২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

আগুন নিয়ে বাহাস

-

‘বাহাস’ শব্দটি আরবি। বর্তমানে অপ্রচলিত। তবুও এর ব্যবহার অপ্রাসঙ্গিক হবে না। শব্দটির বাংলা অর্থ- আলোচনা, তর্কাতর্কি, যুক্তিতর্ক, পাল্টাপাল্টি কথা কিংবা বাকযুদ্ধ। ব্রিটিশ আমলে ভূ-ভারতে অনেক খ্রিষ্টান যাজকের সাথে মুসলিম আলেমদের বাহাস হতো। নিজ ধর্মের বহু মত নিয়েও হতো বাহাস। এসব যেমন ছিল জ্ঞানের আধার, তেমনি ছিল উপভোগ্য। বাহাস শুধু নির্মল আনন্দ বিতরণ করেনি; এ নিয়ে কখনো বা হয়েছে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। অনেক প্রাণ ঝরেছে। যা হোক, ইদানীং ধর্মীয় বাহাসের অস্তিত্ব নেই।

তবে এ দেশে লোকসংস্কৃতিতে এখনো বাহাসের প্রচলন দেখা যায়। পালা বা কবিগানে কবিয়াল আর বয়াতিরা বিষয়বস্তুর বয়ান করেন গানে গানে কিংবা তাৎক্ষণিক শব্দের বুননে, যা উপস্থিত দর্শক-শ্রোতা প্রাণভরে উপভোগ করেন। তাদের বাকপটুতায় হন বিমোহিত।

শুধু ভারতীয় উপমহাদেশেই নয়, প্রাচীন আরব সমাজেও বাহাসের ছিল দোর্দণ্ড প্রতাপ। ইসলামের প্রাথমিক যুগেও যা ছিল বহমান। তখন আরবরা গোত্রপ্রীতিতে ছিল মোহাচ্ছন্ন। কবিতায় গোত্রীয় শৌর্যবীর্য ও গৌরবগাথা বর্ণনায় তাদের জুড়ি মেলা ভার। পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে গোত্রীয় স্তুতি। প্রাচীন আরবি সাহিত্যে কবি ইমরুল কায়েস আর হাসসান বিন সাবিতের নাম সুবিদিত।

আমাদের সমাজে জনমানসে এখন লক্ষণীয় একটি প্রবণতা হলো, দেশে কোনো ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটলেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত সবাই তৎক্ষণাৎ ঝাঁপিয়ে পড়েন বিষয়টির সাফল্য, কৃতিত্ব আর ব্যর্থতা নির্ণয়ে। যেন তর সইছে না। কে কার আগে বলবেন, তা নিয়ে প্রতিযোগিতা। কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার হলো, কিছু দিন পর প্রকৃত ঘটনা জানলে দেখা যায়, তাতে তথ্যবিভ্রাট কতটা উৎকট। তাদের মুখনিঃসৃত বাণী সত্য থেকে কত দূরে।

বলছিলাম, পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভাঙেনি কোনো তরুণীর কাচের চুড়ি। ভেঙে চুরমার বহু পরিবার। এবার আগুনে পুড়ে অঙ্গার তরতাজা ৭১ প্রাণের স্বজনদের হৃদয় ক্ষতবিক্ষত। এমন মর্মান্তিক ঘটনায় অনেকের বাহাসে ব্যতিব্যস্ত থাকা দেশবাসী দেখছেন অবাক বিস্ময়ে।

চুড়িহাট্টায় আগুন নিয়ে সরকারের অনেক কর্তাব্যক্তি ছিলেন বাহাসি ভঙ্গিতে। দেশের দুই বিশিষ্ট ব্যক্তি একে অপরের প্রতি ‘মালকোচা’ মেরে নামেন বাহাসে। তা এই দুঃখের দিনেও দু’জনের বাহাস দেখে শোকে বিহ্বল প্রাণ জুড়িয়ে যায়। এটা যে ক্যানভাসারের ‘সালসা’ কিংবা ‘শ্রীপুরের বড়ি’র মতো কাজ করেছে!

চকবাজারে আগুনের সূত্রপাত নিয়ে রাষ্ট্রের উঁচুপর্যায় থেকে তৃণমূলের অনেকে জড়িয়ে পড়েছিলেন বাহাসে। গণমাধ্যমও এতে অংশ নিয়ে ছেপেছে উত্তেজক সব খবর। এমন হতে পারে, প্রথম দিন আগুনের উত্তাপ ঠাহর করতে না পেরে ব্যর্থতা ঢাকতে এই কসরত। ‘অনুশোচনা’ বলে একটি কথা! আগের দিনের গাফিলতি পাঠককে পুষিয়ে দিতে হবে না?

আগুনের সূত্রপাত নিয়ে বাহাস। গ্যাস সিলিন্ডার নাকি রাসায়নিক পদার্থ? তা নির্ণয়ে সবাই করেছেন প্রাণপাত। কেউ বলেছেন, আগুনের পেছনে গ্যাস সিলিন্ডার দায়ী। কেউ বলেছেন, না কেমিক্যাল। আবার অনেকে ‘ভারসাম্য’ রক্ষা করতে গিয়ে বলেছেন, সিলিন্ডার-কেমিক্যাল মিলেমিশে একাকার। ফলে এমন বিভীষিকা। সব মিলিয়ে এই সর্বনাশ। মুহূর্তে ‘বিজনেস হাব’ চুড়িহাট্টা হয়ে পড়ে মৃত্যুপুরী!

২০ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১০টা। চুড়িহাট্টা মসজিদের কাছে হাজী ওয়াহেদ ম্যানশনে আগুনের লেলিহান শিখা। ধারে-কাছে আরো চার-চারটে বাড়িতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে আগুন। ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে ঘটনাস্থলে ছুটে আসে। তবে পানিসঙ্কটে তাদের হিমশিম খেতে হয়। ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি বিপুল স্বেচ্ছাসেবী আশপাশের বাসিন্দাদের সরিয়ে নেন নিরাপদ স্থানে। আগুনে যে কয়টি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, প্রতিটির নিচতলায় ছিল রাসায়নিক দ্রব্য। একই সাথে প্লাস্টিক সামগ্রীর দোকান আর গুদাম।

আমাদের স্মৃতি দুর্বল; তবুও অনেকের স্মরণে এখনো জ্বলজ্বল করছে নিমতলীর সেই ঘটনা। ২০১০ সালের ৩ জুন। পুরান ঢাকার নিমতলীতে কেমিক্যাল গুদামে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ঘটেছিল ১২৪ জনের প্রাণহানি। এরপর পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি এলাকা থেকে কেমিক্যালের দোকান, গুদাম ও বিপজ্জনক সব কারখানা সরানোর দাবি ওঠে। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকেও দেয়া হয় প্রতিশ্রুতি। শেষ অবধি, সে দাবি হালে পানি পায়নি। ফলে নিমতলী থেকে চুড়িহাট্টা। এবার চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ড প্রমাণ করে জননিরাপত্তায় আমরা কতটা উদাসীন! আগুনে এই যে বিপুল প্রাণহানি; ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার কিভাবে তা সামলে উঠবে, এর কি কোনো জবাব আছে? এই প্রশ্নের জবাবে সরকার মুখরক্ষার ব্যর্থ প্রয়াসে লিপ্ত।

এ দিকে ভয়াবহ এ আগুনের পেছনে ‘ধনীদের লোভ’ দায়ী, এমন অভিযোগ বিশ্বের প্রসিদ্ধ গণমাধ্যম ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকার। দেশী ছেড়ে বিদেশী পত্রিকার উদ্ধৃতি দেয়ার বিষয়ে টিপ্পনী থেকে গা বাঁচাতে কৈফিয়ত- আমরা এখনো মনেপ্রাণে কলোনিয়াল মেন্টালিটি ছাড়তে পারিনি। মনোজগতে রয়ে গেছে উপনিবেশ। তাই বিদেশী শুনলেই মনে জাগে একধরনের সুখানুভূতি।

নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, আগুন একটি ছোট দোকানে ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে রাখা ছিল অনুমোদনবিহীন রাসায়নিক পদার্থ। মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে দোকানের পাশের আবাসিক ভবনে, যেখানে রাখা ছিল হাজার হাজার সুগন্ধি বোতল। আগুনের তাপে তা ফুটতে থাকে খৈয়ের মতো ফটাস ফটাস শব্দে। চোখের পলকে গ্রাস করে লেলিহান শিখা। অবৈধভাবে রাখা কেমিক্যালের মজুদই ভয়াবহ এ পরিণতির মূল কারণ, ব্যক্তি হলে বলতাম মূল হোতা।

পত্রিকাটির প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, এশিয়ার দরিদ্র দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। কিন্তু দারিদ্র্য আর ঘনবসতি নয়, পুরান ঢাকার আবাসিক ভবনে মজুদ করে রাখা অনুমোদনবিহীন রাসায়নিক ও দাহ্য পদার্থই বিপুল প্রাণহানির জন্য দায়ী। মুনাফার স্বার্থে কখনো ঘুষ দিয়ে, কখনো বা গোপনে আইন ভেঙে প্লাস্টিক তৈরির রাসায়নিক দ্রব্য আবাসিক ভবনে রেখে দেন ধনী বণিকেরা। চুড়িহাট্টার বাসিন্দারা ধনীদের ওই লোভের আগুনেই পুড়ে মরেছেন। এটি দারিদ্র্যের ব্যাপার নয়, লোভের করুণ পরিণতি।

এই যখন অবস্থা, তখন বাহাসের ঘোরে প্রকৃত ঘটনা আড়াল করতেই কি না জানি না, আগুনের সূত্রপাত নিয়ে মাতামাতিতে আমরা ছিলাম ব্যতিব্যস্ত। কথায় আছে না- ‘হুজুগে বাঙালি’। সবাই বেমালুম ভুলে যাই, আগুনে যারা হারিয়েছেন বাবা-মা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, সন্তানসন্ততি, স্বজন আর প্রিয়জন- তাদের বেদনা কত তীব্র আর গভীর। এসব ঘটনা রোধে ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্রীয়পর্যায়ে সবাই যেন বেভুলা ও গাফেল। জাতি হিসেবে আমরা কি এতটাই দায়িত্বহীন? সামনের দিনগুলোতে কপালে কী আছে, তা শুধু বিধাতাই জানেন। দায়িত্বহীন সমাজে তিনিই অসহায়ের সহায়, অনাথের নাথ; নিরাশ্রয়ের আশ্রয়; একমাত্র ভরসাস্থল। তার কাছেই সাধারণের যত আরজি। ফরিয়াদ, প্রভু হে- রক্ষা করো আমাদের।
camirhamza@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement
বস্ত্র-পাট খাতে চীনের বিনিয়োগ চায় বাংলাদেশ জামালপুরে সাব রেজিস্ট্রারকে হত্যার হুমকি মামলায় আ’লীগ নেতা গ্রেফতার গাজায় অনাহার যুদ্ধাপরাধ হতে পারে : জাতিসঙ্ঘ ‘প্রত্যেককে কোরআনের অনুশাসন যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে’ মতলব উত্তরে পানিতে ডুবে ভাই-বোনের মৃত্যু প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের শেষ ধাপের পরীক্ষা শুক্রবার লম্বা ঈদের ছুটিতে কতজন ঢাকা ছাড়তে চান, কতজন পারবেন? সোনাহাট স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ ত্যাগ করলেন ভুটানের রাজা জাতীয় দলে যোগ দিয়েছেন সাকিব, বললেন কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই কারওয়ান বাজার থেকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে ডিএনসিসির আঞ্চলিক কার্যালয় এলডিসি থেকে উত্তরণের পর সর্বোচ্চ সুবিধা পেতে কার্যকর পদক্ষেপ নিন : প্রধানমন্ত্রী

সকল