো ৬০ বছরে সেক্রেটারি হওয়া, ছোট একটি বাড়ি করা। মানে একটা স্টেরিও টাইপড জীবন। কিন্তু আমার স্বপ্ন ছিল পিএইচডি করব, পড়াশোনা করব। আমি বললাম, ‘আমাকে ইন্টারভিউতে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিন।’ উনি বললেন, ‘আমরা অ্যাসিস্ট্যান্ট চিফের পাঁচটি পোস্টের জন্য বিজ্ঞাপন দিচ্ছি। একটা মেরিট কোটাতে। আর পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে দু’টি করে। তুমি কি আবেদন করতে চাও?’

আমার কিন্তু কোনো কোয়ালিফিকেশন ছিল না। কোয়ালিফিকেশন একটাই আমি বইটি লিখেছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, একবার যদি ইন্টারভিউ বোর্ডে যেতে পারি তাহলে সফল হবো। তখন ড. মাহবুবুল হককে বললাম, ‘হ্যাঁ, আমি আবেদন করব। আমাকে শুধু যদি ইন্টারভিউ কার্ড পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতেন, তাহলে চেষ্টা করতে পারতাম।’ তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে তুমি যাও, সেক্রেটারির সাথে কথা বলে দেখি।’ পরে আমাকে ফোনে বললেন, তুমি অ্যাপ্লাই করো।

তখন পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন কামরুল ইসলামের বন্ধু। তিনি বললেন, মান্নানের একটা অ্যাপ্লিকেশন পাঠালাম, ওকে ইন্টারভিউ কার্ড পাঠিয়ে দিও। কয়েক দিন পরই ইন্টারভিউ কার্ড এসে হাজির। কার্ড যেদিন পেলাম, আমার মনে হলো জীবনের স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। আমার মা তখন ইসলামাবাদে ছিলেন। তাকে আমি সব বললাম। মা বেশি শিক্ষিত ছিলেন না। কিন্তু পিএইচডি, ব্যারিস্টারি পড়াÑএসব তিনি ভালো করেই বুঝতেন। তিনি সব সময় আমাকে লেখাপড়া করার জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন। রাওয়ালপিন্ডিতে গেলাম ইন্টারভিউ দিতে, আমার বইটা হাতে নিয়ে। দেখলাম, পাঁচজনের কমিটিতে ড. মাহবুবুল হক রয়েছেন। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন, তিনি একজন ওল্ড আইসিএস অফিসার। বাকি তিনজন সদস্যকে চিনতাম না।
মাহবুবুল হক আমাকে প্রশ্ন করা শুরু করেন। ধীরে ধীরে তিনি আমাকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করলেন। আমি উত্তর দিতে গিয়ে কিছুটা

অস্বস্তিতে পড়ে যাই। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, বইটিতে তুমি কী মেসেজ দিতে চেয়েছ, কী লিখতে চেয়েছ ইত্যাদি। চেয়ারম্যান বিষয়টি লক্ষ করলেন। ‘ইকোনমিক প্লানিং’ বইটি টেবিলের ওপর রেখেছিলাম। তখন চেয়ারম্যান বইটি হাতে নিয়ে বললেন, এটা কার লেখা? বললাম, স্যার আমার। তখন তিনি যে কথাটি বলেছিলেন তা এখনো আমার কানে বাজে : ‘দ্য বয় হু ক্যান রাইট দিস বুক অ্যাট দ্য এজ অব টোয়েন্টি ফোর, হ্যাজ এনাফ কোয়ালিফিকেশন ফর এন অ্যাসিস্ট্যান্ট চিফ।’ আমি বুঝলাম, কাজ হয়ে গেছে।

এর পরের ইতিহাস হলো, আমার জীবন সংগ্রামের ইতিহাস। প্লানিং কমিশনে জয়েন করি। এখানে এসেই আমি পাকিস্তানের রাজনৈতিক আকাশে ঝড়ের ঘনঘটা দেখতে পেলাম। বুঝতে পারলাম, আমার দেশ ছাড়ার সময় হয়ে গেছে। পিএইচডি করতে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাই। এরই মাঝে বাংলাদেশের জন্য স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে। আমি রাষ্ট্রহীন অবস্থায় পড়ে গেলাম। এক সময় এমন অবস্থা দাঁড়াল যে, আমার মেয়ের জন্য ছয় ডলার দিয়ে একটি বারবি ডল পর্যন্ত কিনতে পারিনি। তাকে অনেক দিন দাঁড়ানো অবস্থায় দেখিনি। যখন বাড়ি থেকে কাজের উদ্দেশে বের হতাম, তখন তাকে শোয়া দেখতাম, আবার রাতে যখন বাসায় ফিরেছি, তখনো তাকে শোয়া দেখেছি। তবে এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে আমি শিখেছি, যদি কারো ডিটারমিনেশন থাকে, পারপাজ থাকে, ভিশন থাকে, তাহলে জীবনে সফলতা আসবেই। আমি স্বপ্ন দেখতাম, সেই স্বপ্ন এখন নতুন প্রজন্মকে দেখানোর চেষ্টা করছি। 

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লি: প্রাক্তন মুখ্য অর্থনীতিবিদ-ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক, জেদ্দা  hmct2004@yahoo.com 


আরো সংবাদ



premium cement