২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

রাষ্ট্রীয় অর্থে বিত্তবান ও বিশিষ্টজনদের জন্য ইফতার

-

‘ইফতার’ শব্দটি আরবি ‘ফুতুর’ শব্দ থেকে এসেছে। ‘ফুতুর’ অর্থ নাশতা। ‘ইফতার’ অর্থ খোলা, উন্মুক্ত করা, ছেড়ে দেয়া ইত্যাদি। ইসলামি পরিভাষায় সূর্যাস্তের পর খেজুর, পানি বা অন্য কোনো খাদ্যদ্রব্য ভক্ষণের মাধ্যমে রোজা ছেড়ে দেয়াকে ইফতার বলা হয়। রোজার অপরিহার্য একটি অংশ ইফতার। এটা সাহরি খাওয়ার মতোই ইবাদত এবং রাসূল সা:-এর সুন্নত। ইফতারির সময় হওয়ার আগে থেকে ইফতার সামগ্রী নিয়ে বসে থাকা ইবাদত। কিন্তু ইফতারের সময় হওয়া মাত্রই কোনোরূপ বিলম্ব না করে ইফতার করে নিতে হবে। একজন রোজাদার ইফতারের সময় দিনের সব ক্লান্তি ভুলে সওয়াবের উদ্দেশ্যে খুশিমনে ইফতার করে থাকেন। ইফতারের আরেকটি বড় ফজিলত হচ্ছে, এ সময় রোজাদারের দোয়া আল্লাহ তায়ালার দরবারে কবুল হয়। তখন একজন রোজাদার খালেস নিয়তে আল্লাহর কাছে যা চাইবেন তা-ই আল্লাহর দরবারে কবুল হবে। রোজার ইফতার আল্লাহর বান্দার জন্য সে সুযোগ করে দিয়েছে।

বিশ্বব্যাপী ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা প্রতি বছর রমজান মাসব্যাপী রোজা পালন করে থাকেন। একজন মুসলমান রোজা পালনরত অবস্থায় পানাহার ও বৈধ জৈবিক কাজ থেকে বিরত থাকেন। রোজা রাখার উদ্দেশ্যে একজন মুসলমান সুবহে সাদিকের আগে আহার গ্রহণ করেন এবং সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর ইফতারের মাধ্যমেই পুনঃআহার গ্রহণ করেন। রোজাদার ব্যক্তিকে ইফতার করানো সওয়াবের কাজ। এ বিষয়ে হাদিসে আছে, একজন রোজাদার ব্যক্তিকে ইফতার করালে রোজাদার ব্যক্তির সমপরিমাণ সওয়াব যে ব্যক্তি ইফতার করান, তিনি প্রাপ্ত হন; তবে এতে যে ব্যক্তিকে ইফতার করানো হয় তার সওয়াবে কোনো কমতি হয় না। ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী, এরূপ ইফতারের ব্যবস্থা একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত অর্থের মাধ্যমে নির্বাহ করতে হয়।

ইসলাম ধর্মের কেন্দ্রভূমি সৌদি আরবের পবিত্র মক্কা ও মদিনা নগরীতে রমজান মাসে ওমরাহ ও হজ পালনের উদ্দেশ্যে গেলে দেখা যায়, সেখানকার বিত্তবান ব্যক্তিরা সওয়াব হাসিলের জন্য নিজ উদ্যোগে রোজাদারদের ইফতার করানোর জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকেন এবং এসব ব্যক্তি ইফতারের সময় একজন রোজাদারকে যে পরিমাণ খাদ্য ও পানীয় প্রদান করেন, তা তার চাহিদার অতিরিক্ত হয়ে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য মুসলিম দেশেও এ প্রথাটি চালু রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের সব মুসলিম দেশের মসজিদে রোজার মাসে রোজাদারদের জন্য মসজিদ কমিটির ব্যবস্থাপনায় ইফতারের আয়োজন করা হয়।

মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন মুসলিম দেশের মসজিদে ব্যক্তি উদ্যোগে ইফতারের আয়োজনে অর্থের সঙ্কট দেখা দিলে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে অনুদান দেয়ার ব্যবস্থা আছে। এরূপ ক্ষেত্রে আগে থেকেই রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সাথে মসজিদ কমিটির কর্মকর্তাদের যোগাযোগ করতে হয়। মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিটি দেশে দেখা গেছে, বিত্তবানদের অর্থায়নের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের জন্য ইফতারের আয়োজন এবং এরূপ আয়োজনে প্রায়ই রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোনোরূপ সহায়তা প্রদানের আবশ্যকতা দেখা দেয় না। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন মুসলিম দেশের বিত্তবানেরা তাদের নিজ অর্থে সব শ্রেণী-পেশার মানুষের জন্য ইফতারের আয়োজন করার কারণে রাষ্ট্র কর্তৃক রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যয়ে বিত্তবানদের জন্য আলাদাভাবে ইফতার আয়োজনের আবশ্যকতা দেখা দেয় না।

রমজান মাসে আমাদের দেশের বিভিন্ন মসজিদে সংশ্লিষ্ট মসজিদ কমিটির ব্যবস্থাপনায় ক্ষুদ্র পরিসরে ইফতারের আয়োজনের ব্যবস্থা থাকলেও তাতে রাষ্ট্রীয় অর্থের কোনো সংশ্লেষ নেই। তবে আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয় অর্থে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং বিভিন্ন বিভাগ ও দফতর কর্তৃক বিত্তবান ও বিশিষ্টজনদের জন্য ইফতারের আয়োজন করা হয়। এসব বিত্তবান ও বিশিষ্টজনদের দেখা যায়, সম্পূর্ণ রোজার মাসেই রাষ্ট্রীয় অর্থে আয়োজিত কোনো-না-কোনো ইফতার পার্টিতে উপস্থিত থেকে ইফতারের কাজ সমাধা করছেন। এসব ইফতার পার্টিতে উপস্থিত বিত্তবান ও বিশিষ্টজনদের অনেকেরই ব্যক্তি উদ্যোগে ইফতারের আয়োজন করে দেশের দরিদ্র জনমানুষের জন্য ইফতারের সংস্থানের সামর্থ্য থাকলেও তারা তা না করে রাষ্ট্রীয় অর্থে আয়োজিত ইফতার অনুষ্ঠানে নিজেদের উপস্থিতিকেই বড় করে দেখেন।

বিভিন্ন মুসলিম দেশে আমাদের দেশের মতো, রোজার মাস ব্যতিরেকে বছরের অবশিষ্ট সময় সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের কার্যালয়ে নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী কার্য সম্পন্ন হয়। সচরাচর এ সময়সূচি সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা অথবা সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৬টা অবধি হয়ে থাকে। কিন্তু রোজার মাসে মানুষ যাতে তাদের পরিবারের সাথে নিজ আবাসস্থলে গিয়ে ইফতার করতে পারেন, বিষয়টি বিবেচনায় সরকারি ও বেসরকারি উভয় ধরনের কার্যালয়ের সময়সূচির পরিবর্তন করে তা সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা ৩০ মিনিট অথবা সকাল ৯টা ৩০ মিনিট থেকে বিকেল ৪টা অবধি করা হয়।

আমাদের ঢাকা শহরের মতো মুসলিম দেশের অন্য কোনো রাজধানী শহরে সাধারণত তীব্র যানজট নেই। রোজার মাসে ইফতারের পূর্বক্ষণে কর্মপেশায় নিয়োজিত মানুষ নিজ ঘরে ফেরার জন্য উন্মুখ থাকায়, এ সময় যানজটের মাত্রা তীব্রতর হয়। আমাদের দেশে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী এ দু’জন পদধারীকে ‘ভিভিআইপি’রূপে গণ্য করা হয়। সরকারের অপর সব মন্ত্রী এবং সামরিক-বেসামরিক কর্মে নিয়োজিত যুগ্মসচিব ও তদূর্ধ্ব পদমর্যাদার কর্মকর্তারা ‘ভিআইপি’ হিসেবে গণ্য। আমাদের ভিভিআইপি পদধারীরা যখন সড়কপথে শহরের এক স্থান থেকে অপর স্থানে যাতায়াত করেন, তখন তাদের যাতায়াত নির্বিঘœ করার জন্য অপরাপর সবার যাতায়াতের পথ রোধ করা হয়। ভিআইপিদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন, যারা চলাচলের সময় তাদের যানের সামনে-পেছনে অথবা শুধু সামনে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যসংবলিত বিশেষ নিরাপত্তা যানের সুবিধা ভোগ করে থাকেন। এ ভিআইপিরা চলাচলের সময় আশপাশের যানবাহনের চলাচলের গতি শ্লথ বা নিয়ন্ত্রণ করে ভিআইপিদের চলাচল নির্বিঘœ করার পদক্ষেপ নেয়া হয়।

প্রতি বছর রমজান মাসে রাষ্ট্রপতির কার্যালয় বঙ্গভবন এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় গণভবনে তাদের উদ্যোগে একাধিক ইফতার অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। উভয় কার্যালয়ে ভিভিআইপি এবং ভিআইপিদের আগমন ও প্রস্থান নির্বিঘœ করার জন্য ক্ষেত্রবিশেষে সাধারণের চলাচলে পথরোধ এবং ক্ষেত্রবিশেষে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয়। যেদিন এভাবে জনসাধারণের চলাচলে পথরোধ এবং যান চলাচলে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, সেদিন দেখা যায়Ñ অপরাপর সড়কে যানজট এত বেশি তীব্র হয় যে, নির্ধারিত সময়ে ঘরমুখো মানুষের পরিবারের সদস্যদের সাথে ইফতার করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তা ছাড়া, বিভিন্ন বিভাগ কর্তৃক আয়োজিত ইফতারের অনুষ্ঠানে ভিভিআইপিদের উপস্থিত হতে দেখা যায়। যেসব ইফতার অনুষ্ঠানে ভিভিআইপিরা উপস্থিত হন, তার চার পাশের সড়কে যান চলাচলে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। এর ফলে এসব সড়কে সাধারণ মানুষের চলাচলে বিঘœ ঘটায় তাদের পক্ষে যথাসময়ে ঘরে পৌঁছে ইফতার করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।

ইসলাম ধর্মে সব রোজাদারের জন্য যথাসময়ে ইফতার করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এ বিষয়ে রাসূল সা: বলেন, ‘লোকেরা ততক্ষণ কল্যাণে থাকবে যতক্ষণ তারা ইফতার জলদি করবে।’ রাসূল সা: অপর এক হাদিসে বলেন, ‘আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নিকট সবচেয়ে প্রিয় সে বান্দা, যে ইফতার সঠিক সময়ে করে।’

রাসূল সা:-এর জীবদ্দশায় তিনি ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে মক্কা বা মদিনায় অবস্থানকালে এবং তাঁর মৃত্যুপরবর্তী খলিফাদের শাসনামলে কখনো রাষ্ট্রের কোষাগারে রক্ষিত অর্থ দ্বারা তাদের নিজেদের ও বিশিষ্টজনের জন্য ইফতারের আয়োজন করা হয়েছে, এমন নজির পাওয়া যায় না।

ড. এ পি জে আবদুল কালাম ভারতের রাষ্ট্রপতি পদে যোগদানের পর রমজান মাস সমাগত হলে তার সচিব পি এম নায়ার তাকে বলেন, রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ইফতার অনুষ্ঠানের আয়োজন একটি রেওয়াজ এবং অতীতে অপর সব রাষ্ট্রপতি এ রেওয়াজটি মেনে চলেছেন। রাষ্ট্রপতির সচিব সে রেওয়াজ অনুযায়ী ইফতার আয়োজনের উদ্যোগ নেয়ার পর রাষ্ট্রপতি তার কাছে জানতে চান, এ অনুষ্ঠানের জন্য ব্যয় বরাদ্দ কত? সচিব রাষ্ট্রপতিকে জানান, বরাদ্দ প্রায় ২২ লাখ রুপি। এত বিশাল বরাদ্দের বিষয়ে অবহিত হওয়ার পর রাষ্ট্রপতি তাকে বলেন, যারা এ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে আসবেন তারা তো সব সময় ভালো খাবার খেয়ে অভ্যস্ত।

সুতরাং ইফতার আয়োজনের জন্য যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ আছে সে অর্থ দিয়ে এতিমখানায় এতিমদের জন্য খাদ্য, পোশাক ও কম্বল কিনে তা যেন পৌঁছে দেয়া হয়। রাষ্ট্রপতির নির্দেশনামোতাবেক এতিমখানার তালিকা করে সামগ্রীগুলো পৌঁছে দেয়ার আয়োজন করা হলে রাষ্ট্রপতি তার সচিবকে ডেকে ব্যক্তিগতভাবে এক লাখ রুপির একটি চেক প্রদান করে তাকে বলেন, তার এ ব্যক্তিগত দানের বিষয়টি যেন গোপন রাখা হয়। সচিব এর উত্তরে বলেন, বিষয়টি গোপন রাখা তার পক্ষে সম্ভব নয়, কারণ মানুষজনের জানা উচিত ভারতের রাষ্ট্রপতি পদে একজন মহৎ হৃদয়বান ব্যক্তির আগমন ঘটেছে। আবদুল কালাম ভারতের রাষ্ট্রপতি পদে আসীন থাকাকালে কখনো রাষ্ট্রের অর্থ ব্যয়ে বিত্তবান ও বিশিষ্টজনদের জন্য ইফতারের আয়োজন করা হয়নি।

রাষ্ট্রের অর্থের মালিক দেশের জনগণ। দেশের জনগণের প্রদত্ত কর রাষ্ট্রীয় তহবিলে জমা হয়। রাষ্ট্রীয় তহবিলের যেকোনো অর্থ ব্যয় আইন ও নীতিনৈতিকতা দ্বারা সমর্থিত হওয়া অত্যাবশ্যক। দেশের সাধারণ জনমানুষসহ দরিদ্র ও নিপীড়িতদের বঞ্চিত করে আমাদের দেশে যেভাবে রাষ্ট্রীয় অর্থ দ্বারা বিত্তবান ও বিশিষ্টজনদের জন্য ইফতারের আয়োজন করা হয় এবং এক শ্রেণীর বিত্তবান ও বিশিষ্টজনদের প্রতিটি ইফতার পার্টিতে উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয় তা আইন, নীতিনৈতিকতা ছাড়াও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণযোগ্য নয় বলে মনে করা যায়।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক

E-mail: iktederahmed@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement
নারায়ণগঞ্জ জেলার শ্রেষ্ঠ ওসি আহসান উল্লাহ ‘ট্রি অব পিস’ পুরস্কার বিষয়ে ইউনূস সেন্টারের বিবৃতি আনোয়ারায় বর্তমান স্বামীর হাতে সাবেক স্বামী খুন, গ্রেফতার ৩ ফতুল্লা প্রেস ক্লাবের ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত বদরের শিক্ষায় ন্যায়-ইনসাফের সমাজ প্রতিষ্ঠায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে : সেলিম উদ্দিন ইসলামের বিজয়ই বদরের মূল চেতনা : ছাত্রশিবির পরিবেশ দূষণে বাংলাদেশে বছরে ২ লাখ ৭২ হাজার মানুষের মৃত্যু : বিশ্বব্যাংক নোয়াখালীতে ল’ইয়ার্স কাউন্সিলের ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত ‘আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ল’ ইয়ার্স কাউন্সিল কাজ করে যাচ্ছে’ পুকুরে পাওয়া গেল ১০০ ইলিশ অবন্তিকার আত্মহত্যা : জবির সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের জামিন আবারো নামঞ্জুর

সকল