২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

একটি ‘মতলবি’ সাক্ষাৎকার

একটি ‘মতলবি’ সাক্ষাৎকার - ছবি : সংগ্রহ

আজকাল ‘বিকল্প’ কথাটি সবার মুখে মুখে শোনা যায়। অনেকে বলে খানিক তৃপ্তিও বোধ করেন। ফলে লোকমুখে দ্রুত প্রসার ঘটেছে শব্দটির। দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে গত শতকের আশির দশকে বিকল্প ট্যাক্সি চালু করা হয়। তখন থেকেই মূলত আমাদের সমাজে একটু একটু করে শব্দটি পরিচিত হয়ে ওঠে। আর এখন তা তুমুল জনপ্রিয়। দুঃখের কথা হলো, বিকল্প ট্যাক্সি প্রকল্পটি সফল হয়নি। যায় মাঠে মারা।
রাজনীতি, গণমাধ্যম, শিল্প-সাহিত্য, চলচ্চিত্রে কোথায় নেই ‘বিকল্পধারা’? তবে রাজনীতি ও মিডিয়ায় ‘বিকল্প’ কথাটি বহুল উচ্চারিত একটি শব্দ। শূন্য দশকে ২০০৪ সালে ‘বিকল্পধারা’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠিত হয়। এত বছর পরেও দেশীয় রাজনীতিতে ‘সাবালক’ হয়ে উঠতে পারেনি দলটি। বড় দুই দলের বাইরে বিকল্প হওয়া তো দূরের কথা, এ দল ঘোষণার পর প্রথম রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে ওই সময়ের শাসক দলের নেতাকর্মীর ধাওয়া খেয়ে মহাখালী রেলগেটে খ্যাতনামা এক চিকিৎসকের অসহায়ভাবে দৌড়ানোর দৃশ্য সবার হৃদয়ে ঝড় তোলে। এমন কর্মকাণ্ডে তখন ক্ষমতাসীন দল হয় ব্যাপকভাবে সমালোচিত।

অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করে তো আর দিন চলবে না। এক সময় চলচ্চিত্রে বিকল্পধারা বেশ জনপ্রিয় ছিল। শর্টফিল্ম বা স্বল্পদৈর্ঘ্য, অর্থাৎ ছোট ছবি দেখার হিড়িক পড়েছিল। শর্টফিল্মের আগের সেই অবস্থা আর নেই। ‘কুটি’ ছবি নির্মাণের প্রবণতা গেছে থিতিয়ে। নির্মাতাদের আবেগে ভাটার টান পড়েছে। এখন মিডিয়ায় বিকল্প ধারা প্রভাব ফেলেছে তীব্রভাবে। বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়া। এটা শক্তিশালী বিকল্প গণমাধ্যম। জুলিয়ান অ্যাস্যাঞ্জ উইকিলিকসে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের গুরুত্বপূর্ণ সব গোপন নথি ফাঁস করে আসেন পাদপ্রতীপের আলোয়। দুনিয়াব্যাপী তোলেন ঝড়। সেই ঝড়ের আঘাত লাগে মার্কিন মুলুকে; একেবারে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতার ভিত্তিভূমিতে; সোজা হোয়াইট হাউজে। মূলধারার মিডিয়ায় ধরে কাঁপন। পরিণতিতে অ্যাস্যাঞ্জের সময় কাটে চার দেয়ালের মাঝে। লন্ডনে ইকুয়েডর দূতাবাসে। তখন থেকে গণমাধ্যমে ‘বিকল্প’ শব্দটি বেশ তাজিমের সাথে হয় উচ্চারিত। তবে মজার ব্যাপার হলো- দেশে অন্যান্য ক্ষেত্রে বিকল্প ধারা আপাতত মার খেলেও মিডিয়ায় এর বাড়বাড়ন্ত।

এখন টুইটার, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদি তুমুল জনপ্রিয়। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মাঝে মাঝে দেখা যায় সব তেলেসমাতি কাণ্ড। অনেক সময় সোশ্যাল মিডিয়া হয়ে ওঠে ‘গুজবের কারখানা’। অন্যের চরিত্র হননের যেন এক যুতসই হাতিয়ার। সম্প্রতি ইউটিউবে আপলোড করা সাক্ষাৎকারভিত্তিক ভিডিও ফুটেজ নিয়ে হয়েছে শোরগোল। যাকে বলে ক্যায়োটিক সিচুয়েশন। আপলোড আর পাল্টা আপলোড এবং ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রতিযোগিতা। দেখেশুনে মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়, এ যেন গ্রামীণ পালাগানের আধুনিক সংস্করণ। পালাগানে দুই শিল্পী মনের মাধুরী মিশিয়ে উভয়ের বক্তব্য গানে গানে খণ্ডনের করেন প্রাণপণ চেষ্টা। আর ‘নেটিজান’রা করে থাকেন ফেসবুকে স্ট্যাটাস আর ইউটিউবে ভিডিও ফুটেজের অ্যাটাক এবং কাউন্টার অ্যাটাক। এমন ‘কাজিয়া’ দেখে সাধারণত আমরা আমোদিত। কারণ এটা আমাদের নিরানন্দ জীবনে আনে ফুর্তি। অনাকাক্সিক্ষত প্রাপ্তিতে হই আহ্লাদিত। কয়েক দিন এই নির্মল আনন্দ বিতরণের কারিগর ছিলেন অভিনেতা এবং টিভি উপস্থাপক শাহরিয়ার নাজিম জয়। শতভাগ কৃতিত্বের দাবিদার তিনি। তাকে জানাই অভিনন্দন। এমন বৈচিত্র্যময় কাজের জন্য দিচ্ছি বাহবা! বড় হওয়ায় ‘বেয়াদবি’ হবে বলে, পিঠ চাপড়ে উৎসাহিত করা গেল না। মাত্রাজ্ঞান বলে একটি কথা আছে না? হাজার হোক তিনি একজন সম্মানিত টিভি উপস্থাপক। একই সাথে মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী। সমাজের কাছে তার একটা সম্মান আছে বৈকি।

তবে জয়ের এই কাজে গোসসা করেছেন অনেকে। ক্ষেপেছেন বহুজনে। বিপুলসংখ্যক নেটিজান বকেছেন আচ্ছামতো। জুড়িয়েছেন মনের জ্বালা। তাদের তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠার দরকার কেন পড়ল, তার আগামাথা কিছুই গেল না বোঝা। তারা তো বলতে পারতেন, বেগুনের গুণ খুঁজে দরকার কী, বাবা? নিজের আলো না থাকায় অন্যের আলোয় হতে চান আলোকিত। প্রাসঙ্গিক হোক আর না হোক, অন্যের সম্মানহানিতে জুড়ি মেলা ভার। এসব না বলে, উল্টো বলছেন, জয় ‘ব্যর্থ’ অভিনেতা। ব্যর্থতার গ্লানি ঢাকতে উপস্থাপনার জগতে তার পা রাখা। অনুষ্ঠানে বলেন উল্টাপাল্টা কথা। বেকায়দায় পড়লে বয়ান করেন দুঃখকথা। জয়ের বিরুদ্ধে নেটিজান অনেকে আকথা-কুকথা বলে মেটাচ্ছেন মনের জ্বালা। এতে জয় হয়ে পড়েছেন দিশেহারা। অথচ কেউ আমলে নিলেন না তার সংবেদনশীল মনের ব্যাকুলতা। দেখলেন না দিলের ব্যথা। তা নিয়ে কারো নেই মাথাব্যথা। দিলে চোট লাগায় হৃদয়ে রক্তক্ষরণে তাকে হতে হচ্ছে ‘জর্জর’। বারবার কৈফিয়ত দিতে আসতে হচ্ছে ইউটিউব চ্যানেল আর ফেসবুকে। দর্শকদের কাঠড়ায় দাঁড়ান বেলা-অবেলা। কেউ বুঝুন আর না বুঝুন, এটি তার এক ধরনের ‘স্বচ্ছতা’! এ দিকে তার আত্মপক্ষ সমর্থনে পেরেশান দেখে অনেকেরই ঢাকাই মুভি আনারকলির একটি গান মনে পড়ে যেতে পারে- ‘হায়রে আমার বদনসিবি/ উঠেছি নিলামে রে, উঠেছি নিলামে/ কেউ আমারে কিনলো না তো ভালোবাসার দামে রে।’ এটি জয়ের জন্য বদনসিবই বটে। এমন কাজে মেলার কথা প্রশংসার ফুলঝুরি। উল্টো, মনঃপূত না হওয়ায় জুটছে বকাঝকা!

শাহরিয়ার নাজিম জয়কে বিপাকে ফেলার কারিগর সাংবাদিক আমিরুল মোমেনীন মানিক। তিনি কেন যে ‘অবজেকটিভ জার্নালিজম’ করতে গেলেন। তাতেই বেধেছে গোল। ফলে সাক্ষাৎকারটি হয়ে পড়ে বিতর্কিত। উপস্থাপক জয়ও পড়ে যান মাইনকার চিপায়। জয়ের বেহাল দশায় দুর্জনেরা গুনগুনিয়ে গাইছেন হায়দার হোসেনের ঢাকাইয়া ভাষায় রচিত, জনপ্রিয় গান- ‘আমি ফাঁইসা গেছি মাইনকার চিপায়/ আমারো দিলের চোট বোঝে না কোনো হালায়।’

ফিরে দেখা : নাঈম ইসলাম এক বীরত্বগাথার নাম। গুলশান কড়াইল বস্তির ১০ বছর বয়সের এ শিশুর নামের সাথে যোগ হয়েছে ‘শিশু স্পাইডারম্যান’, ‘খুদে হিরো’, ‘পাইপ বয়’ উপাধি। ঢাকার বনানী এফ আর টাওয়ারে আগুন নেভানোর সময় ফায়ার সার্ভিসের ফুটো হয়ে যাওয়া পাইপ চেপে ধরে রেখে নাঈম যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে; তাতে সে সবার চোখে ‘হিরো’। নাঈমের বীরত্বগাথার গল্প নিয়ে দেশ-বিদেশে যখন চলছিল উচ্ছ্বাস হইচই; অভিযোগ, সেই উচ্ছ্বাসের আলোর ঝলকানিতে অভিনেতা শাহরিয়ার নাজিম জয় ‘ময়লা’ ছিটিয়ে কালিমা লেপনের চেষ্টা করেন। জয়ের বিরুদ্ধে অনেকের অভিযোগ, কোনো গোষ্ঠীকে খুশি করে কিছু পাওয়ার খায়েশে সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক চিন্তা থেকে অবুঝ শিশু নাঈমের অর্জন ভূলুণ্ঠিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। দেশের এ দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে নাঈমের মতো শিশুরা যখন দায়িত্ববোধের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বড়দের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে অনুসরণীয়-অনুকরণীয় হচ্ছে; তখন উপস্থাপক জয় ‘মতলবি’ সাক্ষাৎকার নিলেন নাঈমের। এতে শিশুটির বিরাট অর্জন সাময়িক মেঘে ঢাকা পড়ে। তবে পরক্ষণেই তা গেছে কেটে।

২৮ মার্চ বনানীর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে শিশু নাঈমের অসাধারণ ভূমিকায় মুগ্ধ হয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ওমর ফারুক সামি তাকে পাঁচ হাজার ডলার অনুদান দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে শাহরিয়ার নাজিম জয় তার এক সাক্ষাৎকার নিলে সেখানে সেই অর্থ নিজে না নিয়ে নাইম ‘এতিমখানার শিশুদের দান’ করতে চায় বলে জানায়। তার এ সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণ, বেগম খালেদা জিয়া কয়েক বছর আগে ‘এতিমদের টাকা মেরে খেয়েছেন’, তাই। তারপর সাংবাদিক আমিরুল মোমেনীন মানিকের কাছে দেয়া সাক্ষাৎকারে শিশুটি জানায়, নিজের পড়ালেখার জন্য সে অর্থসাহায্য চায়। জয়ের সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানে উল্লিখিত তার এতিমখানায় অর্থদান করার বিষয়টি আগে থেকেই তাকে শিখিয়ে দেয়া হয়েছিল বলে জানায়। এ ঘটনার পর জয়ের ভূমিকা হয়ে পড়ে মারাত্মক প্রশ্নবিদ্ধ। তাকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াসহ সবখানে সমালোচনা শুরু হয়। ২ এপ্রিল শাহরিয়ার নাজিম জয় এক ভিডিও বার্তায় জানান, নাঈমকে তিনি কোনো কথা শিখিয়ে দেননি। শিশুটি যে বক্তব্য দিয়েছে, তা সে কোথা থেকে শিখে এসেছে, তা তিনি জানেন না।’ পরে ফের শিশুটি এবং তার মায়ের আরেকটি সাক্ষাৎকার নেন জয়। সেখানে শিশুটিসহ তার মাকে দিয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা চালিয়েছেন। তবে তার সেই ‘খুচরা চালাকি’ মাঠে মারা গেছে বলেই অনেকে কণ্ঠ উঁচিয়ে বলছেন।

২০১৭ সালের ১৮ ডিসেম্বর। রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আড়ানি স্টেশনের পূর্বে ঝিনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণীর ছাত্র শিহাব ও দ্বিতীয় শ্রেণীর লিটন উপস্থিত বুদ্ধিতে একটি ট্রেনের দুর্ঘটনা ঠেকিয়েছিল। বিচ্ছিন্ন রেল সেতুর সামনে দাঁড়িয়ে দুই শিশুর লাল জামা ওঠানোয় ট্রেনের ইঞ্জিনসহ ৩১টি ওয়াগন দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পায় সেদিন। ওই দুই শিশু ঠিকমতো গুছিয়ে কথাও বলতে পারত না। দেশ-বিদেশে শিহাব-লিটনকে নিয়ে বীরত্বের কাহিনী লেখা হয়। এর আগে কুমিল্লায় এক শিশু দুর্ঘটনা থেকে ট্রেনের শত শত যাত্রীকে রক্ষা করে অকুণ্ঠ প্রশংসা কুড়ায়। তেমনি বীরত্বের ঘটনা ঘটিয়েছে ২৮ মার্চ বনানীর অগ্নিকাণ্ডের সময় বস্তিবাসী নাঈম। সাক্ষৎকার নিয়ে তার সেই অর্জনে ভাগ বসাতে চেয়েছিলেন কেউ। নিজের আলো না থাকলে কী আর করা। অন্যের কাছে থেকে ধার নেয়া; চাঁদ যেমন সূর্যের আলোয় আলোকিত। এই আর কী।
camirhamza@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement