১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

চকবাজারের আগুন : প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন চাই

চকবাজারের আগুন : প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন চাই - ছবি : সংগৃহীত

ঢাকায় আবারো ঘটল ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। গত ২০ ফেব্রুয়ারি বুধবার রাতে রাজধানী ঢাকা আবারো হয়ে ওঠে অতলান্ত শোকের সাগর। ২০১০ সালের নিমতলী ট্র্যাজেডির পর ২০১৯। মাঝের ৯ বছরে আমাদের কোনো শিক্ষা হয়নি। না সাধারণ মানুষের, না সরকারের বা প্রশাসনের। সেই পুরনো ঢাকায়ই একসাথে কয়েকটি বাড়িতে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল ৭৮টি তরতাজা মানুষ। লাশের পর লাশের সারি দেখে আমাদের প্রাণ কেঁদে উঠেছে, চোখ ফেটে অশ্রু ঝরেছে। মৃত মানুষের আত্মীয়স্বজনের বুকফাটা কান্না, আহাজারিতে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। বাতাসে ভেসে রয়েছে হৃদয় মুচড়ে দেয়া পোড়া লাশের গন্ধ। ছড়িয়ে গেছে সারা দেশে, সারা বিশ্বে।

গভীর শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন। সোমবার দেশজুড়ে পালন করা হয়েছে এক দিনের রাষ্ট্রীয় শোক। এ দিন জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয় দেশের সব সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান/ভবন এবং বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোতে। জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করা হয়েছে শোক প্রস্তাব। আর মিডিয়ায় আবারো পুনরাবৃত্তি হয়েছে সেই নিমতলীর ঘটনার পর যেসব কথা বলা হয়েছিল, সেগুলোর। ‘ভালোবেসে চিরকাল যা যা বলে লোকে’, নির্মলেন্দু গুণের সেই কবিতার মতো ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর চিরকাল আমরা যেসব কথা বলে থাকি, বলে আসছি- সেসব কথাই। আবারো বলেছি, এখনো বলছি।
পুরান ঢাকার চকবাজার হলো রাজধানীর সবচেয়ে জনবহুল এলাকাগুলোর অন্যতম এবং অতিব্যস্ত ব্যবসাকেন্দ্র। সরু রাস্তা, অলিগলি, পুরনো ভবন আর ঘিঞ্জি বসতি নিয়ে এই এলাকা। নিচে কলকারখানা, দোকানপাট, গুদাম; ওপরে মানুষের বসবাস। দোকান-গুদাম মালপত্রে ঠাসা। রাসায়নিক ও দাহ্য পদার্থে ভরপুর। বেশির ভাগ ভবনের এক দিকে মানুষের বসবাস, অন্য দিকে কেমিক্যালের গোডাউন। আগুনের সূত্রপাত সম্পর্কে পাঁচ দিন পরও সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারেনি কেউ। তবে আগুন যে রাসায়নিক দাহ্য বস্তুর কারণে দ্রুত ছড়িয়েছে এবং ভয়াবহ হয়ে উঠেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

আবাসিক এলাকায় এ ধরনের কলকারখানা এবং রাসায়নিকের মজুদ বিশ্বের আর কোথাও আছে কি না সন্দেহ। নিমতলীর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ক্ষত না শুকাতেই আবারো ঘটল সেই একই ঘটনা। এবার পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায়। আর অগ্নিকাণ্ডের নেপথ্যে সেই কেমিক্যাল গোডাউন, যেখানে রয়েছে দাহ্য পদার্থের বিশাল মজুদ।

২০ ফেব্রুয়ারি রাত ১০টা। ঢাকাসহ সারা দেশ মহান ভাষা দিবস একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ঠিক তখন ব্যস্ত চকবাজারে যানজটের মাঝে গ্যাস সিলিন্ডারভর্তি একটি পিকআপ ভ্যানের সাথে সিএনজি অটোরিকশার ধাক্কায় সিলিন্ডারগুলো বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। চার দিকে প্রাইভেট কার, পিকআপ ভ্যান, মোটরসাইকেল, রিকশার ছোটাছুটির মাঝে আগুন ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
আগুন লাগে পাশের দোকানপাট, বসতবাড়িতে। চকবাজারের অসংখ্য রাসায়নিক কারখানা ও গুদামের দাহ্য পদার্থের সংস্পর্শে আগুন দ্রুত ভয়াল আকার ধারণ করে। চকবাজারের কেমিক্যাল গুদামে রাখা বডি স্প্রে ও এয়ারফ্রেশনারের বোতল একের পর এক বিস্ফোরিত হতে থাকলে পাশের ভবনগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়ে যায়। পুড়ে অঙ্গার হয় ৭৮টি তরতাজা প্রাণ। গুরুতর আহত ৪১ জন। কতজন নিখোঁজ রয়েছে তার নির্দিষ্ট সংখ্যা জানা যায়নি। সম্পূর্ণ পুড়ে যাওয়া পাঁচটি ভবনের একটি ওয়াহেদ ম্যানশনের বেসমেন্টে ছিল ড্রাম ও বস্তাভর্তি ১১ ধরনের কেমিক্যালের মজুদ। এর পরিমাণ ২৮ ট্রাক। এগুলোয় আগুন ধরলে পরিস্থিতি কতটা ভয়াহত হতে পারত ভাবতেও গা শিউরে ওঠে। সরু অলিগলিতে দমকল বাহিনীর ঢুকতে সমস্যা হয়েছে। আশপাশে জলাধারের অভাবেও আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে বেগ পেতে হয়।

৭৮টি প্রাণহানির পর এখন আবার সরকার, প্রশাসন এবং সংশ্লিষ্টরা একটু নড়েচড়ে উঠেছেন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মো: এনামুর রহমান বলেছেন, পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল কারখানা সরাতে আগামী তিন মাসের মধ্যে জায়গার ব্যবস্থা করা হবে। রোববার সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় তিনি এ কথা বলেন। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. জাবেদ পাটোয়ারী বলেছেন, পুরান ঢাকা কেমিক্যালমুক্ত করতে সব সংস্থা একসাথে কাজ করলে পুলিশ তাতে সহায়তা দেবে। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক ঘটনাস্থল দেখতে গিয়ে বলেন, এটি একটি মানবসৃষ্ট বিপর্যয়। এ বিপর্যয়ের পেছনে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের গাফিলতি আছে কি না, খতিয়ে দেখা দরকার। এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করবেন বলেও ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।

এ ঘটনায় কেমিক্যাল আইনে চকবাজার থানায় অপমৃত্যুর মামলা করেছে পুলিশ। আর ফায়ার সার্ভিসের ডেপুটি ডিরেক্টর দিলীপ কুমার ঘোষকে প্রধান করে গঠন করা হয়েছে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি। এক সপ্তাহের মধ্যে তাদের রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া ১২ সদস্যের আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে শিল্প মন্ত্রণালয়। এ কমিটিকে পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। আর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় স্বজনদের তথ্য জানতে হটলাইন চালু করেছে চকবাজার থানা এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। এ হটলাইনে (৯৫৫৬০১৪) কল করে স্বজনেরা নিখোঁজদের তথ্যসহ যেকোনো ধরনের তথ্য জানতে এবং জানাতে পারবেন।

অগ্নিকাণ্ডে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তার কোনো পরিসংখ্যান এখনো পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির মহাসচিব জহিরুল হক ভূঁইয়া সাংবাদিকদের জানান, এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে, ১০০ কোটি টাকার মতো ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আমরা বিস্তারিত পরে জানাব। যারা নিহত হয়েছেন তাদের পরিবার-পরিজনের সারা জীবনের যে ক্ষতি হলো, তা কি কখনো আর্থিক মানদণ্ডে মাপা সম্ভব হবে?
নিমতলী ট্র্যাজেডির পর সরকার গঠিত টাস্কফোর্স ওই এলাকার বিভিন্ন গুদামে যেসব রাসায়নিক চিহ্নিত করে, তার মধ্যে ছিল থিনার-বি, থিনার-সি, অ্যাসিটেট, ইথানল, ইথাইল অ্যাসিটেট, টলুইন, প্রোপাইলিন অ্যালকোহল, প্রোপাইলিন গাইকলসহ ২০টি দাহ্য পদার্থ। চকবাজারের বিভিন্ন রাসায়নিক কারখানার শত শত গুদামে রয়েছে নানা রকম বিস্ফোরক ও দাহ্য পদার্থের মজুদ।

নিমতলী ট্র্যাজেডির পর পুরান ঢাকায় সব ধরনের রাসায়নিক কারখানা স্থাপন, রাসায়নিক পদার্থের মজুদ ও বিপণন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। সে সময় নিমতলী এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালত ১০৪টি মামলা দায়ের করেন এবং ৩৫ লাখ ১৮ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করেন।

২০১০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সময় বেঁধে সরকার ব্যবসায়ীদের সব রাসায়নিক দোকান ও গুদাম অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দিলেও এ ব্যাপারে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। ২০১১ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঢাকা মহানগরের আবাসিক এলাকা থেকে ৮০০টি রাসায়নিক কারখানা ও গুদাম কামরাঙ্গীরচর ও কেরানীগঞ্জে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এ ব্যাপারে একটি টেকনিক্যাল কমিটিও গঠন করা হয়। ২০১৪ সালের মধ্যে কেরানীগঞ্জে ২০ একর জমির ওপর রাসায়নিক পল্লী স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও তা বাস্তবে রূপ নেয়নি।

আশ্চর্য হলেও সত্য, ২০১০ এবং ২০১৯-এর ঘটনাপ্রবাহে তেমন কোনো তফাৎ নেই। রোববারের আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী বলেন, সভায় কিছু সুপারিশ এসেছে, যেগুলোর সাথে ২০১০ সালে নিমতলীর ঘটনার পর যেসব সুপারিশ এসেছিল তার মিল রয়েছে। সেজন্য তারা ওই সুপারিশগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের ওপর জোর দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যাতে দেশের আর কোথাও এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনা না ঘটে।

সুপারিশগুলো তুলে ধরে মন্ত্রী এনামুর রহমান বলেন, জরুরি ভিত্তিতে আবাসিক এলাকা থেকে কেমিক্যাল কারখানা সরিয়ে নেয়া হবে। তিন মাসের মধ্যে ঢাকা শহরের বাইরে জায়গার ব্যবস্থা করে প্লট বরাদ্দ দিয়ে সেগুলো সরিয়ে নেয়া হবে। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন থেকে সাজেশন আসছে অনুমোদনহীন যেসব কেমিক্যাল কারখানা আছে, সেগুলোর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার। অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপন আইন এবং ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ভবন নির্মাণ নিশ্চিত করার বিষয়ে জোর দেয়া হয়েছে।

এ দিকে নিমতলী ট্র্যাজেডির পর পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল গোডাউন সরানোর ব্যাপারে পরস্পরকে দোষারোপ করছেন দুই সাবেক শিল্পমন্ত্রী। সাবেক শিল্পমন্ত্রী ‘আমির হোসেন আমুর কারণে পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল গোডাউন সরানো যায়নি’ মর্মে সাবেক শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়ার বক্তব্যের সমালোচনা করেছেন আমু। তিনি বলেছেন, দিলীপ বড়–য়ার তার নিজের ব্যর্থতা ঢাকতেই আমার ওপর দায় চাপাতে চেয়েছেন। সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে আমু বলেন, ‘ক্ষমতায় থাকতে গোডাউনগুলো সরানোর জন্য বারবার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ব্যবসায়ীরা রাজি হননি।’ আমু যে ভাষাতেই দিলীপ বড়ুয়ার সমালোচনা করুন না কেন, তিনি যে ব্যবসায়ীদের কাছে যেকোনো কারণেই হোক, নতি স্বীকার করেছিলেন, সেই বাস্তবতা ঢাকা পড়ার কোনো কারণ নেই। তদুপরি ঢাকার ট্যানারি শিল্প সাভারে সরিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রেও আমুর সফলতা প্রশ্নসাপেক্ষ।

আমরা ভবিষ্যতে এ ধরনের বিতর্ক আর দেখতে চাই না। বাস্তবে সাফল্যের প্রমাণ দিতে হবে সরকারকে। পুরান ঢাকার জনগণের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে
সেখানকার সব রাসায়নিকের দোকান, গুদাম ও কারখানা অন্য কোথাও সরিয়ে নিতে আশু ব্যবস্থা গ্রহণের বিকল্প নেই। পাশাপাশি নিরাপদ যেকোনো স্থানে রাসায়নিক দ্রব্য মজুদকারীদের জন্য ফায়ার লাইসেন্স গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক করতে হবে।

এ ছাড়া পুরান ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় যেকোনো ধরনের অগ্নিকাণ্ড দ্রুত মোকাবেলার জন্য বুড়িগঙ্গার পানি তুলে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায়, বিশেষ করে পুরান ঢাকার সরু অলিগলিতে ফায়ার-হাইড্রেন্ট বসানো দরকার। এই সুপারিশ ২০১০ সালেও করেছিলেন বিশেষজ্ঞরা।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল