১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`
সময়-অসময়

পোস্টমর্টেম : জাতীয় নির্বাচন-২০১৮

পোস্টমর্টেম : জাতীয় নির্বাচন-২০১৮ - ফাইল ছবি

গত ৩১ মার্চ দেশে চতুর্থ ধাপে উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো, যাতে মাইকিং করেও ভোটকেন্দ্রে ভোটার আনা যায়নি (কুমিল্লার মেঘনা উপজেলায় মসজিদের মাইকে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার জন্য আহ্বান জানানোর পরও কেন্দ্রে ভোটাররা উপস্থিত হননি)। ভোটদানে ভোটারদের অনীহা সম্পর্কে জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কমিশনার জানালেন, ‘নির্বাচন বিষয়ে অনাস্থা থেকেই নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হচ্ছে না। যেসব কারণে আমরা ভোটারদের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছি, সেগুলোর কারণ খুঁজে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ একান্ত আবশ্যক। এমতাবস্থায় ভোটারদের ওপর এ দায় চাপানো ঠিক নয়। বিগত দুই বছরে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, তা নিয়ে নির্বাচন কমিশনের আত্মসমালোচনা প্রয়োজন। ওইসব নির্বাচনে যেসব ভুলভ্রান্তি হয়েছে, সেগুলোর পুনরাবৃত্তি রোধ করা দরকার’ (সূত্র : ০১-৪-২০১৯ ইং জাতীয় পত্রপত্রিকা)।

রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রযন্ত্র বিগত ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনকে কলঙ্কের তিলক পরিয়েছে। ভোটাধিকারকে কলুষিত করার জন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিটি স্তরের ব্যবস্থাপনা যা জনগণের অর্থে পরিচালিত, তাদের সবাই এ কলঙ্কের অংশীদারিত্ব নিয়েছেন। জাতীয় সম্প্রচার মাধ্যম অর্থাৎ বিটিভি ও বাংলাদেশ বেতার নগ্নভাবে শাসক দলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করেছে।

এক সমীক্ষায় দেখা যায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক এক মাসে বাংলাদেশ টেলিভিশন আর বাংলাদেশ বেতারের প্রধান বুলেটিন মোতাবেক সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল ও জোটগুলোর খবরের মোট হিস্যা এটাই ছিল যে, আওয়ামী লীগ আর জোটসঙ্গীদের জন্য বরাদ্দ করা সময়ের সাথে এর তুলনা করলে বিটিভির হিসাবটা দাঁড়ায় ৩৬১ মিনিট বনাম মাত্র এক মিনিট। আর বেতারে হিসাবটা ২৪৯ মিনিট বনাম মাত্র চার মিনিট।

নির্বাচনের আগে আর পরে এক মাসের প্রধান বুলেটিন ও সংবাদ পর্যালোচনা এবং নির্দিষ্ট কিছু অনুষ্ঠান পর্যবেক্ষণ করে জাতীয় মিডিয়াতে এ পরিসংখ্যান প্রকাশিত হয়েছে। গণমাধ্যম দুটি চলে জনগণের টাকায়, কিন্তু পরিচালিত হয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে। এখানে খবর বাছাই বা খবরের গুরুত্ব নির্ণয়ে ক্ষমতাসীন সরকারের প্রতি পক্ষপাত প্রকট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীনের মতে, এ প্রবণতা নতুন নয়।

বেতার ও বিটিভি বস্তুত ক্ষমতাসীন দলের চ্যানেল এবং মুখপাত্র হিসেবে কাজ করে থাকে। নির্বাচনী খবর ও পর্যালোচনায় সরকারের প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল ও জোটের অনুপস্থিতি হচ্ছে এ প্রবণতার একটি দিক। পর্যবেক্ষণে দেখা যায় যে, নির্বাচন কমিশনের তৎপরতার খবরও খুব কম জায়গা পেয়েছে। নির্বাচনী মামলা-হামলা বা অনিয়মের বিষয়ে কোনো খবরই প্রদর্শিত বা প্রকাশ হয়নি।

নির্বাচনের পরে বেড়ে গেছে ‘সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে’ ধাঁচের খবর। তখন সব খবর ‘সরকারময়’। কেউ সরকার বা নির্বাচনের সমালোচনা করলে সেটা ‘সংবাদ হয়নি’। অথচ সরকারদলীয় নেতা যখন সমালোচনাকে নিন্দামন্দ করেছেন, সেটা ‘খবর’ হয়েছে। খবরে ঢুকেছে সরকারতোষণমূলক মন্তব্য। তবে বিটিভি-বেতারের এসব নির্বাচনী খবরের প্রতি গণমানুষের আগ্রহ ছিল না।

সাধারণ সমীক্ষায় দেখা যায়, নির্বাচনের সময় জনগণ বিটিভি দেখেনি। অন্য টিভি চ্যানেল দেখেছে। কারণ সরকারের এই চ্যানেল দেখে কোনো লাভ হয় বলে জনগণ মনে করে না। সরকারের খবর ছাড়া অন্য খবর থাকে না বলে জনগণ বিটিভি দেখেনি। জনগণের মতে, সরকারের উন্নয়নের খবর জানতে চাইলে বিটিভি দেখা যেতে পারে। জাতীয় মিডিয়ার পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, বিটিভিতে রাত ৮টার খবরের ২৭ দিনের এবং বেতারে রাত সাড়ে ৮টার খবরের ২৯ দিনের সময় হিসাব করা হয়েছে।

এ পর্যবেক্ষণে আরো নির্বাচন সংক্রান্ত আলোচনা ছিল, সরকারের উন্নয়নকাজ নিয়ে আলোচনা আলেখ্য, প্রচারণাধর্মী গান ও প্রামাণ্যচিত্র। বিটিভিতে দেখা নিউজ বুলেটিনের মোট সময়কাল ছিল ৮২০ মিনিট। এর প্রায় অর্ধেক জুড়ে ছিল নির্বাচনসংক্রান্ত খবর। বেতারে শোনা বুলেটিনের মোট সময়কাল ছিল ৭২৫ মিনিট এবং এতে নির্বাচনসংক্রান্ত খবরের হিস্যা অর্ধেকের কিছু কম।

কোনোটিতেই বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের খবর নির্বাচনসংক্রান্ত খবরের ১ শতাংশের বেশি স্থান পেতে পারেনি। অথচ নির্বাচনী খবরে সরকারি দল-জোটের হিস্যা ৮০ শতাংশের বেশি ছিল (সূত্র : ২৮-৩-২০১৯ ইং জাতীয় পত্রিকা)।

একসময় এ দেশের মানুষ বিটিভিকে ‘সাহেব বিবি গোলামের’ বাক্স বলে সম্বোধন করত। আজও তার কোনো ব্যতিক্রম হচ্ছে না। বরং সরকার বিরোধীদের কুৎসা প্রচারের জন্য বিটিভি ও বাংলাদেশ বেতার পাইকারিভাবে ব্যবহার হয়ে আসছে। ফলে ভোটকেন্দ্রে উপস্থিতির মতো জাতীয় সম্প্রচার মাধ্যমের প্রতিও জনগণ আস্থা হারিয়ে ফেলেছে বলে বিটিভি ও বেতারের সংস্পর্শ মানুষ ত্যাগ করেছে। এ অবস্থায় সঠিক সংবাদ পাওয়ার জন্য ভিন্ন চ্যানেল বা বিদেশী চ্যানেলের ওপর জনগণ টিভি নির্ভর করছে।

গত ২৬ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর নিশ্চিত করে বলেছে, ‘বাংলাদেশের একাদশ সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। এই দফতরের মুখপাত্র রবাট পালডিনো সেদিন ওয়াশিংটনে নিয়মিত ব্রিফিংয়ে এ কথা বলেন। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে এর আগে প্রকাশিত মার্কিন প্রতিবেদনের প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু ছিল না। ব্যালট বাক্স ভরে রাখা, বিরোধী দলের ভোটার ও এজেন্টদের ভয়ভীতি দেখানোসহ নানা ধরনের অনিয়মের খবর পাওয়া গেছে (২৮-৩-২০১৯ ইং জাতীয় পত্রিকা)।’

পোস্টমর্টেম : জাতীয় নির্বাচন-২০১৮ শিরোনামের জাতীয় নির্বাচন এবং একই আদলে অনুষ্ঠিত অন্যান্য পাবলিক নির্বাচনে রাষ্ট্র, সরকার, নির্বাচন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, আমলাতন্ত্র ও আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার কলঙ্কজনক কার্যক্রম উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রবীণ অধ্যাপক অধ্যাপক ফজলুল হকের মন্তব্য দিয়ে ইতিটানতে চাই। পয়লা এপ্রিল জাতীয় প্রেস ক্লাবে ফ্রি থিংকার্স ফাউন্ডেশন আয়োজিত এক আলোচনা সভায় তিনি অকপটে বলেছেন, ‘আজ দেশের স্বনামধন্য নির্বাচন কমিশন নিন্দিত অবস্থায় চলে গেছে। গণতন্ত্র এখন ভয়ানক খারাপ অবস্থায় আছে। মানুষের ভোটের অধিকার নেই। রাজনীতি হয়ে গেছে রাজনৈতিক দল ছাড়া।’

বাংলাদেশের রাজনীতির বাস্তবতা হলো, রাজনীতি এখন আর রাজনীতিবিদদের হাতে বা নিয়ন্ত্রণে নেই। আন্তর্জাতিক রাজনীতি গোয়েন্দা ও অর্থশালীদের দখলে চলে গেছে। আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করা হচ্ছে জনগণের বিরুদ্ধে। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বোদ্ধাদের মতে, Powerful individuals are able to influence the making of law অর্থাৎ প্রভাবশালীদের প্রভাবেই আইন প্রণীত হচ্ছে। তারা এটাও মনে করেন যে,  Crime is a political concept used to protect powerful people. নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে সংবিধানে যা-ই লিপিবদ্ধ থাকুক, প্রভাবশালীদের হাতের মুঠোয় জিম্মি আজ গণমানুষের অধিকার।

‘রাজনৈতিক দলে রাজনীতি নেই’ বলে প্রদত্ত বক্তব্য খুবই প্রণিধানযোগ্য এবং সময়ের প্রতিফলন। বড় রাজনৈতিক দলে Appointed Leader এর আধিক্য ও প্রভাব বেশি। ফলে তৃণমূল থেকে উঠে আসা নেতৃত্ব কোণঠাসা, তাই রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্তগুলোও ARMY STYLE হয়ে আসছে। জার্মানির বিখ্যাত চ্যান্সেলর Otto Von Bismarck এর মতে, Politics is the art of the possible. সেই possible অর্থাৎ সম্ভাবনা অর্থাৎ জাতিগত সম্ভাবনা এখন একটি সুবিধাভোগী চক্রের হাতে বন্দী হওয়ার গণমানুষকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে হয়।

আধুনিক রাষ্ট্র বিজ্ঞানীদের মতে, Conflict and Co-Operation are two basic modes of politics. কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতি বিদ্বেষপূর্ণ, আক্রোশমূলক ও প্রতিহিংসাপরায়ণ অবস্থায় দাঁড়িয়েছে যার মাত্রা চরম শিখরে নিয়েছে বর্তমান রাষ্ট্রযন্ত্র, সরকার এবং সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন রাষ্ট্রীয় সংগঠন আইন প্রয়োগের নামে ভোতা অস্ত্রের ব্যবহারের মাধ্যমে।

বিদ্বেষ এতই চরমে উঠেছে যে, ৭৪ বছরের একজন অসুস্থ নারীকে যিনি তিনবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তার চিকিৎসা ও মুক্তির জন্য রাষ্ট্রের কৌশল ও অপকৌশলের প্রতি দৃষ্টিপাত করলেই বোঝা যাবে। বিষয়টি ভবিষ্যতের জন্য কতটুকু খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে রইলো তা আগামী দিন বলতে পারবে। রাজনৈতিক নোংরামি কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে, তা নিয়ে বিশেষ আলোচনার প্রয়োজন পড়ে না।

কারণ এফ আর টাওয়ারের অগ্নিসংযোগে ঢাকার বনানীর শিশু বালককে পুরস্কারের লোভ দেখিয়ে কারাবন্দী ঘটনার সাবেক প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে কুৎসা রচনা করে মিডিয়াতে প্রকাশের মাধ্যমে চরম নোংরামির লজ্জাকর দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমান শীর্ষ ক্ষমতাবানের বিবেকে এ কুৎসা রটনা কতটুকু প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে তা দেখার জন্য জনগণ অবশ্যই তাকিয়ে থাকবে।

তবে বকধার্মিক মিডিয়া কর্তৃক সাবেক প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে পুরস্কারের লোভ দেখিয়ে শিশু বালকের মুখ থেকে যে বক্তব্য নেয়া হয়েছে, এ ধরনের বক্তব্য সরকার প্রধানমন্ত্রী ও তার পারিষদ হরহামেশাই বলে আসছেন, বিশেষ করে ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের একতরফা প্রচার-প্রচারণার সময়ে।

রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা ও রাজনীতির মাফিয়াদের কারণে এমনিভাবে পচন ধরছে, যার দুর্গন্ধ গোটা জাতিকে ভোগ করতে হচ্ছে। এর থেকে পরিত্রাণের হাতিয়ার হতে পারে জাতির জাগ্রত বিবেক ও ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা। ২০১৮ সালের আদলে অনুষ্ঠিত ২০১৯ সালের পাবলিক নির্বাচনগুলো প্রমাণ করে, গতানুগতিক নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় ভোটাধিকারের প্রশ্নে, গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার কোনো দিনই প্রতিফলন ঘটবে না। শত নির্যাতন করে হলেও ক্ষমতাসীনরাই ক্ষমতায় থাকবেন। রাজনীতি ও রাষ্ট্র চলবে আমলানির্ভর হয়ে, রাজনৈতিক কর্মীরা ছিটকে পড়ছেন ও পড়বেন এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতির উন্মেষ ঘটার পরিবর্তে মুখ থুবড়ে পড়বে, যদি না জাতির বিবেক জাগ্রত হয়।

বি: দ্র: পোস্টমর্টেম : জাতীয় নির্বাচন-২০১৮ সিরিজের এখানেই ইতিটানা হলো। আরো তথ্যবহুল তথ্য-উপাত্ত সম্পর্কিত বক্তব্য পুস্তকাকারে প্রকাশিত হবে, ইনশাআল্লাহ।

লেখক : কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail: taimuralamkhandaker@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
শিবপুরে মোটরসাইকেলের ধাক্কায় পথচারীর নিহত চকরিয়ায় ত্রিমুখী সংঘর্ষে নিহত ১, আহত ৩ গাজা মানবিক নরকে পরিণত হয়েছে : জাতিসঙ্ঘ প্রধান রাফা হামলার পরিকল্পনা ইসরাইলের ত্যাগ করা উচিত : চীন গাজা যুদ্ধে নতুন যে কৌশল অবলম্বন করল ইসরাইল হাসপাতালের শৌচাগারে মিলল নবজাতক শিশু ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোয়াত্রার ঢাকা সফর স্থগিত জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিসিডিপি গঠন করা হবে : পরিবেশমন্ত্রী অননুমোদিত জমি ভরাট কার্যক্রমের সন্ধান পেলে দ্রুত ব্যবস্থার নির্দেশ ভূমিমন্ত্রীর ভাসানচর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এক ব্যক্তিকে গলা কেটে হত্যা ইসরাইলকে পারমাণবিক স্থাপনায় আঘাতের ব্যাপারে সতর্ক করলো আইআরজিসি

সকল