১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

গণতন্ত্র সুরক্ষায় আমেরিকার চাপ কার্যকর হবে?

গণতন্ত্র সুরক্ষায় আমেরিকার চাপ কার্যকর হবে? - ফাইল ছবি

গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষায় ভূমিকা রাখার ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক সময় বিশেষ নীতি গ্রহণ করেছিল। বিশেষত স্নায়ুযুদ্ধোত্তর সময়ে যুক্তরাষ্ট্র যখন এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল তখন দেশে দেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় বিশেষভাবে সোচ্চার হয়ে ওঠে ওয়াশিংটন। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আমেরিকার প্রভাবে সোভিয়েতভুক্ত স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর প্রায় সব ক’টিতে উদার ধরনের গণতন্ত্র চর্চা শুরু হয়। পূর্ব ইউরোপীয় সোভিয়েত মিত্র দেশগুলোতেও একই ধরনের চর্চা দেখা যায়। এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের আরব রাজতান্ত্রিক ও সামরিক একনায়কতান্ত্রিক দেশগুলোতেও কার্যকর গণতন্ত্র অনুসরণের জন্য চাপ তৈরি করা হয়।

চলতি দশকের শুরুতে আরব জাগরণের পথ ধরে মধ্যপ্রাচ্যের একনায়কতান্ত্রিক শাসনের পরিবর্তন হতে থাকে। পরিবর্তনের পথ ধরে সূচিত নির্বাচনে মধ্যপন্থী ইসলামিস্টরা ক্ষমতায় আসতে শুরু করলে আরব রাজতান্ত্রিক লবি বিশেষভাবে জোরালো হয়ে ওঠে। বিভিন্ন দেশে আবার সামরিক একনায়কতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ঘটতে থাকে। উদার গণতন্ত্রের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত ও চলমান দেশগুলোর কোনো কোনোটিতে আবার স্বৈরতন্ত্রের বিকাশ ঘটতে থাকে। এর মধ্যে ক্রিমিয়া, জর্জিয়া, ইউক্রেন ও সর্বশেষ সিরিয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাশিয়া-চীনের সমন্বিত বিকল্প শক্তির বিকাশ ঘটতে শুরু করে। আমেরিকার বিভিন্ন নীতির কারণে সংক্ষুব্ধ দেশগুলোও ভারসাম্য রক্ষার জন্য চীন-রাশিয়া বলয়ের সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করতে শুরু করে দেয়। নতুন এই পরিস্থিতিতে আমেরিকার অভ্যন্তরেই জাতীয়তাবাদী চেতনা চাঙ্গা হতে শুরু করে। এতে মিত্র দেশগুলোর সাথে এক ধরনের টানাপড়েন দেখা দেয় ওয়াশিংটনের।

এ ধরনের এক ধোঁয়াশা পরিস্থিতিতে আমেরিকার কংগ্রেস ও সিনেটে দু’টি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। দুই ঘটনারই কেন্দ্রে রয়েছে বাংলাদেশ। গত ৩০ ডিসেম্বর বাংলাদেশে হয়ে যাওয়া নির্বাচন নিয়ে নানামুখী তর্কবিতর্ক ছিল। অনেক আগে থেকেই বিশেষত, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরে সরকারের একপক্ষীয় নির্বাচনের দিকে ঝোঁকার প্রবণতা স্পষ্ট হতে থাকে। এরপরও বিরোধী দল বিএনপি ও তার মিত্ররা নির্বাচনে অংশ নেয়। এমনকি নির্বাচনের আগের রাতে বিভিন্ন স্থানে ব্যালট দিয়ে আগাম বাক্স ভর্তি করার পরও তারা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াননি।

বাংলাদেশের নতুন প্রবণতা
এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে দু’টি প্রবণতা লক্ষ করেছেন পর্যবেক্ষকরা। প্রথমত, এখানে উদার গণতন্ত্র চর্চার পরিবর্তে নিয়ন্ত্রিত বা একদলীয় গণতন্ত্রের চর্চা শুরু হয়েছে। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রেখে এই ব্যবস্থায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে চেপে রাখার কৌশল রয়েছে। দ্বিতীয়ত, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ব্যাপারে সোচ্চার পশ্চিমা দেশগুলোকে খুব বেশি প্রভাব বিস্তার করতে না দিয়ে তাদের অর্থনৈতিক চাওয়া-পাওয়াগুলো পূরণের ব্যবস্থা থাকবে এ ব্যবস্থায়। আর সন্ত্রাসবিরোধী লড়াই তথা ইসলামিস্টদের দমন করে রাখার যে ইস্যুতে সব আন্তর্জাতিক পক্ষের অনাপত্তি রয়েছে, সেটিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হতে পারে।

বাংলাদেশের এবারের নির্বাচনে কার্যত দুটো পক্ষ তাদের হিসাব-নিকাশ তৈরি করেছিল। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদের সামনে সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের সহযোগী হওয়ার এজেন্ডার পাশাপাশি ছিল গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষা করার বিষয়। তাদের সামনে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের ব্যাপারে দল হিসেবে কোনো আপত্তি ছিল না। জনসমর্থন নিয়ে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তারা ক্ষমতায় আসতে পারে বলে তারা মনে করেন। অন্য দিকে রাশিয়া-চীনের সামনে মুক্ত অবাধ নির্বাচন বা গণতন্ত্র চর্চার ব্যাপারে বিশেষ কোনো আকর্ষণ ছিল না। তাদের অর্থনৈতিক বিনিয়োগ ও কৌশলগত স্বার্থই ছিল মুখ্য। এর মাঝখানে কিছুটা সংশয়ী অবস্থানে ছিল ভারত।

বাংলাদেশের বৃহৎ প্রতিবেশী এ দেশটি বর্তমান শাসকদলকে এক দশক যাবৎ নিরঙ্কুশভাবে সমর্থন জুগিয়ে আসছে। দেশটির কৌশলগত, নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক- অনেক বিষয়ে সঙ্ঘাত রয়েছে চীনের সাথে। বলা যায়, গত এক দশককালে ভারতের ভূমিকা এশিয়ার এই অঞ্চলে ছিল চীনের প্রভাব রোধে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগীর। ভারত সম্ভবত বাংলাদেশের ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্তকারী ভূমিকায় আসে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার এক বা দুই সপ্তাহ আগে। এই সময় থেকে স্পষ্ট হয় যে, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখতে সব কিছু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দিল্লি।

সপ্তাহকাল আগ পর্যন্ত একতরফা নির্বাচনের সব আয়োজন সত্ত্বেও যেখানে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসার ব্যাপারে এক ধরনের অনিশ্চয়তা বিরাজ করছিল, সেখানে হাওয়া পাল্টে যেতে থাকে ডিসেম্বরের শেষ দিকে। রাশিয়ার পাশাপাশি চীনা সমর্থন স্পষ্ট হতে থাকে শাসকদলের ক্ষমতা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে। অপরদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের কার্যকর সক্রিয়তাও সেভাবে আর দেখা যায়নি।

গণতন্ত্রের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া!
শেষ পর্যন্ত ২৯ ডিসেম্বর রাতে অনানুষ্ঠানিক এবং ৩০ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিক নির্বাচন সম্পন্ন হয়। এ সংসদ নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক তর্কবিতর্কের মধ্যেই ’৯৭ শতাংশ আসনে বিজয়ী সরকারি দল ও জোটকে অভিনন্দন জানানো অব্যাহত থাকে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা সহযোগীরা প্রথম দিকে এই প্রতিযোগিতায় থাকেনি। অবশ্য পরে নানাভাবে তারা সরকারের সাথে সম্পৃক্ত হয় এবং একপর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জার্মানির পক্ষ থেকেও নতুন সরকারপ্রধানকে অভিনন্দন জানানোর খবর আসে।

এর মধ্যে বাংলাদেশের নির্বাচনের ব্যাপারে পশ্চিমের প্রভাবশালী গণমাধ্যমে সমালোচনামূলক প্রতিবেদন আসতে থাকে। বাংলাদেশের নির্বাচন ও গণতন্ত্রের সাথে উত্তর কোরিয়ার গণতন্ত্রের তুলনা হতে থাকে। এই নির্বাচনকে তামাশা বলে উল্লেখ করে বাংলাদেশ একদলীয় ব্যবস্থার দিকে যাচ্ছে বলে উল্লেখ করা হতে থাকে। ৩১ জানুয়ারি প্রভাবশালী ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্ট ‘একটি গণতন্ত্রের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া : বাংলাদেশ’ শিরোনামে নিবন্ধে উল্লেখ করে, ‘দেশটির রাবার স্ট্যাম্প সংসদ তার কর্তব্যকর্ম আজ থেকে শুরু করছে। গত মাসে সুস্পষ্ট প্রতারণামূলক নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার চতুর্থ মেয়াদ শুরু করবেন।

এটি দক্ষিণ এশিয়ায় তার দীর্ঘতম প্রধানমন্ত্রিত্বের রেকর্ড তৈরি করবে। ৮৮ বছর বয়সী সাবেক স্বৈরশাসক এরশাদ বিরোধী দলের নেতা হিসেবে খেলবেন। আসল বিরোধী দল এ নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছে এবং তারা সংসদে যেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রধান খালেদা জিয়া এখন কারাগারে রয়েছেন (আর তার পুত্র এবং রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী এখন নির্বাসনে)। বিএনপির প্রধান সহযোগী দল জামায়াতে ইসলামীকে ২০১৪ সাল থেকে কার্যত নিষিদ্ধ অবস্থায় রাখা হয়েছে। তাই সংসদের প্রথম অধিবেশন হবে সর্বতোভাবে আনুষ্ঠানিকতা এবং হাস্যরসে ভরপুর। লীগ সফলভাবে বিরোধী দলকে বেশ দূরত্বে সরিয়ে রাখতে পেরেছে, আদালতে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে এবং প্রচারমাধ্যমের সমালোচকদের কণ্ঠ নীরব করে দিতে পেরেছে। শেখ হাসিনা এখন অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দেবেন; ঠিক তখন বাংলাদেশের সহনশীলতা ও গণতান্ত্রিক শিকড়ের কথা ভুলে যেতে হবে।’

ইকোনমিস্ট এর পরের এক সংখ্যায় অবশ্য বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রশংসা করে সমালোচনার কণ্ঠকে নমনীয় করেছে। এর মধ্যে বিশ্বগণমাধ্যমের সমালোচনার তীব্রতা কিছুটা কমে আসে। এমন একটি আবহ তৈরি হয় যে, পাশ্চাত্য তার সব ধরনের আপত্তি সত্ত্বেও বাংলাদেশে নতুন সরকারের সাথে কাজ করে যাবে।

আমেরিকার নতুন চাপ
কিন্তু এর মধ্যে মার্কিন প্রতিনিধিসভার পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির সদস্যরা দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে লেখা চিঠিতে বাংলাদেশে গণতন্ত্র রক্ষায় ব্যবস্থা নিতে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ এবং সে সম্পর্কে কংগ্রেসকে জানাতে বলেছে। আর সিনেটের আর্মড ফোর্সেস কমিটির শুনানিতে এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় কমান্ডাররা বাংলাদেশের বর্তমান শাসকদের একদলীয় ব্যবস্থার দিকে যাওয়াকে ‘উদ্বেগজনক’ বলে উল্লেখ করেছেন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওকে কংগ্রেসের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির দেয়া এই চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের সাম্প্রতিক নির্বাচনে জালিয়াতি, অবৈধভাবে ভোট ডাকাতি এবং ভোটারদের হয়রানির বিষয়ে মার্কিন প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে হবে। ৩০ ডিসেম্বরের জালিয়াতির নির্বাচনে ভয়াবহ সন্ত্রাস, গণগ্রেফতার এবং বাকস্বাধীনতাকে দমন করা হয়।’ চিঠিতে কংগ্রেসম্যানরা বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের নেতিবাচক প্রবণতা নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন এবং ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফলের বিশ্বাসযোগ্যতার অভাবের গুরুতর অভিযোগের আলোকে এ প্রবণতাটির প্রতি সাড়া দেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে একটি রূপরেখা তৈরি করতে হবে বলে মনে করছি।’

এতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলা হয়, ‘গণতন্ত্র, আইনের শাসন এবং ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মানবাধিকার রক্ষা মার্কিন স্বার্থকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ইতিবাচক। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের যে রিপোর্ট এসেছে তা গুরুতর। এসব রিপোর্ট মার্কিন স্বার্থের জন্য হুমকি।’

চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, আফগানিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও থাইল্যান্ডে এ বছর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এশিয়ার নির্বাচনের এই সিরিজে কার্যকর গণতন্ত্র চর্চা গুরুত্বপূর্ণ। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত অঙ্গীকার ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’ অন্য দিকে মার্কিন সিনেটের আর্মড সার্ভিস কমিটির গুরুত্বপূর্ণ এক শুনানি অনুষ্ঠিত হয় কয়েক দিন আগে, যেখানে শেখ হাসিনার ‘একদলীয় শাসন’ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। শুনানিতে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক বাহিনীর দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে বক্তব্য উপস্থাপন করেন ও প্রশ্নের উত্তর দেন, ইউএস ইন্দো-প্যাসিফিক কমান্ডের কমান্ডার অ্যাডমিরাল ফিলিপস এস ডেভিডসন এবং যুক্তরাষ্ট্রের কম্বাইন্ড ফোর্স কমান্ডার জেনারেল রবার্ট বি আব্রামস। শুনানির বাংলাদেশ অংশে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিরাপত্তার বিষয়ে জোর দিয়ে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সাথে মার্কিন সামরিক বাহিনীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলা, আঞ্চলিক নিরাপত্তা বলয় কৌশল তৈরিসহ বেশ কিছু মূল্যায়ন তুলে ধরা হয়েছে।

গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে শুনানির বাংলাদেশ অংশে বলা হয়, ‘ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের জয় পাকাপোক্ত করে অব্যাহতভাবে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার যে ধরন ৩০ ডিসেম্বরের বাংলাদেশের নির্বাচনে দেখা গেছে, তা উদ্বেগের বিষয়। একই সাথে তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার দিকে অগ্রসর হওয়ার আশঙ্কা বাড়িয়ে দিচ্ছে।’ এতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সাথে আমেরিকার সেনাবাহিনীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করতে হবে; এটা করতে হবে কৌশলগত বড় পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। সেই সাথে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা, প্রতিশ্রুতি পূরণ এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য এখানে আঞ্চলিক নিরাপত্তা বলয় তৈরি করতে হবে।’

এই সময়ে এএফপির এক মূল্যায়নধর্মী প্রতিবেদনে উইড্রো উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর স্কলার্সের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সিনিয়র অ্যাসোসিয়েট মাইকেল কুগেলম্যানের বক্তব্যের বরাত দেয়া হয়। তিনি বলেছেন, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর বাংলাদেশ কার্যত একদলীয় স্বৈরতান্ত্রিক দেশে পরিণত হয়েছে। তবে এ দেশটির কার্যকারিতা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের সাথে অনেকটাই মানানসই। শেখ হাসিনাকে যুক্তরাষ্ট্র দরকারি অংশীদার মনে করে আসছিল। তিনি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে খুবই কঠোর, তিনি বেশ লক্ষণীয় মাত্রায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছেন। বাংলাদেশের খুবই গোলযোগপূর্ণ অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি সত্ত্বেও তাকে স্থিতিশীলতা রক্ষাকারী মনে করা হয়েছিল।

এতে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রবান্ধব ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার জন্য ওয়াশিংটনের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য বাস্তবায়নে দেশটির সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা করে চলেছে বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কার মতো উচ্চপর্যায়ের অবকাঠামো চুক্তি করেনি চীনের সাথে। বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ হচ্ছে আঞ্চলিক শক্তি ও উদীয়মান মার্কিন মিত্র, ভারত। দেশটি শেখ হাসিনার কট্টর সমর্থক। ফলে বিকল্প থাকলেও ওয়াশিংটনের সামনে অন্য কিছু করার সুযোগ খুব কম।

বিরোধী দল অবশ্য আশা করছে, মার্কিন সমালোচনা ফল দেবে। বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক হুমায়ুন কবির নির্বাচনের আগে ওয়াশিংটনে নীতিনির্ধারকদের সাথে বৈঠক করেছিলেন। তিনি বলেন, গণতন্ত্রায়নের জন্য কাজ না করলে সম্পর্ক সীমিত থাকবে- এমনটি পরিষ্কার করা উচিত যুক্তরাষ্ট্রের। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে কম্বোডিয়া বা ভেনিজুয়েলার মতো দেশে পরিণত করেছেন।

প্রতিনিধি পরিষদের সর্বশেষ বিবৃতি এবং সিনেটের প্রতিরক্ষা কমিটির শুনানির বক্তব্যে মনে হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতন্ত্র চর্চার বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে নিতে চাইছে। দেশটি জানে, কোনো দেশ স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে গেলে সেই দেশ রাশিয়া-চীন বলয়ের সাথে ঘনিষ্ঠতা তৈরির ব্যাপারে প্রলুব্ধ হয়। দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে সে পথে যেতে দিতে চায় না ওয়াশিংটন।

শাসন পাল্টানোর ফর্মুলা
প্রশ্ন হলো, যুক্তরাষ্ট্র কি বাংলাদেশে গণতন্ত্র সুরক্ষার জন্য সিদ্ধান্তকারী কোনো কিছু করার ইচ্ছা রাখে? অথবা সে ধরনের কোনো আকাক্সক্ষা থাকলেও সেটি কার্যকর করার মতো সক্ষমতা দেশটির এখন কি আছে? এই প্রশ্নের সরল উত্তর পাওয়া কঠিন। যুক্তরাষ্ট্র ল্যাটিন আমেরিকার ভেনিজুয়েলায় মাদুরোর শাসন পরিবর্তনের একটি কর্মসূচি বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে। এ জন্য অর্থনৈতিক টুলসগুলোর ব্যবহার শুরু করেছে অনেক আগে থেকে। এখন সর্বাত্মক অবরোধ কার্যকর করার পর সামরিক পদক্ষেপ নেয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। ভেনিজুয়েলার আটকে রাখা অর্থ বিরোধীদের দিয়ে তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া হতে পারে। চেষ্টা করা হতে পারে সামরিক বাহিনীতে বিভক্তি আনার। যেভাবেই হোক, রাশিয়া ও চীনের কঠিনভাবে সমর্থনপুষ্ট মাদুরোকে ক্ষমতাচ্যুত করে আস্থাভাজন গুয়াইদোকে ক্ষমতায় বসানোর প্রচেষ্টা সফল হলে এটিকে একটি মডেল হিসেবে নিতে পারে ওয়াশিংটন।

সাউথ এশিয়ান জার্নালে সাবরিয়া চৌধুরী এটিকে ভিন্ন মতের শাসন পরিবর্তনে আমেরিকান ফর্মুলা হিসেবে বর্ণনা করেছেন তার লেখায়। তিনি এই ফর্মুলাকে বাংলাদেশে প্রয়োগের সম্ভাবনাও দেখতে পেয়েছেন। তিনি দুই দেশের নানা সাযুজ্যও তুলে ধরেছেন। বলেছেন, প্রচণ্ড দুর্নীতি, দারিদ্র্য, বায়ু ও পানির দূষিত মান, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, বাকস্বাধীনতা ও মত প্রকাশের অভাব- এসব ক্ষেত্রে ভেনিজুয়েলার সাথে বাংলাদেশের মিল রয়েছে। দুই ক্ষেত্রেই আইন প্রয়োগকারী, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অর্গান ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে রাজনৈতিকভাবে ভূমিকা রাখে। এ অবস্থায় গতানুগতিকতা কার্যকারিতা হারায়।

ভেনিজুয়েলায় শেষ পর্যন্ত এই ফর্মুলা কাজ করবে কি না, আর করলেও সেটি বাংলাদেশে প্রয়োগ করা হবে কি না সেটি বিতর্কের বিষয়। তবে আমেরিকার হাউজ ও সিনেটের উদ্বেগ এবং ব্যবস্থা নেয়ার কর্মকৌশলের তাগিদ ঢাকার উদ্বেগকে বাড়িয়ে দেবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবার জার্মানি ও সংযুক্ত আরব আমিরাত সফরের সাথে এই উদ্বেগের কোনো-না-কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে। জার্মানি হলো ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধান নেতা আর আরব আমিরাত মুসলিম দেশগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের এজেন্ডা বাস্তবায়নে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বলে মনে করা হয়।
mrkmmb@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement