২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কাশ্মিরের আসিফা বানু

আসিফা বানু - ছবি : সংগ্রহ

কাশ্মিরের জম্মুতে শিশু আসিফার হত্যাকাণ্ডে ভারতজুড়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে আজও। ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মুতে রাসানা গ্রামে এখন আর কোনো মুসলমান বলতে গেলে নেই-ই। পুরো ভারতে মানুষ এ অসুস্থ মানসিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে শুরু করেছে। ভূস্বর্গ কাশ্মির হয়ে উঠেছে অগ্নিগর্ভ।

জম্মু ও কাশ্মির ভারতের একটি রাজ্য বা প্রদেশ। আপেল, আখরোট ও চেরিফলের এক রোমান্টিক অঞ্চল কাশ্মির। এখানে ফুল ও প্রচুর আপেল, বাদাম জন্মে। ফলের বাগানগুলো চোখজুড়ানো। কাশ্মিরি মরিচ সারা উপমহাদেশে বিখ্যাত। উন্নতমানের জাফরান এখানে চাষ হয়। বিশাল বড় টিউলিপ ফুলের বাগান দেখার মতো। বাজারে গেলে কাশ্মিরিরা প্রায়ই গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল কিনে আনে। কাশ্মিরের শাল ও কারপেট বিশ্বখ্যাত। সেখানকার ডাল লেকে নৌকা ভ্রমণ মন জুড়িয়ে দেয়। ভ্রমণপিয়াসীরা বারবার এখানে ছুটে আসেন।

বাদশাহ জাহাঙ্গীরের স্বর্গ উপত্যকা খ্যাত এই কাশ্মির। জম্মুতে প্রধানত হিন্দু, লাদাখে বৌদ্ধ ও পুরো কাশ্মিরে মুসলমানদের বসবাস। শ্রীনগর হ্রদের শহর নামে পরিচিত। কাাশ্মিরের ডাল হ্রদ, হজরত বাল মসজিদ, মোগল স্থাপত্য শালিমার বাগ, নিশাত বাগ, ফালগাম, চশমে মাহি, জামেয়া মসজিদ, বাদামবারি, শাহ-ই হামদান, বেতাব ভ্যালি অপূর্ব। টিউলিপবেষ্টিত গুলমার্গ সৌন্দর্যপিয়াসীদের ‘ভূস্বর্গ’। আবহাওয়ার কারণে মানুষের গড় আয়ু বেশি। বিশ্বের সর্বোচ্চ গলফ মাঠও এখানে। কাাশ্মিরি মেয়েরা মাথায় রূপার মাদুলি লাগানো। তারা জড়োয়ার ওড়না দিয়ে নৌকায় করে ফুল ও সবজি বিক্রি করে। চাষি পুরুষরাও নৌকায় করে পণ্য ফেরি করে থাকে।

তবে অপরূপ কাশ্মিরে এখন শোকের মাতম চলছে। বহু বছর ধরে প্রচণ্ড বিক্ষোভ চলছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চরম নির্যাতনের কারণে। প্রতিনিয়ত বিক্ষোভে মানুষ প্রাণ দিচ্ছে, ইসরাইলি পেলেটগানের আঘাতে অন্ধ হচ্ছে বহু লোক। বন্দী হচ্ছে হাজারে হাজার। জম্মু থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে একটি মন্দিরের ভেতর আট বছরের অসহায় মুসলিম শিশু আসিফা বানুকে অপহরণের পর গণধর্ষণ ও হত্যা করা হয়েছিল। চার্জশিটে পুলিশ উল্লেখ করে, মন্দিরের ভেতর শিশুটিকে চারদিন রাখা হয়েছিল অভুক্ত। তাকে ধর্ষণের সময় ঘুমের ওষুধ সেবন করানো হতো এবং সে যখন ছটফট করত, তখন ওষুধের ক্রিয়ায় আওয়াজও করতে পারত না।

এসব কাজ মন্দিরের তত্ত্বাবধায়ক সঞ্জিরামের উপস্থিতিতে করা হয়েছে। তার নিজের ছেলে বিশাল, এক ভাগিনা ও স্পেশাল পুলিশ অফিসার দীপক খাজুরিয়াও শিশুটিকে ধর্ষণ করে। এখন জানা যাচ্ছে, দু’জন পুলিশ অফিসারসহ আটজন মেয়েটিকে চারদিন ধরে নির্যাতনের পর পাথর দিয়ে মাথায় আঘাত করে হত্যা করে। আসিফার দেহ রাসানার জঙ্গল থেকে পুলিশ উদ্ধার করেছিল। ৪০ কিলোমিটার দূরে কাঠুয়া জেলার একটি গ্রামের জঙ্গলে আসিফাকে কবর দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ ভালো কোনো জায়গায় কবরস্থ হওয়ার জায়গাও মিলেনি তার। তবে আসিফার জানাজায় হাজির ছিল লক্ষাধিক মানুষ।

রাজনৈতিক নেতা, আইনজীবী, সিভিল সোসাইটির লোকেরা এ ঘটনাকে যাযাবর গুজ্জার মুসলমানদের এলাকা থেকে সরিয়ে দিয়ে ‘জনতাত্ত্বিক’ পরিবর্তন আনার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখছেন। পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চ এ নৃশংসতাকে গুজ্জারদের মধ্যে ভীতি সঞ্চারের প্রক্রিয়া মনে করছেন। ওরা জম্মুর মোট জনসংখ্যার ৮ শতাংশ।

কাঠুুয়ার মুসলমানেরা জম্মু ও কাশ্মিরে ফরেস্ট রাইট অ্যাক্ট বলবৎ করার দাবি তুলেছিল। কিন্তু বিজেপি সরকার বলেছে, গুজ্জার মুসলমানরা এখানে জায়গা দখল করছে। বনমন্ত্রী লাল সিং বলেছেন, সংবিধানের ৩৭০ ধারা মতে- কেন্দ্রীয় সরকারের আইন মানতে বাধ্য নয়। ভূমি ও জনতাত্ত্বিক কারণে গুজ্জার মুসলমানরা ঘৃণা ও সহিংসতার শিকার। নিয়মিত হয়রানি, নিগ্রহ, আক্রমণ, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি বহুদিন ধরে চলে আসছে। যাযাবর হওয়ার কারণে তারা আজ এখানে, কাল ওখানে বসবাস করছে। তাই কোনো বিচার পাচ্ছে না। এলাকার হিন্দুরা তাদের একটি কবরস্থানের জন্যও স্থান দেয়নি। তাই শিশু মেয়েটিকে জঙ্গলের অনেক ভেতরে নিয়ে কবর দিতে হয়েছে। আরো নির্যাতনের ভয়ে মেয়েটির বাবা-মা দোষীদের নাম বলতেও ভয় পাচ্ছেন।

পুলিশ তদন্ত কেন করল তার বিরুদ্ধেও সেখানে আন্দোলন করেছে ‘হিন্দু একতা মঞ্চ’। সঞ্জিরাম এ আন্দোলনের চালিকাশক্তি। এই সংগঠনকে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক দল সহায়তা দিয়েছে। এর মধ্যে স্থানীয় বিজেপি ও কংগ্রেসও রয়েছে। স্থানীয় এমপি ড. জিতেন্দ্র সিংহ, যিনি প্রধানমন্ত্রীর দফতরেও মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন, তিনিও একতা মঞ্চকে সমর্থন করেছেন। তিনিই প্রথম ভারতের সিনিয়র নেতা যিনি এমন বীভৎস অপরাধের পক্ষের শক্তিকে সবুজ সঙ্কেত দেখালেন এবং বিজেপির দু’জন সিনিয়র মন্ত্রী, লাল সিং ও চন্দর প্রকাশ গঙ্গা র‌্যালিতে অংশ নিয়েছেন। এই ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। লাল সিং ২০১৬ সালের এক ভাষণে গুজ্জারদের লক্ষ করে বলেছিলেন, ‘১৯৪৭ সালের ঘটনা কি আপনারা ভুলে গেছেন?’ কোথাও কোথাও অবস্থা এখন এমন পর্যায়ে, যারা বিক্ষোভ পরিচালনা করছেন তাদের ‘পাকিস্তানি এজেন্ট’ রূপে গণ্য করা হচ্ছে। কাঠুয়ার জেলা হাসপাতাল দু’মাস সময় নিয়েছে পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট দিতে। তারপরও যে ডাক্তার ধর্ষণের আলামত সত্য বলে প্রতিবেদন দিয়েছেন, তাকে হঠাৎ বদলি হতে হয়েছে।

পুলিশ বলেছে, যাযাবর গুজ্জার সম্প্রদায়কে উচ্ছেদ করতেই ওই শিশুকন্যাকে ধর্ষণ ও হত্যা করা হয়েছে। গ্রীষ্মের সময় এ যাযাবররা পাহাড়ে গবাদিপশুকে ঘাস খাওয়াতে নিয়ে যায়। যা হোক, মুসলিম যাযাবরদের উচ্ছেদের কৌশলে কাজ দিয়েছে। ওই ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের পর অন্য মুসলিম পরিবারগুলো ভয়ে সেখান থেকে একে একে চলে যাচ্ছে। আসিফার পরিবারের বাড়িটি খালি পড়ে রয়েছে। এখন জানা যাচ্ছে, মুসলিম যাযাবররা যেন তাদের এলাকায় ছাগল চরাতে না আসে, সেটা নিশ্চিত করতে ওই ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে।

বিবিসির রিপোর্টে জানা যায়, ‘শিশুদের ওপরে যৌননিপীড়ন চালানোর একটা বড় কারণ বিকৃত মানসিকতা, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় পিডোফিলিয়া। মনোবিজ্ঞানে এটা মানসিক বিকৃতি বলেই স্বীকৃত।’ দ্বিতীয় কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে অন্ধ বিশ্বাস ও কুসংস্কার। বহু হিন্দু এমন কুসংস্কারে বিশ্বাস করে থাকে যে, শিশু বা কুমারীদের সঙ্গে অবৈধ যৌন সংসর্গ করলে যৌনরোগ নিরাময় হয়। কুমারী পূজা হিন্দু ধর্মীয় বিশ্বাসের অংশ। নিউ লাইট স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রধান সমাজকর্মী উর্মি বসু মত পোষণ করেন, এই বিশ্বাসের সাথে রোগ নিরাময়ের ধারণা সম্পর্কিত। তার ভাষায়, ‘আমরা যৌনকর্মী এবং তাদের সন্তানদের নিয়ে কাজ করি। আমাদের সাথে যারা আছেন, তাদের অনেকেরই বয়স ৬০-৬৫, এমনকি ৭০। তারা বলেন, বহু মানুষ মনে করেন যে; কুমারী নারী বা শিশুদের সঙ্গে যৌন সংসর্গ করলে তাদের নিজেদের যৌনরোগ নিরাময় হয়। ভারতের বহু প্রদেশে এ ধারণা প্রচলিত রয়েছে।’

তৃতীয় বিষয়টি হলো- ক্ষমতা দেখানো। পশ্চিমবঙ্গ শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশনের সভানেত্রী অনন্যা চক্রবর্তী মনে করেন, ‘ধর্ষণ বা যৌননির্যাতন নিশ্চিতভাবেই ক্ষমতা দেখানোর চেষ্টা। ঝাড়ফুঁকের ভণ্ডরাও এই বিশ্বাসকে সাধারণ ও অজ্ঞদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়। চতুর্থ হলোÑ নির্যাতন করে প্রতিপত্তি জাহির করা। বিবিসির সৌতিক বিশ্বাস বলছেন, ‘ভারতে দুর্বলদের ওপর সবলদের কর্তৃত্ব ফলাতে ধর্ষণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। শ্রেণিবৈষম্য এবং পুরুষশাসিত যে সমাজে হিংসা ছড়িয়ে ভোট পাওয়ার চেষ্টা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে, সেখানে ক্রমবর্ধমান ধর্ষণের ঘটনাকে স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবে দেখছেন অনেকেই।’

২০১৭ সালে ভারতে ৩৪ হাজার ৬০০টি ধর্ষণ মামলা হয়েছে। ২০১৫ সালে ৩৪ হাজার ৬৫১টি। ২০১২ সালে ২৪ হাজার ৯২৩টি ঘটনা ঘটে ধর্ষণের। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের জরিপে বলা হয়েছে, ভারতে প্রতি বছর সাত হাজার ২০০ শিশুকে ধর্ষণ করা হয়। আসিফার মতো আরো কিছু ধর্ষণের ঘটনা পুরো ভারতে তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল। যেমন- ২০১২ সালে দিল্লিতে পাবলিক বাসে ২২ বছরের ছাত্রীকে ধর্ষণ; ২০১৩ সালে মুম্বাইয়ে ২২ বছরের এক ফটোসাংবাদিককে পাঁচজন মিলে যৌননির্যাতন, ২০১৪ সালে ১৪ ও ১৬ বছরের দুই বালিকাকে গণধর্ষণ ও হত্যা, ২০১৫ সালে ৭১ বছর বয়সী এক বৃদ্ধ খ্রিষ্টান সন্ন্যাসিনীকে ছয়জনে ধর্ষণ করে। শুধু কাশ্মিরেই ১০ হাজারের বেশি মুসলিম নারীকে ধর্ষণ করেছে সেনা ও পুলিশ বাহিনীর লোকেরা।

ভারতের প্রেসিডেন্ট রামনাথ কোবিন্দ বলেছেন, ‘দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর জিনিস হলো শিশুর হাসি। সমাজে তাদের নিরাপত্তা প্রয়োজন। স্বাধীনতার ৭০ বছর পরও এমন ঘটনা লজ্জাজনক। আমরা কেমন সমাজ নির্মাণ করেছি, তা এখন ভেবে দেখার বিষয়।’ আইএমএফ প্রধান ক্রিস্টিন লোগার্দ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে মহিলাদের বিষয়ে ‘আরো বেশি গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এক সময়ের এমপি ফজলে বারি বলেছেন, কাশ্মির উপত্যকা সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে, বিশ্বের বাঘা বাঘা গোয়েন্দা এখানে কাজ করছেন। এদের মধ্যে মোসাদ, সিআইএ, আইএসআই সবাই আছে। হিন্দু জাতীয়তাবাদী শক্তির জোয়ার কাশ্মিরে সমাজ কাঠামোকে আঘাত করেছে। আইনজীবী দীপিকা এস রাজাওয়াত আসিফা বানুর জন্য আদালতে লড়ছেন। তিনি নিজেও হুমকির মুখে বলে জানা যায়। তিনি বলেন, ‘এখন আমি নিজেও যেকোনো সময় ধর্ষণের শিকার হতে পারি। কতদিন জীবিত থাকব, জানি না।’ তিনি বিষয়টি এনডিটিভি এবং আদালতকে জানিয়েছেন।

সম্প্রতি কাঠুয়া, উন্নাও, সুরাতসহ বিভিন্ন স্থানে ধর্ষণ, গণধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় অশান্ত ভারত। বিশেষ করে, জম্মু ও কাশ্মিরের কাঠুয়ায় আট বছর বয়সী শিশু আসিফা বানুকে গণধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় ভারতের রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে বিনোদন জগতের মানুষও প্রতিবাদ করেছেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১২ বছরের কম বয়সী শিশুর ধর্ষকদের মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে একটি অধ্যাদেশ সই করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উপস্থিতিতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে। মোদি টুইটে বলেন, ‘আমাদের কন্যারা এখন ন্যায্য বিচার পাবে।’ দেখা যাক, তারা তা কতটুকু পায়।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব, বাংলাদেশ সরকার ও গ্রন্থকার


আরো সংবাদ



premium cement