১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

দুষ্টের লালনের পরিণাম গণনিষ্ক্রিয়তা

দুষ্টের লালনের পরিণাম গণনিষ্ক্রিয়তা -

দেশে একের পর এক এমন সব ঘটনা ঘটছে, যা দেখে সবাই শিউরে উঠছেন। প্রকাশ্যে শত শত মানুষের সামনে নিষ্ঠুরভাবে কেউ হত্যার শিকার হলেও গণপ্রতিরোধ নেই। সবাই অসহায় দর্শক হয়ে তা প্রত্যক্ষ করছেন। প্রতিরোধ গড়ে তোলার বিন্দুমাত্র প্রচেষ্টা নেই। এ ধরনের ঘটনা যে একটি ঘটেছে, তা কিন্তু নয়। এমন বহু ঘটনা হরহামেশা ঘটছে। সমাজে এক ধরনের অপসংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, যা হলো, প্রকাশ্যে অপরাধ সংঘটিত হলেও তা এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা। বরগুনায় এবার দিনদুপুরে হাজারো মানুষের সামনে নারকীয় হত্যার ঘটনা ঘটল, কেউ এগিয়ে এলেন না। এর জন্য কে দায়ী? এতে সামাজিক মূল্যবোধ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে? এর আগে দেশবাসী অসহায়ভাবে দেখেছে, নিছক বিরোধী দলের কর্মী সন্দেহে পুরান ঢাকায় প্রকাশ্যে নৃশংসভাবে কুপিয়ে বিশ্বজিৎ নামে এক কর্মজীবী তরুণকে হত্যা করেছিল ছাত্রলীগের সশস্ত্র কর্মীরা।
প্রশ্ন হচ্ছে, এসব ঘটনা রোধে রাষ্ট্র কী পদক্ষেপ নিয়েছে? রাজনৈতিক বিবেচনায় এসব খুনি বেশির ভাগ সময় পার পেয়ে যাচ্ছে। এতে অপরাধীদের অভয়াশ্রমে পরিণত হচ্ছে সারা দেশ। অপরাধ করে ক্ষমতাধরদের আশ্রয়ে থাকায় তাদের বিচার হয় না। আগের ঘটনার বিচার না হওয়ায় এমন বীভৎস দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে বলে সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করছেন। অপরাধীদের বিচার হলে এভাবে প্রকাশ্যে একের পর এক খুনের ঘটনা ঘটত না, এটিই তাদের অভিমত। হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে ঘাতকেরা ছাড় পেলে, অপরাধীরা তখন অপরাধ করতে ভয় পায় না; বরং আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে এবং যেকোনো অপরাধ-অপকর্ম অবলীলায় ঘটিয়ে যায়।

হত্যা-খুন আগেও হতো। তবে তখন হতো গোপনে বা নির্জনে। অপরাধীরা প্রকাশ্য হতে ভয় পেত। পুলিশ ধরবে, গণপিটুনি খাবে, চিহ্নিত হলে ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হবে। এখন চিত্র সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। সাধারণ মানুষ অপরাধের প্রতিরোধে এগিয়ে আসছে না। এর পেছনে অন্যতম কারণ, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জেঁকে বসেছে ভয়ের সংস্কৃতি। এমন পরিস্থিতি এক দিনে সৃষ্টি হয়নি। দীর্ঘ দিন ধরে দেশের রাজনীতিতে ক্রমবর্ধমানভাবে জেঁকে বসেছে দুর্বৃত্তায়ন। ফলে সমাজ-রাষ্ট্রে জন্ম নিয়েছে এক বিষবৃক্ষ। এটি কি সমাজ ও রাষ্ট্রের ব্যর্থতা? প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন ওঠে, কেন সমাজ বা রাষ্ট্র ব্যর্থ হচ্ছে? এককথায় এর উত্তর মেলা ভার। তবে গুরুত্বপূর্ণ কারণটি বোঝা যায়, যারা এসব নিষ্ঠুরতার সাথে জড়িত, তারা কোনো-না-কোনোভাবে ক্ষমতাসীনদের লেজুড় এবং তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে লালিতপালিত। এসব দুর্বৃত্ত অপরাধের বহু ‘বিজয় মুকুট’ অর্জন করে তবেই এমন নিষ্ঠুর ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। ফলে প্রকাশ্যে কোপানোর অপসংস্কৃতির ধারাবাহিকতা দেখছেন দেশবাসী। নিকট অতীতে এমন নিষ্ঠুর ঘটনা খুব একটা দেখা যায়নি। এখন নিষ্ঠুর-বর্বর ঘটনার স্বাভাবিকীকরণ হওয়ায় দিন দিন সমাজ-রাষ্ট্রকে তা গ্রাস করছে। এসব দেখে শুধু ক্ষুব্ধ ও হতাশা নয়, মনে আতঙ্ক অনুভূত হওয়াও স্বাভাবিক।

পরিবার ও সমাজে এখন যা ঘটছে, তা নির্মূল করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি। দেশে আগের মতো এ নীতি প্রতিপালিত না হওয়ায় বিপদের আশঙ্কায় মানুষজন প্রতিরোধের সাহস হারিয়ে ফেলেছে। ক্ষেত্রবিশেষে দেখা যায়, কাউকে উপকার করতে গিয়ে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে অনেককে। অন্যের উপকার করতে গিয়ে নিজেই হচ্ছেন নিপীড়নের শিকার। এতে গণপ্রতিরোধপ্রবণতা লোপ পাচ্ছে।

চাপাতি দিয়ে উপর্যুপরি কোপানোর এ বর্বরতার উৎসের হয়তো কিছু তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যেতে পারে। যেমন তত্ত্বীয়ভাবে বলা হয়- মানুষের প্রবৃত্তিতে দু’টি বিষয় কাজ করে। একটি শুভচিন্তা; অন্যটি পশুপ্রবৃত্তি। শুভচিন্তার ফলে মানুষ কল্যাণকর সৃজনশীল কাজ করে থাকে। আর পশুপ্রবৃত্তিতে সহিংসতা বড় একটি উপাদান। রাষ্ট্রের বিধান অনুযায়ী, অপরাধীকে কঠোর শাস্তি দিয়ে মানুষকে পশুপ্রবৃত্তি থেকে বিরত রাখা সম্ভব। কুপ্রবৃত্তি দমনে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অনুশাসনের যথাযথ প্রয়োগ অতীব জরুরি। দুর্ভাগ্যবশত দেশে এসবের অভাব। ফলে যখন-তখন নিষ্ঠুর সব ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। অন্য দিকে, বিশ্বায়নের ফলে নেতিবাচক বা ক্ষতিকর বৈশ্বিক উপাদান আমাদের সমাজে অনুপ্রবেশ করেছে। যেমন- অনলাইন সংস্কৃতি। তরুণেরা এগুলোতে বুঁদ হয়ে আছে। এটিও সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য অনেকাংশে দায়ী। এসব নিয়ন্ত্রণে বিকল্প ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি দেশে। তা ছাড়া পরিবার ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান এখন আগের মতো ভূমিকা পালন করতে পারছে না। নতুন জীবনে প্রবেশ করায় অর্থের দাপট ও লোভে, দ্রুত যেকোনো জিনিস পাওয়ার অন্যায় আকাক্সক্ষা বাড়ছে। কিন্তু এর মোকাবেলায় সেভাবে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঢেলে সাজানো সম্ভব হয়নি। যার কারণে রাষ্ট্রীয় অনুশাসন শক্ত পাটাতনে দাঁড়াতে পারছে না, ক্রমাগত ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে। বরগুনাসহ আগে যেসব ঘটনা ঘটেছে, তা বারবার ঘটতে থাকবে যতক্ষণ না রাষ্ট্র ও সমাজের কঠোর অনুশাসন কার্যকরভাবে বলবৎ করা হবে।

এর সমাধান যাদের হাতে, তাদের তা করতে বাধ্য করবে কারা? ‘বিড়ালের গলায় ঘণ্টা’ বাঁধবে কে? কারা এর জন্য দায়ী, গলদ কোথায়, প্রতিকারই বা কী? বলা যায়, এ আমাদের সামষ্টিক পাপ। তাই কেউই এর দায় এড়াতে পারি না। পরিবার, প্রতিবেশী, সমাজ, রাষ্ট্র- কেউই না। সর্বোপরি রাজনীতি। সবাইকে এর কিছু না কিছু দায় নিতে হবে।

‘সামাজিক সচেতনতা ও সামাজিক প্রতিরোধের’ কথা আমরা অহরহ বলি। কিন্তু সমাজ কি মরে গেছে, নাকি পচে-গলে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে? সব কিছু টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ছে কেন? এসব অপরাধ তো কালেভদ্রে ঘটে না, ঘটছে হরহামেশা? গোপনে বা লোকচক্ষুর অন্তরালে ঘটছে না, প্রকাশ্য দিবালোকে এসব হচ্ছে। তাহলে প্রতিরোধের দৃষ্টান্ত চোখে পড়ে না কেন?

কয়েক দশক আগেও সমাজে ছোটখাটো অপরাধ, ঝগড়া-বিবাদ বা কোনো অনাচার হলে স্থানীয় শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিরা সালিসে বসতেন। বিবেকবান বয়োজ্যেষ্ঠরা পারিবারিক-সামাজিক সঙ্কটগুলোর শান্তিপূর্ণ সমাধান করতেন। এখন তেমন ‘সামাজিক ন্যায়বিচার’ তো নেই, বরং যা আছে তা হলো- গোষ্ঠী, পরিবার, দলপ্রীতির রঙ্গমঞ্চ। রাজনৈতিক বিবেচনায় ক্ষমতাবানেরা পার পেয়ে যান। মানে, প্রশ্রয় পান। বিচারের নামে হয় অবিচার। শক্তিহীনকে অমানবিক শাস্তি দেয়া হচ্ছে। সালিসের নামে দুর্বলের ওপর নেমে আসে অনাকাক্সিক্ষত শাস্তির খড়গ। সবই হয় ‘ক্ষমতার’ সমীকরণে। অন্য দিকে, প্রকাশ্যে পাশবিক অপরাধ করা হলেও কেউ এগিয়ে আসেন না প্রতিরোধ করতে। নিজে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে কেউ এগিয়ে আসেন না। কেউ বা ভয় পান আইনি ঝামেলা। দু-একজন সাহস করে এগিয়ে এলেও তাদের খেসারত দিতে হয়।

এ কথাও ঠিক, সমস্যার মধ্যেই সমাধান আছে। যখন প্রতিবাদে কাজ হয় না, তখন প্রতিরোধ করতে হয়। আজ আমাদের দৃষ্টান্ত চাই প্রতিবাদের, জাগরণ চাই সাহসী মানবিকতার। দেশে সমাজ ও জনতা বলে কিছু যদি থেকে থাকে, তাহলে জেগে উঠতেই হবে। অপরাধীরা অপরাধ করার আগে যাতে ভয় পায় পুলিশকে। পুলিশ যেন ভয় পায় জনতার কাছে জবাবদিহিকে। জনতাকে যাতে ভয় পান প্রশাসক ও শাসকেরা। তাই গণতন্ত্র যেমন লাগবে, তেমনি দরকার আইনের গণপাহারা। কিন্তু যখন জনতার মধ্যে ভীতি ও সুবিধাবাদ, পুলিশ-শাসক-প্রশাসকের মধ্যে জবাবদিহির অভাব খুব বেশি দেখা যায়, তখন সমাজে অপরাধীরা ভয় পায় না, পুলিশ যেমন উচিত তেমন করে নড়ে না। তখন ক্ষমতাসীনেরা নীতিকথা দিয়ে ছেলে ভোলানো ছড়া শুনিয়ে কোটি কোটি মানুষকে ভুলিয়ে রাখেন। তখন যা হওয়ার কথা, তা-ই হলো এবার বরগুনার রিফাত হত্যাকাণ্ডে। আমরা কোন অবস্থায় বেঁচে আছি, তা যেন দেখিয়ে দিয়ে গেল মর্মান্তিক এ ঘটনা। আমাদের জানা দরকার, প্রথম হত্যাটি হয় অবিচারের মাধ্যমে। তখন তৈরি হয় খুনের পরিবেশ। দ্বিতীয় হত্যাকাণ্ড ঘটে জনতার দর্শক হয়ে যাওয়ায়। তৃতীয় যে হাতটি হত্যা ঘটায় সেটি খুনির। রিফাত হত্যার দৃশ্যে এ তিন পক্ষই যার যার ভূমিকায় অবতীর্ণ। নুসরাত হত্যায়ও কিন্তু জড়িত ছিল বহুপক্ষ। আর বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডেও একই কার্যকারণ নিহিত। আমরা বড়জোর, খুনের প্রত্যক্ষ হাতটার বিচার চাই। তবে প্রথম দুই হাতকে দায়মুক্তি দিলে অস্বাভাবিক মৃত্যুর তালিকায় যে কারো নাম উঠতে পারে। তা বন্ধ হবে না।

রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এই দম বন্ধ করা পরিস্থিতি উত্তরণের একমাত্র পথ- দেশে নিরপেক্ষভাবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে বিচারহীনতার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসার আশু উদ্যোগ নেয়া। 
camirhamza@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement
তীব্র তাপপ্রবাহে বাড়ছে ডায়রিয়া হিটস্ট্রোক মাছ-ডাল-ভাতের অভাব নেই, মানুষের চাহিদা এখন মাংস : প্রধানমন্ত্রী মৌসুমের শুরুতেই আলু নিয়ে হুলস্থূল মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে মূল্যস্ফীতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না এত শক্তি প্রয়োগের বিষয়টি বুঝতে পারেনি ইসরাইল রাখাইনে তুমুল যুদ্ধ : মর্টার শেলে প্রকম্পিত সীমান্ত বিএনপির কৌশল বুঝতে চায় ব্রিটেন ভারতের ১৮তম লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফার ভোট আজ নিষেধাজ্ঞার কারণে মিয়ানমারের সাথে সম্পৃক্ততায় ঝুঁকি রয়েছে : সেনাপ্রধান নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে বিএনপি : কাদের রৌমারীতে বড়াইবাড়ী সীমান্তযুদ্ধ দিবস পালিত

সকল