২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির’

ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন - ফাইল ছবি

অন্যান্য পেশার লোকদের রাজনীতিকীকরণ আর যা-ই হোক গণতন্ত্রের সাথে যায় না। এই রাজনীতিকীকরণের প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই গণতন্ত্রকে দুর্বল করার বীজ বপন করা হয় এবং শেষমেশ হত্যা করা হয়।

আমাদের দেশে এই রাজনীতিকীকরণের ধারণা ঘটনাচক্রে মুক্তিযুদ্ধের গণতান্ত্রিক লক্ষ্য অর্জনকে ব্যর্থ করে দেয়। গণতন্ত্রের জন্য আমাদের সব সংগ্রাম, আমাদের সব আত্মদান অর্থহীন করে দেয়। অল্প সময়ের ব্যবধানে বিপ্লবী সরকার হিসেবে একদলীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। আমাদের দেশে জনগণের ভোটে মুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠানে অস্বীকৃতি জানানোটা কোনো লজ্জার ব্যাপার নয়।

একজন ইচ্ছা করলেই বিপ্লবী হতে পারে না। আজীবন ক্ষমতায় থাকার জন্য বৈপ্লবিক রাজনীতির আকর্ষণ অস্বীকার করা যাবে না। জনগণের অর্থে রাজা-বাদশাহর মতো ব্যয়বহুল জীবন-যাপনের লোভ হবেই-বা না কেন? বিপ্লবী সরকার গঠনে সফল হতে হলে এবং সেই বিপ্লবী সরকার চালাতে হলে বড় ধরনের চক্রান্তকারীদের একটা গ্রুপ দরকার হয়। এই ব্যবস্থায় যে ধরনের আনুগত্য দাবি করা হয় তা নিশ্চিত করার জন্য একজনের বিরুদ্ধে আরেকজনের গোয়েন্দাগিরি চালু রাখতে হয়। গোয়েন্দা ব্যবস্থাপনাকে রাষ্ট্রের ভেতরে সর্বত্র পরিব্যাপ্ত করতে হয় যাতে জীবনের কোনো দিক ক্ষমতাসীনদের নজরদারির বাইরে না থাকে। ক্ষমতাচ্যুত করতে কে কোথায় ষড়যন্ত্র করছে সেই দুশ্চিন্তায় তাকে থাকতে হচ্ছে সর্বক্ষণ। অর্থাৎ সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র সর্বত্র থাকতেই হবে।

একদলীয় সরকার এবং সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা যদি জনগণের জন্য ভালোই হতো তাহলে কেন সেখানে বাকস্বাধীনতা এবং জনগণের নির্বাচনের স্বাধীনতা বহাল থাকে না।

কথা বলাই আমাদের মানবিক বৈশিষ্ট্য। বাকস্বাধীনতাকে অস্বীকার করা হলে মানুষের পক্ষে কোনো মানবিক সমাজ গঠন সম্ভব হয় না। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনমতের কথা শোনা যায় না, সেখানে এটি একটি অজ্ঞাত ব্যাপার। গোপন শাসনের গোপনীয়তা রক্ষা করাতেই তাদের সাফল্য। দেশ জনগণের; কিন্তু জনগণ জানবে না দেশ কিভাবে চলছে।

সাম্যবাদী অর্থব্যবস্থার ভিত্তি হচ্ছে প্রকল্পভিত্তিক উন্নয়ন। তাই প্রকল্পের সফলতাই সেখানে সাফল্যের মাপকাঠি। মানবিক উন্নয়ন, যেমন ধরুন মুক্ত চিন্তা কিংবা সহজাত মানবিক মূল্যবোধ বা সুধী সমাজ নির্মাণ ইত্যাদি সেখানে বিবেচ্য বিষয় নয়।

দেশ স্বাধীন হলেই যে জনগণের মুক্তি আসে না তার অভিজ্ঞতা বাংলাদেশেই দেখছি। তাই মুক্তিযুদ্ধের মুক্তি আমাদেরই নিশ্চিত করতে হবে।

স্বাধীন বাংলাদেশে মানিক মিয়া, জহুর হোসেন চৌধুরী, সালাম সাহেবের মতো সাংবাদিকদের ঐতিহ্য রক্ষা করতে না পারা সাংবাদিকদের বড় ব্যর্থতাই বলতে হবে।

শুরু হতেই স্বাধীন বাংলাদেশে সাংবাদিকেরা কেন নিজেরা দলীয় কর্মী হতে গেলেন এর রহস্য ঐতিহাসিকদের জানতেই হবে। আমার মতে, পেশাজীবী সাংবাদিক ও আইনজীবীরা দলীয় কর্মী না হলে বাংলাদেশের ইতিহাস ভিন্নতর হতো। দেশ মুষ্টিমেয় লোকের অন্যায়-অবিচারের স্বর্গরাজ্য হতে পারত না।

কয়েক দিন আগে চাকরিচ্যুত এক ভদ্রলোক তার ক্ষুধার্ত শিশুটির জন্য দুধের প্যাকেট চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েন। সংবাদে প্রকাশ, পুলিশ ও দোকানের মালিক তার করুণ কাহিনী শুনে তার প্রতি সদয় হন। পুলিশ অফিসার নিজের টাকা দিয়ে দুধের মূল্য পরিশোধ করে দেন। পরে লোকটিকে ওই দোকানেই একটা চাকরি দেয়া হয়। বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তিলাভের জন্য অবৈধভাবে সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে আমাদের দেশের অনেক যুবককে ডুবেই মরতে হচ্ছে। অনেকেই বিদেশে মান-মর্যাদা হারিয়ে অসহায়ভাবে কাজ করছে। জাতি হিসেবে আমাদের এ অপমান ও লজ্জা থেকে বাঁচার জন্য কোনো উদ্যোগ নেই। কিন্তু কিছু লোক রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপব্যবহার করে সীমাহীন ঐশ্বর্যের অধিকারী হতে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে না। তারা থাকছে মহানন্দে। তারা আইনের ঊর্ধ্বে থেকে নিরীহ জনসাধারণের ওপর ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে চলছে।

যদি জনগণের শাসন তথা গণতন্ত্র বিকাশের সুযোগ দিতে হয় তবে একদলীয় ব্যবস্থার রাজনীতিকীকরণের কাঠামো ভেঙে দিতে হবে।
রাজনীতি এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতার পটভূমিতেই একনায়কত্ববাদের আবির্ভাব ঘটে। এই সত্য অনুধাবন করা হচ্ছে না। এর ফলে ক্ষমতালোভী আমলাদের বিজয় সূচিত হয়। সরকারের চিন্তা হচ্ছে কী করে নিজেদের স্বপ্নের রাজ্যে রাজা-বাদশাহর বিলাসিতা নিয়ে টিকে থাকা যায়। জনগণকে বঞ্চিত রেখে জনগণের বিরুদ্ধে ক্ষমতা ব্যবহার করতে প্রশাসনের প্রত্যেকেই এখন শক্তিশালী। শুধু দেশের যারা মালিক সেই জনগণ অসহায়। এর নামই জবরদখলের শাসন।

আমি ভাবতে পারি না, নিজেদের লোক কীভাবে নিজেদের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর অন্যায়, অবিচার চালাতে পারে। ভালো লাগে যখন দেখি কিছু লোকের দায়িত্ববোধ রয়েছে। তারা শালীনতাবোধ এখনো হারাননি। এ জন্যই আমি আশাবাদী, একটি স্বাধীন জাতির মর্যাদা ও গৌরব নিয়ে সবাই মিলে নিরাপদে বাঁচার গুণাবলি আমাদের আছে।

সমাজতান্ত্রিক একনায়কত্ববাদী জীবনের সাথে কারাজীবনের তুলনা করা চলে। কারাবন্দীদের কল্যাণ চিন্তাটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়; কিন্তু বিনা প্রতিবাদে শৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্ব বহন করে। তাদের জীবন ধারণের অবশ্যই সুযোগ দেয়া হবে; কিন্তু তাদের কোথায় ব্যথা সেটি প্রকাশ করতে দেয়া হবে না। জানার প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করা হবে না। কারণ, জেলবন্দীরা অসহায়।

আমার কাছে তাই বাকস্বাধীনতাই স্বাধীনতা এবং জনমত হচ্ছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বৈধতা। কারণ, সরকারকে মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করতে হবে। মানবিক মূল্যবোধ ও মানবিক জীবনের জন্য অপরিহার্য বিষয়াবলিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। প্রকল্প উন্নয়নের অর্থ হতে হবে জন-আকাক্সক্ষার বাস্তবায়ন। বর্তমানে প্রকল্প উন্নয়নের মাধ্যমে ক্ষমতাসীনদের সহযোগীদের মধ্যে আর্থিক সুযোগ-সুবিধা বিলি-বণ্টনই মুখ্য উদ্দেশ্য।

জনগণের জন্য কী ভালো সে সম্পর্কে সরকারই সর্বোত্তম ধারণা রাখে এটা সমাজের চিন্তাশীল মানুষ মেনে নিতে পারেন না। জনগণের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগে সরকারের দায়বদ্ধতা থাকতে হবে জনগণের কাছে। পেশাজীবী সাংবাদিক ও পেশাজীবী আইনজীবীদের অবশ্যই পেশাগত স্বাধীনতা বজায় রাখতে হবে, যাতে তারা গণতন্ত্র রক্ষার সৈনিক হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারেন। যদিও আমরা গণতন্ত্র নিয়ে আলোচনা করছি, গণতন্ত্র সংরক্ষণের অপরিহার্য রক্ষকদের পেশাগত স্বাধীনতার কথা ভুলে যাচ্ছি।

সাংবাদিকেরা হচ্ছেন জনগণের বাকস্বাধীনতা রক্ষার যোদ্ধা-সৈনিক। জনগণের পক্ষ থেকে বাকস্বাধীনতার ধারক ও রক্ষক হচ্ছে স্বাধীন সংবাদপত্র। সাংবাদিকেরা পেশাগতভাবে বোবা থাকার জন্য দলীয় কর্মী হতে পারেন না।

একইভাবে আইনজীবীদেরও পেশাগত স্বাধীনতা রক্ষা করে চলতে হবে, যাতে তারা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষায় শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারেন। আমাদের দেশের আইনজীবীরা দলীয় কর্মী হওয়ার কারণে দলনেতার প্রতি রয়েছে তাদের মূল আনুগত্য। সত্যি বলতে কী, স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের আইনজীবীরা আইনের শাসন এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য প্রতিষ্ঠানভিত্তিক কোনো সংগ্রাম করেননি। বিচার বিভাগে স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে বা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় যোগ্য ও সাহসী বিচারপতি নিয়োগের প্রশ্ন তাদের কাছে অগ্রাধিকার পায়নি। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগের জন্য গঠিত কমিশনের মৃত্যু নীরবেই হয়ে গেল।

তাই আমরা আইনের শাসনের বদলে ভয়ের শাসনে আছি। গণতন্ত্র সিস্টেমিক অব্যবস্থাপনায় ভুগছে।

শিক্ষকেরা জ্ঞান বিতরণে সৎ এবং নিবেদিত থাকতে পারেন না যখন তারা রাজনৈতিক আনুকূল্য পাওয়ার জন্য দলীয় কর্মী হওয়াটাকে অগ্রাধিকার দেন। আর দলীয় কর্মী হতে গিয়ে তারা তাদের একাডেমিক স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলেন। স্বাধীনভাবে জ্ঞানের চর্চা এবং একাডেমিক স্বাধীনতার প্রতি অনুরাগ হারাবার চেয়ে আর কী দুর্ভাগ্য থাকতে পারে একজন শিক্ষকের জন্য। ক্ষতি হচ্ছে ছাত্রদের, ক্ষতি হচ্ছে জাতির।

আমি মানুষ গড়ার শিক্ষার কথা বলছি। যেখানে শিক্ষকদের বৈষয়িক স্বার্থই বড়, সেখানে সুশিক্ষা তো অবহেলিত হতে বাধ্য। শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কে শ্রদ্ধার অভাব দেখা দিচ্ছে। ক্যাম্পাসে দলীয় রাজনীতির স্থান থাকবে না এ দাবি তো শিক্ষকদের পক্ষ থেকে ওঠাই স্বাভাবিক ছিল। ছাত্র-শিক্ষক মিলে দলীয় রাজনীতি করতে গিয়ে মুক্তচিন্তার সুযোগ শিক্ষাঙ্গন থেকে বিলুপ্তির পথে। কলুষিত দলীয় রাজনীতি থেকে শিক্ষাব্যবস্থাকে দূরে রাখার কথা ভাবা হচ্ছে না।

আমরা কি এ ধরনের নৈরাজ্যিক এবং অবমাননাকর অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম করেছিলাম? আমরা তো মানুষের মতো বাঁচতে স্বাধীনতা চেয়েছিলাম। আমরা বাকস্বাধীনতা বা নির্বাচনের স্বাধীনতা হারানোর জন্য সংগ্রাম করিনি। ভয়ভীতি, নিরাপত্তাহীনতায় জীবন ধারণের চেয়ে একজন স্বাধীন মানুষের জন্য আর কী অমানবিক বা অধঃপতিত জীবন হতে পারে? ভয়মুক্ত জীবনই স্বাধীনতা। আমরা আমাদের সুবিচারের অধিকার ও স্বাধীনতাকে অস্বীকার করতে পারি না।

এ দেশের জনগণ সেই বাংলাদেশ চেয়েছে, যাকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বলা যায়, ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির’। হ

লেখক : সিনিয়র আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট


আরো সংবাদ



premium cement