১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মোদির তরী গন্তব্যে কি পৌঁছবে?

- ছবি : সংগৃহীত

১১ এপ্রিল ভারতের লোকসভা নির্বাচনের সাতটি পর্বের মধ্যে প্রথম পর্ব অনুষ্ঠিত হবে। মে মাসের ১৯ তারিখ পর্যন্ত চলবে এ নির্বাচন। ২৩ মে ভোট গণনার পর জানা যাবে পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য ভারতের নেতৃত্ব দেবেন কারা। এখন পর্যন্ত প্রাক-নির্বাচনী যেসব জরিপ প্রকাশ হচ্ছে, তাতে ‘নরেন্দ্র ম্যাজিক’ বা বিজেপির প্রভাব নিম্নগামী হলেও অধিক আসনে শাসক জোটই জিতবে বলে মনে করা যায়। তবে এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে নরেন্দ্র মোদি আবার সরকারের নেতৃত্ব দিতে পারবেন কি না তা নিয়ে বেশখানিকটা সংশয় রয়ে গেছে। একাধিক মতামত জরিপে বলা হচ্ছে, ভারতে বিজেপি বিরোধী দলগুলো অর্ধেকের বেশি আসনে জয় পাবে। কিন্তু এসব দল অভিন্ন জোট গঠনে সক্ষম না হওয়ার কারণে এনডিএ’র বাইরে সরকার গঠন বেশখানিকটা অনিশ্চিত থেকে যেতে পারে।

১৯৪৭ থেকে ২০০৯
ভারতীয় স্বাধীনতা-উত্তরকালের বেশির ভাগ সময়জুড়েই শাসনকর্তৃত্ব ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের হাতে ছিল। অন্য দিকে ভারতের রাজ্য-রাজনীতিতে প্রাধান্য বিস্তার করেছে কংগ্রেস, ভারতীয় জনতা পার্টি, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী), প্রভৃতি জাতীয় দল এবং একাধিক আঞ্চলিক পার্টি। দু’টি সংক্ষিপ্ত পর্যায় বাদে ১৯৫০ সাল থেকে ১৯৯০ সাল অবধি জাতীয় কংগ্রেস সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ঘোষিত জরুরি অবস্থাজনিত গণ-অসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে ১৯৭৭ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে, কংগ্রেসকে ক্ষমতাচ্যুত করে জনতা পার্টি ক্ষমতায় ছিল। ১৯৮৯ সালে জনতা দলের নেতৃত্বে জাতীয় ফ্রন্ট বামফ্রন্টের সহযোগিতায় নির্বাচনে জয়লাভ করে দুই বছর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকে। ১৯৯১ সালে কোনো পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ না করতে পারায় কংগ্রেস পি ভি নরসিমা রাওয়ের প্রধানমন্ত্রিত্বে একটি সংখ্যালঘু সরকার গঠন করেছিল।

১৯৯৬-১৯৯৮ সময়টি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের অস্থিরতার যুগ। এই সময় একাধিক স্বল্পকালীন জোট কেন্দ্রে সরকার গঠন করে। ১৯৯৬ সালে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য বিজেপি সরকার গঠন করেছিল। তারপর কংগ্রেস এবং বিজেপি-বিরোধী যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। ১৯৯৮ সালে বিজেপির নেতৃত্বে এনডিএ ক্ষমতা লাভ করে। এ সরকারই ভারতের প্রথম পূর্ণ সময়কালের অকংগ্রেসি সরকার। ২০০৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন জোট ইউপিএ লোকসভায় বিপুলসংখ্যক আসনে জয়লাভ করে এবং বিজেপি-বিরোধী বাম সংসদ সদস্যরা ইউনাইটেড প্রগেসিভ অ্যাল্যায়েন্স (ইউপিএ) সদস্যদের সহায়তায় সরকার গঠন করে। ইউপিএ ২০০৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে পুনরায় ক্ষমতায় আসে। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে বিজেপি।

‘মোদি হাওয়া’র গতিবিধি

২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদি এক ধরনের মোহময়ী আবহ তৈরি করতে পেরেছিলেন। তিনি যুবকদের কর্মসংস্থান এবং আপামর ভারতবাসীকে ‘আচ্ছে দিন’ বা সুদিন ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। পাঁচ বছর পর এখন বলছেন, যদি ফের ক্ষমতায় আসেন, তাহলে সেই স্বপ্নপূরণের কাজে হাত দেবেন তিনি। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, তাহলে গত পাঁচ বছরে তিনি করলেন কী? জবাবে প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেছেন, গর্ত ভরতেই অনেকটা সময় চলে গেছে। সে কাজেও যে ঘাটতি থেকে গেছে, আগামী পাঁচ বছর সেটা পূরণ করবেন। আর মানুষের স্বপ্নপূরণের কাজে হাত দেবেন।

রাফায়েল দুর্নীতির অভিযোগ তুলে নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে ‘চৌকিদার চোর হ্যায়’ সেøাগানটি জনপ্রিয় করে তুলেছেন রাহুল গান্ধী। ভোটের মুখে সেই সেøাগানের অভিমুখ ঘোরাতেই ব্যস্ত প্রধানমন্ত্রী। মোদির পাশাপাশি অমিত শাহ, রাজনাথ সিংহ, সুষমা স্বরাজ, যোগী আদিত্যনাথরা দেশের নানা প্রান্তে ভিডিওর মাধ্যমে নব্য ‘চৌকিদার’দের সাথে আলাপচারিতা করছেন। তারা নাম না করে প্রধান লক্ষ্য করছেন রাহুল গান্ধীকেই।

আসলে রাহুলের একের পর এক অভিযোগের ধাক্কায় বেকায়দায় থাকা মোদির সমস্যা বাড়িয়েছে রাহুলের ‘ন্যায়’ প্রকল্প। ক্ষমতায় এলে প্রতি গরিব পরিবারকে মাসে ছয় হাজার টাকা করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন রাহুল।

পাঁচ বছর আগে মোদি দেখাতেন স্বপ্ন। এখন তার কৌশল হিন্দুত্ব ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদ চাঙ্গা করে, স্থিতির জন্য তার সরকারকে রক্ষা করতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা। পুলওয়ামার ঘটনার পর পাকিস্তানে পাল্টা আক্রমণ করে পালে হাওয়া লাগাতে চেয়েছিলেন মোদি। সেটি খুব একটা কাজে আসেনি। তবে পাকিস্তান ইস্যু কাজে লাগানোর চেষ্টা এখনো অব্যাহত রেখেছেন। বলছেন, পাকিস্তান মোদিতে অখুশি। রামমন্দির ইস্যুতেও ভালো সাড়া পাওয়া যায়নি। উগ্র জাতীয়তাবোধ চাঙ্গা করা আর জোট কৌশল এখন মোদির প্রধান ভরসা। সেটি কতটা মোদির জন্য সাফল্য আনবে, সে বিতর্ক থেকে যাচ্ছে।

নির্বাচনী জরিপ ও প্রচার প্রবাহ
ভারতে নির্বাচনের পূর্ববর্তী সময়ে দ্রুত পরিস্থিতি পাল্টে যেতে দেখা যায়। লোকসভায় হিন্দি বলয়ের ১২৬ আসনের এক জরিপে দেখা যায়, ২০১৪ সালে এসব আসনের ১০৪টিতে জয় পেয়েছিল বিজেপি। এবার সেখানে সর্বোচ্চ ৮৪টি আসনে বিজেপি জয় পেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অন্য দিকে কংগ্রেসের আসন আগের বারের ১৩ থেকে বেড়ে এবার ২৭-এ উন্নীত হবে বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। গত মার্চ মাসে করা এবিপি নিউজ-সি ভোটারের জরিপ অনুসারে, ৫৭৩ আসনের লোকসভায় ২৬৪টি আসনে বিজেপিসহ এনডিএ জোট জয় পেতে পারে। এর বিপরীতে কংগ্রেসের ইউপিএ জোট আসন পেতে পারে ১৪১টি। আর অন্য দলগুলোর আসন সংখ্যা দাঁড়াতে পারে ১৩৮টিতে। এই দৃশ্যপট অনুসারে এনডিপি নিশ্চিতভাবে সরকার গঠন করবে, এমনটি মনে হয় না। জি ২৪ তাস-এর জরিপেও ফলাফল এর কাছাকাছি। এই জরিপ অনুসারে এনডিএ ২৬৪, ইউপিএ ১৬৫ এবং অন্য দলগুলো ১১৪টি আসনে জয় পেতে পারে। একই সময়ে নিউজ ন্যাশন-এর জরিপে এনডিএ জোট ম্যাজিক সংখ্যা ২৭২ অতিক্রম করে আরো একটি আসন বেশি পাবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই জরিপ অনুসারে ইউপিএ’র আসন হবে ১৩৩ এবং অন্যান্য দলের আসন ১৩৭টি।

ভারতীয় জনমত জরিপ সংস্থাগুলোর সমীক্ষা সব সময় সঠিক হতে দেখা যায় না। তবে একটি প্রবণতার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। সে প্রবণতাটি হলো এখন এ ধরনের, এনডিএ জোটের বিকল্প হিসেবে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ এখন পর্যন্ত এককভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার পর্যায়ে যেতে পারেনি।

রাজ্যে রাজ্যে হাওয়া পাল্টাচ্ছে?
মোদি ভারতবাসীর সামনে ৫ বছর আগে গুজরাট মডেলের কথা বলেছিলেন, যেখানকার উন্নয়নের বহিরাঙ্গ বাইরের মানুষ জানলেও ভেতরটা সেভাবে তারা বুঝতে পারেনি। কিন্তু গত পাঁচ বছরের শাসনামলে গুজরাটেই বড় রকমের চ্যালেঞ্জে পড়ে গেছেন মোদি। অব্যাহতভাবে কৃষক ও প্যাটেলদের ক্ষোভ-বিক্ষোভে বিধানসভা নির্বাচনে বিরোধী পক্ষ ভোটপ্রাপ্তির দিক থেকে বিজেপির কাছাকাছি পৌঁছে গেছে যেখানে। নিম্নবর্ণের প্যাটেলদের নেতা হার্দিক প্যাটেল সেখানে উদীয়মান নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। এবার তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দিয়েছেন কংগ্রেসে। বিজেপি সরকারের মামলায় দুই বছরের শাস্তি হওয়ায় লোকসভা নির্বাচনে তার অংশগ্রহণ এখনো বেশখানিকটা অনিশ্চিত। এরপরও এবার গুজরাটে সম্ভবত বিজেপির একতরফা ফলাফল হচ্ছে না।

গুজরাটের পাশের মহারাষ্ট্রে বিজেপির সরকার রয়েছে। এ রাজ্যের অন্যতম শক্তিমান দল শিবসেনা বিজেপির ক্ষমতার অংশীদার হলেও মাঝে মধ্যেই বিগড়ে যায়। এরপরও বিজেপি-শিবসেনা মিলে অধিক আসনে জয় পেতে পারে। এখানে কংগ্রেস এবং সারদ পাওয়ারের দল ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস নিজেদের অবস্থানকে আগের চেয়ে শক্তিশালী করতে পেরেছে, কিন্তু লোকসভায় গরিষ্ঠতা পাবে কি না সংশয় রয়ে গেছে।

মধ্যপ্রদেশ দীর্ঘ দিন ধরে ছিল ‘বিজেপির ঘাঁটি’। কিন্তু গত মেয়াদে সেখানে বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে উত্তাল কৃষক বিক্ষোভ রয়েছে। দুর্বার আন্দোলনে কৃষকদের দাবির কাছে রাজ্য সরকারকে নতি স্বীকার করতে হয়েছে। ফলে এবারের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি মধ্যপ্রদেশে অধিক আসনে জয় পেলেও প্রতিপক্ষ কংগ্রেসের আসন বেশ বাড়তে পারে।

হিন্দি বলয়ের অন্যতম রাজ্য হরিয়ানায় বিজেপির দাপট রয়ে গেছে। হরিয়ানায় কংগ্রেস এবারো ভালো ফল করতে পারবে বলে মনে হয় না। তবে রাজস্থানে কংগ্রেস তীব্র লড়াই করতে যাচ্ছে বলে মনে হয়। এখানে বিজেপি বা কংগ্রেস যেকোনো দলই বাঘে-মোষে লড়াইয়ে বেশি আসনে জয় পেতে পারে। পার্শ্ববর্তী পাঞ্জাবে এখন কংগ্রেসই শাসন করছে। বিজেপি-আকালি দলের জোট এবারো ভালো ফল করতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। এখানে চারটি লোকসভা আসনে আম আদমি পার্টি (এএপি) জয় পেয়েছিল। এবার সে সংখ্যা মনে হচ্ছে মাত্র এক-এ নেমে আসবে। এ সুবিধা কংগ্রেস পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। রাজধানী নয়াদিল্লিতে লোকসভার সব আসনেই এর আগে বিজেপি জয় পেয়েছিল। কিন্তু বিধানসভার নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে আম আদমি পার্টি। দলটির নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল তার ইমেজ ধরে রাখতে পারেননি। কংগ্রেসের সাথে জোট গড়ার চেষ্টাও সফল হয়নি। ফলে রাজধানীর বেশির ভাগ আসনে এবারো বিজেপির পদ্ম ফুলের জয় হবে বলে মনে হচ্ছে। উত্তরাখণ্ডে এবার বিজেপি তার আধিপত্য বজায় রাখতে পারবে বলে মনে হয়। তবে ছত্তিশগড়ে কংগ্রেসেরই এবার বেশি আসন পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

দক্ষিণের অহিন্দি বলয়ের রাজ্যগুলোতে বিজেপি সাধারণভাবে খুব ভালো করতে পারে না। তামিলনাড়–তে এআইডিএমকের সাথে বোঝাপড়া করে কিছু আসন পেতে চেয়েছিল বিজেপি; কিন্তু সেখানে এবার ডিএমকে বা দ্রাবিড়া সুনেত্রা কাজাগান দল জয়ী হবে বলে মনে হচ্ছে। তাদের সাথে বোঝাপড়া রয়েছে কংগ্রেসের। অন্ধ্র প্রদেশে বিজেপি আসনসংখ্যা শূন্য পার হতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। সেখানে আঞ্চলিক দল তেলেগু দেশম পার্টি (টিডিপি) বেশির ভাগ আসনে জয় পেতে পারে। এখানে কংগ্রেসের আসন সংখ্যা বাড়তে পারে। বিজেপির আমলে আলাদা রাজ্য হওয়া তেলেঙ্গানাতে আঞ্চলিক দল টিআরএস-এর প্রাধান্যই বজায় থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। অবশ্য এ রাজ্যে দু-একটি আসন বিজেপির পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কর্নাটকে বিজেপি বেশি আসন পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও জোট রাজনীতি সেখানে কংগ্রেসকে অধিক আসন পেতে সহায়তা করতে পারে। গোয়া, পন্ডিচেরি এবং ইউনিয়ন শাসিত বিভিন্ন এলাকায় বিজেপি বা কংগ্রেস কারো একক প্রাধান্য নেই।

কেরালাতে ঐতিহ্যগতভাবে বিজেপির কোনো প্রভাব নেই। এবারেও ভালো কিছু করতে পারবে বলে মনে হয় না। এ রাজ্যে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাম দলগুলো ও কংগ্রেসের মধ্যে হতে পারে। রাহুল গান্ধী এখানকার একটি আসনে লড়াই করতে পারেন। এখানে দু-একটি আসনে জয় পাওয়া যায় কি না, সেই আশা করছে গেরুয়া শিবির।

জম্মু ও কাশ্মিরে বিজেপির ভরসা হিন্দুগরিষ্ঠ আসনগুলো। জম্মুর দু’টি আসন বিজেপি পেতে পারে। তবে বিজেপির আসন কমে কংগ্রেসের আসন এখানে বাড়তে পারে। আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে মেহবুবা মুফতির পিডিপির চেয়ে ফারুক আব্দুল্লাহর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল কনফারেন্স বেশি ভালো করবে বলে মনে হচ্ছে।

ভারতের সর্বাধিক আসনের রাজ্য, উত্তর প্রদেশ এবার নির্বাচনী আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে। সেখানকার বৃহৎ দুই আঞ্চলিক দল অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী পার্টি বা এসপি ও কুমারী মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি বা বিএসপি অন্য কয়েকটি ছোট দল নিয়ে জোট গড়েছে। এ জোটে কংগ্রেসকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়াস সফল হয়নি। ফলে বেশির ভাগ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে ত্রিমুখী। এতে উত্তর প্রদেশে বিজেপির বিপর্যয় চরম আকার না নিলেও এক-তৃতীয়াংশ আসনে জয় পাওয়া তাদের জন্য কঠিন হবে। এর প্রভাব পড়তে পারে জাতীয় ফলাফলে।
বিহারে নীতিশ কুমারের জেডিইউর সাথে জোট করেছে বিজেপি। অন্য দিকে লালুপ্রসাদের আরজেডির সাথে কংগ্রেস ও কয়েকটি ছোট দলের জোট হয়েছে। বিভিন্ন জরিপ অনুসারে, এই মেরুকরণে রাজ্যটির আসন আধাআধি ভাগ হয়ে যেতে পারে। বেশি আসন পাওয়ার সম্ভাবনা এনডিএর।

উড়িষ্যায় দীর্ঘ দিন ধরে নবীন পট্টনায়কের দল বিজু জনতা দলের একক আধিপত্য চলে আসছিল। এবার বিজেপি সেখানে আসন বাড়ানোর চেষ্টা করছে। শেষ পর্যন্ত বিজু জনতা দলের গরিষ্ঠতা এখানকার লোকসভার আসনে থেকে যেতে পারে; যদিও বিজেপির আসন দু-একটি বাড়তে পারে।

দ্বিতীয় সর্বাধিক আসনের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ এবার আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে। সেখানে তৃণমূলের ঘাসফুল, বিজেপির পদ্ম আর বামফ্রন্টের হাতুড়ি-কাস্তের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। বেশ কয়েকটি আসনে কংগ্রেস লড়াই করবে। পশ্চিমবঙ্গে জয়ের ব্যাপারে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বিজেপি। এখানে জয় মানে, সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া নয়। আগেরবার পাওয়া দু’টি আসনকে দুই অঙ্কের কোটায় নিয়ে যেতে পারলে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির জন্য সেটিই অনেক বড় অর্জন। তেমন সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। সেটি অবশ্য নির্ভর করবে তৃণমূলবিরোধী ভোটের ধারা বামফ্রন্টের দিকে থাকবে, নাকি বিজেপির দিকে চলে যাবে তার ওপর।

উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোকে বেশ ক’বছর ধরে বিজেপি টার্গেট করেছে। এ ক্ষেত্রে তাদের প্রধান কৌশল হলো, আঞ্চলিক দলগুলোর সাথে সমঝোতা করা। এই কৌশলে আসামসহ ‘সাতবোন’ রাজ্যে বিজেপি জোট অধিক আসনে জয় পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে ত্রিপুরায় বিজেপির বিপর্যয় ঘটতে পারে।

জোট কৌশলে হারজিত
নির্বাচনে জোট কৌশল হারজিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। বিজেপি নির্বাচনী জোট গঠনের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক দলগুলোকে বেশি ছাড় দিয়ে কাছে টানার কৌশল গ্রহণ করলেও তেমনটি দেখা যায় না কংগ্রেসের ক্ষেত্রে। উত্তর প্রদেশে কংগ্রেস ছাড় দিলে এসপি-বিএসপি-কংগ্রেস মহাজোট হতে পারত। তা হলে এই রাজ্যে বিজেপির আসনসংখ্যা দুই অঙ্ক ছাড়ানো বেশ কঠিন। বিহারে জেডিইউ বিজেপির দিকে চলে যাওয়ায় বেশখানিকটা ছাড় দিয়ে জোট করেছে কংগ্রেস এবং আরজেডি। কিন্তু দিল্লি বা পাঞ্জাবে আম আদমি পার্টির সাথে জোট গঠনের ক্ষেত্রে ‘উদারতা’র পরিচয় দিতে পারেনি কংগ্রেস। এর সুফল যে বিজেপির পক্ষে যাবে, তাতে সংশয় নেই।

বিজেপির মহারাষ্ট্রে শিবসেনাসহ অন্য অনেক স্থানে শরিকদের সাথে যে সমস্যা ছিল তা অনেকখানি মিটেছে। আসামে, জাতীয় নাগরিকত্ব আইনকে কেন্দ্র করে যে ‘অসম গণতান্ত্রিক পরিষদ এনডিএ ছেড়ে গিয়েছিল, তারাও ফিরে এসেছে। বিহারে নীতিশের জেডিইউ, রামবিলাস এলজেপির সাথে সমঝোতা নরেন্দ্র মোদির দল আগেই পাকা করে ফেলেছে। উত্তর প্রদেশে অখিলেশের এসপি এবং মায়াবতীর বিএসপির ‘মহাঘটবন্ধন’-এ কংগ্রেস না থাকায় নিশ্চয়ই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে বিজেপি। এই জোট যে হলো না, তাতে অবশ্যই মায়াবতীর একগুঁয়েমির ভূমিকা আছে, কিন্তু অস্বীকার করা যাবে না যে, কংগ্রেসও অহং ছেড়ে প্রয়োজনে মাথা ঝুঁকাতে শেখেনি। সে তুলনায়, সম্পর্কের নানা ওঠাপড়া সত্ত্বেও এখন অবধি যে কর্নাটকে দেবগৌড়া-কুমারস্বামীর জেডিএস-এর সাথে জোট অটুট রয়েছে, তা কংগ্রেসের পক্ষে স্বস্তির কথা। পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তর-পূর্ব ভারতীয় রাজ্যগুলোতেও কংগ্রেসের কৌশল খুব একটা পরিণামদর্শী মনে হয়নি। ফলে এ অঞ্চলে বেশি ভালো ফল কংগ্রেস করতে পারবে বলে মনে হয় না। ছত্তিশগড়ে কংগ্রেস বেশ এগোতে পারলেও মধ্যপ্রদেশে বড় রকমের সাফল্য আশা করার মতো অবস্থা তৈরি হয়নি। অথচ তৃণমূলের কৃষক-মজুরদের দাবি আদায়ের অনেক আন্দোলন রাজ্যটিতে হয়েছে। উত্তরাখণ্ডেও কংগ্রেসের নিশ্চিত সাফল্য আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ।

তৃতীয় ফ্রন্টের আবির্ভাব
তৃতীয় ফ্রন্টের আবির্ভাবের একটি প্রচেষ্টা এর আগে লক্ষ করা গিয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সামনে রেখে এটি এগিয়েছিল। কিন্তু তা নির্দিষ্ট কোনো কাঠামোগত রূপ নেয়নি। এবারই প্রথম নিজের রাজ্যের বাইরে এসে অন্ধ্র প্রদেশ থেকে প্রচার শুরু করেছেন মমতা। এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডু মমতার প্রস্তাবিত ফেডারেল ফ্রন্টের অন্যতম সংগঠক এবং ঘটনাচক্রে তৃণমূল নেত্রী মমতার মতো তার সাথেও কংগ্রেসের কোনো বোঝাপড়া হয়নি আসন নিয়ে। ‘২০১৯ বিজেপি ফিনিশ’-এর যে সেøাগান পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তুলেছেন, অন্ধ্রে দেয়া তার বক্তৃতায় সেটাই উচ্চারিত হয়েছে বারবার। মমতা বলেছেন ‘মোদি হটাও’, জনতা বলেছে ‘দেশ বাঁচাও’। পশ্চিম বঙ্গে একই দিন মোদি ও মমতা সমাবেশ করেছেন। এতে মোদি মমতাকে বলেছেন উন্নয়নের পথে ‘স্পিডব্রেকার’, আর মমতা জবাবে মোদিকে বলেছেন ‘এক্সপায়ায়ারি বাবু’। অবশ্য সেখানে মোদির জনসভার দ্বিগুণ লোক মমতার সভায় হয়েছিল বলে রিপোর্ট বেরিয়েছে।

অন্ধ্রে চন্দ্রবাবু এবং কেজরিওয়ালের সাথে বৈঠক করেন মমতা। তারা দুইজনই পশ্চিমবঙ্গের প্রচারে যাবেন বলে ঠিক হয়েছে। তাদের আধা ঘণ্টার আলোচনায় ভোট-পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়েও কথা হয়। কথা ওঠে রাহুল গান্ধীর বিভিন্ন বক্তৃতার বিষয়বস্তু নিয়েও। তবে একটি ব্যাপারে সবাই একমত, মূল লড়াই যেহেতু বিজেপির সাথে, তাই সেটাকেই লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। আরো একটি বিষয়ে তারা একমত। তা হলো আঞ্চলিক দলগুলোর অগ্রগতি যেকোনো মূল্যে নিশ্চিত করতেই হবে, যাতে বিজেপি-বিরোধী সরকার গঠনের ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা অপরিহার্য এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়।

রাহুল-প্রিয়াঙ্কা কতটা পারবেন এগোতে?
কংগ্রেস-প্রধান রাহুল গান্ধী দেশের এ-মাথা থেকে ও-মাথা চষে ফেলছেন। তিনিই দলের ‘স্টার’ প্রচারক। সম্প্রতি তিন রাজ্যে জয়ের পেছনে তার ভূমিকা অনস্বীকার্য। যেভাবে তিনি কৃষিঋণ ও রাফায়েল বিমান কেনাবেচায় অনিল অম্বানীকে সুবিধা পাওয়ানোর বিষয়টিকে সামনে এনে জনসমর্থন পেয়েছেন, তা নিশ্চয়ই তার পুরনো ‘নাবালক’ ভাবমূর্তি অনেকটাই ভেঙে দিয়েছে। এক লাফে প্রত্যাশাও বেড়ে গেছে। কৃষিঋণ মওকুফ করা সম্পন্ন চাষিদের ক্ষতে কিছুটা প্রলেপ দিতে পারে, তবে এটা দীর্ঘমেয়াদি সুরাহা হিতে পারে না। তেমনি ‘চৌকিদার চোর হ্যায়’ সেøাগানটিও পুলওয়ামা হামলা এবং ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’-এর পর বিজেপির বাগাড়ম্বরের মতো ক্রমেই ঝাঁজ হারাচ্ছে। বিজেপি ইতোমধ্যে বাণিজ্যিক প্রচার সংস্থা মারফত দু’টি সেøাগান- ‘মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়’ (মোদি যেখানে, সম্ভব সেখানে) এবং ‘আপনা মোদি আয়েগা’ (আপনার মোদি এসেছে) পেয়েছে, যা স্মার্ট মিডিয়ায় ভালো ‘খাবে’।

কংগ্রেস প্রচারে গতি আনতে প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে মাঠে নামিয়েছে। রাহুলের চেয়ে বছর দেড়েকের ছোট বোন প্রিয়াঙ্কা চলনে-বলনে-চেহারায় তার দাদী ইন্দিরার স্মৃতি উদ্রেককারী। যেভাবে তিনি ইউপির ময়দানে নেমেই সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন, তাতে অনেকের আশা ছিল নিজে ভোটে দাঁড়িয়ে দলকে নেতৃত্ব দেবেন। কিন্তু কিছু দিন পরই প্রিয়াঙ্কা বললেন, ভোটে কেবল প্রচার করবেন, প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়। পরে অবশ্য ‘দল চাইলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে জানিয়েছেন। তবে এ ব্যাপারে তার সুস্পষ্ট ও সুদৃঢ় বক্তব্য দরকার। তার বক্তব্যে এখনো সেই হৃদয়বিদারী শেল নেই, যাতে শত্রুশিবিরে কম্প সৃষ্টি হবে আর সমর্থকেরা হবেন বিশেষভাবে উজ্জীবিত। ফলে এবারে দলে যোগ দিয়েও প্রিয়াঙ্কা বোধহয় ‘তুরুপের তাস’ হয়ে উঠতে পারবেন না। উত্তর প্রদেশে জোট গড়ার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা আশা করেছিলেন অনেকে। সেটি শেষ পর্যন্ত দেখা যায়নি। উত্তর প্রদেশ, দিল্লি, রাজস্থান ও হরিয়ানায় জোট গঠিত হলে বিজেপিবিরোধী আসন কম করে হলেও ২৫টি বাড়তে পারত। আর এটি বিজেপির ক্ষমতায় যাওয়ার পথে বড় একটি বাধা হয়ে দাঁড়াতো। তবে এরপরও বিজেপিবিরোধীদের সব আশা এখনো ফুরিয়ে যায়নি।

mrkmmb@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement