২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

একজন মহাত্মনকে আপ্যায়নের আকুতি

-

মহাপ্রাণের অধিকারী যিনি, তিনিই ‘মহাত্মন’। শব্দটি শোনার সাথে সাথে ছেলেবেলার কথা মানসপটে ভেসে ওঠে। কৈশোরে স্কুলজীবনে দেখেছি, বিদ্যালয়ে নামীদামি কেউ এলে, তাকে মানপত্র দেয়ার রেওয়াজ ছিল। মানপত্রে বিখ্যাত ওই ব্যক্তিকে উদ্দেশ করে সম্বোধন করা হতো ‘মহাত্মন’। সেই থেকে এই ভারী শব্দটির সাথে পরিচয়। তবে এর অর্থ জানা ছিল না। শুধু মনে ধরেছিল। তখন থেকেই সমাজের জ্ঞানীগুণী কাউকে দেখলে তাজিমের সাথে তাকাতাম।

আমরা যারা সমাজের আতরাফ বা নিচু শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করি, তারা আশরাফ- মানে বংশীয় বনেদি ঘরের কাউকে দেখলে শ্রদ্ধায় ‘গদগদ’ হয়ে বিগলিত হয়ে যাই। মতলববাজ যারা; তারা তোয়াজ করতে বিড়ালের মতো মিউ মিউ করে পিছু নেন তাদের। আশায় থাকেন, কখন শিকে ছিঁড়বে। যদি নগদ নারায়ণ কিছু মেলে! সেই মওকার লোভে বুঁদ হয়ে থাকেন সারাক্ষণ। তোহফা না মিললেও ক্ষতি নেই। রথী-মহারথীদের পিছু পিছু ঘুরে যে উত্তাপ সংগ্রহ করেন, তাতে সমাজে নিজেকে কেউকেটে হিসেবে প্রতিষ্ঠায় কাজে লাগাতে পারেন। গ্রামীণ সমাজে প্রান্তজনেরা তাদের বেশ খাতির করে থাকে। সাধারণের বদ্ধমূল ধারণা, সাধে কি ক্ষমতাধর কেউ কাউকে তার সোহবতে রাখেন? নিশ্চয়ই এর পেছনে মাহাত্ম্য আছে। ফলে তরতরিয়ে তাদের কদর যায় বেড়ে।

একটু বড় হয়ে ‘অভিজাত’ শব্দটির সাথে পরিচিত হই। শহুরে জীবনে প্রথমে পড়ালেখা, পড়ে জীবিকার তাগিদে শহরবাসী হওয়া। এখন আমি রাজধানীর বাসিন্দা। এই সুবাদে ভদ্রজনের মুখে শব্দটির তাৎপর্য বুঝতে শেখার চেষ্টা; যদিও পাঠ্যবইয়ে শব্দটি বারবার পড়েও মর্মার্থ অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছি বহুকাল। ইদানীং শব্দটির মানে একটু-আধটু বুঝে আসছে। তবে ‘আলো-আঁধারি’ রয়ে গেছে। গুরুজনের কাছে শোনা, ‘বিদ্যা আর অর্থ যার কাছে হাত ধরাধরি করে আসে; তিনিই অভিজাত।’ এ জন্যই আমাদের সমাজে অভিজাত শ্রেণীর বাড়তি কদর। সমাজে অনেকের জ্ঞান আছে, অর্থ নেই। কেউ আবার অঢেল টাকার মালিক। কিন্তু বিদ্যার বেলায় ‘ঠনঠনা’। বিদ্যা ও সম্পদ যূথবদ্ধ হলে তার আর লাগে কী? আত্মীয়স্বজন ও পরিচিতজন ‘ধন্যি ধন্যি’ রবে সালাম ঠোকে।

ভাববার কোনো কারণ নেই, অভিজাতেরা কেবল আমাদের সমাজেই মান্যবর। আদিকাল থেকেই তাদের আলাদা নজরে দেখা হয়। সে ইতিহাস অতি পুরনো। প্রাচীন গ্রিসেও তারা ছিলেন অতীব প্রভাবশালী। রাষ্ট্রীয় কাজে ছিলেন বড়ই নামীদামি। তাদের কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে অভিজাততন্ত্র। একালের আমলাতন্ত্রের সাথে এর মিল রয়েছে ষোলোআনা, যা এখন রাষ্ট্রবিজ্ঞানে একটি তত্ত্ব হিসেবে পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত। তত্ত্বটি শিক্ষার্থীরা পড়ে থাকে মহানন্দে। এ তত্ত্ব পড়ে অনেকে খুশিতে হয় আত্মহারা। ভবিষ্যতে তারাও যাতে রাষ্ট্রের একজন সভ্য অর্থাৎ আমলা হতে পারে, সে চিন্তায় থাকে দিশেহারা। অভিজাত শাসকগোষ্ঠী দিয়ে দেশ পরিচালনার নীতিই অভিজাততন্ত্র। এটা একধরনের সরকারব্যবস্থা, যেখানে জোর দেয়া হয় অগ্রাধিকার পাওয়া একটি ছোট্ট অভিজাত শাসক শ্রেণীর ওপর। এই অভিজাত শাসক শ্রেণীই দেশ পরিচালনা করত। বাংলা অভিজাত শব্দের ইংরেজি ‘অ্যারিস্টোক্র্যাসি’। ইংরেজি এই শব্দটির আবার উৎপত্তি গ্রিক অ্যারিস্টোক্র্যাটিয়া থেকে, যার অর্থ ‘রুল অব দ্য বেস্ট বর্ন’। আমাদের ভাষায় বলা যায়, ‘যাদের জন্ম বনেদি ঘরে, তাদের শাসন।’ একসময় গ্রিসে গ্রিকরা এই শাসনের ভক্ত-অনুরক্ত ছিল। এর ধারাবাহিকতায় আসে বংশগত উত্তরাধিকার। উত্তরাধিকারের রাজনীতি বর্তমানে এই উপমহাদেশীয় গণতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য, যা প্রবল দাপটে বিদ্যমান। আমরাও রাজনীতিকদের উত্তরাধিকারকে খুব আপনজন ভেবে তোয়াজ করি। দেশবাসী, মানে আমজনতা, মনে করেন ঐক্যের প্রতীক। শাসন বা দলীয় নেতৃত্বে তাদের ধারে-কাছে অন্য কাউকে ভাবি না।

সেই তাদের নিত্য সহচর বড় বড় আমলা। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল। আমলারা রাষ্ট্রের অপরিহার্য উপাদান। ক্ষমতার কাছে থাকায় তারাও ক্ষমতাধর। সাধারণের কাছে সম্মানীয়; অর্থাৎ অভিজাত। এমন একজন অভিজাতকে ‘রোদেলা দিনে’ সাধারণের প্রতিনিধি হয়ে মিজানুর রহমান নামে এক ব্যক্তি সাধ করে খাওয়াতে যান শরবত, মানে ‘শরাবান তহুরা’। প্রাচীনকাল থেকে এখনো আমাদের সমাজে অতিথিকে প্রথমে আপ্যায়ন করা হয় শরবত দিয়ে। গ্রীষ্মের খরতাপে তো কথাই নেই। প্রাণ জুড়াতে শরবতের জুড়ি মেলা ভার। বাংলাপ্রীতির কারণে আমাদের কাছে অতিথি শব্দটি প্রিয় হয়ে উঠেছে। তিথির আগে একটি ‘অ’ দিলে হয় অতিথি। তিথি অর্থ সময়। তাহলে অতিথি হলো অসময়ের সঙ্গী, যা অনাকাক্সিক্ষত। আগেকার দিনে হিন্দুসমাজে বিয়ে অথবা যেকোনো শুভ কাজ শুরু করার আগে তিথি দেখার চল ছিল। আর আমাদের সমাজে মেহমান কাক্সিক্ষত। তাকে আপ্যায়ন করা হয় সানন্দচিত্তে।

মূল কথায় ফিরে আসি। দেশের এক ডাকসাইটে আমলাকে প্রান্তজন মিজানুর রহমান খাওয়াতে চেয়েছিলেন এক গ্লাস শরবত। তার মনোবাঞ্ছা পূরণ হয়নি। ঢাকা ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান ‘অযাচিত আপ্যায়নে’র আহ্বানে সাড়া দেননি। সাড়া না দেয়ায় অনেকে হন মনঃক্ষুণ্ন। তবে এতে মনঃক্ষুণ্ন হওয়ার কিছু নেই। গায়ে পড়ে কোনো ভদ্রলোক, ভুল বললাম- ‘অভিজাত’কে আগবাড়িয়ে আপ্যায়ন করতে যাওয়া অভদ্রতা। এমন মেজবানের আবদার পূরণ করতে গেলে উচ্চপদের মর্যাদা ঠিক থাকে না। পদমর্যাদা হয় ভূলুণ্ঠিত। ‘জাত’ বলে একটি কথা আছে না? তার মতো খানের পক্ষে এভাবে আপ্যায়িত হওয়া শোভন নয়। তিনি পাঞ্জাবি নন, ‘বাঙালি খান’। ইতিহাসে অবশ্য খান, লোদী আর পাঠানদের অতীত সুখকর নয়। মোগলদের সাথে যুদ্ধে হেরে তারা অনেকে ভাটি বাংলায় ডেরা গেড়েছিলেন। অনেকে বিক্রমপুরে আশ্রয় নিয়েছিলেন, এক অর্থে ফেরারি জীবন। তবে তাদের বংশধর অনেকে এখন এ দেশে প্রতিষ্ঠিত। আছেন বহালতবিয়তে।

এই তথ্য উপস্থাপন করে মুচকি হেসে কেউ বলতে পারেন- বখতিয়ার খিলজির বাংলা অভিযানের কথা শুনে রাজা লক্ষণ সেন প্রাসাদের খিড়কি দরজা দিয়ে পালিয়ে বাঁচেন। ঢাকার জুরাইনবাসী মিজানুর যখন শরবত নিয়ে আপ্যায়িত করতে যান, তখন ওয়াসার এমডি তার কার্যালয়ে ছিলেন না। প্রক্সি দেন আরেক পরিচালক। কেন মিজান পরিবার-পরিজন নিয়ে এমন কাণ্ড করলেন, ভেবে পাই না। টিআইবির প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়ায় ওয়াসার এমডি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ঢাকা ওয়াসার পানি ‘শতভাগ বিশুদ্ধ’ ও সুপেয়। এই বক্তব্যকে কথার কথা ধরে নিলেই সব ‘ল্যাঠা’ চুকে যেত। বিষয়টিকে বিবেচনায় নেয়া উচিত ছিল মিজানুরের। আমাদের সমাজে অতি কথন দোষের কিছু মনে করা হয় না। ‘আষাঢ়ের গল্প’ ধরে নিলেই হতো। এ কথাও ঠিক, এটি আষাঢ় মাস নয়। চলছে গ্রীষ্মের তাপদাহ। গরমকালে সবার একটু-আধটু মাথা গরম হতে পারে। তাই কথায় মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। তবে সব সময় অতি কথন ভালো ফল বয়ে আনে না। বছর চল্লিশ আগের একটি গল্প- এক ঘটক কনের বাড়িতে গেছেন মেয়ে দেখাতে পাত্রসমেত। পাত্রীর আত্মীয়স্বজনের কাছে পাত্রের কীর্তি সম্পর্কে দিয়েছেন এক লম্বা ফিরিস্তি। এতে পাত্রীর স্বজনেরা খুশিতে আটখানা। কিন্তু গোল বাধে ঘটকের বাড়তি কথায়। মেয়ে দেখার আগের দিন পাত্রের প্রচণ্ড গরমে ঠাণ্ডাগর্মি লাগায় কাশি বাধে। তবু নির্দিষ্ট দিনে পাত্র আত্মীয়স্বজন নিয়ে যায় পাত্রীর বাড়িতে। পাত্রীর বাড়িতে কাশি শুরু হয় পাত্রের। সবার সামনেই খুক খুক করে কাশে। পাত্রীর মামা জিজ্ঞেস করলেন, কাশি হলো কিভাবে? ঘটক কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বলে বসেন, ‘কাশির দেখেছেন কী, কাশতে কাশতে তো গলা দিয়ে রক্ত ঝরে।’ ঘটকের এমন কথায় পাত্রীপক্ষ বলে, ‘হায় হায় এ তো দেখছি, যক্ষ্মা রোগী। এমন ছেলের সাথে মেয়ে বিয়ে দেবো না।’ চল্লিশ বছর আগে বলা হতো- ‘যার হয় যক্ষ্মা, তার নাই রক্ষা’। কী আর করা, ঘটকের অতি কথনে সে বিয়ে যায় ভেঙে।

আমাদেরও হয়েছে এমন দশা, ‘মানি লোক’ একটু বেশি বলে মান বাঁচালেন কার্যালয় থেকে বাইরে বাইরে ঘুরে। আর মিজান একজন অভিজাতকে খাওয়াতে গেলেন শরবত। তার জানা উচিত, রন্ধনশিল্পী কখনো পেটুক হন না। তিনি অন্যকে খাইয়ে পান অনাবিল আনন্দ। ঢাকাবাসী পর্যাপ্ত পানি পাচ্ছেন, এতেই আমাদের চিত্ত প্রশান্ত হওয়ার কথা। হোক না তা ময়লা-দুর্গন্ধযুক্ত। রাজধানী তো আর পানির হাহাকারে কারবালা হয়ে যায়নি। এক দশক ধরে তাকসিম এ খানের ‘সুযোগ্য’ নেতৃত্বে ঢাকাবাসী পাচ্ছেন চাহিদামতো পানি। এই খেদমতের কোনো দাম কি নেই? তাই বলে ওয়াসার এমডির মতো একজন মহাত্মনকে শরবত পান করাতে আকুতি জানানোবড়ই অনুচিত।
camirhamza@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement
নাটোরে ভ্যানচালককে কুপিয়ে হত্যা হাজীদের জন্য বাড়ি ভাড়া করতে পারছে না বেসরকারি এজেন্সিরা গাজার যে ছবি 'ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো অব দ্য ইয়ার' গুঁড়া চিংড়ির কেজি ১৬০০ টাকা! গাজায় যুদ্ধবিরতি আলোচনায় মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় থাকতে চাইছে না কাতার থামছে না পুঁজিবাজারে পতন বিনিয়োগকারীদের আর্তনাদ ভারতের লোকসভা নির্বাচনে ভোট শুরু: নাগাল্যান্ডে ভোটার উপস্থিতি প্রায় শূন্য কারাগার এখন বিএনপি নেতাকর্মীদের স্থায়ী ঠিকানা: রিজভী আন্দোলনে ব্যর্থ বিএনপির হাল ধরার কেউ নেই : ওবায়দুল কাদের পাবনায় ভারতীয় চিনি বোঝাই ১২টি ট্রাকসহ ২৩ জন আটক স্বচ্ছতার সাথে সরকারি অনুদানের চলচ্চিত্র বাছাই হবে: তথ্য প্রতিমন্ত্রী

সকল