১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

চাঁদ দেখা গেছে, চাঁদ দেখা যায়নি

- ফাইল ছবি

সমাজ ও রাষ্ট্রে সব কিছু নিয়মমাফিক ও স্বাভাবিকভাবে পরিচালিত হওয়ার কথা। কিন্তু এই সময়ে এ দেশে কোনো কিছু আইনকানুন, রীতি-রেওয়াজ, বিশেষত শরিয়াহ অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হওয়ার যেন সুযোগ নেই। বলা চলে, আইনের শাসন নেই। সমাজে ন্যায়ানুগতা নেই। ধর্মের বিধান মেনে চলার সুযোগ কম। সবই কর্তার ইচ্ছায় কীর্তন। তুঘলকি কাণ্ড ঘটে গেল এবার ঈদ উদযাপন নিয়ে। কোনো পর্যায়ে জবাবদিহিতা দেখা যায় না। সুতরাং যারা এই কাণ্ডকারখানার জন্য দায়ী, তাদেরও জবাবদিহি করতে হয়নি। কোনো সভ্য দেশ হলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের পদত্যাগ করতে হতো। তাহলে কে নেবে এই ব্যর্থতার দায়? তা নিয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সরব হলেও সরকারের তাতে যেন যায়-আসে না। তার কারণ তারা মূলত জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে না। গণতন্ত্রের অনুসরণের দায় তাদের ওপর বর্তায় না। দেশ চলছে ‘খামখেয়ালি’ স্টাইলে। জনশ্রুতি আছে, সর্বোচ্চ কর্তৃত্বের টেলিফোনের পর বদলে যায় ‘জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটি’র সিদ্ধান্ত। এ দিকে, বিপাকে পড়ে যান কোটি মানুষ।

বিভ্রান্তির কারণে একই দেশে এক দিনের পরিবর্তে তিন দিন ঈদ উদযাপিত হচ্ছে। সরকারি ঘোষণা মোতাবেক, বুধবার সারা দেশে ঈদ উদযাপন করেছেন সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। এ দেশে সরকার ব্যতীত অন্য কোনো সামাজিক বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ক্ষমতাবান না থাকায় যেকোনো আদেশ, নিষেধ ও অনুষ্ঠান সরকারের মর্জিমাফিক হয়ে থাকে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে একে বলা হয় ‘প্যাট্রন-ক্লায়ান্ট রিলেশন’। এখানে ধর্মীয় নেতারা নির্ভর করেন সরকারের আজ্ঞা-অনুজ্ঞার ওপর। সরকারি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রযতেœ যে চাঁদ দেখা কমিটি রয়েছে, তার প্রতিনিধিত্ব নিয়ে প্রশ্ন আছে। অভিযোগ, সরকারি প্রজ্ঞাপনে স্বাক্ষর দেয়ার প্রয়োজনে কিছু আলেমকে রাখা হয়।

যা হোক, চাঁদ দেখা নিয়ে এই বিভ্রান্তি নতুন নয়। শরিয়াহর দৃষ্টিভঙ্গি যদি সরকারের বিপক্ষে যায়, তাহলে মেরুদণ্ডহীন ব্যক্তিদের করার কিছুই থাকে না। অতি সাম্প্রতিক একটি ঘটনা থেকে উদাহরণ দেয়া যাক। একনিষ্ঠ আলেম-ওলামাদের অনেক আচরণ ও ব্যবহারকে যখন ‘জঙ্গিবাদের নমুনা’ বলে প্রচার করা হয়, তখন আলোচিত একজন আলেম সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি এর কোনো প্রতিবাদ করেননি অথবা করতে পারেননি। পরে তিনি তার সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেছেন। এ দিকে, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম নিয়ে দ্বীনদার মুসলমানদের প্রতিক্রিয়া রয়েছে। জনগণ মনে করে, এখন অন্য অনেক প্রতিষ্ঠানের মতো এটিও সরকারের খেদমতের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এর প্রচারণা ও প্রকাশনা দেখলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে। মসজিদে প্রবেশ করলে এর নমুনা মিলবে।

মুনাজাতে অপ্রাসঙ্গিক কথার অভিযোগও রয়েছে। ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠা নিয়ে অনেকে অতিরিক্ত ব্যক্তিবন্দনা করেন। মূলত এটি ছিল মরহুম আল্লামা আবুল হাশিম প্রতিষ্ঠিত ‘ইসলামি একাডেমীর’ সরকারি রূপান্তর। আরব দেশগুলোতে সাদ্দাম হোসেনের মতো একনায়ক অথবা সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণাপুষ্ট শাসকেরা জনসাধারণের ধর্মীয় আবেগকে ব্যবহার করার জন্য ‘রাষ্ট্রধর্ম’ প্রবর্তনের মাধ্যমে অন্য সব কিছুর সাথে ইসলামকেও ‘জাতীয়করণ’ করেছিলেন। যা হোক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন অনুরূপভাবে ধর্মীয় বিষয়াবলি এমনকি জুমার খুতবা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করার কথাও শোনা যায়। জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটি যদি ফাউন্ডেশনের প্রযতেœ হয়ে থাকে, তাহলে তারা এর মূল দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারেন না। চাঁদ দেখার বিষয়টি তাৎক্ষণিক। কিন্তু এর পূর্বাপর দায়দায়িত্ব এবং পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহের কর্তব্যের বেলায় ব্যর্থতা রয়েছে। সামাজিক গণমাধ্যমে লোকজন দ্বিধাহীনভাবে মনের কথা প্রকাশ করেন। তারা লিখেছেন, ফাউন্ডেশনের বিতর্কিত প্রধানকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। তবে এর সত্যতা যাচাই করার সুযোগ ঘটেনি। অনেকের মতে, দায়িত্বজ্ঞান থাকলে সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলার দায়ে তার পদত্যাগ করা উচিত।

এখন ঘটনার বিবরণে আসা যাক। আগেই বলা হয়েছে, এবার দেশে তিন দিন ঈদ হয়েছে। ঈদের আগের দিন ও পরের দিনও দেশের বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত হয়েছে ঈদ জামাত। একদল লোক ‘সৌদি আরবের সাথে সঙ্গতি রেখে’ সাধারণভাবে পালিত ঈদের আগের দিন ঈদ পালন করে থাকেন। আর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় চাঁদ দেখা কমিটি জানিয়েছিল, দেশের কোথাও চাঁদ দেখা যায়নি। তাই বুধবার নয়, বৃহস্পতিবার ঈদ উদযাপন করা হবে। পূর্বনির্ধারিত তারিখ অনুযায়ী এবং সরকারি ক্যালেন্ডার মোতাবেক ঈদ হওয়ার কথা বুধবার। সেভাবেই সরকারি ছুটি ঘোষিত হয়েছে এবং গণমাধ্যমে তা প্রচার করা হয়। অবশ্য নতুন ঘোষণায় বেশির ভাগ লোক আশাহত হয়েছেন। তা সত্ত্বেও যেহেতু ঈদ চাঁদ দেখার ওপর নির্ভরশীল, দেশের মানুষ তা মেনে নেয়।

তারা তারাবি নামাজ পড়ে বুধবার রোজা রাখার প্রস্তুতি নেন। এর প্রায় তিন ঘণ্টা পর রাত সোয়া ১১টায় চাঁদ দেখা কমিটির পক্ষ থেকে ধর্মপ্রতিমন্ত্রী নতুন করে ঘোষণা দেন- ‘শাওয়ালের চাঁদ দেখা গেছে, বুধবারই ঈদ হবে।’ তাহলে ততক্ষণ চাঁদ লুকিয়ে ছিল কোথায়? জানানো হয়েছে, মঙ্গলবার রাত ১০টার পর কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী ও ভুরুঙ্গামারী উপজেলা এবং লালমনিরহাটে পাটগ্রাম উপজেলার শতাধিক ব্যক্তি চাঁদ দেখেছেন। সেটি সঠিক কি না তা যাচাইয়ের জন্য কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসকের সাথে যোগাযোগ করা হয়। এরপর কমিটির সদস্যরা আবার বৈঠক করে সিদ্ধান্ত বদল করেছেন। এই ঘোষণা আগের ঘোষণার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। প্রজ্ঞাপনে সব জেলা প্রশাসকের সাথে যোগাযোগের যে কথা বলা হয়েছে, তা সত্যি হলে কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসকের সাথে যোগাযোগ না হওয়ার কথা নয়। তাহলে কি যোগাযোগের ক্ষেত্রে কোনো ত্রুটি ছিল?

প্রথম ঘোষণাটি দেয়ার সময় যথেষ্ট হোমওয়ার্ক করা হয়নি বলে মনে করা যায়। এ রকম দায়সারা গোছের তথ্য সংগ্রহের পর তাৎক্ষণিকভাবে ঘোষণাটি দেয়া বড় ধরনের ত্রুটি। তদুপরি, দ্বিতীয় ঘোষণায় জনমনে বিভ্রান্তি ও অনৈক্য সৃষ্টি করেছে। নানা কারণে সরকার সামগ্রিকভাবে বিশ^াসযোগ্যতা হারিয়েছে, সেহেতু সরকারের পরিবর্তিত সিদ্ধান্ত কোনো কোনো এলাকার মানুষ গ্রহণ করেনি বলে জানা যায়। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, বরিশালের গৌরনদী উপজেলার ২০টি এবং দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার পাঁচটি গ্রামসহ কয়েকটি উপজেলার মানুষ বৃহস্পতিবার ঈদ উদযাপন করেছেন। তারা সরকারি ঘোষণার চেয়ে ‘শরিয়াহ মোতাবেক চাঁদ দেখার’ ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন বেশি। অনেক মানুষের ধারণা- হয়তো প্রথম ঘোষণাটি সঠিক ছিল। সর্বোচ্চ কর্তৃত্বের নির্দেশেই দেশ চলে। এখন চোর ধরতেও যেন তার অনুমতি লাগে। লক্ষ করা যায়, সরকারি ঘোষণা এবং মন্ত্রীদের বক্তৃতায় উল্লেখ থাকে যে, তার নির্দেশে এটা করা হয়েছে। ওই সময় যেহেতু তিনি দেশে ছিলেন না। বরং সাত খুনের আসামি ধরতেও উচ্চ আদালতের নির্দেশ পেতে হয়েছে। পরে তিনি আদালতের নির্দেশ নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন।

চাঁদ দেখার ক্ষেত্রেও কারো একক সিদ্ধান্ত কাজ করেছে কি না, তা সন্দেহযুক্ত। তবে এ বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণে যে সতর্কতা থাকা প্রয়োজন, চাঁদ দেখা কমিটি এর প্রতিফলন ঘটাতে পারেনি। চাঁদ দেখা গেছে, চাঁদ দেখা যায়নিÑ এ ধরনের পারস্পরিক বিপরীত ঘোষণায় প্রশাসনের ব্যর্থতা প্রমাণিত হয়েছে। ব্যর্থতার দায় সুস্পষ্টরূপে নিরূপণ হওয়া দরকার। শরিয়াহ এবং জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনে এ সিদ্ধান্ত নেয়া জরুরি। অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দায়িত্ব এড়ানো যায় না। জানা গেছে, সমাধান হিসেবে আধুনিক প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে চাঁদ দেখার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। চাঁদ দেখা একটি স্বাভাবিক-প্রক্রিয়া। অস্বাভাবিক উপায়ে চাঁদ দেখার চেষ্টা গ্রহণযোগ্য হবে না। চাঁদ দেখা কমিটিতে আবহাওয়া অধিদফতর ও স্পার্সোর সদস্যরা রয়েছেন।

আর কী প্রযুক্তি ব্যবহার করতে চান তারা? ঈদের চাঁদ দেখার বিষয়টি আনন্দদায়ক। এ নিয়ে বিতর্ক ও বিভ্রাট দুর্ভাগ্যজনক। একটি সিদ্ধান্তই সংসারকে সাময়িকভাবে বিপাকে ফেলতে পারে, চাঁদ দেখা না দেখার ঘটনাটি তার প্রমাণ। সরকারের তরফ থেকে এই বিপাক ও বিভ্রান্তির জন্য দুঃখ প্রকাশ করা হয়নি। বিলম্বিত সিদ্ধান্তের সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দেয়নি সরকার। বরং ধর্ম প্রতিমন্ত্রী বলেছেন- ‘কিছু লোকের খুঁতখুঁতানি আছে, তারাই পবিত্র কুরআন-হাদিসের নির্দেশনা না জেনে নানা ধরনের মন্তব্য করছেন।’ সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে- সরকার বা ইসলামিক ফাউন্ডেশন কি শরিয়াহকে ব্যাখ্যা করার একক কর্তৃত্ব নিয়েছে?

মনে রাখতে হবে, ঈদ উৎসব মিল্লাতে ইসলামিয়ার সবচেয়ে বড় উৎসব। এ নিয়ে ছেলেখেলা বা তুঘলকি কাণ্ড গ্রহণযোগ্য নয়। বিষয়টি স্পর্শকাতর ও আবেগময়। এ ঘটনা চাঁদ দেখা কমিটির পুনর্গঠনকে অপরিহার্য করে তুলেছে। আর ব্যর্থতার দায়দায়িত্ব নীতিগতভাবে সরকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের। এসব ক্ষেত্রে পদত্যাগ একটি স্বাভাবিক বিষয়। উন্নত গণতন্ত্রে সামান্য ব্যর্থতায়ও মন্ত্রীরা পদত্যাগ করেন। কিন্তু আমাদের দেশে রাজনীতিকেরা ক্ষমতার মোহ ত্যাগ করতে পারেন না। ‘তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার সোনার হরিণ চাই।’ ন্যায়-সত্য ও বিবেকনির্ভর রাজনৈতিক সংস্কৃতি এ দেশে আর কবে চালু হবে?

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement