২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পোস্টমর্টেম : জাতীয় নির্বাচন-২০১৮

-

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সেবা সমন্বয় ছিল দাবি করে র‌্যাবের মহাপরিচালক ২৪-২-২০১৯ ইং তারিখে বলেন, ‘এমন ঐক্য, সমন্বয় চাকরি জীবনে তিন দশকেও দেখি নাই।’ (সূত্র : জাতীয় পত্রিকা, ২৫/২/২০১৯ ইং)। ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ যে কৌশলে জাতীয় নির্বাচন হয়ে গেল, নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে প্রতিরক্ষা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সব প্রধানসহ উচ্চ থেকে নি¤œপর্যায়ের সরকারি কর্মচারী, কর্মকর্তা থেকে সিপাহি পর্যন্ত সরকার গঠনের অংশীদারিত্বের দাবি করতেই পারেন। প্রতিটি বিষয়ের ‘দৃষ্টিকোণ’ই মুখ্য বিষয়। একজন বক্তা কোন দৃষ্টিতে নির্দিষ্ট আলোচ্য বিষয়টি দেখছেন, তার প্রকাশভঙ্গিতে সে মনোভাবই প্রকাশ পাবে, এটাই স্বাভাবিক। একটি নির্ভরযোগ্য নির্বাচনের জন্য নির্বাচন পরিচালকমণ্ডলী তথা সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, নির্বাচন কমিশনের যেমন একটি ভূমিকা বিবেচনায় আনা দরকার, অন্য দিকে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মূল স্টেকহোল্ডার হলো নির্বাচকমণ্ডলী তথা ভোটার, এ কথাও বিবেচনায় আনতে হবে।

(একজন ভোটার) যার কোনো রাজনৈতিক Indentification নেই, এমন কোনো ভোটারকে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা বা তিনি ভোট দিতে পেরেছেন কি না মর্মে জিজ্ঞেস করলে কত পারসেন্ট ভোটার র‌্যাব প্রধানের সাথে একমত পোষণ করবেন? এ প্রশ্নের জবাব বা বিশ্লেষণ যদি চাওয়া হয়, তবে এর ব্যাখ্যা কী দাঁড়াবে? বাস্তবতা ও গ্র্যামাটিকলার বক্তব্য এক কথা নয়। ‘গ্রামার’ তথা ‘ব্যাকরণ’কে উল্টো পথে পরিচালনা করতে হলে যে প্রস্তুতি ও চতুরতার প্রয়োজন হয়, সে প্রস্তুতির সফলতার দাবিদাররা ইতোমধ্যে রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়েছেন বটে। কিন্তু ইতিহাসের পাতার পুরস্কার এখনো ঘোষিত হয়নি, যার জন্য আক্ষেপ না করে অপেক্ষা করতে হবে। কারণ, ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করেনি, তবে বিকৃত হলে আলাদা কথা।

আমাদের দেশে পাবলিক পারসেপশনের কোনো মূল্যায়ন নেই, কেন নেই তাও বিচার-বিশ্লেষণের দাবি রাখে। জোরগলায় বলা হয়, শতভাগ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়েছে, কিন্তু প্রকৃতভাবে ভোটার কতজন ভোট দিতে পেরেছে, সেটাই বিবেচ্য হওয়া উচিত ছিল। সরকার পক্ষ থেকে জোরগলায় আরো বলা হয়, বিরোধী দল মাঠে ছিল না, পোস্টার ছাপায়নি, সাংগঠনিক শক্তি নেই, কেন্দ্রে যায়নি প্রভৃতি। কিন্তু ভোটার কেন কেন্দ্রে যায়নি, এর জবাব বা ব্যাখ্যা সরকার কিভাবে কোন কথা বলে জনগণকে বুঝ দেবে?

প্রধান নির্বাচন কমিশনার যখন নির্বাচনের সুষ্ঠতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে জোরগলায় কথা বলেন তখন মনে হয়, অসত্য কথা বলার জন্য গিনেস বুকে সিইসির নাম ওঠার সুযোগ হতে পারে, কিন্তু নির্বাচনী ব্যবস্থাকে তিনি যেভাবে বিপর্যস্ত করে দিয়ে গেলেন এর জবাব কী হবে, তা অবশ্যই তার ভাগ্যাকাশে একদিন উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠবে।

আঞ্চলিক ভাষায় গ্রামগঞ্জে মানুষ একটি কথা বলে থাকে, তা হলো ‘বাপ মরছে তাতে কোনো অসুবিধা নাই, যম যে বাড়ি চিনেছে সেটাই এখন সমস্যা।’ বাংলাদেশে ভোট জালিয়াতির নির্বাচন আগেও হয়েছে, কিন্তু ২০১৮ ইং জাতীয় নির্বাচন যে পদ্ধতির জন্ম দিয়ে গেল, এতে যে কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে তাতে সব রেকর্ড ভঙ্গ করে এটাই প্রমাণ হয়েছে যে, ভোটারবিহীন একটি নির্বাচনকে শুধু কৌশল ও কথার জোরে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন বলে চালিয়ে দেয়া যায়। ভোট জালিয়াতি বন্ধ করার জন্য দেশবাসী নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করে সংবিধান সংশোধন করেছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে ক্ষমতায় এসে যখন সংবিধান থেকে ওই অনুচ্ছেদ বাতিল করে দেয় তখনই শুরু হয় বিপত্তি। ‘শত্রুপক্ষের শরীরে আঘাত করবে, কিন্তু রক্ত বেরোবে না’ এ নীতিমালার সাথে নির্বাচন কমিশনের নীতিমালার তুলনা করা যায়। বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট ফজর নামাজ পড়ে কেন্দ্র পাহারা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে ড. কামাল হোসেনের জোর দাবি আগের রাতেই ভোটের সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভর্তি করা হয়েছে। দেশবাসী যারা ভোট দিতে পারেনি, ড. কামাল হোসেনের বক্তব্যের সাথে তারাও একমত অবশ্যই পোষণ করবেন বলে মনে করি।

তবে একটি প্রশ্ন থেকে যায়, কেন্দ্র পাহারা দেয়ার আহ্বান জানিয়ে ড. কামাল হোসেন পাহারা দেয়ার জন্য নিজে কেন সারা দিন কেন্দ্রে অবস্থান নেননি? যিনি দেশবাসীর ভোটাধিকার প্রয়োগের আহ্বান জানিয়েছিলেন, তিনি কেন ভোটকেন্দ্রে শুধু মিডিয়ায় নিজ বক্তব্য দিয়েই দায়িত্ব শেষ করলেন? ফ্রন্ট নেতা হিসেবে তার কেন্দ্রে ‘অবস্থানের’ মাধ্যমে কেন্দ্র পাহারা দেয়ার সংবাদ যদি চাউর হতো তবে দেশব্যাপী অনেক নেতাই তাকে অনুসরণ করে কেন্দ্রে অবস্থান করত। তবে তিনি (ড. কামাল হোসেন) এখনো প্রহসনমূলক একতরফা ভোটারবিহীন তথাকথিত নির্বাচনের প্রতিবাদে সোচ্চার ও অনড় রয়েছেন, ন্যূনতম আপস করছেন না। অন্য দিকে ভোটের দিন বেলা প্রায় ১১টার দিকে ভোটের স্বাভাবিকতা নিয়ে বিএনপি মহাসচিব যে বক্তব্য দিয়েছেন কোন যুক্তিতে, তাও জনগণের সামনে পরিষ্কার হওয়া বাঞ্ছনীয়।

ড. বদরুদ্দোজা চৌধুরী সংক্ষেপে বি. চৌধুরী যিনি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব, বিএনপির বদৌলতে মন্ত্রী থেকে রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত পদ একোয়ার করেছিলেন, তিনিও জনগণের ভোটাধিকার প্রশ্নে নীরবতাই পালন করে গেলেন। বিনিময়ে নিজ পুত্রসহ দলীয় সম্পাদককে সংসদ সদস্য পদে অধিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। সরকারের বিরুদ্ধে অনেক উচ্চবাচ্য করলেও শেষ অবধি উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সাবেক রাষ্ট্রপতি হয়তো নীরবতাকেই সঠিক বলে মনে করেছেন। অন্য দিকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে তাকে অপসারণের জন্য বিএনপির ওপর তিনি প্রতিশোধমূলক ভূমিকা নিলেন কি না, এটাও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তবে বিএনপিকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য তিনি আন্দোলন করবেন না বলে ইতঃপূর্বে সাফ জানিয়েছিলেন। অন্য দিকে তাকে অপসারণের ক্ষেত্রে বিএনপি ভিন্নপথ অবলম্বন করলেও পরিস্থিতি এত দূর হয়তো গড়াত না। তা ছাড়া, সতর্ক করে দেয়া বা সংশোধন করার সংস্কৃতি রাজনীতি থেকে কি উঠে গিয়েছিল?

বন্ধু যখন শত্রু হয় তখন সে শত্রুতা চরমে চলে যায়। একজন ব্যক্তি রাষ্ট্রপতির আসন গ্রহণের পর ব্যক্তির উত্তরাধিকার সৃষ্টির চেয়ে শুধু জনগণ আর জনগণের অধিকার নিয়ে ভাবা উচিত ছিল, কিন্তু তিনি জনগণের পক্ষ সমর্থন না করে তার নিজের অবস্থান ঠিক রেখেছেন। অন্য দিকে বি. চৌধুরীকে বাদ দিয়ে যাকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে (অধ্যাপক ইয়াজউদ্দীন প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় যিনি ইয়েস উদ্দিন) বিএনপি রাষ্ট্রপতি পদে বসাল, সে ব্যক্তির নির্বুদ্ধিতা ও কাপুরুষতার জন্যই বিএনপির দুরবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, যার ঘানি এখনো টানতে হচ্ছে। ইয়েস উদ্দিনের মতো একজন মেরুদণ্ডহীন ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত করে বিএনপিকে চরম মূল্য দিতে হলো।

অন্য দিকে নির্বাচনের প্রাক্কালে বিএনপি নেতাদের টেলিফোনিক বার্তা যখন ফাঁস হচ্ছিল, তাতেই তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মনোবল প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। তৃণমূলকে কেন্দ্র কোনো সময়ই মূল্যায়ন করে না, তা জেনেও তৃণমূল সব সময় কেন্দ্রের দিকে তাকিয়ে থাকে। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের ভাষায় বিএনপি মহাসচিব যখন তার টেলিফোন ধরেন না তখন জাতীয় নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কতটুকু সমন্বয় করা হয়েছে, তাও তৃণমূলের বুঝতে বাকি ছিল না। ‘অর্থ’ ২০১৮ জাতীয় নির্বাচনে ব্যাপক প্রভাব রেখেছে। রাজনৈতিক দলের কাছে অর্থশালীদের ব্যাপক সমাদর অর্থাৎ গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ‘অর্থ’ কত শক্তিশালী তা নির্বাচনের সময় বোঝা যায়। লক্ষ্মীপুর জেলার একটি আসনে স্বতন্ত্রভাবে একজন প্রার্থী জয়যুক্ত হয়েছেন, যা বর্তমান জমানায় কল্পনা করা যায় না। এলাকার জনশ্রুতি রয়েছে, তিনি সব দলের রাজনৈতিক নেতাদের অর্থের বিনিময়ে ক্রয় করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েও এমপি হয়েছেন।

তিনি যখন বুঝলেন, টাকা হলেই বাংলাদেশে এমপি পদ ক্রয় করা যায় তখন নিজের স্ত্রীর জন্যও সংরক্ষিত আসনে একটি এমপি পদ হালাল করে নিলেন। টাকাওয়ালারা নির্বাচনের সময়ই ব্রিফকেস নিয়ে নমিনেশন শিকারে নেমে পড়ে। তাদের তদবিরই সর্বশ্রেষ্ঠ তদবির। নির্বাচন শেষ হওয়ার পর থেকেই টাকাওয়ালাদের এখন আর দলে দেখা যাচ্ছে না, কর্মসূচিতে থাকা তো দূরের কথা, পদত্যাগ করতে পারলেই যেন বাঁচে। এমন দু-একটি ঘটনা গেল সপ্তাহেই জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে (সূত্র : জাতীয় পত্রিকা, ২৬-০২-২০১৯ ইং)। তবে এ দৃশ্য সরকারি দলে দেখা যাবে না। কারণ, এমপি নির্বাচিত না হলেও হালুয়া-রুটির একটি সুযোগ সরকারি দলে অবশ্যই রয়েছে। নতুবা একই চিত্র দেখা যেত সরকারি দলেও। টাকা হলেই সব কিছু হালাল করা যায়, এটাই হলো বর্তমানে আমাদের নির্বাচনী সংস্কৃতি।

‘মুক্তিযুদ্ধ’কে শেখ হাসিনা সরকার একতরফাভাবে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছে এবং এখনো তা করছে অনৈতিকভাবে। কবি আল মাহমুদ একজন মুক্তিযোদ্ধা হওয়া সত্ত্বেও তার লাশ সরকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নিতে দেয়নি। যেমনটি আরাফাত রহমান কোকো বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত একজন সাবেক সেনাপ্রধানের সন্তান হয়েও সেনা কবরস্থানে তার লাশ দাফন করতে দেয়া হয়নি। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা একজন মুক্তিযোদ্ধা, যার কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল- ‘আমি মেজর জিয়া বলছি’ এবং ‘We Revolt’ বলে যুদ্ধ শুরু হওয়ার সংবাদটি তার কণ্ঠেই দেশবাসী প্রথম শুনেছিল। অথচ মুক্তিযুদ্ধের সফলতার একমাত্র দাবিদার হয়ে রইল সরকারি দল। এ মর্মে বিএনপি সরকারি দলের জবাব দিতে কতটুকু সফল ছিল তাও বিএনপির খতিয়ে দেখা জরুরি।

সরকার চায় ক্ষমতা। শেখ হাসিনা সরকার নৈতিকতাকে কোনো প্রকার তোয়াক্কা না করে শুধু ক্ষমতা দখলের নেশায় ভোটারবিহীন নির্বাচন করেছেন, যদিও তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি আর একটি বিতর্কিত নির্বাচন দেখতে চান না।
কৌশলী নির্বাচন করে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করেছেন বটে, কিন্তু নি¤œবর্ণিত বিষয়গুলো নির্বাচনী সংস্কৃতিতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল- 
প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন নির্বাচনের সংস্কৃতি চালু।

নির্দলীয় সাংবিধানিক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দিয়েও অসাংবিধানিক কাজ করানো সম্ভব। যার ফলে সঠিকভাবে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের শপথ কচুপাতার পানিতে পরিণত হলো।
প্রমোশন, সুবিধাজনক পোস্টিং, পুরস্কার ও মেডেলের পরিবর্তে চাকরির শর্তবহির্ভূত যেকোনো কাজ কারানো যায়, নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্যের বিরুদ্ধে বড় বড় রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাকে দাঁড় করানো সম্ভব।  ‘মিথ্যা’কে কত সহজে প্রতিষ্ঠা করা যায় তার একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন হলো।

লেখক : কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail: taimuralamkhandaker@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement