২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে’

- ছবি : নয়া দিগন্ত

বিজ্ঞানী নিউটনের তৃতীয় সূত্র- ‘প্রতিটি ক্রিয়ার একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে।’ অর্থাৎ যা কিছু করি না কেন, তার একটি সমান ফল বা পরিণতি অবধারিত। সেই অর্থে বলা চলে- সমাজে কেউ ভালো কাজ করলে ইতিবাচক প্রতিফল তার প্রাপ্য। কেউ খারাপ কাজে লিপ্ত হলে কপালে দুর্ভাগ্য নিশ্চিত। ঠেকানোর উপায় নেই। এটা প্রকৃতির প্রতিশোধ। বহুল প্রচলিত প্রবাদ- যেমন কর্ম তেমন ফল।

অবশ্য, দেশে এখন যে সামাজিক অবস্থা বিরাজমান; তাতে এ কথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, ‘চোরে না শোনে ধর্মের কথা’। সুনীতির দিন বাসি, আদর্শবানের দিন শেষ। প্রতিযোগিতার এ যুগে নীতিকথার যেন কদর নেই। ভালো কথায় পেটের ভাত জোটে না। নীতিকথা শুধু বইয়ের পাতাতেই মানানসই; বাস্তবে অচল। এমন ভাবনায় অনেকের মন আচ্ছন্ন। চার পাশে চেনাজানা অনেককে পাওয়া দুষ্কর নয়, যেনতেনভাবে বিত্তবৈভব পেতে তাদের কত কসরত। এ জন্য বড়ই পেরেশান আর হয়রান। দম ফেলার ফুরসত নেই। ধান্ধায় প্রাণপাত। চায় শুধু ‘সাফল্য’। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা আর ক্ষমতা। তবে এতে অনেকে হয়ে পড়েন হিতাহিতজ্ঞানশূন্য। তাদের দেখলে সাধারণেরও মায়া আর করুণায় মন বিষন্ন হয়ে ওঠে। তেমন দু’টি ঘটনা বর্তমানে বেশ আলোচিত।

১১ মার্চ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন। ভোট গ্রহণের আগের রাতে বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলে ব্যালট পেপারে সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরতে সহযোগিতা করায় হল প্রভোস্ট শবনম জাহান সাময়িকভাবে বরখাস্ত হয়েছেন। যাদের জন্য তিনি অপকর্মটি করলেন, অপবাদের এত বড় গ্লানি মাথা পেতে নিলেন, তারা কেউ তার দুর্দিনে পাশে দাঁড়ালেন না। সত্যি এটি বড়ই ‘অকৃতজ্ঞতা’। রীতিমতো ‘নিমক হারামি।’ যার জন্য করি চুরি, সেই বলে চোর! বেচারির রুটি-রুজি নিয়ে এখন টানাটানি। এমন কাজ করায় কোথায় কপালে জুটবে পুরস্কার-সম্মান; সেখানে নিন্দার কাঁটা বিঁধল পায়ে। কপালে কলঙ্কতিলক; এটাও কি মানা যায়! এমন হলে তো কেউ কারো উপকার করবে না। এমনিতেই কথার প্রচলন হয়নি- উপকারীকে বাঘে খায়।

শবনম জাহানের করুণ কাহিনী খবরের কাগজে ছাপা হয়েছে। শিরোনাম- ‘চাকরিচ্যুত হলেন মৈত্রী হলের সেই প্রাধ্যক্ষ’। ২৮ মার্চ রাতে ভিসি অধ্যাপক ড. মো: আখতারুজ্জামানের সভাপতিত্বে সিন্ডিকেট সভায় তাকে সাময়িকভাবে চাকরিচ্যুত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। একই সাথে, কেন তাকে স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যুত করা হবে না- এ বিষয়ে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর আগে ডাকসু নির্বাচনের দিন প্রাথমিকভাবে ভোট জালিয়াতির সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় তাকে প্রাধ্যক্ষ পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। শবনম জাহানের সাময়িক চাকরিচ্যুতির বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেন সিন্ডিকেট সদস্য হুমায়ুন কবীর। নৈতিক স্খলনের ঘটনায় তার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তির সুপারিশ করেছে তথ্য অনুসন্ধান কমিটি। এ ঘটনায় এককভাবেই তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হলো। ১১ মার্চ ডাকসু ও হল সংসদের ভোট গ্রহণের দিন সকালে মৈত্রী হলে বস্তাভর্তি ‘সিল মারা’ ব্যালট পেপার ধরা পড়েছিল। এ ঘটনায় তিন ঘণ্টা বিলম্বে ভোট গ্রহণ শুরু করতে হয়।

ঘটনাস্থল বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় (ববি)। মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ববির শিক্ষক ও নগরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সম্মানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের চা-চক্র ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়েছে। অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। এর প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। ভিসি মহোদয় তো ‘ঠিক কাজ’ই করেছেন। আমাদের বঙ্গীয় সমাজ বাস্তবতায় গুরুজনদের সাথে ‘পোলাপান’দের একসাথে বসে আনন্দ উপভোগের রেওয়াজ মনে করা হয় বেমানান। অনেকেই ভালো চোখে দেখেন না এটাকে। ভিসি যদি এ দৃষ্টিকোণ থেকে নিজের সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদের সে অনুষ্ঠানে যেতে বারণ করে থাকেন, তাতে দোষের কী হলো? শিক্ষার্থীদের সাথে বসে খানাপিনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নির্মল আনন্দ উপভোগ করা কি শরমের বিষয় নয়! লোকনিন্দার কথা না হয় বাদই দিলাম। কিন্তু শিক্ষার্থীরা গোসসা করে নিজেদের কল্পিত সম্মানহানির অভিযোগে প্রতিবাদ করবেন, এটা হয় না। ব্যাপারটা বড়ই অবিবেচনাপ্রসূত; অন্যায়।

আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ায় ওই দিন দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেটিং সোসাইটির আন্তঃবিভাগীয় বিতর্ক প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে ভিসি প্রফেসর এস এম ইমামুল হক মাথা গরম কবে আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলেছেন- এমন অভিযোগ শিক্ষার্থীদের। তবে বিতর্কিত মন্তব্য করার অভিযোগ শুরু থেকেই অস্বীকার করে আসছেন ভিসি। না হয়, ভিসি এমন কথা মুখ ফসকে বলেই ফেলেছেন। তাই বলে গুরুর বিরুদ্ধে আন্দোলন-বিষোদগার? ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলায় শিক্ষার্থীদের ক্ষ্যাপার কী আছে? সাদা চোখে দেখলে সব সাদামাটা। দ্বিমাত্রিক অর্থাৎ দুই দিক থেকে দেখলে নেতিবাচক কোনো উপাদান খুঁজে পাওয়া যাবে কি? চার পাশে দেখা যায় অনেক বাবা-মা সন্তানদের রাগের মাথায় বকাঝকা করেন। ‘হারামজাদা’ বলতেও শোনা যায়।

তাই বলে ওই সন্তান বাবা-মায়ের নিষিদ্ধ সন্তান হয়ে যায় না। রাগের মাথায় আর অভিমানে ববি ভিসি যদি এমন কথা বলেও থাকেন, তা শিক্ষার্থীদের দেখেও না দেখা উচিত। বিষয়টি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখা যায়। কে না জানে, ক্ষমা হচ্ছে মানবজীবনের একটি মহৎ গুণ। সেই আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিউজিল্যান্ডে শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসীর গুলিতে মসজিদে জীবনসঙ্গিনী হারিয়েও খুনিকে স্বামী মাফ করে দিয়েছেন। এই তো সে দিনের কথা। আর ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলা অনেকের মতে নস্যি! এর প্রতিবাদে ছাত্রছাত্রীদের ভিসির পদত্যাগের দাবি কতটা যুক্তিসঙ্গত, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। আর একটি বিষয়- ভিসি মহোদয় দাবি করেছেন, তিনি এমন কথা বলেননি। গুরুজন হয়ে তিনি কি অসত্য কথা বলবেন?

মন্তব্যের জন্য ইতোমধ্যে দুঃখ প্রকাশ করেছেন ভিসি। তা সত্ত্বেও ভিসির পদত্যাগের দাবিতে গোঁধরা শিক্ষার্থীদের বাড়াবাড়ি বটে। দুঃখ প্রকাশের নামে ভিসি ‘কৌশলী বক্তব্য’ দিয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন শিক্ষার্থীরা। তাদের ভাষ্য, ভিসি ক্ষমা প্রার্থনা করে যে দায়সারা বক্তব্য দিয়েছেন তা চতুরতা মাত্র। শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকারের সন্তান’ বলে এখন তা অস্বীকার এবং প্রকৃতপক্ষে সত্যকে আড়ালের চেষ্টা করছেন ভিসি। তাকে ‘নিঃশর্ত ক্ষমা’ চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চলে যেতে হবে। এর নাকি কোনো বিকল্প নেই। অন্যথায় শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন।

নিন্দুকেরা উল্টো বলছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কুয়েত মৈত্রী হলের প্রভোস্ট তার পদমর্যাদা ‘জলাঞ্জলি’ দিয়ে পছন্দের প্রার্থীদের নির্বাচিত করতে যেমন উঠেপড়ে লেগেছিলেন, পরিণামে এখন ‘বলির পাঁঠা’ হয়ে পস্তাচ্ছেন। আর অতি জোশে বেফাঁস কথা বলে অবস্থা বেগতিক দেখে তড়িঘড়ি নিজের কথা প্রত্যাহার করে সাধের পদ থেকে পত্রপাঠ বিদায়ের ভয়ে ভীত ভিসির এই পিছুটান। দুঃখ প্রকাশের বিষয়ে তিতা কথা- ‘ঠেলায় পড়লে বাঘেও ধান খায়!’ শিক্ষার্থীরা আরো বলছেন, ভিসি পদ ঝুঁকিমুক্ত করতে এখন তিনি ব্যতিব্যস্ত। নিজের বুঝ তো সবাই বোঝে। আর তিনি তো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি। কিন্তু বিপদ বুঝি তার পিছু ছাড়ছে না।

দু’টি ঘটনা দেখে অভাজনের নিবেদন, ‘ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না।’ পরিণতির কথা না ভেবে কোনো কাজ করতে নেই। কাজের প্রতিক্রিয়া মাথায় না রাখলে মাছের লোভে ঠোকর দিয়ে ফাঁদে আটকে বক যেমন বাঁচার জন্য পাখা ঝাপটায়, তা থেকে লোককথার উদ্ভব- ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে’। এই ঘটনার পর ভুক্তভোগী দু’জনের ছটফটানি দেখে ঠিক তেমন দৃশ্য কারো মনে পড়লে কি খুব দোষ দেয়া যায়?

camirhamza@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement