২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি মানুষকে ছাড়িয়ে যাবে

- ছবি : সংগৃহীত

বিশ্বখ্যাত গ্রন্থ দ্য ভিঞ্চি কোড-এর লেখক ড্যান ব্রাউনের সর্বশেষ থ্রিলারের নাম অরিজিন। অরিজিনের কাহিনীতে অ্যাডমন্ড কার্শ নামে একজন বিশ্বসেরা কম্পিউটার বিজ্ঞানী, ভবিষ্যৎদ্রষ্টা, কোটিপতি উদ্যোক্তা দাবি করেন যে, তিনি মহাবিশ্বের জন্ম ও উদ্ভবের রহস্য আবিষ্কার করে ফেলেছেন। তার আবিষ্কার প্রকাশ পেলে পৃথিবীর সব ধর্মের ভিত নড়ে যাবে। কারণ মহাবিশ্বের উদ্ভব সম্পর্কে ইহুদি, খ্রিষ্টান বা ইসলাম ধর্ম যে ব্যাখ্যা দিয়ে আসছে, তার সাথে প্রকৃত সত্যের কোনো মিল নেই, যেটা তিনি আবিষ্কার করেছেন।

সুতরাং ধর্মের অসারতা এমনই স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, মানুষ আর এর ছায়াও মাড়াবে না। বিজ্ঞানী তার এই আবিষ্কারের বিষয়টি একটি ভিডিও অ্যানিমেশনের মাধ্যমে চিত্রায়ন করেছেন এবং সেটি প্রকাশ করার জন্য একটি সম্মেলন আহ্বান করেন। বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, ধর্মীয় নেতাসহ নানা সেক্টরের বাছাই করা সেরা ব্যক্তিরা তার আমন্ত্রণে সম্মেলনে যোগ দেন।

৩১৮ জন সুনির্বাচিত ব্যক্তিত্বের সেই সম্মেলনে দুনিয়া কাঁপানো আবিষ্কারের বিষয়টি প্রকাশ করার সময় অজ্ঞাত আততায়ীর গুলিতে বিজ্ঞানী কার্শের মৃত্যু ঘটে এবং একটি অনন্য রোমাঞ্চকর উপন্যাসের কাহিনী ডালপালা মেলতে শুরু করে।

বিজ্ঞানীর মৃত্যুর পেছনে ধর্মীয় নেতাদের হাত আছে বলে স্বাভাবিকভাবেই পাঠক ধরে নেন। কারণ, ওই বিজ্ঞানী আপাতদৃষ্টে নাস্তিক ছিলেন এবং ধর্মের মূলোৎপাটনের কাজটি বিশ্বের সামনে ফাঁস করে দিতে উদ্যত হয়েছিলেন। আর তিনি যে ধর্মের মূলোৎপাটন করতে যাচ্ছেন, সে কথা আবার বলেছিলেন তিন ধর্মের তিনজন সেরা ধর্মনেতার কাছে। সুতরাং ধর্মীয় নেতারা কার্শের আবিষ্কার প্রকাশ করতে দিতে চাইবেন না, এটা স্পষ্টই ছিল।

লেখক এমন চমৎকারভাবে কাহিনী এগিয়ে নিয়েছেন যে, পাঠক ভিন্ন কিছু ভাবার অবকাশই পান না। সাড়ে চার শ’ পৃষ্ঠারও বেশি, এই বিশাল কাহিনীর একেবারে শেষের দিকে গিয়ে যখন রহস্যের উন্মোচন ঘটে, তখন পাঠক চমৎকৃত হন এই সত্য দর্শনে যে, পুরো কাহিনীর মূল নায়ক বা খলনায়ক আসলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে স্বচালিত একটি সুপার কম্পিউটার। উইনস্টন নামের এই সুপার কম্পিউটারটি বিজ্ঞানী কার্শের উদ্ভাবন এবং বিশ্ব এখনো উইনস্টনের কথা জানে না। কারণ, কার্শ তার এই উদ্ভাবনের বিষয়টি গোপন রেখেছেন। এটি হলো এমন একটি সুপার কম্পিউটার, যেটি বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে আধুনিক ‘ডি-ওয়েভ’ টাইপের সুপার কম্পিউটারের চেয়ে বহুগুণ শক্তিশালী উন্নততর সংস্করণ, যাকে কার্শ বলেন ‘ই-ওয়েভ’ টাইপ। এই কম্পিউটারই নেপথ্যে থেকে সমস্ত কলকাঠি নাড়ে এবং অত্যন্ত নিপুণভাবে একটি সুদূরপ্রসারী চক্রান্তের জাল বিস্তার করে।

বিজ্ঞানী কার্শের ওপর হামলা হতে পারে, এমন ধারণা থেকে উইনস্টন সম্ভাব্য হামলাকারীর হাত থেকে তাকে বাঁচানোর জন্য একজন সাবেক সৈনিককে ভাড়া করে এবং ওই সম্মেলনে ঢোকার সুযোগ তৈরি করে দেয়। অর্থাৎ অরিজিন উপন্যাসের নায়ক (প্রধান চরিত্র) মূলত একটি সুপার কম্পিউটার, যেটি কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তায় সমৃদ্ধ এবং স্বচালিত।

উপন্যাসটি নানা কারণেই পড়ার মতো। তবে সেকথা পরে বলা যাবে। আজ আমরা কথা বলব কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে।

অরিজিন উপন্যাসে কার্শের তৈরি সুপার কম্পিউটার উইনস্টন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে বিশ্বের সমস্ত ওয়েবসাইট ঘেঁটে মানবজীবন ও বিশ্বজগতের যাবতীয় বিষয়ে অধ্যয়ন, তথ্য সংগ্রহ ও তা বিশ্লেষণ করে সেটিকে জ্ঞানের পর্যায়ে উন্নীত করতে পারে। সেই সাথে সে অর্জিত জ্ঞান বাস্তবে প্রয়োগও করতে পারে। জ্ঞানকে বাস্তবে প্রয়োগের জন্য পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে যে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও ধারাবাহিক কর্মপ্রয়াস গ্রহণের প্রয়োজন হয়, সেটিও নিখুঁতভাবেই সম্পন্ন করতে পারে উইনস্টন।

বাস্তব বিশ্বে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে যেসব গবেষণা চলছে তার মূলকথা কিন্তু ওই-ই। অর্থাৎ মানুষের চিন্তাভাবনার ধরন যদি কৃত্রিম উপায়ে কোনো যন্ত্রের মাধ্যমে করানো যায়, তাহলে সেটাই হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। যন্ত্র যখন মানুষের মতো বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন হয়, মানুষের ভাষা বোঝার ক্ষমতা অর্জন করে, মানুষের মতো যুক্তির মাধ্যমে ঘটনার অনুধাবন, সমস্যা সমাধান, উপলব্ধি, শিক্ষণ, পরিকল্পনা, কোনো বস্তুর অবস্থানের পরিবর্তন ঘটানো বা কোনো বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার মতো সামর্থ্য অর্জন করে তখন সেটাই হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্র।

দৈনন্দিন জীবনে আমরা এখন প্রতিনিয়ত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়তা পাচ্ছি বা উপস্থিতি অনুভব করছি। আমরা টেলিভিশনে রোবটের সংবাদ পাঠ দেখেছি। স্বচালিত গাড়ি রাস্তায় চলতে দেখেছি। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাথে আমাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সম্ভবত সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে। ফেসবুক আপনার লাইক দেয়া বন্ধুটির পোস্টগুলোকে সামনে এনে দিচ্ছে, আপনি চিনতে পারেন এমন লোকের ছবি তুলে ধরছে, আপনার বিশেষ বিশেষ স্মৃতি বা কোনো নির্দিষ্ট মাসের কর্মকাণ্ডের স্মৃতি একটি ছোট্ট ভিডিওতে তুলে ধরছে, আপনার পোস্টে কেউ কোনো মন্তব্য করলে সেটি নির্দিষ্ট করে আপনাকে দেখাচ্ছে। তার মানে আপনার আনন্দের জন্য ফেসবুক সব সময় প্রস্তুত ও সক্রিয়।

কিন্তু ফেসবুকের দফতরে বসে কোনো কর্মী এসব করে দেয় না, বরং কম্পিউটারের ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়া নির্দিষ্ট প্রোগ্রামই স্বয়ংক্রিয়ভাবে এসব কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। এটাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। উচ্চতর ক্ষমতাসম্পন্ন কম্পিউটার, রোবট ও অন্যান্য যন্ত্র এর অন্তর্ভুক্ত।

বিশ্বের শীর্ষ ৫০০ প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মী নিয়োগপ্রক্রিয়ায় কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তাসম্পন্ন কম্পিউটারের সাহায্য গ্রহণ, অর্থাৎ অটোমেশন পদ্ধতির ব্যবহার শুরু করেছে। বিশ্বখ্যাত পত্রিকা ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের খবরে এমনটিই বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, চাকরিপ্রত্যাশীদের সিভিতে উল্লিখিত বিভিন্ন শব্দ বিশ্লেষণের মাধ্যমে সবচেয়ে উপযুক্ত প্রার্থী খুঁজে বের করছে রোবট! রোবট ছাড়াও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং মেশিন লার্নিং টুল ব্যবহারের মাধ্যমে কর্মী নিয়োগের পদ্ধতি বিশ্বের বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে। যেমন সোস্যাল মিডিয়ার অ্যাকাউন্ট বিশ্লেষণের মাধ্যমে ব্যক্তির চরিত্র ও বুদ্ধিমত্তা নির্ধারণ করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপক নিয়োগ দেয় ডিপসেন্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান।

সানফ্রান্সিসকো ও ভারতভিত্তিক এ প্রতিষ্ঠানটি জানাচ্ছে, তারা ব্যক্তির ফেসবুক, টুইটার, লিংকডইন ইত্যাদি সোস্যাল মিডিয়ার অ্যাকাউন্ট বিশ্লেষণের কাজে ডেটা সায়েন্স ব্যবহার করে থাকে। সোস্যাল মিডিয়ায় আপনি কী ধরনের ছবি পোস্ট করছেন, কী লিখছেন, কী ধরনের খবর শেয়ার করছেন, আপনার প্রোফাইলের ছবিটা কেমন ইত্যাদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে আপনার আচরণগত দক্ষতা নির্ণয় করা হচ্ছে এবং আপনাকে সেভাবেই মূল্যায়ন করা হচ্ছে।

মূলত মানুষের প্রয়োজন মেটাতেই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উদ্ভাবন।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জনক হচ্ছেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী ও গণিতবিদ অ্যালান ম্যাথিসন টুরিং।

তবে জন ম্যাকার্থি সর্বপ্রথম ১৯৫৫ সালে অৎঃরভরপরধষ ওহঃবষষরমবহপব টার্মটি ব্যবহার করেন। পরের বছর নিউ হ্যামশায়ারের হ্যানোভার শহরের ডার্টমাউথ কলেজে অনুষ্ঠিত এক অ্যাকাডেমিক কনফারেন্সে তিনি তা প্রথম প্রকাশ করেন। এ জন্য জন ম্যাকার্থিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অন্যতম জনক বলা হয়। তার অন্য সহযোগীরা হলেন- মার্ভিন মিনস্কি, অ্যালেন নিউয়েল এবং হার্বাট এ সায়মন।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রসার আগামী দিনগুলোয় বিশ্ববাসীর জন্য স্বস্তি বয়ে আনবে, না দুর্ভোগ বাড়াবে- তা নিয়ে বোদ্ধা মহলে রয়েছে বিতর্ক। বিজ্ঞানের দ্রুত উন্নতি মানবজীবনে যে প্রশান্তির পরশ বইয়ে দিয়েছে, তা আরো বেগবান হবে; নাকি মানবসভ্যতাকেই কোনো এক অজানা বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাবে- এ নিয়ে ভাবার অবকাশ রয়েছে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কিভাবে এর স্রষ্টাকে অতিক্রম করতে পারে এবং মানবজাতির জন্য হুমকি বয়ে আনতে পারে তা বোঝা কঠিন নয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্নয়ন কৌশল এমন স্তরে পৌঁছবে, যাতে মানুষের সাহায্য ছাড়াই যন্ত্ররা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজেদের উন্নতি ঘটাতে পারবে। এমনটি যদি ঘটে, তাহলে আমাদেরকে বুদ্ধিমত্তার বিস্ফোরণের মুখোমুখি হতে হবে। যার ফলে যান্ত্রিক বুদ্ধি আমাদের অতিক্রম করবে। Space X-এর প্রতিষ্ঠাতা ইলন মাস্ক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্নয়নকে Summoning the Demon. অর্থাৎ দৈত্যকে ডেকে আনার শামিল আখ্যায়িত করে এটাকে মানবজাতির জন্য সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হুমকি হিসেবে অভিহিত করেছেন।

পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং বলেছেন, কোনো মানুষ যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে মানুষেরই বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে শুরু করে তবে পরিণতি হবে মারাত্মক।

আমরা জানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়াসহ বিশ্বের অনেক দেশই সামরিক খাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করছে। একদিন হয়তো দেখা যাবে, যুদ্ধক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবট সৈনিক নেমে গেছে। তাদেরকে শত্রু চেনার মতো ডেটাবেজভিত্তিক জ্ঞান দেয়া হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান নিয়ে রোবট সৈনিকেরা শত্রু তথা মানুষ নিধন করে যাচ্ছে। এই রোবট সৈনিকের হাতে মানুষের জীবননাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দেয়া নৈতিকভাবে আদৌ সঙ্গত কি না, এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে।

তবে ড্যান ব্রাউনের অরিজিনে ই-ওয়েভ টাইপের সুপার কম্পিউটারও মানুষের বুদ্ধিমত্তার কাছে পরাস্ত হয় অথবা মানুষের বৃদ্ধিমত্তা কখন কিভাবে কাজ করবে, নিজের কাজ সহজ করে নিতে উদ্ভাবনী কৌশল কাজে লাগাবে তার কোনো থৈ উইনস্টন খুঁজে পায় না। সেজন্যই উইনস্টন এই উপন্যাসের নায়ক না হয়ে খলনায়ক হয়ে ওঠে। নায়ক-নায়িকা হন রক্তমাংসের মানুষ, প্রফেসর রবার্ট ল্যাংডন ও অ্যামব্রা ভিডাল।


আরো সংবাদ



premium cement