২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

অপরাধের রাজনীতিকীকরণ

- ফাইল ছবি

বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্রে একটি নতুন প্রবাদবাক্যসম উচ্চারণ ‘রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন’ অথবা ‘দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি’। তার মানে হলোÑ বাংলাদেশের রাজনীতি অপরাধীদের দখলে চলে গেছে। এর আরেকটি অর্থ হতে পারে, দুর্বৃত্তায়ন বা অপরাধপ্রবণতা রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। যেসব ঘৃণ্য শব্দ অপরাধীদের বেলায় প্রযোজ্য হওয়ার কথা, যেমন- খুন, গুম, জখম, হামলা, মামলা, নারীর ইজ্জত লুণ্ঠন প্রভৃতি সবই রাজনীতিবিদেরা করছেন অথবা এগুলো রাজনীতিকদের কলাকৌশলে পরিণত হয়েছে। এ রকম হাজারো ঘটনা বাংলাদেশের সমাজে আপনার চোখের সামনেই ঘটছে। প্রতিদিন সংবাদপত্র এবং চ্যানেলগুলো এ ধরনের অসংখ্য সংবাদ প্রকাশ করছে। ইদানীং এ ধরনের আরেকটি প্রবণতা আমাদের রাষ্ট্র ও সরকারকে আচ্ছন্ন করছে। আর তা হলো- অপরাধের রাজনীতিকীকরণ। সমাজে চোরচোট্টা, গুণ্ডাপাণ্ডা ও বাটপাড়-বদমাশ কোন কালে ছিল না? যে অপরাধ করে, সে অপরাধী। তার কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই।

আমাদের প্রধানমন্ত্রী প্রায়ই এ কথা বলে থাকেন। কিন্তু সমাজ ও সরকার যখন কোনো অপরাধীকে দলীয় পরিচয়ে উপস্থাপন করে, তখন তার অপরাধ ঢাকা পড়ে রাজনৈতিক পরিচয়টিই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। আগেই বলা হয়েছে, রাজনীতির মধ্যে অপরাধ এখন এমনভাবে ‘গ্রহণযোগ্য’ হয়ে উঠেছে যে, চুরি করে কেউ যখন হাতেনাতে ধরা পড়ে, তার লোকেরা বা দলীয় নেতারা তার পক্ষ নিতে এমনকি মিটিং-মিছিল করতেও লজ্জাবোধ করেন না। তারা ছলে-বলে-কৌশলে দলীয় লোকটি যে চোর নয়, তা-ই প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। কখনো কখনো অপরাধী ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা রাজনৈতিক পরিচয়ের বলে প্রতিপক্ষের ওপর দায় চাপাতে চায়। ব্যক্তি, সমাজ, দল যখন অপরাধের পক্ষ নেয়, তখন ‘আনুগত্যের’ স্বার্থে না হয় সেটা করা হয় বলে ধরে নেয়া যায়।

কিন্তু যখন খোদ সরকার কোনো অপরাধকে রাজনীতিকীকরণের মাধ্যমে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে চায়, তখন নিশ্চয়ই প্রশ্ন উত্থাপন করতে হয়। এর সর্বশেষ উদাহরণ হচ্ছে, ঢাকার বনানীর এফ আর টাওয়ার মামলায় বিএনপি নেতা তাসভির উল ইসলাম। তিনি যদি সত্যিই অপরাধ করে থাকেন, দল তার পক্ষ নিতে পারে না। যদি তিনি অপরাধী না হয়ে থাকেন অথবা তার অপরাধ প্রমাণ না করে রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে সরকার এবং সরকারি দল উদ্দেশ্যমূলকভাবে তুমুল ঢাকঢোল পেটাতে থাকে তখন সহজেই বোঝা যায়, এই প্রচারের মাধ্যমে ওই দল রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি করতে চায়।

প্রকাশিত তথ্য মতে, কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপি নেতা তাসভির উল ইসলাম এফ আর টাওয়ারের বর্ধিত অংশের মালিক। দুর্ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যেই রাজউক জানায়, ভবনটির অনুমোদন ছিল ১৮ তলার, তা ২৩ তলা পর্যন্ত উঠে গেছে। কিভাবে তা ২৩ তলা হয়ে গেল তার সমর্থনে নথিপত্র রাজউকে থাকার কথা; কিন্তু নেই। পুলিশের মহাপরিদর্শক জাবেদ পাটোয়ারীও প্রশ্ন তুলেছেন, বিগত ১৪ বছর বিষয়টি রাজউক জেনেও কেন চুপ করে ছিল? ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছেন, বহুতল ভবনে অনিয়মের ব্যাপারে তারা এখন জিরো টলারেন্সে। এখন আর কথা বলার সময় নেই। এটা অ্যাকশনের সময়।

প্রতিটি ঘটনা-দুর্ঘটনার পরপরই কর্তৃপক্ষ তর্জন-গর্জন করে থাকে। তবে একসময় যখন গণরোষ থেমে যায়, তখন তারাও থেমে যান। যেমন- পুরান ঢাকায় রাসায়নিক পদার্থজনিত আগের অগ্নিকাণ্ডের পর তারা ওই রকম বড় বড় ফাঁকাবুলি আউড়ে ছিলেন সরবে। তবে পাঁচ বছরেও তাদের অ্যাকশনে যাওয়ার কোনো নজির দেখা যায়নি। নেতা ও কর্তারা জিরো টলারেন্সের কথা অনেক ক্ষেত্রে অনেকবারই জাতিকে শুনিয়েছেন। কিন্তু একসময় অপরাধীরা জিরো থেকে হিরো হয়ে গেছে। এ দেশে অপরাধী জেলে গেলে নাকি জনপ্রিয়তা বাড়ে! ফুলের মালা গলায় দিয়ে তারা ‘মামাবাড়ি’ থেকে যেন বেরিয়ে আসে। একজন ইউনিয়ন কাউন্সিল চেয়ারম্যানের কথা জানি। তিনি ধর্ষণ মামলার আসামি হিসেবে গ্রেফতার হয়েছিলেন। যখন সরকার বদল হলো, দলীয় নতুন সরকারকে তিনি বুঝাতে সক্ষম হলেন, মামলাটি ‘ষড়যন্ত্রমূলক’। অনেক অর্থের বিনিময়ে তিনি ‘বেকসুর খালাস’ পেয়েছিলেন।

সরকারি দল তাকে প্রকাশ্যে হিরো বানিয়ে দেয়। গডফাদাররা সগৌরবে ক্ষমতাসীন দলের লোক পরিচয় দিচ্ছেন। মানুষকে বোকা বানিয়ে বিগত বোগাস নির্বাচনে তারা স্বামীর বদলে স্ত্রী, বাবার বদলে ছেলেকে সংসদ সদস্য বানিয়ে প্রকারান্তরে তাদের অপরাধের স্বীকৃতি দিয়েছেন। দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত একজন মন্ত্রীকে গুড ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট দিয়ে বলেছেন, তার চরিত্র, ফুলের মতো পবিত্র। আরেকজন সন্ত্রাসী নেতার ‘অভিভাবক’ হিসেবে দায়-দায়িত্ব স্বীকার করেছেন। একজন সংসদ সদস্যকে তিনি নিজে দুর্নীতিবাজ বলার পরও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সেখানে খোলস বদল হয়েছে মাত্র। বাংলাদেশে এ রকম উদাহরণ যেকোনো জায়গায় দেখতে পাবেন।
এফ আর টাওয়ারের ক্ষেত্রে ফিরে আসি। সেখানে আরো দু-একজন আসামির সাথে তাসভির গ্রেফতার হয়েছেন। তিনি ভবনের সর্বোচ্চ অংশের মালিক। কিন্তু যিনি মূল মালিক বা ডেভেলপার তাদের কোনো হদিস নেই।

এখানে একটা বড় ‘যদি’ আছে। মূল মালিক যদি আওয়ামী লীগার হয়ে থাকেন, অন্যরাও যদি কেউ একই পরিচয় বহন করেন, তখন আইন কেন হবে অন্ধ? তখন যেন চোখে দেখে না, কানে শোনে না এবং তাদের আক্কেলবুদ্ধি নেই। দেখা যায়, যদি তারা বিরোধী পক্ষের কেউ হন, তাহলে আর রক্ষা নেই। শুধু মালিককে ধরা হবে না, তার স্ত্রী-সন্তান-পরিজন কেউই রেহাই পাবে না। এমনকি পুলিশ তার মামাতো ভাই, চাচাতো ভাই বা খালাতো ভাইকেও গ্রেফতার করবে। আইন বলে, বাবা ছেলের অপরাধের জন্য দায়ী নন। তেমনি বাবার অপরাধের জন্য ছেলের শাস্তি হতে পারে না। কিন্তু বর্তমান ক্ষমতাসীনেরা এমন উদাহরণও স্থাপন করেছেন, বাড়ির দারোয়ান ও ড্রাইভারও রক্ষা পায়নি। অপর দিকে এই সরকার সব অপরাধের বোঝা বিরোধীদের ঘাড়ে তুলে দিয়ে নিস্তার পেতে চায়। জঙ্গি হামলার সময় পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের দেয়া বিবৃতি মনে করার চেষ্টা করুন। দেখবেন, আকার-ইঙ্গিতে তারা বিরোধী দলকে দায়ী করেছেন বিনা প্রমাণে। বিগত ১২ বছরে যেকোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে ‘জঙ্গি’ রূপ দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এ কাজ করার জন্য রাষ্ট্রের এজেন্সিগুলোকে কাজে লাগানো হয়েছে। নিজেদের লোক দিয়ে আগুন লাগিয়ে বিএনপিকে সন্ত্রাসী দল প্রমাণের প্রাণান্ত চেষ্টও দেখা গেছে। এর ফলে পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিকবিশ^ ভুল বার্তা পেয়েছে। সে অনুযায়ী কাজও করেছে। পরে তারা দেখেছে, ওই তথ্যগুলো ছিল সর্বৈব মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তাদের স্বরূপ প্রকাশ পেয়েছে। এখন হয়তো তারা পরিবর্তনের চেষ্টা করছে। তবে এতে হয়ে গেছে অনেক দেরি।

দেশব্যাপী পরিবহন নৈরাজ্য, তিনটি বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড এবং সারা দেশে আইনশৃঙ্খলার ব্যাপক অবনতির কারণ বিচারহীনতার সংস্কৃতি। ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা যত অপরাধই করুক না কেন, তাদের সাত খুন মাফ। পুরান ঢাকার বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের কথাই ধরা যাক। সবাই দেখেছেন, কয়েকজনের ফাঁসি হয়েছে। তাদের একজন বাদে আর সবাই পলাতক। আর বিরোধী পক্ষ বলছে, তারা নাকের ডগায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। পুলিশ তাদের দেখেও দেখতে পাচ্ছে না। এভাবে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হত্যা ও হানাহানি ঘটিয়ে শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংসের প্রান্তসীমায় শাসক দলের সহযোগীরাই পৌঁছে দিয়েছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। গ্রেফতার হলে তারা ছাড়া পেয়ে যায়। চক্ষুলজ্জার ভয়ে পুলিশ অপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা করলেও অনায়াসে তারা বেরিয়ে আসে। এই তো সে দিন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন ছাত্র ছিনতাই করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়ে।

তাদের পুলিশে দেয়া হয়নি। ছেড়ে দেয়া হয়েছে। কারণ, তারা ‘ছাত্রলীগের কর্মী’। এভাবে গোটা দেশকে তারা অপরাধের অভয়ারণ্যে পরিণত করেছে। শুধু শিক্ষাঙ্গন নয়, দেশের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে তারা অপরাধের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে। রাতের অন্ধকারে ভোট চুরি করে গণতন্ত্রকে কলঙ্কিত করেছে। জনগুরুত্বপূর্ণ বিভাগে এমন সাত রাজার ধন মানিকদের পদায়ন করেছে; যারা খুন, সন্ত্রাস ও দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত। বিশেষত নির্বাহী বিভাগ দুর্নীতির সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। যারা এসব করছে তারা যদি বিশেষ দলের লোক হয়ে থাকে, তারা সাধারণত বিচারের সম্মুখীন হচ্ছে না। তারা যাতে গ্রেফতার না হয়, মনে করা যায়- সে জন্য আইন প্রণয়ন করা হয়েছে যে, সরকারের পূর্বানুমতি ছাড়া মামলা হলেই গ্রেফতার করা যাবে না। সম্প্রতি প্রমাণ হয়েছে প্রশাসনের শীর্ষে অবস্থানকারী ছয়জন সিনিয়র সচিব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট নিয়েছেন। শাসক দলের একান্ত অনুগত হওয়ার কারণে তারা এ অন্যায় করার সাহস পেয়েছেন। তাদের কিছু হবে, এমন বিশ^াস করা কঠিন।

রাষ্ট্রবিজ্ঞান বলে- রাষ্ট্রের যেকোনো পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জনে ‘পলিটিক্যাল উইল’ বা রাজনৈতিক সদিচ্ছা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু রাজনৈতিক কর্তৃত্ব যদি অপরাধের রাজনীতিকীকরণ ঘটান, তাহলে এটা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে যে, রাষ্ট্রযন্ত্র হয়ে পড়ছে অপরাধপ্রবণ। সরিষায় ভূত থাকলে ভূত তাড়াবে কে? বেড়ায় যদি ক্ষেত খায়, তাহলে ক্ষেত রক্ষা পাওয়ার আর কোনো উপায় আছে কি?

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement