২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সঙ্কটময় সময়

সঙ্কটময় সময় - ছবি : সংগ্রহ

সঙ্ঘাত, সংঘর্ষ ও সঙ্কট একসূত্রে গাঁথা এবং সময়কে জড়িয়ে থাকে নানা আঙ্গিকে। বহু কারণের মধ্যে একটি প্রধান কারণ, এর নিয়ন্ত্রক এবং শিকার উভয়েই কোনো না কোনো সময়ে এসব ঘটনার উৎসাহী সঙ্গী হয়ে থাকে।

অনুসন্ধানীরা চেষ্টা করেছেন কারণ নির্ণয় করতে। কিন্তু প্রতিদিন অবস্থার বহুমাত্রিকতা তাদের কোনো স্থির লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করেনি। একজন অনুসন্ধানী একটি চমৎকার স্বগোক্তি করেছেন। তিনি প্রশ্ন করেছেন, সঙ্ঘাত-সঙ্কটহীন সময় কি কখনো ছিল?

বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে মানব ইতিহাসে দৃকপাত করে বলেছেন, ‘যখন দল, গোষ্ঠী, মতবাদ বা ধর্মীয় উপস্থিতি ছিল না, তখন সম্ভবত মানুষ সবচেয়ে সুখী ছিল।’ কারণ তারা যা পেত তাতেই সন্তুষ্ট থাকত। যখন দল ও গোষ্ঠী সৃষ্টি হলো তখন স্বার্থ এবং অধিকারের প্রশ্ন এলো। তখনই সঙ্ঘাত এবং সংঘর্ষের জন্ম হলো এবং তার আর শেষ হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
এর কারণ বহুমাত্রিক হলেও, একটি প্রধান কারণ মানুষের ক্ষমতা এবং অর্থের মোহ। আসলে অর্থও অনেকাংশে গৌণ, কেননা এই বিষয়টি মানুষের তৈরি। ক্ষমতার বিষয়টি মানুষের অঙ্গাঙ্গি কর্মকাণ্ড। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এর গতি অপ্রতিরোধ্য।

কেন অপ্রতিরোধ্য? জবাব সাধারণভাবে দিলে বলতে হবে, মানুষ তার প্রয়োজন মেটাতে গিয়েই বুঝতে পারে, তাকে তার আরব্ধ বস্তু পেতে শক্তি ব্যয় করতে হবে। তখন থেকেই তার অজান্তেই মানুষ ক্ষমতার দাস এবং পূজারী হয়ে পড়ে। ‘একচ্ছত্র ক্ষমতা’ বলে যা বলা হয়, তার বাস্তবতা ঠিক নয়। ক্ষমতা ভাগ করে নিতেই হয় তা ব্যবহার করতে হলে। যেমন, একজন ক্ষমতাধর বলে পরিচিত হয় ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ তার সহকর্মী বা অনুরাগী তাকে সাহায্য করে। অর্থাৎ তিনি তাদের ছাড়া ক্ষমতাধর নন।
এখন ক্ষমতা ধরে রাখতে হলে কী করতে হবে? এখানে বিজ্ঞানী নিউটনের তৃতীয় সূত্র স্মরণ করা যায়। যেমন ‘প্রতিটি কর্মকাণ্ডের প্রতিফল একই হয় (টু এভরি অ্যাকশন দেয়ার ইজ ইকুয়াল অ্যান্ড অপজিট রি-অ্যাকশন)। এটি অপূর্বভাবে ঘটে চলেছে।

সময় কি সঙ্কটময় ছিল সব সময়? এর জবাব ও সহজ এবং একটি। তা হলো ‘হ্যাঁ’। তবে তার আচার-গভীরতা-বিস্তৃতি ভিন্ন। মানুষ সময়কে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে বারবার এই সঙ্কট সৃষ্টি করে নিজেই এর শিকার হয়েছে। এই বৃত্ত থেকে কখনোই বের হতে পারেনি। এই সঙ্ঘাত-সঙ্কট সৃষ্টিকারীরা কখনোই নিজেদের দায়ী করে না। অনেককে দায়ী করার পর যখন বুঝতে পারে, তাদের বক্তব্য গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না, তখন তারা ধর্মকে দায়ী করে থাকে। অথচ বিশ্বের কোনো ধর্মই হত্যা-সঙ্ঘাত-সংঘর্ষকে উৎসাহ দেয় না।
এটা সত্য, ধর্ম অনাচার-অবিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে উৎসাহ দেয়। ধর্ম শুধু নিজেকে আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে শক্তির ব্যবহার করতে বলে। অথচ ধর্মবিরোধীরা অনেক বিশাল সঙ্ঘাত-সংঘর্ষের জন্য ধর্মকে দায়ী করে। এভাবে পায়ে পায়ে বর্তমানে এসে পড়েছে সময়।

বর্তমান সময়কে বলা হয় প্রযুক্তির সময়। কেননা, সব বিষয় এখন প্রযুক্তিনির্ভর। এমনকি মানুষে-মানুষে সম্পর্কও নির্ণয় করছে প্রযুক্তি। ফলে এই বিষয়গুলো ক্রমে জটিল হয়ে পড়ছে। অথচ জটিলতাহীন সম্পর্ক মানবসমাজে সর্বদাই শান্তি রক্ষা করেছে। ক্ষমতা এবং শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করার নানা চেষ্টা চলেছে মানব সৃষ্টির সময় থেকেই; যেমন হাবিল-কাবিলের ঘটনা।

এখন প্রযুক্তি এই কাজটি অনেক সহজ করে দিয়েছে।
এর একটি চমৎকার বিশ্লেষণ দিয়েছে ‘গ্লোবাল জাস্টিস নাও’ (জিযেএন) নামের এক সংস্থা। তারা দেখিয়েছেন, কিছু বাণিজ্য সংস্থা (করপোরেশন) বহু দেশকে পেছনে ফেলে দিয়েছে সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে। কেবল ৯টি দেশকে এরা পেছনে ফেলতে পারেনি। এ দেশগুলো হলো (সম্পদের ক্রমানুসারে) যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, জার্মানি, ফ্রান্স, ব্রিটেন, ইতালি, ব্রাজিল ও কানাডা।

এর পরই তালিকায় বাণিজ্য সংস্থা এসেছে ওয়ালমার্ট। তার পরে এসেছে স্পেন, অস্ট্রেলিয়া। এরপর বাণিজ্য সংস্থা টেট গ্রিড। গ্লোবাল জাস্টিসের হিসাব সম্পদের ওপর। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদের পরিমাণ বলা হয়েছে ৩৩৩,৬০০০,০০০,০০০ ডলার। চীনের-২৫৯১,০০০,০০০,০০০ ডলার। ওয়ালমার্টের ৫০০,৩৪৩,০০০,০০০ ডলার।

বাংলাদেশ ২৭,০৮০,০০০,০০০ ডলার সম্পদ নিয়ে এই ৭২৩টি সংস্থা ও রাষ্ট্রের মধ্যে ৫০০তম স্থানে। ভারত ২২৯,৩০০,০০০,০০০ ডলার সম্পদ নিয়ে ২৮তম। পাকিস্তান ৪৫,৬৪০,০০০,০০০ ডলার সম্পদ নিয়ে ২৮৯তম স্থানে রয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত ভিয়েতনাম ৪৯,২৩০,০০০,০০০ ডলার সম্পদ নিয়ে ২৬০তম স্থানে রয়েছে। জিযেএন বলেছে, বিশ্বের ১০০টি সম্পদ অধিকারীর মধ্যে ৬৯টিই করপোরেশন, যার শীর্ষে রয়েছে ওয়ালমার্ট (দশম স্থান)। প্রথম ১০টি করপোরেশনের সম্পদের পরিমাণ তিন ট্রিলিয়ন ডলার। যেমন রাশিয়া, বেলজিয়াম এবং সুইডেনের চেয়ে ওয়ালমার্ট, অ্যাপল এবং শেল করপোরেশন অনেক বেশি ধনী। জিযেএনের ডাইরেক্টর নিক ডিয়ারডেন এই সম্পদের রিপোর্ট প্রকাশের পর মন্তব্য করেছেন ‘করপোরেশনগুলোর এই সম্পদ বিশ্বের অনেক সমস্যার মূলে’। যেমন, আবহাওয়ার পরিবর্তন এবং মানুষে মানুষে অসমতা। জনগণ, এমনকি বহু সরকার এবং দেশ এই করপোরেশনগুলোর হিসাব নেয়ার ‘অধিকার রাখে না’ বলে তিনি মন্তব্য করেছেন।

ব্রিটেন যুক্তরাষ্ট্র প্রধানত তাদের ট্যাক্স আইন ইত্যাদির সাহায্যে এসব করপোরেশনকে এমন সম্পদের অধিকারী হতে সাহায্য করেছে বলে নিক উল্লেখ করেন। এখন এই করপোরেশনগুলো রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের একাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে বলে তারা বলেছে। তারা ব্রিটেনকে অনুরোধ করেছে, ‘বর্তমানের জিযেএনের আন্দোলনকে যেন আইন দিয়ে বন্ধ করা না হয়।’ আন্দোলনটি হচ্ছে আন্তর্জাতিক করপোরেশনগুলোর ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে সরকারের জনগণের অধীনে আনতে হবে।

সময়ের সঙ্কট শুধু অর্থনৈতিক কারণে হতে হবে, তা ঠিক নয় বলে মন্তব্য করেছে বিখ্যাত লেখক- অনুসন্ধানী জেফরি লুইস। এক প্রবন্ধে তিনি মন্তব্য করেছেন, ‘এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্টের একটি মাত্র ‘টুইট’ (ইন্টারনেটের মাধ্যমে মন্তব্য ও তথ্য আদান-প্রদান) দিয়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাধিয়ে দিতে পারে। ট্রাম্প ইন্টারনেট ব্যবহার করেন ব্যাপক মাত্রায়। তার ঠাট্টাও ‘টুইট’ করেন প্রায়ই। জেফরি বলেছেন, হয়তো অনেকেই এটাকে ঠাট্টা না মনে করে প্রেসিডেন্টের হুকুমও মনে করতে পারেন। ফলে যুদ্ধ শুরু হওয়া অবাক কিছু নয়। যেমন মার্কিন প্রেসিডেন্ট এমন এক ‘টুইটে’ ঠাট্টা করে লিখলেন, ‘রাশিয়া এক অশুভ (ইভিল) সাম্রাজ্য (এম্পায়ার)। সবাই শঙ্কিত হলেন, রাশিয়া এর প্রতিবাদে কি সঙ্ঘাতে জড়িয়ে পড়বে? কারণ প্রেসিডেন্ট রিগ্যানের এই মন্তব্যটি আসে দু’টি দেশের সঙ্কট যখন খুব নিচে ছিল। কারণ তখন একটি যাত্রীবাহী প্লেন গুলিতে ভূপাতিত হয়। ঠিক একই রকম ঘটনা ঘটে ইরাকের প্রেসিডেন্টের ব্যাপারে। সাদ্দাম মনে করতেন, আমেরিকা কখনো বাগদাদ আক্রমণ করবে না। তাই এই টানাপড়েনের সময়ে প্রয়োজনীয় টেলিফোনটি তিনি করেননি। ফলে ইরাক মার্কিন আক্রমণের শিকার হলো এবং সাদ্দামকে তারা হত্যা করল।

নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে মুসলিম হত্যাযজ্ঞ সাদা আধিপত্যবাদের নিষ্ঠুর নগ্ন প্রকাশ। বিশ্ব সাদার আধিপত্যের শিকার হয়েছে বারবার। এই ধারা এখনো চলছে এবং ক্রাইস্টচার্চের ঘটনা এ ক্ষেত্রে সর্বশেষ বলা যায়।
এপির স্টিফেন রাইট ঘটনাটি রিপোর্ট করতে গিয়ে অনুসন্ধানে পান নিউজিল্যান্ডের ‘সাদা আধিপত্যবাদের’ আন্দোলন বহুদিন ধরে চলছিল। এই হত্যাকারী ব্রেন্টন ট্যারান্ট অস্ট্র্রেলিয়া থেকে এসে এখানে সাদা আধিপত্যবাদীর এলাকায় বসতি স্থাপন করে এবং একপর্যায়ে তাদের চেয়েও ক্রুর হয়ে ওঠে। সে প্রায়ই ইউরোপের এমন আধিপত্যের এলাকায় যেত আলোচনার জন্য। রাইট লিখেছেন, অস্ট্রেলিয়ার এই সাদা আধিপত্য এলাকা সত্যিকারভাবে অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। এই আধিপত্যবাদীদের প্রধান লক্ষ্য মুসলমান।

এই রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে, ‘ঘৃণার অপরাধ’ (হেট ক্রাইম) এই এলাকায় এখন তুঙ্গে। আসলে আমেরিকার মতো অস্ট্র্রেলিয়ার ইতিহাসেও স্থানীয় বাসিন্দা হত্যার আকার ছিল বিশাল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবং অস্ট্রেলিয়া দখলের সময় সাদারা লাখ লাখ স্থানীয় অধিবাসীদের (কালোদের) হত্যা করে নিজেদের সাদা রাষ্ট্র ঘোষণা দেয় এবং সেভাবে কর্মকাণ্ড চালু রাখে। এই সাদা রাষ্ট্রে বাদামি বা কালোরা দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে গণ্য, যদিও তারাই ছিল সংশ্লিষ্ট ভূখণ্ডের প্রকৃত অধিবাসী। নিউজিল্যান্ডে সংখ্যালঘুদের ওপর বিশেষ খবরদারি করা হয় বলে জেফরি লিখেছেন। কিন্তু এই খবরদারি ট্যারান্টের মতো চূড়ান্তবাদীদের ব্যাপারে করা হয় না। মার্কিন সরকারের প্রতিরক্ষা দফতরের বিশ্লেষক পল বুকানন লিখেছেন, ‘ক্ষুদ্র মুসলিম, কথিত চূড়ান্তবাদীদের ওপর সরকার কড়া নজর রাখে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে। অথচ ট্যারান্টের গ্রুপের মতো হত্যাকারী গ্রুপের ওপর কোনো নজরই রাখে না।’ তার মতে, এসব ‘জিহাদির’ জন্ম হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক বোমাবর্ষণের ফলে। এরা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত। এরাই মার্কিন আক্রমণস্থলে গিয়ে স্থানীয়দের সাহায্য করার চেষ্টা করে বলে বুকানন লিখেছেন।

ব্রিটেনে ডিনস ফুলার বলে ৫০ বছর বয়সী এক সাদা আধিপত্যবাদী ‘তুই কি মরতে চাস’ বলে চিৎকার করে এক মুসলিম যুবককে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করেছে।

এই ছোট ছোট ঘটনা ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়ার সাদা আধিপত্যবাদীদের ক্রমবর্ধমান ভয়াবহ কর্মকাণ্ডের চিত্র প্রকাশ করছে। অথচ সরকার কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এটা অনেকের কাছে সরকারের প্রচ্ছন্ন সহায়তা বলে মনে হতে পারে বলে রাইট লিখেছেন।

এসব ঘটনা প্রতিরোধ এবং নিবারণ অনেকটা সহজ যদি সরকার অপরাধীদের প্রতি খানিকটা পক্ষপাতদুষ্ট না হয়। অবশ্য এটা এখন বাস্তবতা যে, পশ্চিমা শক্তির সমর্থিত মুসলিমবিরোধী আন্দোলন এবং কর্মকাণ্ডের গতি অপ্রতিহত। এর প্রতিরোধ এবং সমাপ্তি অতি প্রয়োজন। নতুবা এই ব্যাধি পুরো সমাজকে গ্রাস করবে। ফলে সৃষ্টি হবে ভয়াবহ অশান্তি, যা থেকে কেউই রেহাই পাবে না।

হিংসা এবং ক্ষমতা দখল অনেককে এমন পর্যায়ে নিয়ে যায় যে, তারা তখন পশুরও অধম হয়ে পড়ে। সমাজে এই ঘৃণা বিদ্বেষ ছড়ায় ক্ষমতালিপ্সুরা। পরিশেষে তারা নিজেরাও রেহাই পায় না।

তবে এই ধারা চলে আসছে অতীতকাল থেকে। যেমন খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে অ্যাশিরিয়ান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য কয়েক লাখ লোককে হত্যা করা হয়েছিল। স্পেন থেকে মুসলিম এবং ইহুদিদের বিতাড়ন করা হয় যথাক্রমে ১৪৯২ এবং ১৫০২ সালে। স্পেনে মুসলমানরা পরাজিত হলে তাদের খ্রিষ্টান হতে বাধ্য করা হয়েছে। তবে তাতেও তারা রক্ষা পায়নি। ১৫০২ খ্রিষ্টাব্দে তাদের বের করে দেয়া হয়। ঠিক একইভাবে উত্তর আমেরিকার অধিবাসীদের তাদের বাসস্থান থেকে বিতাড়ন করে ‘নিজেদের’ জায়গা বলে দখল করে নেয় ইউরোপীয়রা।
হত্যাকাণ্ডের সবচেয়ে ভয়াবহ উদাহরণ হচ্ছে হিরোশিমার ওপর ‘লিটল বয়’ নামক, চার হাজার কেজির এক আণবিক বোমা নিক্ষেপ। এর প্রয়োজন ছিল না। কেননা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানিরা এর মধ্যে পরাজিত হয়েছিল এবং আত্মসমর্পণ করেছিল। তবু আনবিক বোমা নিক্ষেপ করা হয় বিশ্বযুদ্ধে বোমার কার্যকারিতা দেখার জন্য। এতে ৭০ হাজার লোক সাথে সাথে মৃত্যুবরণ করে এবং শহরটির চিহ্ন প্রায় মুছে যায়।

মধ্যযুগে আফ্রিকার কার্থেজ নগরী রোমানরা ধ্বংস করেছিল। তারা শহরের দেয়াল ভেঙে (১৪৬ খ্রিষ্টাব্দে) শহরে ঢুকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষ হত্যা করে। অন্যান্য হত্যাকাণ্ড একই মাত্রায় ভয়াবহ। সে সময়ে ইহুদি-খ্রিষ্টান সংঘর্ষে কয়েক লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটে। স্পেন থেকে মুসলিমদের বের করে দেয়া হয় ১৪৯২ খ্রিষ্টাব্দে (আলহামরা ঘোষণা দিয়ে)। সেখানে ইসলাম নিষিদ্ধ এবং মুসলমানদের খ্রিষ্টান হতে বাধ্য করা হয়। এদের বলা হতো মরিসকোস। ২৭০টি গ্রামের সব মুসলমানকে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল। এ ছাড়া ১৬২০ আয়ারল্যান্ডের হত্যাকাণ্ড, ১৮৭৪-এর ব্রিটিশ স্কটল্যান্ড হত্যাযজ্ঞ সেই ভয়াবহ স্মৃতি বহন করে। ১৮৭৭-৭৮ সালে রাশিয়া-তুরস্ক যুদ্ধের সাত লাখ ৫০ হাজার মুসলমানের হদিস পাওয়া যায়নি। তবে বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় হত্যাযজ্ঞগুলো ঘটেছে চীন ও রাশিয়ার এলাকায়। ইউক্রেনের হত্যাযজ্ঞে ৮০ লাখ লোকের প্রাণহানি ঘটে বলে ইতিহাসে উল্লেখ করা হয়। এই মৃত্যু ও যুদ্ধ ফলে দুর্ভিক্ষ ঘটে।

সব অনুসন্ধান এবং বিশ্লেষণে একই তথ্য বেরিয়ে আসে। তা হলো, সঙ্কট-সংঘর্ষ তৈরি করা হয় ক্ষমতালিপ্সুদের স্বার্থে। বিপুল প্রচারণার মাধ্যমে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয় এগুলো ধর্মীয় কারণে বা মতবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য। তবে ঐতিহাসিকেরা বলেছেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ধর্মের নামে ক্ষমতাবানেরা তাদের স্বার্থ উদ্ধার বা দখল কর্ম সম্পাদন করে থাকে। এ ধারা চলতে থাকবে বলে আগেই বলা হয়েছে। তবে প্রযুক্তির কল্যাণে এই ধারা এমন মারাত্মক হয়ে উঠবে যে, তখন মানবজাতির অস্তিত্বই বিপন্ন হবে। বারবার চেষ্টা করা হয়েছে এমন অবস্থার পরিবর্তনের জন্য। কিন্তু ক্ষমতা এবং অর্থের লোভ সব প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দেয়। এর কারণ হিসেবে মার্কস বলেছিলেন, ‘পলিটিকস ইন দ্য আর্ট অব লুকিং ফর ট্রাবল, ফাইন্ডিং ইট এভরিহোয়ার, ডাইগনজিং ইট ইনকারেক্টলি অ্যান্ড অ্যাপ্লাইং দিং রং রিমেডিস’। হয়তো মার্কসের সবটুকু গ্রহণ করা যাবে না, তবে তিনি একটি পরিপূর্ণ চিত্র এঁকেছেন। জেফারসনও একই কথা বলেছেন। ‘রাজনীতিবিদ এবং তাদের সরকার প্রায়ই জনগণের কথা ভুলে তাদের নিজ স্বার্থই দেখে।


আরো সংবাদ



premium cement