২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

‘চাষা’ অপবাদ ঘোচাতে কর্মসূচি!

‘চাষা’ অপবাদ ঘোচাতে কর্মসূচি! - ছবি : সংগ্রহ

মানবসভ্যতার সূচনা পর্ব কৃষি। চাষাবাদ আর কাপড় বুননই সভ্যতার প্রারম্ভ। তবু চাষবাস যারা করেন; শহুরে সভ্যরা তাদের পাত্তা দিতে নারাজ। পাশে জায়গা দেয়া তো দূরের কথা, ভদ্রলোকেরা রেগে গেলে ‘চাষা’ বলে গালি দেন। সেই ‘চাষা’দের তাড়িয়ে ‘চাষা’ অপবাদ ঘোচানোর মাহেন্দ্রক্ষণ আসতে বুঝি আর দেরি নেই। আমাদের ললাটের এ কলঙ্ক তিলক চিরতরে মোচনের সুদিন এলো বলে! ফলে হৃদয়ে বইছে তীব্র এক সুখানুভূতি। সেই সম্ভাবনার ঝিলিকে সবাই পুলকিত। এমন আলামত দেশের অর্থনীতির দিগন্তরেখায় স্পষ্ট। খুশির এ বারতায় সবাই আচ্ছন্ন। নিকট অতীতে আমরা সম্পূর্ণ কৃষিনির্ভর হলেও এখন অবস্থা পাল্টে গেছে। অনেকেই শহরের বাসিন্দা। তাই বিবর্ণ অতীতের জন্য জ্বলছি অন্তর্জ্বালায়। ‘চাষা’ উপাধি সাফসুতরো করতে সবাই একাট্টা।

সাবেক পূর্ব বাংলায় গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মাঠে ফসল ফলানো ছাড়া আর কী-ই বা করার ছিল? বিদ্যের জোর না থাকায় পূর্বপুরুষেরা করতেন কৃষিকাজ। এই সেদিন পূর্ব বাংলায় ১৯২১ সালে প্রথম উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। শিক্ষাহীন কৃষকের জীবন ছিল বর্ণহীন নিষ্প্রাণ; বৈচিত্র্যহীন ধূসর। ছিল গ্রাম্যতায় ভরা। সভ্য সমাজ থেকে অনেক দূরে। সে অবস্থা থেকে দেশ এগিয়েছে অনেক দূর। আমরা আর বিদ্যাহীন মূর্খ নই। গড়ে তুলেছি হালকা, মাঝারি আর ভারী শিল্প। সাথে সাথে বিতাড়িত করছি কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি। এতে করে দেশের অর্থনীতি ফুলে-ফেঁপে উঠছে। কৃষির ওপর নির্ভরতা কমেছে। জাতীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির দিকে তাকালেই তা বোঝা যায়। আন্তর্জাতিক অনেক সংস্থার মতে, বাংলাদেশ দ্রুত জায়গা করে নিচ্ছে উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোর কাতারে। নিজেদের প্রয়োজনেই কৃষি অর্থনীতি থেকে বেরোনোর জোর প্রয়াস আমাদের। কৃষিমুক্ত অর্থনীতি গড়াই এক নম্বর কর্মসূচি! এ যেন ধনুর্ভঙ্গ পণ।

মুশকিল হলো, চাষাবাদ করে ফসল ফলিয়ে এখনো মানুষকে তার খাবার জোগাড় করতে হয়। খাদ্যের জন্য চাষবাসই একমাত্র ভরসা। তাই দেশে দেশে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে জোর দেয়া হয় কৃষিতে। প্রায় সব দেশই কৃষিতে ভর্তুকি দিয়ে থাকে, যাতে কৃষকের আর্থিক ভিতে আঘাত না লাগে। নড়বড়ে হয়ে না পড়ে। যতই পশ্চাৎপদ হোক না কেন, কৃষিকে একটু হলেও জায়গা করে দিচ্ছে তারা। অবশ্য, বলতে পারি- কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করে খাদ্য আমদানি করে খাবো আমরা। তবু ‘চাষা’ অপবাদ ঘোচাতে চাই! এর একটি যুৎসই কৌশলও উদ্ভাবন করেছি। তা আর কিছু নয়, উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য না দেয়া, যাতে দরিদ্র কৃষক বছরের পর বছর লোকসান দিয়ে এক সময় সামর্থ্য হারিয়ে জমিজিরাত বিক্রি করে চাষাবাদ ছেড়ে দেন। ফলে দেশ চাষিমুক্ত হয়ে ঘুচবে ‘চাষা’ অপবাদ।

কৃষকমুক্ত সমাজ গঠনপ্রক্রিয়ার শুরু স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে। এক সময় পাট ছিল কৃষকের সোনালি আঁশ। প্রধান অর্থকরী ফসল। কিন্তু পাটের দাম রাতারাতি পড়ে গেলে তা চাষিদের গলার ফাঁসে পরিণত হয়। ক্ষোভে-দুঃখে পাটে আগুন দিয়ে মনের জ্বালা মেটালেন কৃষক। তখন থেকে পাট চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন পাটচাষিরা। দেশে পাটচাষির সংখ্যা দ্রুত যায় কমে। তখন কৃষকমুক্ত সমাজ গঠনের কিঞ্চিত সম্ভাবনা দেখা দেয়। ফলে এক সময়ের বিশ্বে অন্যতম পাট উৎপাদনকারী দেশের তালিকা থেকে আমাদের মুক্তি মিলে যায়! পাটের পর নতুন উপসর্গ হয়ে দেখা দিয়েছে ধান। এখন ষোলকলা পূর্ণ হতে চলেছে।
এবার সত্যি সত্যিই পাকা ধানের ক্ষেতে মনের দুঃখে আগুন দিয়েছিলেন এক কৃষক। টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে বেশ কয়েক দিন আগে নিজের পাকা ধানে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন আবদুল মালেক সিকদার নামের এই কৃষক। বাজারে ধানের দাম অস্বাভাবিকভাবে পড়ে গেলে এবং ধানকাটা শ্রমিকের মজুরি বেড়ে যাওয়ায় দিশাহারা হয়ে এ কাজ করেন তিনি। মালেক দেখতে পাচ্ছিলেন, একজন মজুরকে তিন বেলা খাওয়ানোসহ এক হাজার টাকা দিতে হবে। কাটার পর সেই ধান প্রতি মণ বিক্রি করা যাবে মাত্র ৫০০ টাকায়। তার মানে শ্রমিকপ্রতি তার খরচ প্রায় দুই মণ ধান। এটি দেখে রাগে, ক্ষোভে পেট্রল কিনে জমির একাংশে ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেন। এটাই তো চেয়েছি আমরা! মানে, যারা ‘সভ্য’ হওয়ার কাঙাল। দাম না পেয়ে ধান চাষে নিরুৎসাহিত হয়ে বহু ‘চাষা’ পেশা পরিবর্তনে বাধ্য হবেন।

আমাদের অবস্থা সেই ভিক্ষুকের মতো, যে এক সময় ভিক্ষা করে সংসার চালালেও কালক্রমে হয়ে যায় মস্তবড় ধনী। সেই ভিক্ষুক দানের পয়সা যে খুঁতিতে রাখত, তা মাটিতে ফেলে পায়ে মাড়িয়ে বলত- হায় আমার কপাল, কেন আমি ভিক্ষার থলের স্মৃতি মন থেকে মুছে ফেলতে পারছি না? সে প্রাণপণে চেষ্টা করছে নিজের অতীত মুছে ফলতে। আমরাও চাষির ছেলেপুলে হয়ে দেশকে চাষিশূন্য করতে উঠেপড়ে লেগেছি। তাদের হাড়ভাঙা পরিশ্রমে উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য না দিয়ে পিষে মারতে মরণখেলায় মেতেছি।

নিকট অতীতে আমাদের পুরো দেশটাই ছিল একটি বৃহদায়তন গ্রাম। আমরা সবাই কৃষকের উত্তরসূরি। অবিভক্ত ভারতে তদানীন্তন পূর্ব বাংলা ছিল কলকাতাকেন্দ্রিক অর্থনীতির কাঁচামাল সরবরাহের ‘ভাঙা কুলো’। তখন আর্থসামাজিক বাস্তবতায় আমাদের কাছে কৃষকই ছিলেন নায়ক। তারাই অর্থনীতিতে প্রাণের সঞ্চার করতেন। এক সময় আমাদের সমাজেও কৃষক ছিলেন সম্মানীয়। সবাই সমীহের চোখে দেখতেন। কৃষি আর কৃষকের সেই দিন আর নেই। উজ্জ্বল রঙ ফিকে হয়ে এসেছে। কৃষক আজ সমাজের প্রান্তজন। কবি-সাহিত্যিকেরা অনেক আবেগঘন কবিতা লিখেছেন। ছোটবেলায় পড়া তেমন একটি কবিতা ‘চাষা’। রচয়িতা রাজিয়া খাতুন চৌধুরাণী। কবিতাটির চিত্রকল্পের সাথে গ্রামবাংলার যাপিত জীবনের ছিল গভীর সম্পর্ক।

কবিতাটির কয়েকটি পঙ্ক্তি এমন- ‘সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা,/ দেশ মাতারই মুক্তিকামী, দেশের সে যে আশা।/ দধীচি কি তাহার চেয়ে সাধক ছিল বড়?/ পুণ্য অত হবে নাক সব করিলে জড়।/ মুক্তিকামী মহাসাধক মুক্ত করে দেশ, / সবারই সে অন্ন জোগায় নাইক গর্ব লেশ।/ ব্রত তাহার পরের হিত, সুখ নাহি চায় নিজে, / রৌদ্র দাহে শুকায় তনু, মেঘের জলে ভিজে।/ আমার দেশের মাটির ছেলে, নমি বারংবার/ তোমায় দেখে চূর্ণ হউক সবার অহংকার।’

চিরদুঃখী কৃষকের পানে তাকানোর যেন কেউ নেই। প্রতি বছরই কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে সরকারের খাদ্য বিভাগের মাধ্যমে ধান-চাল কেনা হয়। তবে সরকারের এ ভর্তুকির অর্থ সাধারণ কৃষকের পকেটে না গিয়ে মধ্যস্বত্বভোগী, ধান-চাল ব্যবসায়ী ও মিল মালিকদের পকেটে চলে যায় বেশির ভাগ সময়। এবারো তা-ই ঘটছে। ফলে ধান ফলাতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন কৃষক। আমরা যারা অতীত মুছে নতুন আঙ্গিকে নিজেদের পরিচিত করতে আগ্রহী, তাদের জন্য এটি জব্বর খবর! যেন ‘মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি’।

বীজধান বুনে দেয়া হলো, গাছ বড় হলো, শীষ এলো, ধান পাকল; তারপর কেটে নতুন ধান গোলায় তোলা হলো। আবাদের ব্যাপারটা মোটেও এমন মসৃণ নয়। বীজতলা তৈরি করা থেকে শুরু করে ধানকাটা পর্যন্ত একজন চাষিকে কী নিবিড় পরিচর্যায় নিবিষ্ট থাকতে হয়, তা শুধু তিনিই জানেন। একজন দরিদ্র কৃষক যখন চড়া সুদে ঋণ নিয়ে সেই টাকায় ধান চাষ করেন, তখন কী পরিমাণ স্নেহ বুকে ধরে তিনি শিশু ধানগাছগুলো বড় করে তোলেন, তা অন্য কারো উপলব্ধি করা কঠিন। সেই কৃষক কত বেশি ক্ষুব্ধ হলে নিজের সৃজিত পাকা ধানক্ষেতে আগুন ধরিয়ে দিতে পারেন, তা উপলব্ধি করা আরো কঠিন। এই দৃশ্য দেখে মনে পড়ে যায়, বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা কবি ফররুখ আহমদ অনূদিত, জগদ্বিখ্যাত কবি আল্লামা ইকবালের ‘খোদার ফরমান’ কবিতাটির কয়েকটি পঙ্ক্তি। ইকবাল মর্মস্পর্শী ভাষায় লিখেছেন-

‘ওঠো, দুনিয়ার গরিব ভুখারে জাগিয়ে দাও,
ধনিকের দ্বারে ত্রাসের কাঁপন লাগিয়ে দাও।
কিষাণ, মজুর পায় না যে মাঠে শ্রমের ফল,
সে মাঠের সব শস্যে আগুন লাগিয়ে দাও।’

সত্যি সত্যিই যদি সব শস্যে আগুন লাগিয়ে দেন কৃষক; তাহলে না খেয়ে উপোস থাকতে হবে সবাইকে। যারা ভাবছেন, পাচার করা লুণ্ঠিত অর্থ বিদেশে বসে বসে খাবেন, তাদের সে আশার গুড়ে বালি। মনে রাখা প্রয়োজন, বসে
বসে খেলে রাজার গোলাও এক সময় ফুরিয়ে যায়। অতএব, সাধু সাবধান! কৃষকের ন্যায্য পাওনা পরিশোধ না করার পরিণতি হবে ভয়াবহ। জাতীয় জীবনে তা বয়ে আনতে পারে চূড়ান্ত অমঙ্গল।

camirhamza@yahoo.com

 


আরো সংবাদ



premium cement
গাজায় সাহায্য বাড়াতে ইসরাইলকে নির্দেশ আইসিজের দিল্লি হাইকোর্টে কেজরিওয়ালের বিরুদ্ধে জনস্বার্থ মামলা খারিজ বস্ত্র-পাট খাতে চীনের বিনিয়োগ চায় বাংলাদেশ জামালপুরে সাব রেজিস্ট্রারকে হত্যার হুমকি মামলায় আ’লীগ নেতা গ্রেফতার গাজায় অনাহার যুদ্ধাপরাধ হতে পারে : জাতিসঙ্ঘ ‘প্রত্যেককে কোরআনের অনুশাসন যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে’ মতলব উত্তরে পানিতে ডুবে ভাই-বোনের মৃত্যু প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের শেষ ধাপের পরীক্ষা শুক্রবার লম্বা ঈদের ছুটিতে কতজন ঢাকা ছাড়তে চান, কতজন পারবেন? সোনাহাট স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ ত্যাগ করলেন ভুটানের রাজা বছরে পৌনে ৩ লাখ মানুষের মৃত্যু দূষণে

সকল