২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সালিসের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি

-

কোনো দাবি বা অধিকার বিষয়ে দু’টি পক্ষের মধ্যে মতদ্বৈধতা দেখা দিলে বিরোধের উদ্ভব হয়। আমাদের দেশে আদালতের মাধ্যমে যেমন বিরোধের নিষ্পত্তি হয়, এর পাশাপাশি সালিসের মাধ্যমে আইনগতভাবে বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা রয়েছে। সালিসের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে সালিস আইন কার্যকর হওয়ার আগেও দেখা গেছে বিরোধে লিপ্ত পক্ষগুলো সমাজের প্রভাবশালী, গ্রহণযোগ্য ও সম্মানিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে পরিচালিত সালিসি কার্যক্রমের মাধ্যমে পক্ষদ্বয়ের সন্তুষ্টিতে বিরোধ নিষ্পত্তিতে সমর্থ হয়েছে। সালিসের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি প্রচলিত আদালত ব্যবস্থাপনার বাইরে বিকল্প পদ্ধতিতে একধরনের বিরোধ নিষ্পত্তি। বর্তমানে আমাদের দেশের আদালতগুলো মামলার ভারে জর্জরিত। প্রতি বছরই দেখা যায় ফৌজদারি ও দেওয়ানি উভয় ধরনের মামলা যে হারে রুজু হচ্ছে, সে হারে আদালতের মাধ্যমে মামলার নিষ্পত্তি হচ্ছে না। আদালতের কাছ থেকে দ্রুত ও ন্যায়বিচার প্রাপ্তি দেশের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার হলেও দেশের নাগরিকদের এ অধিকারটি যে সঠিকভাবে রক্ষিত হচ্ছে না, এটি আজ অজানা নয়।

আমাদের দেশে দেওয়ানি বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে সালিস আইন ১৯৪০ কার্যকর ছিল। এ আইনের অধীন সালিসের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির পর পুনরায় তা আদালতে দাখিল করে চূড়ান্ত করার বিধান থাকায় প্রায়ই বিলম্বের কারণ হয়ে দেখা দিত। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে ২০০১ সালে নতুন সালিস আইন প্রণীত হয় এবং সর্বশেষ তা ২০০৪ সালে সংশোধিত হয়।

পক্ষগণের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তিতে সালিসের মাধ্যমে উদ্ভূত বিরোধ নিষ্পত্তির বিষয়ে উল্লেখ থাকলে সালিস আইনের আওতায় সালিসের মাধ্যমে তা আইনগতভাবে সুরাহার সুযোগ রয়েছে। এরূপ যেকোনো বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য যেকোনো পক্ষ আইনগত কার্যধারা রুজু করলে সালিস আইন ২০০১-এর অধীন সালিসি ট্রাইব্যুনাল গঠন করে ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা হয়। সচরাচর দেখা যায়, সালিসি ট্রাইব্যুনাল তিন সদস্যবিশিষ্ট অথবা এক সদস্যবিশিষ্ট হয়ে থাকে। তিন সদস্যবিশিষ্ট ট্রাইব্যুনালের ক্ষেত্রে আদালত বা পক্ষগুলোর মাধ্যমে নিজ নিজ পক্ষের সালিসকার নিয়োগ দেয়া হয়। উভয় সালিসকারের সম্মতিতে একজনকে সালিসি ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। উভয় পক্ষ এ কাজ করতে ব্যর্থ হলে আদালতের মাধ্যমে চেয়ারম্যানের নিয়োগ দেয়া হয়। একক সালিসকারের সমন্বয়ে গঠিত ট্রাইব্যুনালের ক্ষেত্রে পক্ষগণের সম্মতিতে অথবা আদালতের মাধ্যমে সালিসকার নিয়োগ দেয়া হয়।

সালিসকারের যোগ্যতা বিষয়ে সালিস আইন ২০০১-এ সুনির্দিষ্টভাবে কিছু উল্লেখ নেই; তবে সচরাচর দেখা যায় অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি, আপিল বা হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারক অথবা অধস্তন আদালতের জেলা জজ পদমর্যাদার অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের সমন্বয়ে সালিসি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। আইনজীবীদের মধ্য থেকেও সালিসকার নিয়োগ হতে দেখা যায়। সালিসি ট্রাইব্যুনালে মামলা পরিচালনার জন্য আইনজীবী নিয়োগের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। বিরোধে লিপ্ত পক্ষগুলো নিজের অথবা তারা তাদের প্রতিনিধির মাধ্যমে মামলা পরিচালনা করতে পারেন।

সালিসি ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম গৃহীত হওয়ার পর অন্তর্বর্তী কিছু বিষয়ে আদালতের আদেশ দেয়ার ক্ষমতা থাকে। অন্তর্বর্তী ব্যবস্থার মাধ্যমে আদালত নাবালক বা অপ্রকৃতিস্ত ব্যক্তির পক্ষে সালিসি কার্যধারা পরিচালনার জন্য অভিভাবক নিয়োগ দেয়, আদালত থেকে সালিসি চুক্তির অন্তর্ভুক্ত মালামাল বা সম্পত্তি বিক্রয়ের অনুমোদন দেয়া হয়, সম্পত্তি হস্তান্তরের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়, রিসিভার নিয়োগ দেয়া হয় অথবা অন্তর্বর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে সালিসি কার্যক্রমের প্রতিবন্ধকতার অপসারণ করানো হয়।

সালিসি ট্রাইব্যুনালের বরাবর দাখিল করা যেকোনো বিরোধ ন্যায়সঙ্গত ও পক্ষপাতহীনভাবে নিষ্পত্তি করা ট্রাইব্যুনালের আবশ্যিক দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনকালে ট্রাইব্যুনাল প্রত্যেক পক্ষকে লিখিত বা মৌখিক বা উভয়ভাবে নিজ নিজ মামলা উপস্থাপনের যুক্তিসঙ্গত সুযোগ দিয়ে থাকে। প্রত্যেক পক্ষকে অন্যান্য পক্ষ বা সংশ্লিষ্ট অন্য যেকোনো ব্যক্তির ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপিত দলিল ও প্রাসঙ্গিক অন্যান্য সামগ্রী পরীক্ষা করার যুক্তিসঙ্গত সুযোগ প্রদান করা হয়। সালিসি ট্রাইব্যুনালের বরাবর সালিসের জন্য দাখিল করা যেকোনো বিরোধ ট্রাইব্যুনাল যথাসম্ভব দ্রুত নিষ্পত্তি করে থাকে।

সালিসি ট্রাইব্যুনালের জন্য বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে দেওয়ানি কার্যবিধি এবং সাক্ষ্য আইনের বিধানাবলি যথাযথ অনুসরণ বাধ্যতামূলক নয়। সালিসি ট্রাইব্যুনালের বরাবর পক্ষগণ ট্রাইব্যুনালের ধার্য করা সময়ের মধ্যে নিজ নিজ দাবিনামা এবং তদসমর্থনে দলিলপত্র দাখিল করে থাকে; তবে কার্যধারা চলাকালীন পক্ষগুলোর দাবি সংশোধন বা সংযোজনের বিধান রয়েছে। সালিসি ট্রাইব্যুনালে অন্তর্ভুক্ত একজন সালিসকারের কর্তৃত্বের অবসান ঘটে, যদি তিনি নিজ পদ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন অথবা মারা যান। এরূপ ক্ষেত্রে আদালত নতুন সালিসকার নিয়োগ দেয়।

সালিসি ট্রাইব্যুনাল দেওয়ানি আদালতে বিচারকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে যে পদ্ধতি অনুসৃত হয়, সে পদ্ধতি অনুসরণে সচেষ্ট থাকে। যে ক্ষেত্রে সালিসি ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তে অর্থ পরিশোধের বিষয় থাকে সে ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল বিরোধ উদ্ভবের তারিখ থেকে ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্ত প্রদানের তারিখ পর্যন্ত সালিসি চুক্তিতে নির্ধারিত হারে বা চুক্তিতে অনুরূপ হার না থাকলে ট্রাইব্যুনাল নির্ধারিত হারে সুদ যুক্ত করে আদেশ প্রদান করে থাকে।

বিরোধের বিষয়বস্তুর ওপর সালিসি ট্রাইব্যুনালে দেয়া সিদ্ধান্তকে সালিসি রোয়েদাদ বলা হয়। সালিসি ট্রাইব্যুনালের দেয়া রোয়েদাদ চূড়ান্ত মর্মে গণ্য হয় এবং পক্ষগুলো বা তাদের মাধ্যমে দাবিদার যেকোনো ব্যক্তির ওপর রোয়েদাদ বাধ্যকর থাকে।
যে ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল একাধিক সালিসকারী সমন্বয়ে গঠিত হয় সে ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সিদ্ধান্তে রোয়েদাদ কার্যকর হয়। সালিসি রোয়েদাদ লিখিত আকারে দিতে হয় এবং তাতে সালিসকার বা সালিসকারদের স্বাক্ষর থাকতে হয়।

সালিসি ট্রাইব্যুনালের ঘোষিত রোয়েদাদ দিয়ে যেকোনো পক্ষ সংক্ষুব্ধ হলে রোয়েদাদ ঘোষণার ৬০ দিনের মধ্যে তা বাতিলের জন্য জেলা জজ আদালতে আবেদন করতে পারে। জেলা জজ আদালত যেসব কারণে রোয়েদাদ বাতিল করতে পারে তা হলো- ক. সালিসি চুক্তির কোনো একপক্ষের কোনোরূপ অক্ষমতা ছিল; খ. যে আইনের অধীন পক্ষগণ সালিস চুক্তি করেছে সে আইনটি বৈধ আইন নয়; গ. বিরোধে লিপ্ত যেকোনো পক্ষ সালিসকারী নিয়োগ বা সালিসি কার্যধারা সম্পর্কে যথাযথ নোটিশ প্রাপ্ত হয়নি অথবা যেকোনো পক্ষ মামলা উপস্থাপন করতে অন্য কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণে অক্ষম ছিল; ঘ. সালিসি রোয়েদাদ এমন কোনো বিরোধীয় বিষয় সম্পর্কিত, যা সালিসে প্রেরিত বিষয়ের উদ্দেশ্য বা শর্তবহির্ভূত বা তাতে এমন সিদ্ধান্ত রয়েছে, যা সালিসে পাঠানো বিষয়ে পরিধিবহির্ভূত; ঙ. সালিসি ট্রাইব্যুনালের গঠন বা সালিসি পদ্ধতি বিরোধীয় পক্ষগণের চুক্তির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না অথবা এরূপ চুক্তির অবর্তমানে এ আইনের বিধানাবলির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়; চ. বিরোধের বিষয়বস্তু বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুসারে সালিসের মাধ্যমে নিষ্পত্তিযোগ্য নয়; ছ. সালিসি রোয়েদাদ দৃশ্যত বাংলাদেশের প্রচলিত কোনো আইনের পরিপন্থী; জ. সালিসি রোয়েদাদ বাংলাদেশের জননীতির পরিপন্থী অথবা ঝ. সালিসি রোয়েদাদ তঞ্চকতা বা দুর্নীতি দিয়ে প্ররোচিত বা প্রভাবান্বিত।

সালিসি রোয়েদাদ বাতিল করার আবেদন দাখিলের সময়সীমা উত্তীর্ণ হলে অথবা অনুরূপ আবেদন অগ্রাহ্য হলে দেওয়ানি কার্যবিধির অধীন আদালতে কোনো সালিসি রোয়েদাদ এমনভাবে প্রয়োগ করা হয়, যেন তা ওই আদালতেরই ডিক্রি।
জেলা জজ আদালতের সালিসি রোয়েদাদ বাতিল ঘোষিত হলে বা জেলা জজ আদালত সালিসি রোয়েদাদ বাতিল করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলে বা আদালত কর্তৃক রোয়েদাদ বাস্তবায়ন করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করা হলে উপরোল্লিখিত যেকোনো আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট বিভাগে আপিল দায়েরের বিধান রয়েছে।

সালিসের খরচ সালিসি ট্রাইব্যুনালের নির্ধারিত হয় এবং বিরোধ সংশ্লেষে ট্রাইব্যুনালের খরচ পক্ষগুলোর মাধ্যমে সমানভাবে পরিশোধযোগ্য হয়। সালিসকারদের পারিশ্রমিক এবং সালিসি ট্রাইব্যুনালের প্রতিটি বৈঠকের ব্যয়ভার পক্ষগুলো সমানভাবে বহন করে থাকে। ট্রাইব্যুনাল গঠন-পরবর্তী ট্রাইব্যুনালের সাচিবিক কাজ পরিচালনার জন্য একজন সচিব নিয়োগ দেয়া হয় এবং সচিবের পারিশ্রমিক পক্ষগণ সমান হারে বহন করে থাকে।

সালিসের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল গঠন-পরবর্তী সালিসকার অথবা সালিসকারবর্গ সব সময় দ্রুত ও পক্ষগুলোর সহনীয় ব্যয়ভারে বিরোধ নিষ্পত্তি বিষয়ে সচেষ্ট থাকে। সালিসি ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে দেখা যায়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উভয়পক্ষের সন্তুষ্টিতে কার্যকরভাবে বিরোধ নিষ্পত্তি হয়। আর এ কারণেই যেসব চুক্তিতে সালিসের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত থাকে, সেসব চুক্তির পক্ষগুলো দেশের প্রচলিত আদালতের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির পরিবর্তে সালিসি ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তিতে আগ্রহী হয়।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement