১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পোস্টমর্টেম : জাতীয় নির্বাচন-২০১৮

- ফাইল ছবি

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের টিকিটে মৌলভীবাজার-২ আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ বলেছেন, ‘আগেও আওয়ামী লীগে ছিলাম, এখনো আছি। আমি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে নির্বাচন করলেও আওয়ামী লীগ আমাকে বহিষ্কার করেনি বা আওয়ামী লীগও ছেড়ে যাইনি। তাই জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে নির্বাচিত হয়েও শপথ নিয়েছি।’

২২-৩-২০১৯ সকালে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। নচিকেতা নামক কলকাতার একজন প্রতিবাদী কণ্ঠশিল্পী গানে গানে ‘মন্ত্রীরা সব হারামজাদা’ বলে রাজনীতিকে মিউজিক্যাল চেয়ার খেলার সাথে তুলনা করে বলেছেন, রাজনীতিতে ডান-বামের কোনো পার্থক্য নেই, আজকে যে ডানে কালকে সে বামে, সুবিধামতো এক জায়গায় বসতে পারলেই হলো, নীতির কোনো বালাই নেই। প্রকৃতপক্ষে রাজনীতি হলো একটি আদর্শিক বিষয়, যা খুবই আকর্ষণীয়। কিন্তু বর্তমানে রাজনীতিকদের কর্মকাণ্ডে প্রমাণিত হচ্ছে, রাজনীতি একটি লোভনীয় বিষয়। লোভের বশবর্তী হয়ে জনতার চোখে অনেক নিচে নেমে যেতেও কোনো আপত্তি বা বিপত্তি নেই। লোভনীয় পদে অধিষ্ঠিত হতে একশ্রেণীর রাজনীতিকের চক্ষুলজ্জা তো উঠেই গেছে। বরং তাদের মানসিক ভারসাম্য এমন জায়গায় ঠেকেছে যে, তারা জনগণকে ‘ছদকার ছাগল’ মনে করেন। কারণ, জনগণকে যেভাবেই হোক জবাই করতে পারলেই হলো (!), তাতেই নাকি জনগণ সন্তুষ্ট। এটাই তারা মনে করেন।

জাতীয় নির্বাচনের আগে ঐক্যফ্রন্টের সিলেট জনসভায় উপস্থিত ছিলাম। সেখানে আওয়ামী লীগ সরকারের দুঃশাসনের সবচেয়ে বেশি সমালোচনা করেছেন সুলতান মনসুর। তিনি ছিলেন ১/১১ সরকারের ‘অন্যতম দোসর’। তিনি বিএনপির নির্বাচনী প্রতীক ‘ধানের শীষ’ নিয়ে আওয়ামী ঐক্যজোটের বিরুদ্ধে নির্বাচন করেছেন। তীব্র সমালোচনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কর্মকাণ্ডের। সরকার পরিবর্তনের জন্য জনগণকে আশার আলো দেখিয়েছেন। তিনিই ২২ মার্চ বলেছেন, ‘আমি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে নির্বাচন করলেও আওয়ামী লীগ আমাকে বহিষ্কার করেনি বা আওয়ামী লীগ ছেড়ে যাইনি। তাই জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে নির্বাচিত হয়েও আমি শপথ নিয়েছি।’ জনগণ বিবেচনা করবেন সুলতান মনসুর আদর্শনিষ্ঠ কথা বলছেন, না কিছুর বশবর্তী হয়ে ঐক্যফ্রন্ট ও গণফোরামের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণ করলেন?

তবে সুলতান জনগণের সাথে যে এক ধরনের প্রতারণা করছেন তা কি তিনি খণ্ডাতে পারবেন? তার বক্তব্য মতে, তিনি যদি আওয়ামী লীগেই থেকে থাকেন, তবে গণফোরামে যোগ দিয়ে আওয়ামী লীগের বিপরীত মার্কা ‘ধানের শীষের’ প্রার্থী হয়ে জনগণের ভোট প্রার্থনা করলেন কেন? একই সাথে দু’টি সামাজিক সংগঠন করা যায়। কিন্তু একই সাথে কি দু’টি তথা সরকারি এবং বিরোধী রাজনৈতিক দল করা যায়? সুলতান মনসুর যদি আওয়ামী লীগেই থেকে থাকেন তবে কি শুধু নমিনেশনের আশায় গণফোরামে যোগ দিয়েছিলেন? সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি (ক) উক্ত দল হইতে পদত্যাগ, অথবা (খ) সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোট দান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাহার আসন শূন্য হইবে, তবে তিনি সেই কারণে কোনো নির্বাচনে সংসদ সদস্য হইবার অযোগ্য হইবেন না।’

সংসদ থেকে তার সদস্য পদ যাতে বাতিল না হয়, শুধু এ কারণেই কি সুলতান মনসুর বলেছেন, তিনি আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেননি? জাতীয় সংসদ এ ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নেবে, তাও এখন দেখার বিষয়। সংসদ যেহেতু এখন আওয়ামী লীগের দখলে (সংসদীয় বিরোধী দলসহ) সেহেতু স্পিকারও বিষয়টিতে চুপ থাকতে পারেন। তবে বিষয়টি নির্ভর করছে প্রধানমন্ত্রীর খেয়ালখুশির ওপর। বাংলাদেশের রাজনীতি কি এতই সস্তা হয়ে গেছে যে, মুখভরা ফাঁকাবুলি দিয়ে জনগণকে পটানো যায়? অনেক জেলা পর্যায়ে দেখা যায়, বিএনপির বড় বড় পদে থেকে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির মঞ্চে বক্তৃতা করছেন। অথচ বিএনপি থেকে এ মর্মে কোনো সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেই।

সাংগঠনিক নিয়মশৃঙ্খলা যেখানে মানা হয় না, সেখানেই ঘুণে ধরে, যা সহজে উপলব্ধি করা যায়; তবে যখন ঘুণে ধরা ‘আবাসে’ ধস নামে তখন প্রতিকারের আর সুযোগ থাকে না। দলীয় নেতাদের প্রতি উচ্চপর্যায়ের নেতারা সাংগঠনিক অ্যাকশন নেয়া থেকে বিরত থাকার কারণ, উচ্চপর্যায়ের নেতারাও দলীয় গ্রুপিংয়ে জড়িত নতুবা লোভ তাদের পিছু ছাড়ছে না। দলের কেন্দ্রীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা কী জবাব দেবেন? জবাবদিহিতা না থাকার ফলে তৃণমূলপর্যায়ে নেতাকর্মীদের হৃদয়ে যে রক্তক্ষরণ হয়, তার প্রতিকার না করা কি দলের জন্য শুভ হচ্ছে?

সুলতান মনসুরদের বির্তকিত ভূমিকার কারণে ঐক্যফ্রন্ট তো বটেই, গোটা রাজনীতি আজ বিতর্কিত। আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট (১৯৪৫-৫২) Harry S. Truman বলেছেন, My choice early in life was either to be a piano player in a whore house or a politician. And to tell the truth, there’s hardly any difference. অর্থাৎ ছোটবেলা থেকেই আমার পছন্দ ছিল বেশ্যালয়ের পিয়ানো বাদক বা রাজনীতিবিদ হওয়া, উভয়ের মধ্যে তেমন কোনো তারতম্য নেই। সুলতান মনসুর কি আমেরিকার এই সাবেক প্রেসিডেন্টের মতবাদে বিশ্বাসী? নেতার মঞ্চের বক্তব্য ও ব্যক্তিচরিত্রে যখন সমন্বয় থাকে না তখনই নেতৃত্বের প্রতি গণমানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলে। দেশে আন্দোলনে গণবিমুখতার এটাও কারণ।

গত ২২-২-২০১৯ ইং তারিখে সুপ্রিম কোর্ট অডিটোরিয়ামে ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীদের গণশুনানিতে প্রার্থীরা নিজ নিজ এলাকায় নির্বাচনের আগের রাতে সিল মারাসহ প্রশাসনিক তাণ্ডবের কথা তুলে ধরেন। শুনানির একপর্যায়ে অন্যতম প্রার্থী, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নাল আবদিন ফারুক বিগত নির্বাচনে নিজেদের ব্যর্থতার দায় কতটুকু, তাও আলোচনায় আনার দাবি জানান। জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক আলোচনায় বিএনপি যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেছেন, তৃণমূল নেতাকর্মীদের তিন দিন আলোচনা করার সুযোগ দেয়া হোক, যাতে নির্বাচনবিষয়ক সব বিষয় (দলীয় দায়দায়িত্বসহ) ও তথ্য, সরকারি জালিয়াতি ও ভোট ডাকাতির বিস্তারিত চিত্র প্রকাশ পায়। আমরা মনে করি, সরকারি দলের জালিয়াতি ও ভোট ডাকাতি আজ দিবালোকের মতো সত্য প্রমাণিত হলেও নির্বাচনী মাঠে কেন বিএনপি তথা ঐক্যফ্রন্ট কেন্দ্র পাহারা দেয়ার ঝুঁকি নিতে পারল না, তা নিয়েও বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা হওয়া আবশ্যক।

জাতীয় নির্বাচনের আদলে পরবর্তী উপজেলা ও অন্যান্য নির্বাচনে যা ঘটছে, তার দায় বহনে সরকার ব্যর্থ। এখানে সরকারের কাছে শুধু বিএনপি বা ঐক্যফ্রন্ট পরাজিত নয়, বরং গোটা জাতি আজ পরাজিত। জনগণ হারিয়েছে তাদের ন্যায্য সাংবিধানিক ভোটাধিকার যে জন্য এ জাতি একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছিল।

আলোচনা-সমালোচনা যাই হোক না কেন, প্রতিকারের জন্য রাজনীতিকদের অবশ্যই একটি পন্থা খুঁজে বের করতে হবে। এর পুঞ্জীভূত ক্ষোভ থেকে নেতৃত্বের প্রতি জনগণ দিন দিন আস্থাহীন হয়ে পড়ছে এবং রাজনীতিতে ঘুরে না দাঁড়ানোর এটাও অন্যতম কারণ। তবে জাতীয় নেতৃত্ব বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারছেন কি না, এটাও বিবেচনার বিষয়।

আত্মসমালোচনা একটি দল ও সংগঠনকে মজবুত করে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আত্মসমালোচনা করলে অন্যরা লাভবান হলেও নিদারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আত্মসমালোচনাকারী নিজেই। তবে সস্তা জনপ্রিয়তার দিকে না তাকিয়ে কথা বলার জন্য কাউকে না কাউকে ঝুঁকি তো নিতেই হবে, যাতে রক্ষা পাবে জাতীয় স্বার্থ। আশার কথা, ওপরের স্তরে সংখ্যা কম হলেও নিম্নপর্যায়ে ব্যতিক্রম মাঝে মধ্যে হলেও কিছু দেখা যায়, যাতে বুক ভরে ওঠে। তখন গণমানুষ আশান্বিত হয় এই ভেবে যে, তোষামোদি ও চাটুকারি না করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ক্ষুদ্র হলেও জনগোষ্ঠীর একটি অংশ সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ানোর সৎ সাহস রাখে।

জাতীয় দৈনিকে ২৫-৩-২০১৯ তারিখে প্রকাশিত এক সংবাদে একজন প্রিসাইডিং অফিসারের বক্তব্যে দেখা যায়, ‘৮৫ চাতল বাগহাটা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে রাতে কিছু দুষ্কৃতকারী আমার অবাধ্য হয়ে চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৭২৯টি ব্যালট ছিনিয়ে নিয়ে সিল মেরেছে। ভোট গ্রহণ সম্ভব না থাকায় আমি ওই কেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা করলাম।’ ২৪ মার্চ বেলা ১১টার দিকে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার বাগহাটা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রের দেয়ালে এ বার্তাটি টানিয়ে রাখতে দেখা যায়।

এর নিচে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা শাহ আলমের সই। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও রিটার্নিং কর্মকর্তা মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম গোটা উপজেলার ৮৯টি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ স্থগিত ঘোষণা করেন। তাজুল ইসলাম বলেন, ‘কটিয়াদী উপজেলায় মোট ভোটকেন্দ্র ৮৯টি। সকালে পাঁচটি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়। এসব কেন্দ্রে জোর করে রাতে ব্যালট বাক্স ভরার প্রমাণ পাওয়া গেছে। পরে এ রকম খবর আরো আসতে থাকে। সাড়ে ৯টার সময় সব কেন্দ্রেই ভোট স্থগিত করা হয়।’ রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, কেন্দ্রগুলোতে রাত ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে নৌকা প্রতীকে সিল মেরে বাক্স ভরে রাখা হয়। প্রথমে লোকজন এসে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের মুঠোফোন ছিনিয়ে নিয়ে ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভরে ফেলেন। এ সময় পুলিশ নীরব ভূমিকা পালন করেছে। কোথাও কোথাও পুলিশ ছিল সহযোগীর ভূমিকায়। বাক্স ভরে চলে যাওয়ার সময় দুর্বৃত্তরা নির্বাচনী কর্মকর্তাদের মুঠোফোন ফেরত দিয়ে যায়।

জনগণের অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রপতির নিজ জেলার কটিয়াদী উপজেলার বাগহাটা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার শাহ আলম এবং জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও রিটার্নিং অফিসার অন্যায়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সত্যের পক্ষে দৃঢ়তার সাথে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। যদি দেশব্যাপী নির্বাচনী দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্য কর্মকর্তারা এমনিভাবে সাহসিকতার পরিচয় দিতেন, সত্যের পক্ষে দৃঢ় থাকতেন; তবে নিশ্চয়ই জনগণের ভোটাধিকার ধর্ষিত হতো না। জাতির এ ক্রান্তিলগ্নে যখন সংখ্যাগরিষ্ঠরা চাটুকারিতায় গা ভাসিয়ে দিয়েছে, অন্যায়কে না দেখার ভান করে সহযোগিতা করে, তাদের বিপরীতে শাহ আলম ও তাজুল ইসলামদের প্রতি রইল অনেক অভিনন্দন। জাতি প্রত্যাশায় রইল, আমাদের দেশে সেই ছেলে হবে কবে? কথায় বড় না হয়ে কাজে বড় হবে।

লেখক : কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail : taimuralamkhandaker@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement