২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

প্যারোলে মুক্তি : আইনের মারপ্যাঁচ

খালেদা জিয়ার মুক্তি প্রসঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে বারবার এসেছে প্যারোলের কথা - ছবি : সংগ্রহ

কারাগারে আটক একজন ব্যক্তির শর্তাধীন সাময়িক মুক্তিকে প্যারোল বলা হয়। প্যারোল (Parole) একটি ফরাসি শব্দ। ফরাসি প্যারোল শব্দটির অর্থ প্রতিশ্রুতি। আমাদের বাংলাদেশের কোনো আইনে কারাগারে আটক ব্যক্তির প্যারোলে মুক্তির বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট বিধানের উল্লেখ না থাকলেও কারাগারে আটক ব্যক্তির সাময়িক মুক্তির প্রয়োজন দেখা দিলে তাকে সীমিত সময়ের জন্য তার বা তার পরিবারের সদস্যদের বা নিকটাত্মীয় বা শুভানুধ্যায়ীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া হয়। সচরাচর এ মুক্তির ব্যাপ্তিকাল ১২ ঘণ্টার বেশি হয় না। সাধারণত কারাগারে আটক ব্যক্তির বাবা, মা, সন্তান, স্বামী বা স্ত্রী, শ্বশুর বা শাশুড়ি বা কোনো নিকটাত্মীয়ের মৃত্যু ঘটলে তার জানাজায় বা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নেয়ার জন্য সাময়িক প্যারোলে মুক্তি দেয়া হয়। প্যারোলের মুক্তির আদেশটি সরকারের একটি প্রশাসনিক আদেশ। আমাদের দেশে এ প্রশাসনিক আদেশটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মঞ্জুর করে থাকে। যেকোনো ব্যক্তির মামলা সংশ্লেষে কারাগারে পাঠানো এবং কারাগার থেকে বের হতে হলে উভয় ক্ষেত্রেই বিচারিক আদেশের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কিন্তু প্যারোলে মুক্তির ক্ষেত্রে বিচারিক আদেশের পরিবর্তে প্রশাসনিক আদেশ অনুসৃত হয়।

মামলা সংশ্লেষে পুলিশ কোনো ব্যক্তিকে আটক করলে বিচারিক আদেশের মাধ্যমে তাকে জামিনে মুক্তি দেয়া যায়। এরূপ আটকের পর ব্যক্তিটিকে আদালতে উপস্থাপন করা হলে আদালত তাকে জামিনে মুক্তি দেয় অথবা কারাগারে পাঠায়। জামিনে মুক্তির বিষয়ে সচরাচর দেখা যায় আদালত দু’জন জামিনদারের জিম্মায় নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থের জামানতের বিপরীতে মুক্তির আদেশটি দিয়ে থাকে। এ দু’জন জামিনদারের একজন স্থানীয় আইনজীবী সমিতির সদস্য এবং অপরজন স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি হয়ে থাকেন।

আমাদের দেশে শাস্তিযোগ্য অপরাধগুলোর জামিনযোগ্য ও জামিন-অযোগ্য বিষয়ে বিভাজন রয়েছে। জামিনযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে জামিন পাওয়া মামলা সংশ্লেষে আটক ব্যক্তির অধিকার। এরূপ ব্যক্তির জামিনে মুক্তি নামঞ্জুর করতে হলে আদালতকে বিশেষ কারণ প্রদর্শন করতে হয়। জামিন-অযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে জামিনযোগ্য অপরাধের মতো জামিন পাওয়া আটক ব্যক্তির অধিকার না হলেও আদালত অপরাধের গুরুত্ব ও মাত্রা বিবেচনায় আটক ব্যক্তিকে জামিনে মুক্তি দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে আটক ব্যক্তি শিশু বা মহিলা হলে অথবা বয়ঃবৃদ্ধ বা রোগাক্রান্ত হলে অথবা আটককৃত ব্যক্তির দুগ্ধপোষ্য শিশু থেকে থাকলে আদালত বিশেষ বিবেচনায় জামিনে মুক্তির আদেশ দিতে পারে। মামলা সংশ্লেষে আটক ব্যক্তি জামিনে মুক্তিলাভের পর জামিনের শর্ত ভঙ্গ করলে যে আদালত জামিন আদেশ দেয়, সে আদালত জামিন আদেশ বাতিল করতে পারে; তবে আদালত স্বীয় আদেশ বলে প্রদত্ত তদন্তাদেশের প্রতিবেদন ছাড়া এরূপ জামিন আদেশ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে না। আবার যে আদালত জামিন প্রদান করে, এর অব্যবহিত ওপরের আপিল আদালত যথাযথ কারণে অধস্তন আদালত প্রদত্ত জামিন বাতিল করতে পারেন।
অপরাধ জামিনযোগ্য বা জামিন-অযোগ্য যাই হোক না কেন, এজাহার দায়ের-পরবর্তী অথবা ম্যাজিস্ট্রেট তদন্তাদেশ দেয়ার পর ১২০ দিনের মধ্যে মামলার তদন্তকার্য সম্পন্ন না হলে যেসব মামলার ক্ষেত্রে সাজা মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা অনূর্ধ্ব ১০ বছর নয়, এমন মামলায় আমলি ম্যাজিস্ট্রেট বা তদন্তাদেশদাতা ম্যাজিস্ট্রেট জামিন আদেশ দিতে পারেন। এ ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে সাজা মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা ১০ বছরের ঊর্ধ্বে হলে দায়রা আদালত তদন্তকার্য নির্ধারিত ১২০ দিনের মধ্যে সম্পন্ন না হওয়া বিবেচনায় জামিন আদেশ দিতে পারেন।

দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদধারী রাষ্ট্রপতিকে যেকোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষকে প্রদত্ত যেকোনো দণ্ডের মার্জনা, বিলম্বন ও বিরাম মঞ্জুর করার এবং যেকোনো দণ্ড মওকুফ, স্থগিত বা কমানোর ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।
একজন দণ্ডিত ব্যক্তি সরকারের বরাবর দণ্ড মওকুফ বা স্থগিতের আবেদন করলে সরকার বিচারিক আদালতের বিচারকের মতামত সাপেক্ষে শর্তযুক্ত ও শর্তহীনভাবে দণ্ডিত ব্যক্তিকে মুক্তি দিতে পারে। তা ছাড়া সরকার মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা অনধিক ১০ বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ডে নামিয়ে আনতে পারে। উভয় ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি মৃত্যুদণ্ডের সাজা মওকুফ, স্থগিত বা কমাতে পারেন। সরকার ও রাষ্ট্রপতি এ ক্ষমতা ফৌজদারি কার্যবিধির অধীন প্রয়োগ করে থাকেন।

ফৌজদারি কার্যবিধিতে হাইকোর্ট বিভাগ ও দায়রা আদালতকে যেকোনো মামলায় দণ্ডাদেশ-পরবর্তী আপিল চলমান থাকুক বা না থাকুক, জামিনে মুক্তি দেয়ার ক্ষমতা প্রদান করেছে। হাইকোর্ট বিভাগের কোনো কোনো বিচারক আগাম জামিন দেয়ার ক্ষেত্রে এ ক্ষমতা প্রয়োগ করলেও এ বিষয়ে আপিল বিভাগের সিদ্ধান্তে ভিন্নতা রয়েছে।
প্যারোলে মুক্তি বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০১৬ সালের ১ জুন একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে। এ নীতিমালাটিতে বলা হয়েছে-
ক. ভিআইপি বা অন্যান্য সকল শ্রেণীর কয়েদি বা হাজতি বন্দীদের নিকটাত্মীয়ের যেমন বাবা-মা, শ্বশুর-শাশুড়ি, স্বামী-স্ত্রী, সন্তানসন্ততি এবং আপন ভাই-বোন মারা গেলে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্যারোলে মুক্তি দেয়া যাবে।
খ. ভিআইপি বা অন্যান্য সব শ্রেণীর কয়েদি বা হাজতি বন্দীদের নিকটাত্মীয়ের মৃত্যুর কারণ ছাড়াও কোনো আদালতের আদেশ কিংবা সরকারের বিশেষ সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্যারোলে মুক্তি দেয়ার প্রয়োজন হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনক্রমে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্যারোলে মুক্তি দেয়া যাবে, তবে উভয় ক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও দূরত্ব বিবেচনায় প্যারোল মঞ্জুরকারী কর্তৃপক্ষ সময় নির্ধারণ করে দেবেন।

গ. বন্দীকে সার্বক্ষণিক পুলিশ প্রহরাধীনে রাখতে হবে।
ঘ. মুক্তির সময়সীমা কোনো অবস্থাতেই ১২ ঘণ্টার অধিক হবে না, তবে বিশেষ ক্ষেত্রে সরকার মুক্তির সময়সীমা কমানো বা বাড়ানোর ক্ষমতা সংরক্ষণ করবে।
ঙ. কোনো বন্দী জেলার কোনো কেন্দ্রীয়, জেলা, বিশেষ কারাগার বা সাব-জেলে আটক থাকলে ঐ জেলার ভেতরে যেকোনো স্থানে মঞ্জুরকারী কর্তৃপক্ষ প্যারোল মঞ্জুর করতে পারবে। অপর দিকে কোনো বন্দী নিজ জেলায় অবস্থিত কেন্দ্রীয়, জেলা, বিশেষ কারাগার বা সাব-জেলে আটক না থেকে অন্য জেলায় অবস্থিত কোনো কেন্দ্রীয়, জেলা, বিশেষ কারাগার বা সাব-জেলে আটক থাকলে গন্তব্যের দূরত্ব বিবেচনা করে মঞ্জুরকারী কর্তৃপক্ষ প্যারোল মঞ্জুর করতে পারবে, তবে উভয় ক্ষেত্রেই দুর্গম এলাকা, যোগাযোগব্যবস্থা, দূরত্ব ও নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় মঞ্জুরকারী কর্তৃপক্ষ প্যারোল মঞ্জুর কিংবা নামঞ্জুরের ক্ষমতা সংরক্ষণ করবে।

চ. কারাগারের ফটক থেকে পুলিশ প্যারোলে মুক্ত বন্দীকে বুঝে নেয়ার অনুমোদিত সময়সীমার মধ্যেই পুনরায় কারাগারে পাঠাবে।

ছ. সংশ্লিষ্ট জেলা ম্যাজিস্ট্রেট প্যারোল মঞ্জুরকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে বিবেচিত হবে।
নীতিমালাদৃষ্টে স্পষ্ট প্রতিভাত সরকার সাজাপ্রাপ্ত বা বিচারাধীন ব্যক্তিকে বিশেষ ক্ষেত্রে প্যারোলে মুক্তি দিতে পারে। এটি সম্পূর্ণরূপে সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্বাহী সিদ্ধান্তের একটি বিষয় এবং আদালতের কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়।
প্যারোল ও প্রবেশনের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। প্রবেশন বিষয়ে নির্ধারিত আইন রয়েছে। প্রবেশন অব ওফেন্ডারস অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০ এবং শিশু আইন, ১৯৭৪-এর বিধান অনুযায়ী আদালত শর্তসাপেক্ষে একজন অপরাধীকে সাজা প্রদান-পরবর্তী তার চারিত্রিক সংশোধনের জন্য প্রবেশন অফিসারের তত্ত্বাবধানে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য হস্তান্তর করতে পারেন। আর তাই প্রবেশনের আদেশটি একান্তই বিচারিক আদেশ।
আমাদের দেশে প্যারোল-বিষয়ক নীতিমালা প্রণয়ন-পূর্ববর্তী সাজাপ্রাপ্ত বা বিচারাধীন ব্যক্তির একান্ত আপনজনের মৃত্যু-পরবর্তী জানাজায় অংশ নেয়ার প্রয়োজন দেখা দিলে সীমিত সময়ের জন্য পুলিশের তত্ত্বাবধানে প্যারোলে মুক্তি দেয়া হতো। সে সময়ে সাজাপ্রাপ্ত বা বিচারাধীন একাধিক ব্যক্তিকে দেশের অভ্যন্তরে ও বিদেশে উন্নত চিকিৎসা নেয়ার জন্য দীর্ঘ সময়ের জন্য প্যারোলে মুক্তির ঘটনা প্রত্যক্ষ করা গেছে। বর্তমানে প্রণীত নীতিমালার আলোকে প্যারোলে মুক্তির আদেশ দেয়া হয়।

দেশের সংবিধান ও ফৌজদারি কার্যবিধি রাষ্ট্রপতি ও সরকারকে ক্ষমা প্রদর্শনের যে অধিকার প্রদান করেছে তা রাষ্ট্রপতি ও সরকার বিশেষ বিবেচনায় প্রয়োগ করে থাকে। রাষ্ট্রপতিকে প্রদত্ত ক্ষমতায় বিলম্বন ও বিরাম এ দু’টি বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে। উভয় শব্দের অর্থ সাময়িক মুক্তি, যা প্যারোলের সমার্থক। রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া তার অপর সব দায়িত্ব সরকারের শীর্ষ নির্বাহী প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী সমাধা করে থাকেন। সুতরাং রাষ্ট্রপতি সংবিধানে প্রদত্ত ক্ষমতায় সরকারের সিদ্ধান্তে সাজাপ্রাপ্ত বা বিচারাধীন ব্যক্তিকে প্যারোলে মুক্তি দেয়া হলে তা বিলম্বন ও বিরামকে আকৃষ্ট করে।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement
বাংলাদেশে নতুন করে বাড়ছে ম্যালেরিয়া আক্রান্তের সংখ্যা হিট অ্যালার্ট নিয়ে আবহাওয়া অধিদফতরের নতুন বার্তা ভান্ডারিয়ায় পিকআপ চাপায় বৃদ্ধ নিহত হোচট খেল লিভারপুল, পিছিয়ে গেল শিরোপা দৌড়ে যোদ্ধাদের দেখতে প্রকাশ্যে এলেন হামাস নেতা সিনওয়ার! ফের পন্থ ঝড়, ঘরের মাঠে গুজরাটকে হারাল দিল্লি ইউক্রেনকে গোপনে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র গ্রেফতারের পর যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফিলিস্তিনপন্থীদের বিক্ষোভ আরো বেড়েছে ইউক্রেন যুদ্ধে দুর্নীতি, পুতিনের নির্দেশে গ্রেফতার রুশ উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী!  আমেরিকানরা কি ধর্ম থেকে সরে যাচ্ছে? গাজায় রিজার্ভ ব্রিগেড মোতায়েন ইসরাইলের

সকল