২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

বিএনপির দ্বিধাদ্বন্দ্ব এবং সিদ্ধান্ত

- ফাইল ছবি

একজন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ প্রশ্ন তুলেছেন : ০১. বিএনপি বলেছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে অংশ নেবে না; ০২. অবশেষে নমনীয় করে বলেছিল ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীর অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবে না; ০৩. ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পরও তারা দৃঢ়তার সাথে বলছিল খালেদা জিয়ার মুক্তি ছাড়া তাদের নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রশ্নই আসে না; ০৪. ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে যখন তারা গণভবনে গেল, তারা কী নিয়ে ফিরে এলো? ৫. নির্বাচনে সরকার কী কৌশল অবলম্বন করতে পারে- এ সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা ছিল কি? ৬. নিশীথ রাতের নির্বাচনের পর তারা কেন গণ-আন্দোলনের চেষ্টাও করলেন না?

এসব প্রশ্ন ছাপিয়ে এখন যে প্রশ্নটি প্রবল আকার ধারণ করেছে, তা হলো বিএনপির এমপিদের জাতীয় সংসদে যোগদান। এসব প্রশ্ন শুধু ওই প্রবীণ নেতার নয়, এসব প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে বাংলাদেশের কোটি কোটি জনগণের মধ্যে। এমনিতেই এ দেশের নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ বিএনপির প্রতি সহানুভূতিশীল রয়েছে। ১২ বছর ধরে ক্ষমতাসীন সরকারের অন্যায়, অত্যাচার, চোটপাট ও লুটপাট বিকল্প শক্তি হিসেবে বিএনপির জনপ্রিয়তাকে একরকম নিরঙ্কুশ করে দিয়েছে। জনগণের এত বিশাল সমর্থনকে কাজে লাগাতে বিএনপির ব্যর্থতা রয়েছে। কিন্তু ব্যর্থতার দায়ের বেশির ভাগ শক্তি প্রয়োগের রাজনীতি।

আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা উপদেশ খয়রাত করে থাকেন, ষাটের দশকের মতো জনগণ কেন আন্দোলিত হয় না। তার উত্তরে বলা যায়, সে আমলে অন্যায়-অত্যাচারেরও একটা সীমারেখা ছিল। এখনকার মতো তাৎক্ষণিক গুলির আদেশ ছিল না। বন্দুকযুদ্ধে নিহতের খবর ছিল না। যেকোনো মিছিল বেরোলেই পুলিশ পিটুনি দিত না। গুম-খুন, হামলা-মামলা এ রকম মহামারী আকার ধারণ করেনি। রাজনীতির নিয়মতান্ত্রিক ধরন-ধারণ ও বিষয়-বৈশিষ্ট্য ব্যাপকভাবে বদলে গেছে। মানুষ এখন ভীতির রাজত্বে বসাবাস করে। এ কথাও সত্য, রাজনীতিতে নীতি-নৈতিকতা, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও আদর্শবাদের স্থান সর্বনিম্ন পর্যায়ে চলে এসেছে। সুতরাং নিষ্ঠুর নির্মমতার সামনে যেতে যেমন মানুষ ভয় পায়, তেমনি ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার হিসাব-নিকাশ বেড়েছে।

উত্থিত প্রশ্নগুলোর জবাব এই শক্তি প্রয়োগের রাজনীতির মধ্যেই রয়েছে। এর অর্থ অবশ্যই এই নয় যে, বিএনপি রণকৌশলগতভাবে কোনো ভুল করেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা নিদেনপক্ষে সরকারের নিরপেক্ষতা আইনের মাধ্যমে নিশ্চিত না করে নির্বাচনে অংশ নেয়া ভুল ছিল। এখন অনেকেই বলাবলি করছেন, বিএনপি ড. কামাল হোসেনের কাঁধে সওয়ার হয়ে কোনো কিছু অর্জন করেনি। মাঝখানে ড. কামাল হোসেন আপাতত হিরো হলেন। তাদের দু’জন এমপি নির্বাচিত হলেন। খালেদা জিয়ার মুক্তি ছাড়া নির্বাচনে অংশ না নেয়ার ব্যাপারে নেতাদের দৃঢ় থাকা প্রয়োজন ছিল।

গণভবনে সংলাপে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতিকে প্রাতিষ্ঠানিকতা দিতে তারা ব্যর্থ হয়েছেন। ক্ষমতার স্বার্থে অতীতে রাজা-বাদশাহরা ভ্রাতৃঘাতেও দ্বিধা করেনি। সময় পাল্টালেও ক্ষমতার মোহ ও মদমত্ততা আগের মতোই রয়ে গেছে। একজন বিরোধী রাজনীতিবিদ যদি দূরদৃষ্টি নিয়ে ব্যক্তিকে মূল্যায়ন করতে না পারেন, অথবা দূরদৃষ্টি দিয়ে ভবিষ্যৎ অবলোকন করতে না পারেন তা অবশ্যই তাদের ব্যর্থতা। ক্ষমতাসীন ব্যক্তি বা শাসক স্বাভাবিকভাবেই তার ক্ষমতাকে সংহত করার জন্য সম্ভাব্য সব কিছু করবেন- এটাই স্বাভাবিক। তার বিপরীতে কী রণকৌশল নেয়া যেতে পারে, তা ঐক্যফ্রন্টের পরিকল্পনায় ছিল না বলেই প্রমাণ হয়েছে।

এমনকি যখন দেখা গেল রাতে ভোট রাহাজানি হয়ে গেল তখনো তারা প্রতিবাদ গড়ে তুলতে পারলেন না। মওদুদ আহমদ পরামর্শ দিয়েছিলেন ঐক্যফ্রন্টের সব প্রার্থীই ঢাকায় এসে নির্বাচন কমিশনের সামনে অবস্থান নেবেন। এ ধরনের গণ-আন্দোলনের সূচনা করতে অনেকেই পরামর্শ দিয়েছিলেন। কেন তা মেনে নেয়া হলো না? নির্বাচনের দিন সকালে ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতাদের যে মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছে, তাতে বোঝা যায় তারা আশপাশের কোনো খবর রাখেন না। একজন রাজনীতিবিদ যদি পরিস্থিতির মূল্যায়ন করতে এবং মানুষের মনের খবর না বুঝতে পারেন, তাহলে তাদের রাজনীতি করে লাভ কী? এ ধরনের দূরদৃষ্টি এবং জনগণের প্রতিক্রিয়া বুঝতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে অনেক রক্ত ঝরেছে। গণতান্ত্রিক ও আদর্শিক আন্দোলন অনেক দূর পিছিয়েছে।

এবার জাতীয় সংসদে যোগদানের বিষয়টি আলোচনা করা যাক। এটা নিঃসন্দেহ যে, বিষয়টি ছিল দু’ধারী তরবারির মতো। সংসদে যোগ দিলে নিশীথ রাতের নির্বাচনকে বৈধতা দেয়া হয়। বিএনপি তথা ঐক্যফ্রন্ট প্রথম থেকেই দৃঢ়তার সাথে বলে আসছিল তারা ওই সংসদে যোগদান করবে না, শপথ নেবে না। গণফোরাম থেকে যে দু’জন সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, তারা একে একে শপথ নিলেন। তাদের বহিষ্কার করা হলো। এবার সরকার বিএনপির দিকে হাত বাড়াল। সরকারি নেতানেত্রী, মন্ত্রী-মিনিস্টার এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রী বিএনপির সংসদে যাওয়ার উপকারিতা বর্ণনা করলেন।

ইতোমধ্যে তারাই গুজব রটিয়ে দিলেন যে, বিএনপি সংসদে অংশ নিলে খালেদা জিয়াকে প্যারোলে অথবা জামিনে মুক্তি দেয়া হবে। এ নিয়ে বিএনপির মধ্যে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হলো। মুক্তির উদ্দেশ্যে প্যারোল যে আইনগতভাবে অকার্যকর, সাবেক জেলা জজ ইকতেদার আহমেদ তা তার কলামে বর্ণনা করেছেন। সেখানে এটাও স্পষ্ট হয়েছে, সরকারের সদিচ্ছাই বড় কথা। আর জামিনের বিষয়ে দীর্ঘ সময় সরকারের টালবাহানা স্পষ্ট বিষয়। সরকার চাইছে প্যারোলে মুক্তি মানে বেগম খালেদা জিয়াকে বিদেশে নির্বাসন দেয়া। স্বাভাবিকভাবেই বেগম খালেদা জিয়ার চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী সরকারের কোনো অনুগ্রহ তার নেয়ার কথা নয়। এসব লোভ দেখিয়ে বিএনপির সদস্যদের শপথ ত্বরান্বিত করা হয়েছে। উদ্দেশ্য একটাই, অবৈধ নির্বাচনকে প্রধান বিরোধী দল কর্তৃক স্বীকৃতি নেয়া। বিএনপির একজন এমপি অনেকটা আকস্মিকভাবে শপথ নিলেন। গুজব শোনা গেল অন্যরা লাইনে আছেন। বিএনপির বহিষ্কারকে অগ্রাহ্য করে আরো চারজন যখন গোপনে যোগদান করার সিদ্ধান্ত নিলেন, তখন বিপাকে পড়ল বিএনপি।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল এই যোগদানের মধ্য দিয়ে সরকারের ভবিষ্যৎ কারসাজি অনুমান করলেন। দল থেকে বহিষ্কার করলে সংসদ সদস্য পদ থাকে না, এ রকম উদাহরণ রয়েছে। তারা নিজেদের গা বাঁচানোর জন্য আরেকটি বোগাস বিএনপি তৈরি করতে পারে। সুতরাং বিএনপি নেতৃত্ব অগত্যা স্বীকৃতি না দিয়ে উপায় ছিল না। এতে আপাতত বিএনপির বিভক্তি এড়ানো গেছে। তবে বিএনপির ওই সব এমপি সম্পর্কে জনগণের ক্ষোভ ও ক্রোধ বেড়েছে। এ দিকে আরেকটি প্রশ্ন- মির্জা ফখরুল ইসলামের শপথ না নেয়া প্রসঙ্গে। একই দলে দুই রকম সিদ্ধান্ত বেমানান। তবে বিএনপির অভ্যন্তরীণ সমীকরণ সম্পর্কে যারা খবর রাখেন, তারা বলছেন ব্যক্তিগত পর্যায়ে তার সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা রয়েছে। তা ছাড়া সংক্ষুব্ধ নেতাকর্মী এবং অতিষ্ঠ জনগণের তার এ সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রশমিত হবে।

বিএনপির আরেকটি ভুল সিদ্ধান্ত ২০ দলীয় ঐক্যজোটকে শক্তিশালী না করা। প্রথম দিকে বেগম খালেদা জিয়া যখন বৃহত্তর ঐক্যের সূচনা করেন তখন ড. কামালসহ বামধারার নেতারা শর্ত দেন, বিএনপিকে জামায়াত ছাড়তে হবে। বিএনপি দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে থাকে। ড. কামাল, আ স ম রব, কাদের সিদ্দিকী প্রমুখ ব্যক্তিত্ব রাজনৈকিভাবে অত্যন্ত সম্মানীয় ও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু নির্বাচনের হিসাব-নিকাশে ২০ দলীয় জোট গুরুত্বপূর্ণ। বিএনপি কৌশলগতভাবে উভয় কূল রক্ষা করে চলেছে। তাতে লাভ ও লোকসান দুটোই হয়েছে। জোট সক্রিয় থাকলে হয়তো আন্দোলনের সূচনা করা যেত।

অপর দিকে ঐক্যফ্রন্ট ভেঙে গেলে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতো। সুতরাং বিএনপির মধ্যপন্থী নীতি বাস্তবসম্মত ছিল। এখন যখন ঐক্যফ্রন্ট অকার্যকর হয়ে পড়েছে, তখন ২০ দলীয় জোট সক্রিয় করার সুযোগ এসেছে। কিন্তু ইতোমধ্যে মেধাবী নেতা আন্দালিব রহমান পার্থ জোট ছেড়ে গেছেন। তার এ সিদ্ধান্ত জনগণকে আহত করেছে। তার কারণ তার সম্পর্কে জনগণের ইতিবাচক ধারণা ছিল। বোঝা যায়, সরকার প্রান্তিক বিএনপিকেও ধারণ করার ক্ষমতা রাখে না। এই ভাঙাগড়ার খেলা মানুষ বোঝে না, এমন মনে করার কারণ নেই।

আমাদের অতিকথক তথ্যমন্ত্রী কয়েক দিন আগে বলেছেন, বিএনপি নোংরা রাজনীতি করছে। নোংরা রাজনীতির সংজ্ঞা তিনি বাতলাননি। এর অর্থ যদি হয় অশোভন-অশ্লীল উক্তি, অন্যের চরিত্র হনন, দল ভাঙা এবং লোভলালসা ও ভীতি প্রদর্শন তাহলে এটি তাদের বেলায় অধিকতর প্রযোজ্য। যদি নোংরা রাজনীতির অর্থ হয় অন্যায়, অত্যাচার, বিরোধীদের নির্বিচারে হত্যা, জেল-জুলুম এবং হাজার হাজার মামলা তাহলে সাম্প্রতিক ইতিহাস কী সাক্ষ্য দেয়? এই সে দিন কারা ভাগিয়ে নিয়েছে বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে? অনেক নাটকীয়তা দ্বারা আষ্টেপৃষ্ঠে আটকে রেখেছে এরশাদকে? কারা উসকে দিচ্ছে রওশন এরশাদকে? অতীতে এরা বিএনপির দু’জন এমপি ভাগিয়ে নিয়ে মন্ত্রী বানিয়েছিল। ইতিহাস অনেক সত্য কথা বলবে।

রাজনৈতিক দলগুলো নিয়মতান্ত্রিকভাবে গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হবে, এটাই স্বাভাবিক। নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে পরিবেশ পরিস্থিতির যথার্থ মূল্যায়ন করতে না পারলে তাদের লক্ষ্য হাসিল হবে না। পৃথিবীর সব উন্নত গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলের নিজস্ব গবেষণা কেন্দ্র রয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দল ছাড়া অন্যদের এ রকম গবেষণা কেন্দ্র বিরল। রাজনীতিকেরা দলীয় স্বার্থ দেখতে গিয়ে একপেশে হতে পারেন, ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারেন; কিন্তু একটি নৈর্ব্যক্তিক ও নিরপেক্ষ গবেষণা কেন্দ্র সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে পারে। পৃথিবীর সব দেশে বুদ্ধিজীবীরা নিরাসক্ত মন নিয়ে দলকে সাহায্য করে থাকেন। রাজনীতিকদের উচিত সঠিক সিদ্ধান্তের জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলনে গুরুত্বারোপ করা।

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement