১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পোস্টমর্টেম : জাতীয় নির্বাচন ২০১৮

-

‘ধর্মের কল বাতাসে নড়ে’ প্রবাদটি হাজার বছরের পুরনো। প্রবাদটি যুগ যুগ ধরে আবহমান বাংলায় মুখে মুখে চলে আসছে। ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপি জোরগলায়ই বলে আসছিল, প্রশাসন ও পুলিশের মাধ্যমে সরকারি দল ২৯ ডিসেম্বর ২০১৮ দিবাগত রাতে অর্থাৎ নির্বাচনের আগের রাতেই নৌকায় সিল দিয়ে ব্যালটবক্স পরিপূর্ণ করে রেখেছে। সরকারের পক্ষ থেকে যতই সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি করা হয়েছে, ততই বিভিন্ন সাক্ষাৎকার, টিআইবি রিপোর্ট, দেশী-বিদেশী গবেষণামূলক সংগঠনের বক্তব্যে নির্বাচন কমিশনের জাল-জালিয়াতির কথা প্রকাশ পাচ্ছে। পাশাপাশি সরকার নিজেও তাদের পক্ষে অর্থাৎ সুষ্ঠু নির্বাচনের সাফাই গাচ্ছে। নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করতে শেখ হাসিনা সরকার কোনো ধরনের ত্রুটি করছে না।

১১ জানুয়ারি বামফ্রন্ট ও ২২ ফেব্রুয়ারি ঐক্যফ্রন্টের গণশুনানিতে প্রার্থীরা প্রকাশ্যে নির্বাচনে বিভিন্ন জালজালিয়াতি, অনিয়ম, পুলিশ ও প্রশাসনের ভূমিকা এবং আগের রাতে ভোটবাক্স ভর্তি করার অভিযোগ তুলে ধরেছেন, যা জাতীয় পত্রিকায় বক্তাদের বক্তব্য ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছে। এ দিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নির্লজ্জের মতো সুষ্ঠু নির্বাচনের সাফাই গাইতে ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই ৮ মার্চ ২০১৯ বলেন, ‘নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভর্তি বন্ধ করতে ইলেকট্রিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) ব্যবহার শুরু করা হবে।’ তার বক্তব্য সরল স্বীকারোক্তি না মুখ ফসকে সত্যের প্রকাশ, তা যা-ই হোক না কেন জনগণ মনে করে, দেরিতে হলেও অভিযোগের পক্ষে একটি সাক্ষ্য বা জবানবন্দী পাওয়া গেল, যা ইতিহাসের পাতায় সুরক্ষিত দলিল হিসেবে থাকবে।

পৃথিবীর অনেক ঘটনা ধামাচাপা করা যায়, আবার অনেক ঘটনা খলনায়ককে নায়কে রূপান্তরিত করে, অন্য দিকে ভাগ্যদোষে কোথাও কোথাও নায়কের ভূমিকাও খলনায়কের চরিত্রে পরিস্ফুটিত হয়। ইতিহাস বিকৃত হলে তো কথাই নেই। যে যার মতো করে অনেক সময় ইতিহাস রচনা করে গোষ্ঠীগত স্বার্থ বিবেচনা করে। তদুপরি অনেক ধামাচাপা দেয়ার পরও সত্যের প্রকাশ কোনো-না-কোনোভাবে হয়েই থাকে। গেল জাতীয় নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বা নির্বাচন কমিশনকে সরকার যতই সাধুবাদ জানাক না কেন সিইসির ইভিএম ব্যবহারের পক্ষের যুক্তিকে অর্থাৎ আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তি করার উদাহরণকে সরকার সমর্থন না করে বরং তথ্যমন্ত্রী বলেছে, সিইসির বক্তব্যের সাথে সরকার একমত পোষণ করে না।

বিষয়টির ওপর যদি অ্যাকাডেমিক আলোচনা করি, তবে বিশ্ববিখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও গবেষকদের মতে, রাষ্ট্র অপরাধ করতে ও তা ধামাচাপা দিয়ে সাজা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম (State is able to hide Crimes and escape punishment) মতামতটি সঠিক বলে প্রতীয়মান হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী Chambliss (১৯৮৯) বলেছেন, একটি রাষ্ট্র দু’ভাবে ফৌজদারি অপরাধ করে : ০১. সাংগঠনিকভাবে রাষ্ট্রের মাধ্যমে সংঘটিত ফৌজদারি অপরাধ (State organized crime) এবং ০২. রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতার কথা (State sponsored crime)।

গবেষক গ্রিন এবং ওয়ার্ড ২০০৪ সালে বলেছেন, রাষ্ট্র তার বিভিন্ন এজেন্সি অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় কাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারী-কর্মকর্তাদের দিয়ে অপরাধ সংঘটিত করায়। ওই গবেষকদের বক্তব্য হচ্ছে, ÔState Crime is illegal or deviant activities perpetrated by, or with the complicity of state agencies). রাষ্ট্রের সংঘটিত অপরাধ থেকে জনগণকে রক্ষা করার জন্য অনেক রক্তক্ষয়ী আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে জনগণ রক্ষাকবজ হিসেবে সংবিধান রচনা করে শুধু রাষ্ট্রযন্ত্রণা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য, কিন্তু ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য যুগে যুগে জনগণের সাংবিধানিক অধিকার ভূলুণ্ঠিত ও নিষ্পেষিত হয়েছে ক্ষমতাসীনদের মনোরঞ্জনের জন্য রাষ্ট্রীয় এজেন্সিগুলোর বুটের তলায়, অথচ তারা জনগণেরই বেতনভুক্ত কর্মচারী। রাষ্ট্রধর্ম পালনে সত্য, ন্যায় ও মানবতা একটি বাতুলতা মাত্র, যেখানে ক্ষমতাসীনদের স্বার্থ জড়িত।

আমাদের সমাজ, দেশ ও জাতি ‘সত্যের’ অভাব এমনভাবে ভুগছে যেমন একটি ‘শরীর’ হিমোগ্লোবিনের অভাবে রক্তশূন্য হয়ে দিন দিন মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়, তিলে তিলে জীবন ক্ষয়রোগে চলার ও চেতনার নিজস্ব গতি হারিয়ে ফেলে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ‘মিথ্যা’ জাতির ওপর এমনভাবে চেপে বসেছে, মিথ্যাকে ঘাড় থেকে নামানোর শক্তি যেন জাতি হারিয়ে ‘সন্তানহারা’ শোকে নিঃশেষ ও নিঃশব্দ হয়ে পড়েছে।

সরকার বাহানা করে হোক বা প্রতিপক্ষ বিরোধীদের ঘায়েল করার জন্যই হোক, দুর্নীতি বিরুদ্ধে কথিত ‘জিরো টলারেন্স’ চাউর করে যাচ্ছেন; কিন্তু দুদকের তীর শুধু সরকারবিরোধীদের বুকে। দুর্নীতির ইংরেজি শব্দার্থ করাপশন। দুর্নীতি প্রতিরোধে বাংলাদেশে একটি কথিত স্বাধীন প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যার নাম দুর্নীতি দমন কমিশন, যাদের দায়িত্ব মূলত ও কার্যত এখন শুধু সরকারের তাঁবেদারি ও সরকারবিরোধীদের শায়েস্তা করা। সরকারের প্রতিপক্ষ রাজনীতিবিদেরাই দুদকের টার্গেট। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এ সম্পর্কে অনেক উদাহরণ জানা যাবে।

জনগণের কষ্টার্জিত অর্থে লালিত রাষ্ট্রীয় কর্মচারী-কর্মকর্তা সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদ মোতাবেক শুধু জনগণের সেবায় নিয়োজিত থাকার জন্য বেতনভাতা পেয়ে থাকেন, যাদের ইংরেজি পরিভাষায় ‘পাবলিক সার্ভেন্ট’ বলা হয় এবং তারাই তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে অর্থাৎ আইন প্রয়োগে স্বৈরাচারীমূলক দুর্নীতি করেন। সরকারি আমলাদের দায়িত্ব পালনে অর্থাৎ আইন প্রয়োগে জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন অথবা আইন প্রয়োগে মিথ্যার আশ্রয় নেয়া অথবা জনস্বার্থে যা করা উচিত নয় তাই করে আইন প্রয়োগে বৈষম্য করেন। অর্থাৎ একই আইন ক্ষমতাসীনদের ক্ষেত্রে এক রকম, সাধারণ জনগণের ক্ষেত্রে ভিন্নভাবে প্রয়োগ করেন, এমন পরিস্থিতিকে ‘ক্রাইম অ্যান্ড পলিটিকস’ নামক প্রবন্ধে অ্যাটলাই ই. স্টিভেনসন ‘করাপ্ট ল এনফোর্সমেন্ট’ নামে আখ্যায়িত করেছেন। আইন প্রয়োগে বা দায়িত্ব পালনে যারা আইনের স্বৈরাচারী মনোভাবে বিপরীতভাবে ব্যবহার করেন সেসব দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো সংস্থা বা সংগঠন নেই। সংবিধানের ৭৭ অনুচ্ছেদ মোতাবেক একজন ‘ন্যায়পাল’ নিয়োগ দেয়ার বিধান থাকলেও থলের বিড়াল বেরিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় কোনো সরকারই ‘ন্যায়পাল’ নিয়োগের উদ্যোগ নেয়নি এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথিত ‘জিরো টলারেন্সের’ বর্তমান সরকারও এ মর্মে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না।

২৮ বছর পর হাইকোর্টের রায়ে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ অর্থাৎ ডাকসুর নির্বাচন ১১ মার্চ ২০১৯ তারিখে বিগত জাতীয় নির্বাচনের আদলে হয়ে গেল। উল্লেখ্য, থানার ওসি, এসপি, ডিসিদের মতোই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ প্রশাসনিক সব পোস্টিং রাজনৈতিক বিবেচনায় হয়ে আসছে। এ ধারাবাহিকতা দীর্ঘ দিনের, তবে এখন প্রকট থেকে প্রকটতর হয়েছে। সব বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষক ও শিক্ষক সমিতির মধ্যে রাজনৈতিক মতাদর্শভিত্তিক শিক্ষক রয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা সরকারি সমর্থক, তারা নীল দল ও বিরোধীরা সাদা দল হিসেবে পরিচিত। নির্বাচন পরিচালনায় প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় সাদা দলকে কোনো দায়িত্ব দেয়া হয়নি বলে তফসিল ঘোষণার দিন থেকে অভিযোগ করা হয়েছিল। বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলের শিক্ষার্থীরা সিলমারা ব্যালট উদ্ধার করার দৃশ্য মিডিয়ায় প্রকাশ হয়েছে। অনিয়মের প্রতিবাদে সরব ছাত্রীদের ভূমিকা দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস নির্বাচনের একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে যে বর্ণনা দিয়েছেন তা নিম্নে তুলে ধরা হলো-

‘২০১৮-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও সিটি নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার পর ডাকসু নির্বাচন নিয়ে একটি আশা টিমটিম করে জ্বলছিল। ওই দুই নির্বাচনের পর নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ডাকসু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সেই আশার প্রদীপ এবার নিভে গেল কি না, সেই প্রশ্নের জন্ম হলো। ডাকসুর এই নির্বাচন, নির্বাচনী ব্যবস্থার কফিনে শেষ পেরেক কি না এবং এর মধ্য দিয়ে আমরা একটি দীর্ঘমেয়াদি সঙ্কটে পড়ে গেলাম কি না, সেই আশঙ্কাও দেখা দিলো। কয়েকটি হলে আমি দেখেছি ভোটারদের কৃত্রিম লাইন, যেটা অনেক ভোটারও অভিযোগ আকারে বলছিলেন। ভোট দিতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা যথেষ্ট ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়েছেন।

এক ছাত্রকে আমি দেখলাম, সে সাভার থেকে আসে। তিন-চার ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে সে ভোট দেয়ার চেষ্টা করেছে। অনেকে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ভোট দিতে না পেরে ফিরেও গেছে। রোকেয়া হলে আমরা দেখলাম, দুই দফা ভোট হলো, আবার তা বাতিলও হলো। আর কুয়েত-মৈত্রী হলে যা ঘটল, তা খুবই ন্যক্কারজনক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এমন কলঙ্ক আর হতে পারে না। আমি মনে করি, এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া দরকার। সুফিয়া কামাল হলে দেখলাম, একটি মেয়ে বৈধ কাগজপত্র দেখানোর পরও তাকে ভোট দিতে দেয়া হলো না। আমি মনে করি, জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশন যেমন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, তেমনি ডাকসু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা প্রশাসন প্রশ্নবিদ্ধ হলো। কাজেই শিক্ষক হিসেবে আমরা যে একটি উচ্চ নৈতিকতার কথা বলতাম, সেটি আর থাকল না। এর কারণ হচ্ছে, ক্ষমতাসীন দলের পক্ষের শিক্ষকেরাই হলসহ বিভিন্ন প্রশাসনের দায়িত্ব পান। ফলে তাদের ভেতরে কোথাও এমনটা থাকে যে, ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনকে জয়ী করতে হবে।’ (সূত্র : একটি জাতীয় পত্রিকা, তাং ১২-৩-২০১৯ ইং)।

জাতীয় নির্বাচন ২০১৮ এবং এর ধারাবাহিকতায় ঘটে যাওয়া পর পর কয়েকটি নির্বাচন এটাই প্রমাণ করে, একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন নির্বাচনী সংস্কৃতি এ দেশে চালু হয়েছে, যা নিশ্চয়ই স্বাধীনতার চেতনার অনুকূলে নয়, বরং পরিপন্থী এবং স্বাধীনতার দাবিদারদের দ্বারাই বর্তমানে স্বাধীনতার চেতনা ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। (ক্রমশ)

লেখক : কলামিস্ট ও আইনজীবী (আপিল বিভাগ)
E-mail : taimuralamkhandaker@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
তীব্র তাপপ্রবাহে বাড়ছে ডায়রিয়া হিটস্ট্রোক মাছ-ডাল-ভাতের অভাব নেই, মানুষের চাহিদা এখন মাংস : প্রধানমন্ত্রী মৌসুমের শুরুতেই আলু নিয়ে হুলস্থূল মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে মূল্যস্ফীতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না এত শক্তি প্রয়োগের বিষয়টি বুঝতে পারেনি ইসরাইল রাখাইনে তুমুল যুদ্ধ : মর্টার শেলে প্রকম্পিত সীমান্ত বিএনপির কৌশল বুঝতে চায় ব্রিটেন ভারতের ১৮তম লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফার ভোট আজ নিষেধাজ্ঞার কারণে মিয়ানমারের সাথে সম্পৃক্ততায় ঝুঁকি রয়েছে : সেনাপ্রধান নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে বিএনপি : কাদের রৌমারীতে বড়াইবাড়ী সীমান্তযুদ্ধ দিবস পালিত

সকল