১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪২৯, ০৮ রমজান ১৪৪৫
`

মধ্যপ্রাচ্যের ‘নতুন বসন্ত’ ও শাসন পরিবর্তনের খেলা

মধ্যপ্রাচ্যের ‘নতুন বসন্ত’ ও শাসন পরিবর্তনের খেলা - ছবি : সংগ্রহ

ঠাণ্ডা লড়াইয়ের অবসানের পর শাসন পরিবর্তনে সেনা অভ্যুত্থান কৌশলকে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ‘এক মেরু’ বিশ্বের নেতা যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র ও উদারপন্থা চর্চার ওপর গুরুত্ব দেয়া শুরু করেছিল। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো গণতন্ত্র চর্চা ও মানবাধিকার সংরক্ষণকে উৎসাহিত করাকে তাদের পররাষ্ট্র্র সম্পর্ক নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে নির্ধারণ করে। যুক্তরাষ্ট্রের সামনে বিশ্বকর্তৃত্ব প্রশ্নে চীন-রাশিয়া চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠার পর অপছন্দের সরকার পরিবর্তনের প্রচেষ্টা বারবার ব্যর্থ হয়। এই সাফল্য ও ব্যর্থতা পর্যালোচনার পর পাশ্চাত্য গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ওপর নিজস্ব স্বার্থের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিতে শুরু করেছে।

এ কারণে আবদুল ফাত্তাহ সিসির মতো কট্টর একনায়ক পাশ্চাত্যে ‘আমাদের লোক’ হিসেবে গৃহীত হচ্ছে। সিসি সামরিক অভ্যুত্থান করে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্টকে শুধু ক্ষমতাচ্যুতই করেননি আধুনিক মিসরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় গণহত্যা হয় এই সময়ে। জেনারেল সিসি আগস্ট ২০১৩ সালে কায়রোর রাবা স্কয়ারে এক হাজারেরও বেশি মানুষ হত্যা করেছেন।

সুদানের পরিবর্তনের নানা তাৎপর্য
উত্তর আফ্রিকার অন্যতম বৃহৎ দেশ সুদানে ঘটনার দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। গত সপ্তাহে দেশটির তিন দশক ধরে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট, ওমর আল বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করে একটি সেনা কাউন্সিল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ করে। এর নেতৃত্ব দেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী আউয়াদ ইবনে আউফ। এর একদিন পর জেনারেল আউফকে পদত্যাগে বাধ্য করার পর কাউন্সিলের নেতৃত্ব নেন লে. জেনারেল আবদুল ফাত্তাহ আবদেল রহমান বুরহান। এ সময় জাতীয় নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা প্রধান সালেহ গোশও তার পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন।

জেনারেল ইবনে আউফ ক্ষমতা নেয়ার পর দুই বছরের মধ্যেই নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বলেছিলেন। তিনি দেশের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তিন মাসের জন্য জরুরি অবস্থা এবং রাত্রিকালীন কারফিউ জারির কথাও বলেন। একই সাথে বিক্ষোভ ও গণ-অবস্থানের অবসান ঘটানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু তার কোনোটিই পালিত হয়নি। এরপর পাল্টা অভ্যুত্থানে জেনারেল বুরহান ক্ষমতায় এসে আগের ঘোষণা পাল্টে দেন। তিনি ‘শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত না করার’ শর্তে গণ-অবস্থান অব্যাহত রাখার অনুমতি দিলেন। সেই সাথে আগের ক্ষমতাসীনদের রাষ্ট্রের সব স্থান থেকে উৎখাত, রাত্রিকালীন কারফিউর অবসান, বন্দী রাজনীতিকদের মুক্তি, বিক্ষোভ দমনকালে হত্যার ঘটনার বিচার এবং দুর্নীতি দমনে পদক্ষেপ নেয়ার ঘোষণা দেন।

এরপরও সুদান প্রফেশনালস অ্যাসোসিয়েশন (এসপিএ) তাদের বিক্ষোভ অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে। তারা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনর্গঠন, দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের গ্রেফতার এবং প্রেসিডেন্ট বশিরের আমলে তৈরি করা মিলিশিয়াগুলোকে ভেঙে দেয়ার দাবি জানিয়েছে।

দ্বিতীয় দফা অভ্যুত্থানের পর সেনা কাউন্সিল সেনাবাহিনী ও পুলিশের নতুন প্রধান আর জাতীয় গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা সার্ভিসের (এনআইএসএস) নতুন প্রধানের নাম ঘোষণা করেছে। একই সাথে সাবেক শাসক দলের দুর্নীতি তদন্তের জন্য কমিটি গঠন, বিক্ষোভের সমর্থক হিসেবে গ্রেফতারকৃত পুলিশ ও নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের মুক্তি দান এবং কূটনৈতিক মিশনগুলো পর্যালোচনা করার কথা বলা হয়েছে।

পাল্টা অভ্যুত্থানের পরে এসব পদক্ষেপ ঘোষণার পর সেনা কাউন্সিলের প্রতি সৌদি আরব ও আরব আমিরাত সমর্থন ঘোষণা করেছে। দুই দেশের সেনা প্রতিনিধিদল পাল্টা অভ্যুত্থানের নেতা বুরহানের সাথে সাক্ষাৎ করে এ কথা জানিয়েছেন। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান বলেছেন, পাশ্চাত্য তাদের নিজেদের স্বার্থে সুদানে অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে। আফ্রিকান ইউনিয়ন এবং ইইউ বেসামরিক নেতৃত্বের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বলেছে সেনা কাউন্সিলকে।

সুদানের কথিত ‘আরব বসন্ত’ এবং এর রেশ ধরে অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থানের ঘটনায় শুধু দেশটির ভেতরের ক্ষমতার লড়াই যে সক্রিয় তা নয়, একই সাথে এর সাথে আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র রয়েছে। সুদানে যে পরিস্থিতি দৃশ্যমান হচ্ছে, সেটি এখানকার একমাত্র বাস্তবতা নয়। এর পেছনে অনেক পক্ষের খেলা সক্রিয়। দেশটিতে ওমর আল বশির তিন দশক আগে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিলেন। তিন দশকের রাষ্ট্র পরিচালনায় তিনি সেনাকর্তৃত্ব বজায় রাখার পাশাপাশি একটি বেসামরিক রাজনৈতিক কাঠামো তৈরি করে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। এই কাঠামোর মূল ভিত্তি ছিল ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোর একটি অংশ। মূল ধারার সব ইসলামী দলের সমর্থন তিনি পাননি। যেমন- ড. হাসান তুরাবি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত জেনারেল বশিরের সরকারের বিরোধিতা করে গেছেন। আবার বশিরের দল ন্যাশনাল কংগ্রেস পার্টির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের অনেকের পরিচিতি ছিল ‘ইসলামিস্ট’ হিসেবে।

প্রথম দফা আরব বসন্তের সময় জেনারেল বশিরের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর তাতে প্রধানত নেতৃত্ব দেয় সেকুলার রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি। এ শক্তিটি রাষ্ট্রে একটি সেকুলার গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য এই আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। কিন্তু বশিরের প্রশাসনের পেছনে ইসলামিস্টদের একটি প্রভাবশালী অংশের সমর্থন থাকায় সে অবস্থা বশির সামাল দিতে পেরেছেন। আর তখনকার আঞ্চলিক শক্তিগুলো বিশেষত সৌদি আরব ও আরব আমিরাত বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য সেভাবে সক্রিয় ছিল না।

কিন্তু এর পরে আঞ্চলিক রাজনৈতিক অবস্থার কিছু পরিবর্তনে সৌদি-আমিরাত-মিসর-ইসরাইল অক্ষ সুদানে পরিবর্তন আনার জন্য বিশেষভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে। সুদান এক সময় সৌদি আরবের অনুরোধে দেশটির ইয়েমেন অভিযানে সক্রিয় সহযোগিতা দিয়েছিল। এটি নিয়ে সুদানে নেতিবাচক জনমত সৃষ্টি হওয়ার পর বশির সৌদি আরবের প্রতি সমর্থনকে সীমিত করে ফেলেন। একই সাথে এ অঞ্চলের আরেক প্রভাবশালী পক্ষ তুরস্ক কাতারের সাথে কৌশলগত সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যায়। ইরানের সাথেও এক ধরনের প্রচ্ছন্ন সম্পর্ক সৃষ্টি হতে থাকে সুদানের। আর ভূমিবিরোধ এবং ইথিওপিয়ায় নীল নদের ওপর নির্মিত রেনেসাঁ ড্যাম নিয়ে মিসরের সাথে সম্পর্কের টানাপড়েন বাড়তে থাকে। অন্য দিকে, সুদানকে ভেঙে তৈরি করা খ্রিষ্টান রাষ্ট্র, দক্ষিণ সুদানের পরিস্থিতি অস্থির হয়ে ওঠার কারণে সুদানের স্থিতিশীলতা লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। ফলে সুদানের শাসন পরিবর্তনের ব্যাপারে সৌদি-ইসরাইল-মিসর অক্ষের গোপন সমঝোতা তৈরি হয়। তিন দশক ধরে ক্ষমতায় থাকা এবং গণতন্ত্র চর্চাকে সীমিত রাখার কারণে সুদানে শাসনবিরোধী পেশাজীবী গ্রুপগুলো বেশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এই গ্রুপগুলোকে নেপথ্য সমর্থন দেয়ার মাধ্যমে আরো চাঙ্গা করা হয়।

ওমর আল বশির যে তার সরকারকে উৎখাতের জন্য আন্তর্জাতিক একটি উদ্যোগ এগিয়ে যাচ্ছে, সে সম্পর্কে অবহিত ছিলেন বলে মনে হয়। তিনি সৌদি আরব ও মিসরের সাথে সম্পর্ক উন্নত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু এ চেষ্টা তেমন একটা ফলপ্রসূ হয়নি। এ অক্ষটি আগে থেকেই সুদান ও আলজেরিয়ায় নতুন একটি শক্তিকে ক্ষমতায় নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বশিরের শেষ চেষ্টাটি ছিল, তার বিশ্বাসভাজন কাউকে ক্ষমতায় আনা যায় কি না। এ কারণে প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল আউফের ক্ষমতা গ্রহণের প্রক্রিয়ায় তিনি খুব একটা বাধা দেননি।

আন্তর্জাতিক অক্ষটি এ দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিকে রাজপথে প্রবল দাবি-দাওয়া জানানোর জন্য তৈরি করার পাশাপাশি সুদানের ডিপ স্টেটের মধ্যে নিজস্ব বলয় তৈরির জন্য কাজ করেছে। এ জন্য তারা প্রাথমিকভাবে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা প্রধান সালেহ গোশের সাথে যোগাযোগ গড়ে তোলেন। জার্মানিতে অনুষ্ঠিত এক নিরাপত্তা সম্মেলনে তার সাথে ইসরাইলি গোয়েন্দা প্রধান ও সৌদি-আমিরাতের কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়। কিন্তু বিষয়টি বিস্তারিতভাবে ‘মিডল ইস্ট আই’ ফাঁস করে দেয়ার ফলে শেষ পর্যন্ত জেনারেল গোশকে আর সামনে আনা যায়নি। জেনারেল আউফের সাথে তাকেও পদত্যাগ করতে হয়।

এখনকার সেনা কাউন্সিলের দায়িত্ব গ্রহণকারী জেনারেল বুরহানের সাথে কোনো ধরনের ইসলামিক যোগসূত্রতা নেই। সৌদি-আমিরাত অক্ষ শক্তিটি তাকে আরেক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সামনে নিয়ে এসেছে বলে ধারণা করা হয়। এখন বুরহানকে দিয়ে চেষ্টা করা হতে পারে সুদানি নিরাপত্তা বাহিনীতে ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের ইসলামিস্টদের যে প্রভাব রয়েছে, সেটাকে মুছে দিয়ে সেকুলারদের সামনে নিয়ে আসার জন্য।

বিক্ষোভে নেতৃত্বদানকারী সুদানি প্রফেশনালস ইউনিয়ন যে দাবি জানাচ্ছে সেটি মূলত সুদানি সেনাবাহিনী থেকে ইসলামিস্টদের প্রভাব দুর্বল করার জন্যই। দৃশ্যপটের সামনে সৌদি আরব ও আমিরাতকে দিয়ে এবং পেছনে থেকে মিসর ও ইসরাইল জেনারেল বুরহানকে আর্থিক ও অন্যান্য সহায়তা দিয়ে মিসরের সিসি মার্কা একটি ভূমিকার দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারে। মিসরে মুরসির গণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটানোর জন্য তাহরির স্কোয়ারে যেভাবে সেকুলারিস্টদের নামানো হয়েছিল, তার মতো একটি আয়োজন এখন চলছে সুদানে। এতে দৃশ্যত অর্থনৈতিক মুক্তি, গণতন্ত্র, বৈষম্যের অবসান, রুটি-রুজির অধিকার প্রভৃতি জনপ্রিয় বিষয়গুলোকে সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। কিন্তু অন্তরালের এজেন্ডা হলো, সুদানকে তুরস্ক-কাতারের প্রভাবের বাইরে এনে সেখানে সৌদি-আমিরাত-মিসর-ইসরাইলের অনুগত একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করা। সৌদি আরব প্রকাশ্যে জেনারেল বুরহানের সেনা কাউন্সিলকে সমর্থন করেছে।

এই উদ্যোগের কম ক্ষতিকর দৃশ্যপটটি হতে পারে এমন- জেনারেল বুরহান প্রফেশনালস অ্যাসোসিয়েশনের বিক্ষোভকারীদের সাথে আলোচনা করে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা করবেন, যার অধীনে যথাশিগগির নির্বাচনের আয়োজন করা হবে। এর আগে প্রশাসনের সর্বস্তর থেকে সাবেক শাসক দলের প্রভাব মুছে দেয়ার নামে ইসলামিস্টদের যথাসম্ভব নিষ্ক্রিয় বা ক্ষমতাহীন করা হবে। এরপর নির্বাচনে তিউনিসিয়ার মতো একটি সেকুলার গ্রুপ ক্ষমতায় আসবে। এই সরকারের ওপর পাশ্চাত্য এবং আঞ্চলিকভাবে সৌদি-আমিরাত-ইসরাইলের প্রভাব কার্যকর থাকবে।

আর বাজে দৃশ্যপটটি হতে পারে লিবিয়া বা সিরিয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়া। দেশের নিরাপত্তা বাহিনী এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিকে প্রতিদ্বন্দ্বী দু’টি গোষ্ঠীতে বিভক্ত করে দুই পক্ষের মধ্যে গৃহবিবাদ লাগিয়ে দেয়া হলে দেশটির অখণ্ডতা ও রাষ্ট্রিক অস্তিত্ব বিপন্ন হতে পারে।

তৃতীয় আরেকটি সম্ভাবনা হতে পারে যে, সিসির মতো একজন শক্তিমান জেনারেলকে সমর্থন দিয়ে সেখানে নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের শাসন চালু করা। সৌদি-আমিরাত এ ধরনের শাসনকে অধিক অনুকূল বলে বিবেচনা করে। এটি হলে মিসরে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারী প্রায় সব নেতাই যেভাবে নির্বাসনে অথবা জেলে অন্তরীণ রয়েছেন তেমন একটা অবস্থা সুদানেও সৃষ্টি হতে পারে। এ পরিস্থিতিতে মিসরের মতো সামরিক একনায়কতন্ত্রের সাথে ইসলামিস্টদের সঙ্ঘাত চলবে আর গণতান্ত্রিক সেকুলাররা সুখস্বপ্নে বিভোর থাকতে থাকতে এক সময় দৃশ্যপটের বাইরে চলে যাবে।

আলজেরিয়ার পরিস্থিতি
সুদানে এখন যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তার সাথে লিবিয়া ও আলজেরিয়ার পরিস্থিতির একটি সম্পর্ক রয়েছে। গণতান্ত্রিক ও সামাজিক শক্তিকে উসকে দিয়ে আলজেরিয়ার বুতেফ্লিকার অকার্যকর হয়ে পড়া শাসনের পরিবর্তে এমন আরেকটি শাসকবলয়কে নিয়ে আসা হচ্ছে- যেখানে প্রশাসনে ইসলামিস্টদের খুব একটা ভূমিকা থাকবে না। এর জন্য ফ্রান্স-সৌদি-ইসরাইল অক্ষের একটি নেপথ্য সমঝোতা হয়তো বা তৈরি হবে। আর যদি ভালো কোনো কিছু হয়, সেটি হতে পারে তিউনিসিয়ার মতো একটি উন্নয়ন- যেখানে সেনাবাহিনীর প্রচ্ছন্ন সমর্থনে সেকুলারিস্টরা রাষ্ট্র চালাবেন। তবে ইসলামিস্টদের সহাবস্থানকে মেনে নেয়া হবে। আলজেরিয়ায় বুতেফ্লিকার পতনের পর রাজপথে যে যত দাবিই করুক, সেনাবাহিনী ও অন্যান্য ডিপ স্টেট যাদের যেভাবে ক্ষমতায় চাইবে তারা সেভাবেই থাকবে। আলজেরিয়ার সেনাবাহিনী ইসলামিস্টদের ব্যাপারে কতটা নির্মম হতে পারে, তার নজির নিকট অতীতে দশককাল ধরে চলা ইসলামিস্ট-বিরোধী অভিযান। রাজপথে বিক্ষোভকারীদের ক্লান্ত করার জন্য কিছুটা সময় হয়তো সেখানে নেয়া হচ্ছে।

হাফতার লিবিয়ার সিসি
এর মধ্যে লিবিয়ায় খলিফা হাফতার বাহিনীকে অস্ত্রে সজ্জিত করে ত্রিপোলি দখল অভিযানে নামানো হয়েছে পুরো অঞ্চলের ওপর সৌদি-ইসরাইল অক্ষ শক্তির প্রভাব বিস্তারের জন্য। লিবীয় তেলের ওপর কর্তৃত্ব নেয়ার প্রতিযোগিতায় ফ্রান্স ও ইতালি গোপন সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে হাফতারকে। সিআইএ’র অতি ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত হাফতার তার সর্বশেষ অভিযান শুরু করার আগে মিসরের জেনারেল সিসির সাথে দীর্ঘ বৈঠক করেছেন। সৌদি আরব হাফতারকে সহায়তা দেয়ার বিষয় প্রকাশ্যে স্বীকার করেছে।

লিবিয়া ছিল এ অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে তেলসমৃদ্ধ দেশ। গাদ্দাফি এই তেলসম্পদকে নিজের জন্য কাজে লাগানোর পাশাপাশি দেশের ও জনগণের উন্নয়নের কাজে লাগিয়েছেন। আর এখন দেশটিতে গৃহযুদ্ধ লাগিয়ে দিয়ে লুটপাটের আয়োজন হচ্ছে। হাফতার সেই আয়োজনের সহযোগীর ভূমিকা রাখতে রাজি হওয়ায় তাকে মদদ দেয়া হচ্ছে। লিবিয়ায় ত্রিপোলির সরকারকে বলা হচ্ছে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বৈধ সরকার। কিন্তু এই সরকারকে ভেতর থেকে দুর্বল করার জন্য কাজ করা হয়েছে সন্তর্পণে। হাফতারকে জেতানো গেলে সিসির মতো পাশ্চাত্যের আরেকজন ‘আমাদের লোক’ লিবিয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ দেশের নিয়ন্ত্রণ লাভ করবে।

আরব বসন্তের নতুন তরঙ্গ?
প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ এল সিসির প্রভাবিত মিসরীয় সংসদীয় আইন পরিষদ তাকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার জন্য সংবিধানের সংশোধনী অনুমোদন করেছে। ইসলামপন্থী থেকে ধর্মনিরপেক্ষ প্রায় সব রাজনৈতিক দল বুঝতে পেরেছে, মিসরে এ অবস্থা চলতে পারে না। আরব বসন্তের নতুন তরঙ্গ সফল হলে এর প্রভাব পড়বে মিসরে। দেশটিতে অর্থনীতির যে অবস্থা, তা বিস্ফোরণোন্মুখ। সেখানে মধ্যবিত্ত শ্রেণী ক্রমেই দারিদ্র্য চক্রে প্রবেশ করছে। দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী মোট জনসংখ্যার এখন ৩০ শতাংশ। এমনকি, এদের একটি অংশ কায়রোর কবরস্থানের অপরিসর ঘরে বসবাস করে।
দেশটির বাজেটের এক-তৃতীয়াংশ এখন চলে যাচ্ছে ঋণের সুদ পরিশোধ করার জন্য। সিসির মতো একনায়কেরা হত্যা ও দমন করতে পারে, কিন্তু তারা ক্ষমতার জন্য অযোগ্য বলে প্রমাণ হয়েছে মিসরে। প্রতিটি সূচক বিবেচনায় মিসর আজ জনবিক্ষোভের আশঙ্কার দিক থেকে ২০১১ সালের চেয়ে বেশি ভঙ্গুর। এই মিসরেই আরব বসন্তের প্রথম তরঙ্গকে বিচূর্ণ করে দেয়া হয়েছিল। আর একনায়কতন্ত্রের মৃত্যুর তালিকায় মিসরের সিরিয়াল আসার সম্ভাবনা খুব বেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে।

খেলা চ্যালেঞ্জমুক্ত হবে না
আলজেরিয়া, সুদান ও লিবিয়ায় চলমান পরিকল্পনা সফল হলে সৌদি-আমিরাতের প্রভাব উত্তর আফ্রিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়বে। তবে এ দু’টি দেশকে সামনে রেখে আঞ্চলিক নিয়ন্ত্রণ নেবে ইসরাইল। এর মধ্যে দেশটি জেরুসালেমকে নিজের রাজধানী হিসেবে আইন পাস করে যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতি নিয়েছে। গোলান মালভূমির ওপর ইসরাইলের সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করা হয়েছে। পরের লক্ষ্য যে ‘পশ্চিম তীর’ হবে, সেটি নেতানিয়াহু নির্বাচনে জয়ী হওয়ার আগে ও পরে বলেছেন। এরপর গাজা ও সিনাইয়ের দিকে নজর দিয়ে বৃহত্তর ইসরাইল গঠনের দিকে এগিয়ে যাবেন বারবার প্রধানমন্ত্রী হওয়া নেতানিয়াহু। তাদের এসব পদক্ষেপে আঞ্চলিক আরব দেশগুলো বিরোধিতা করছে। কিন্তু এই বিরোধিতা যতটা কার্যকর, তার চেয়ে বড় কথা, নিজ দেশের জনগণকে আশ্বস্ত করতে এটা করা হচ্ছে।

তবে এই খেলা একেবারে চ্যালেঞ্জমুক্ত হবে না। কারণ এই অঞ্চলে তুরস্ক, কাতার এবং ইরান চুপ করে বসে থাকবে বলে মনে হয় না। ‘মাগরেব’ ও সন্নিহিত অঞ্চল প্রতিপক্ষের প্রভাব বলয়ে চলে গেলে তাদের বড় ধরনের কৌশলগত বিপত্তি ঘটবে। এ কারণে দু’টি পক্ষই যার যার অবস্থান থেকে সক্রিয় হতে পারে। এ ক্ষেত্রে রাশিয়া ও চীন দৃশ্যপটে প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে আবির্ভূত হতে পারে। এমনকি আইএস বা আলকায়েদার মতো শক্তিকেও এখানে সক্রিয় দেখা যেতে পারে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন।

পুরনো আরব বসন্তের মতো নতুন বসন্তও উত্তর আফ্রিকা বা পশ্চিম এশিয়ায় কী পরিণতি নিয়ে আসে তা নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার বেশ কারণ রয়েছে। বাস্তবেই যদি এ অঞ্চলটি বহুপক্ষীয় নানা শক্তির ক্ষমতা বা প্রভাববলয় বিস্তারের ক্ষেত্রে হয়ে ওঠে, তাহলে পুরো অঞ্চলে এমন এক অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে- যার প্রভাব থেকে ইউরোপও মুক্ত থাকতে পারবে না। পুরো অঞ্চল অস্থির ও উত্তপ্ত হবে। এর বিপদ থেকে বাঁচতে সব শক্তির দায়িত্ববান ভূমিকায় আসার কোনো বিকল্প নেই।
mrkmmb@gmail.com

 


আরো সংবাদ



premium cement