২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

আমরা কবে মানুষ হবো

- ফাইল ছবি

দেশে আজ অসৎ কর্ম বেগবান, অপর দিকে সৎ কর্ম ম্রিয়মাণ। এই মুহূর্তে একটি বৃহৎ প্লাটফর্মের মাধ্যমে সুন্দর একটি পরিবেশ তৈরিতে সবার ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা উচিত। সেই প্লাটফর্মের কাজ হবে জাতিকে নৈতিকভাবে উদ্বুদ্ধ করা। নারী ও শিশুর ওপর বলাৎকার শ্লীলতাহানি- অবশেষে আগুনে পুড়িয়ে না ফেরার দেশে পাঠিয়ে দেয়া, সাগর-রুনি, তনু, মিতু এবং হালের রাফিকে পৈশাচিক পদ্ধতিতে পুড়িয়ে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করা হয়েছে। যারা এসব খুনে জড়িত তারা মানুষ নয়, পশুর চেয়েও অধম। প্রথম তিনটির বিচার হয়নি। রাফির খুনের বিচার আলোর মুখ দেখবে কি না, সেটাও বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে জাতির কাছে। গোল্ডেন বা ডিজিটাল বাংলাদেশের এমন কুৎসিৎ চেহারা দেশের ভাবমর্যাদাকে তলানিতে নিয়ে গেছে। নারী ও শিশুদের দেহ নিয়ে এখন শুধু ছাত্রসমাজ ও যুবসমাজ জড়িত নয়, বিদ্যাপীঠের নামীদামি শিক্ষকেরাও জড়িত। প্রতিদিন পত্রিকার লিড নিউজ হয়ে এসব খবর বের হচ্ছে।

সমাজ সুস্থ পথে হাঁটছে না অসুস্থ পথে হাঁটছে, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার প্রয়োজন নেই। দেশে সচেতন মানুষের চরম অভাব। কারণ, তাদের মুখে প্রতিবাদের ভাষা নেই। পবিত্র কুরআনে আছে- নারী ও শিশুর শ্লীলতাহানি যারা করে তারা জাহান্নামের বাসিন্দা। বাংলাদেশ একটি মুসলিমপ্রধান দেশ। এদেশের ৯০ শতাংশ মানুষ মুসলমান। তাদের ধর্ম ইসলাম। ইসলাম অর্থ শান্তি। কিন্তু বাংলাদেশে দেখছি অশান্তি। এতদিন জানতাম আগুনে বাড়িঘর পোড়ে। এখন দেখছি অগণিত মানুষ আগুনে পুড়ে না ফেরার দেশে চলে যাচ্ছে। পত্রিকায় এসেছে, পরীক্ষার প্রশ্ন ও নোটবই দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে প্রায় এক বছর আগে থেকেই নুসরাত জাহান রাফিকে কুপ্রস্তাব দিয়েছিলেন মাদরাসার অধ্যক্ষ এস এম সিরাজউদদৌল্লা।

সেই প্রলোভনে সাড়া না দেয়ায় রাফিকে হয়রানি করতেন সিরাজ। মাদরাসার অধ্যক্ষ অন্য মেয়েদেরও উত্ত্যক্ত করতেন। প্রভাবশালী ব্যক্তি হওয়ার কারণে কেউ মুখ খুলতে সাহস পেত না। (সূত্র : কালের কণ্ঠ-১২ এপ্রিল ২০১৯)। জাবি ও ঢাবিতেও ছাত্রীদের পরীক্ষার প্রশ্ন ও নোটবই দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে শিক্ষকদের কুপ্রস্তাব দেয়ার ঘটনা পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছিল। যৌন হয়রানি বাংলাদেশে এখন নিত্যদিনের চলমান ঘটনা। আমরা কেন বুঝতে পারছি না- আমাদের অপকর্মই আমাদের অবক্ষয়। নৈতিক মূল্যবোধকে জাগ্রত করার জন্য ১০ মিনিট সময় ব্যয় করার মতো কি সচেতন মানুষের অভাব পড়েছে দেশে? নিজ নিজ ধর্মের আদর্শের নীতি-মূল্যবোধ ও দেশপ্রেম সম্পর্কে জাতিকে অনুপ্রাণিত করা এখন সময়ের দাবি। অন্যথায় বাংলাদেশ হেরে যাবে। জাহেলিয়াতি যুগের কায়দায় ধর্ষণ ও নির্যাতন চলছে। দৈনিক ইনকিলাব ১৭ এপ্রিল ২০১৯ এ ধরনের একটি ঘটনার বিবরণ এমন: বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে কিশোরীকে সাত দিন আটকে রেখে ধর্ষণ করা হয়Ñ এরপর তার চুল কেটে গালে জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকা দেয়া হয়। মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতনের এ ঘটনা রেকর্ড করা হয় মোবাইলে। এ কাহিনী প্রকাশ না করতে দেয়া হয় হুমকি। ঘটনাটি ঘটে চট্টগ্রামের সদরঘাটে।

একই তারিখে ফটিকছড়িতে ঘটে আরেকটি ঘটনা। গভীর রাতে ঘরে ঢুকে এক প্রবাসীর স্ত্রীকে ধর্ষণ চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। সারা দেশে চলা আন্দোলন-প্রতিবাদের মধ্যে কমছে না ধর্ষণ, যৌন হয়রানির মতো ঘটনা। কুলাউড়ায় এক যুবতীকে মোবাইল ফোনে ডেকে নিয়ে গণধর্ষণ করেছে সাত দুষ্কৃতকারী। ধর্ষণের দৃশ্য মোবাইল ফোনে ভিডিও রেকর্ড করে পুনরায় ডাকে না এলে ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়ার হুমকি দেয় দুষ্কৃতকারীরা। বর্ষবরণের দিন ধর্ষণের শিকার তিন কিশোরী। কৌশলে ডেকে নিয়ে স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। পাবনা, রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) এবং আড়াইহাজারে (নারায়ণগঞ্জ) এসব ঘটনা ঘটে। বর্ষবরণ অনুষ্ঠান ও বৈশাখী মেলা থেকে ফেরার পথে পৃথক স্থানে ধর্ষণের শিকার হয়েছে দুই কিশোরী।

গৃহবধূ বৃষ্টি হত্যাকাণ্ডে স্বামী ও শ্বশুর গ্রেফতার (নারায়ণগঞ্জ)। ধামরাইয়ে দুই মহিলার লাশ উদ্ধার (সূত্র : দৈনিক ইনকিলাব ১৬ এপ্রিল ১৯)। গোপালগঞ্জ কালেরকণ্ঠ (১২/৪/১৯) প্রতিনিধি সূত্রে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়ক শিক্ষকের বিচার দাবিতে আন্দোলন চলছেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অভিযুক্ত শিক্ষকের বিচারের দাবিতে পঞ্চম দিনেও ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন। দুই শিক্ষার্থীকে যৌন নিপীড়নের ঘটনায় ৮ এপ্রিল রোববার থেকে শিক্ষার্থীরা অভিযুক্ত শিক্ষক মো: আক্কাস আলীকে অপসারণের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। গাজীপুরে প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় ছুরিকাঘাতে এক কলেজছাত্রীকে হত্যা করেছে এক বখাটে। এ ছিল আরেক বর্বরতা। গত ১৩ এপ্রিল ওই ছাত্রী পরীক্ষা দিয়ে কলেজ থেকে বাসায় ফিরছিল। সে সময় প্রকাশ্যে দুপুরে কোনাবাড়ি কাঁচাবাজারের সামনে এ ঘটনা ঘটে। তার মৃত্যুতে পরিবারে চলছে শোকের মাতম (সূত্র কালের কণ্ঠ : ১৮-০৪-১৯)।

১৯ এপ্রিল ২০১৯ বাংলাদেশ প্রতিদিন প্রথম পৃষ্ঠায় লিড নিউজে লিখেছে- ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে সামাজিক অপরাধ। তিন শিশু ধর্ষিত, শিক্ষক বরখাস্ত, থানা ঘেরাও। নোয়াখালীর সেনবাগে চতুর্থ শ্রেণীর এক ছাত্রীকে ধর্ষণ করেছে ষাটোর্ধ্ব এক ব্যক্তি। এ ছাড়া নরসিংদীর বেলাবতে ১০ বছর বয়সী এক শিশুকে ধর্ষণ করেছে মধ্য বয়সী এক ব্যক্তি। রংপুরেও এক শিশু ধর্ষিত হয়েছে। ছাত্রীকে যৌন নিপীড়নের দায়ে লালমনিরহাটের আদিতমারী বড়াবাড়ি এমএইচ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লুৎফর রহমান বরখাস্ত হয়েছেন। গাজীপুরের কোনাবাড়িতে কলেজছাত্রী হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধন ও সমাবেশ হয়েছে। দেশে এখন ধর্ষণ মহামারী আকার ধারণ করেছে। নাটোরের সিংড়ায় বিয়াম ল্যাবরেটরি স্কুলের গণিত শিক্ষক ফজলুর রহমানের বিরুদ্ধে ছাত্রীদের যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন অভিযোগের তদন্তে সত্যতা মিলেছে।

১৭ এপ্রিল বুধবার বিকেলে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির দেয়া দুই পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনে এই সত্যতা পাওয়া যায়। সিরাজগঞ্জে নিজ ঘরে মা-মেয়ের লাশ পাওয়া গেছে। বিভিন্ন স্থানে আরো তিনটি খুন-মরদেহ উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে। হরেক অপরাধের ভয়ঙ্কর চক্র যা ফেসবুক পরিচয় থেকে ঘটছে। মহিলারাও পুরুষকে জিম্মি করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার ভয়ঙ্কর চক্রের সন্ধান পেয়েছে র‌্যাব-কলাবাগান ও আমিনবাজারে। স্ত্রীকে হত্যার কথা স্বীকার কমলের। স্ত্রীকে শ্বাসরোধে হত্যার পর লাশে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়ার কথা স্বীকার করেছে কমল হোসেন। স্ত্রী হাসি বেগমের সাথে প্রথম স্বামীর যোগাযোগ এবং দুবাই যাওয়ার চেষ্টা সেই ক্ষোভ থেকেই স্বামী কমল তার স্ত্রী হাসিকে হত্যার পরিকল্পনা করে। উল্লেখ্য, হাসি ও কমলের উভয়েরই এটা দ্বিতীয় বিয়ে। ধর্ষণ ও খুন নিয়ে এক দিনের ঘটনার বৃত্তান্ত ছাপিয়েছে বাংলাদেশ প্রতিদিন ১৯ এপ্রিল ২০১৯।

এ রকম ভয়াবহ নিউজ অন্যান্য পত্রিকায়ও প্রতিদিন লিখছে। কিন্তু বিচারহীনতার কারণে সামাজিক অপরাধ কমছে না বলে অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন বিভিন্ন সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানে। ২ এপ্রিল ২০১৯ থেকে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত মাত্র ১৫ দিনে ধর্ষণসহ যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৪৭ জন। ১৭ এপ্রিল বুধবার মানবাধিকারবিষয়ক সংগঠন ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ (এমজেএফ) এ তথ্য প্রকাশ করেছে। বিবৃতিতে সংগঠনটি জানায়, ২ থেকে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত ছয়টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ করে এই তথ্য পাওয়া গেছে। ধর্ষণের ৪৭ জনের মধ্যে ৩৯ জন মেয়ে শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। বিভিন্ন কারণে খুন করা হয়েছে ৫ শিশুকে। সংস্থাটি বলছে বিচারহীনতার কারণে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে (সূত্র ইনকিলাব ১৯-৪-১৯)।

আমার জানা মতে, মুসলিমপ্রধান কোনো রাষ্ট্রে ১৫ দিনে ৩৯ জন মেয়ে শিশু ধর্ষিত হয়েছে- এমন তথ্য নেই। শিশু ধর্ষণ বাংলাদেশেই মাত্রাতিরিক্ত বেড়েছে। এটা পুরো জাতি ও দেশের জন্য কলঙ্কজনক অধ্যায়। এ দেশের একশ্রেণীর দলীয় বুদ্ধিজীবীরা এখন পর্যন্ত সড়ক পথে নামেনি- অথচ তারা সেমিনারে অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে বড় বড় কথা বলেন। এসব কেন হচ্ছে- কাদের প্রশ্রয়ে-আশ্রয়ে এসব কদর্য ঘটনাগুলোর দীর্ঘ সারি দেখেও তাদের অন্তরে অনুশোচনাবোধ কাজ করছে না। মত ও দলের ঊর্ধ্বে ওঠে এর প্রতিকার করা প্রতিটি মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। এ দেশের কন্যাশিশুরা জাহেলিয়াতের যুগের শিকার কেন হবে এ প্রশ্ন গোটা দেশবাসীর। সরকারে যারা আছেন তাদের দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটা এরকম- এসব ব্যাপারে রাজনীতিকে টেনে আনবেন না।

সহিংসতা, ফেসবুকের অবাধ নষ্টালিজম, টিভির হিন্দি সিরিয়াল নাটক ইত্যাদি অপসংস্কৃতিতে নৈতিক বিকৃতি এখন চরম আকার ধারণ করেছে। কথায় আছে রাজার দোষে রাজ্য নষ্ট প্রজা কষ্ট পায়। প্রজার ওপর বিশেষ করে যে অবুঝ শিশু কথা বলতে পারে না- কোন দোষে তাকে ধর্ষণ করা হচ্ছে। এটা তো রাষ্ট্রযন্ত্রের পরিচালকদের দেখা প্রয়োজন বলে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানও বলেছেন।

তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, রাষ্ট্রে বিচারহীনতার কারণে এগুলো জ্যামিতিক পদ্ধতিতে বেড়েই চলছে। দেশে বর্তমানে সড়ক দুর্ঘটনায় লাশের মিছিল যেভাবে বাড়ছে, ঠিক একইভাবে ধর্ষিত নারী ও মেয়ে শিশুদের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। সমকামীর জন্য নূহ আ: এবং লুত আ: কওমের মানুষগুলোর ওপর বন্যা ও প্লাবন খরা অগ্নিবৃষ্টি দিয়ে যা আল্লাহর গজব আকারে নাজিল হয়েছিল। আমাদের দেশে প্রতিদিন আগুনে যে ঘরবাড়ি, অফিস এবং মার্কেটে ছড়িয়ে পড়েছে এবং মালামালসহ বহু মানুষ নিহত হচ্ছে- এগুলো আল্লাহর গজব। পাপে জর্জরিত হলে এরকম গজব বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমরা প্রত্যক্ষ করছি। পবিত্র কুরআনেও এসব উল্লেখ আছে। তোমরা অসভ্য পথ ছেড়ে সভ্য পথে ফিরে না এলে আমার গজব দুনিয়াতে আসতেই থাকবে (আল কুরআন)।

লেখক : গ্রন্থকার ও সমাজ বিশ্লেষক
E.m-harunrashidar@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement