১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

জাতীয় ঐক্য এবং জাতীয় ভিত্তিতে সমঝোতা ও আত্মসমালোচনা-২

জাতীয় ঐক্য এবং জাতীয় ভিত্তিতে সমঝোতা ও আত্মসমালোচনা-২ - ছবি : সংগৃহীত

লেখা বা না লেখার পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা
গত ২৯-৩০ ডিসেম্বরের সংসদ নির্বাচন নিয়ে সমালোচনা ও আত্মসমালোচনামূলক কলাম লেখা খুবই জরুরি। শুরু করেছিলামও। ১৬ জানুয়ারি প্রকাশিত কলামটি ছিল ওই নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের নামে জাতির সঙ্গে ছলনা প্রসঙ্গে। ২৩ জানুয়ারি প্রকাশিত কলামটি ছিল ওই নির্বাচনে সাধারণ অনিয়মগুলোর আলোচনা। আরো কয়েকটি বড় অনিয়মের আলোচনা ঐদিনের কলামে স্থানাভাবে সম্ভব হয়নি। ৩০ জানুয়ারির কলামটি ছিল, এইরূপ বিতর্কিত নির্বাচনে প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে। নির্বাচনের এসব বিবিধ আঙ্গিক নিয়ে আলোচনা করা জরুরি; কিন্তু ওই জরুরি আলোচনা এখনো করতে পারিনি। করার ইচ্ছা আছে, কিন্তু না করার জন্যও পরামর্শ আছে। অনেকেই বলাবলি করেন, বার্তা দেন, মন্তব্য লিখেছেন এই বলে যে, কার জন্য কলামগুলো লিখছেন, কাকে সচেতন করার জন্য বা কাকে অসচেতন করার জন্য কলাম লিখছেন; আগে সেটা নিশ্চিত হন, তারপর লিখবেন। কারণ, যদি আপনাদের অনুমান মতে কলাম লেখার ফলাফল শূন্য হয় অথবা ইতিবাচক না হয়, তাহলে এত পরিশ্রম করেইবা লাভ কী? যা হোক, প্রক্রিয়া যখন শুরু করেছি, এটা শেষ করব; অর্থাৎ লেখার প্রক্রিয়া শেষ করব ইনশাআল্লাহ। মার্চ মাস পর্যন্ত লিখতে হবে; তারপর দেখা যাবে কী করলে ভালো বা কী না করলে ভালো।

প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির আহ্বান
এরই মধ্যে ২৫ জানুয়ারি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার ভাষণের অভিনব কথাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, জাতীয় ঐক্যের আহ্বান। বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের বাইরে কোটি কোটি মানুষ এই ভাষণ শুনেছেন। যারা শোনেননি, তারা পরের দিনের পত্রিকায় এর সারমর্ম পড়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের আনুমানিক ১২০ ঘণ্টা পর, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ নতুন সংসদ তথা একাদশ জাতীয় সংসদের উদ্বোধনী অধিবেশনে রেওয়াজ মোতাবেক ভাষণ দেন। পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসির রেওয়াজ মোতাবেক, সরকার যে ভাষণ লিখে দেবে, রাষ্ট্রপতি ওই ভাষণই পড়বেন। অতএব আমাদের রাষ্ট্রপতিও সরকারের অনুমোদিত ভাষণই দিয়েছেন। ৩০ জানুয়ারি সন্ধ্যায়, রাষ্ট্রপতি পার্লামেন্টে যে ভাষণ দেন, সেখানে তিনিও জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানান। অর্থাৎ বর্তমান রাজনৈতিক সরকার, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যে বক্তব্যটি দিতে চাচ্ছেন, সেটি রাষ্ট্রপতির মুখ দিয়েও প্রকাশ পেয়েছে।

ভাষণগুলো আলোচনার গুরুত্ব
অতএব এই আহ্বানটি নিয়ে আলোচনা করা আমাদের জরুরি; আহ্বানটির প্রয়োজনীয়তা, সম্ভাব্যতা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করা জরুরি; এই আলোচনাই শুরু করেছি বুধবার ৬ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত কলামে। ভাষণে প্রধানমন্ত্রী জাতীয় ঐক্যের পাঁচটি যোগসূত্রের কথা উল্লেখ করেছিলেন। এক নম্বর যোগসূত্রটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এর উৎস হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ; মুক্তিযুদ্ধের উৎস হচ্ছে ১৯৭১-এর মার্চের পূর্ববর্তী দু’চার-পাঁচ-দশ বছরের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও পরিবেশ এবং তার প্রতিক্রিয়া। অতএব প্রধানমন্ত্রীর উল্লিখিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গেলে অবশ্যই ’৭১-এর মার্চের পূর্ববর্তী সময়ের এবং ’৭১-এর মার্চের পরবর্তী সময়ের ওপর কিঞ্চিত আলোচনা করতেই হবে। পছন্দ হোক বা না হোক, বাংলাদেশে গত দু’চার দশকের মুক্তিযুদ্ধের আলোচনায় অনেকাংশজুড়েই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের প্রসঙ্গ উঠতেই থাকে। তাই ওই আলোচনাটিই করেছি। আজকের কলামের বাকি অংশটি গত সপ্তাহের কলামের ধারাবাহিকতায় লেখা।

অতীত কলামের সন্ধান
সম্মানিত কোনো পাঠক যদি গত সপ্তাহের কলামটি না পড়ে থাকেন, তাহলে আজকের কলামটি তার কাছে বেখাপ্পা ঠেকবে। তা যেন না লাগে, সে জন্য আমাদের আবেদন, সম্মানিত পাঠক কষ্ট করে গত বুধবার তথা ৬ ফেব্রুয়ারি নয়া দিগন্ত পত্রিকায় প্রকাশিত আমার কলামটি পড়ে নেবেন। নয়া দিগন্ত পত্রিকার আর্কাইভসে গেলে কলামটি পাবেন; অথবা আমার ওয়েবসাইট www.generalibrahim.com.bd-এ গেলে কলামটি পাবেন। আমরা বঙ্গবন্ধু, শহীদ জিয়া এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে আলোচনা শুরু করেছিলাম, সেটি এই কলামের বাকি অংশে শেষ করব। অতঃপর প্রধানমন্ত্রীর উল্লিখিত অন্য যোগসূত্র নিয়ে আলোচনা করছি।

বঙ্গবন্ধু ও শহীদ জিয়া
বাঙালি জাতির জাতীয় স্বার্থে বঙ্গবন্ধু বা শহীদ জিয়া উভয়ই এই কাজ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ করার জন্য তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমানের মানসিক প্রস্তুতির ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে বঙ্গবন্ধুর অবদান ছিল এবং তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান যে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন (প্রথমে নিজের নামে, পরে বঙ্গবন্ধুর নামে), সেটিই অর্জিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। ইতিহাসের স্বাভাবিক গতিপথেই তাদের পথচলার পথ সুস্পষ্ট, সম্পূরক; কোনো মতেই সাংঘর্ষিক নয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ নামক জাতিরাষ্ট্র সৃষ্টির প্রধান স্থপতি ও প্রাণপুরুষ। তারই নেতৃত্বে সৃষ্টি করা বাংলাদেশে, বঙ্গবন্ধু নিজে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫-এর আগস্ট পর্যন্ত প্রথমে রাষ্ট্রপতি, পরে প্রধানমন্ত্রী এবং আরেকবার রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন।

অপরপক্ষে, ২৭ মার্চ ১৯৭১ সালে মেজর জিয়াউর রহমান প্রথমে নিজের নামে দিলেও পরে বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন; প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানীর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের নেতৃত্বে ও পরিচালনাতেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন; অসীম সাহসে ও দক্ষতায় সেক্টর কমান্ডার ও ফোর্স কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। শুধু তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান নন, আমি এবং আমার মতো লাখো মুক্তিযোদ্ধা (বিএলএফ বা মুজিব বাহিনী বাদে), নিজ নিজ সাব-সেক্টর কমান্ডার বা সেক্টর কমান্ডার বা ব্যাটালিয়ন কমান্ডার বা ফোর্স কমান্ডারের অধীনে যুদ্ধ করেছি; তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ছিলেন প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানী; এবং তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের অনুগত। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারই ছিল মুখ্য বিষয়; কোনো রাজনৈতিক দল মুখ্য ছিল না। যা হোক, জিয়ার প্রসঙ্গে আলোচনা শেষ করি। নিয়তি কর্তৃক নির্ধারিত ক্ষণে, ১৯৭৫-এর নভেম্বরের ৭ তারিখে দেশপ্রেমিক সৈনিক ও জনগণ, তদানীন্তন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে জাতীয় নেতৃত্বের ঊর্ধ্ব-স্থানে উৎক্ষেপণ করেন; কয়েক মাস পরেই জিয়াউর রহমান নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হন; ৩০ মে ১৯৮১ সালে বিদ্রোহী আততায়ীদের হাতে তিনি নিহত হন তথা শাহাদত বরণ করেন।

একটি পরিহার্য দ্বন্দ্ব ও প্রয়োজনীয় আহ্বান
কিন্তু গত ৩০-৪০ বছর যাবত বাংলাদেশের চিন্তাশীল মানুষের একটি অংশ, আলোচক সম্প্রদায়ের একটি অংশ, রাজনৈতিক সম্প্রদায়ের একটি অংশ, এই দুই মরহুম মহান নেতাকে তথা শহীদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে, পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। বাংলাদেশের চিন্তাশীল মানুষের একটি অংশ, আলোচক সম্প্রদায়ের একটি অংশ, রাজনৈতিক সম্প্রদায়ের একটি অংশ, এই দুই মরহুম মহান নেতাকে তথা শহীদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে, একের তুলনায় অন্যকে অবমূল্যায়ন করে যাচ্ছেন, অবহেলা করে যাচ্ছেন। দু’টি কাজ অর্থাৎ, প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দাঁড় করানো বা অবমূল্যায়ন, কোনোটিই বাংলাদেশের জন্য মঙ্গলজনক নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়; জাতীয় ঐক্যের অনুকূল নয়। এই প্রবণতা বন্ধ করতে না পারলে, জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করা কঠিন। প্রধানমন্ত্রী এই কাজের সূচনা করতে প্রস্তুত কি না, জানি না। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকে জাতীয় ঐক্যের বাহন ও উসিলা বানাতে চাইলে, সমগ্র জাতি কর্তৃক বঙ্গবন্ধু ও শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে যার যার জন্য প্রযোজ্য, যথাস্থানে, বড়-ছোট আসনে আসীন করতে হবে। আমি বা আমার মতো কেউ তা করতে গেলে কেউ মানবেন, কেউ মানবেন না, ইচ্ছা বা নিয়ত বা প্রস্তাবকে সন্দেহ করা হবে। তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজ বিবেচনায় এই কাজটি শুরু করতে পারেন এবং তা করার ফলেই জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিপ্রস্তর রচনা হতে পারে বলে আমাদের বিশ্বাস। এই দাওয়াতই দিয়েছিলাম, মৌখিকভাবে ১০ এপ্রিল ১৯৯৯ তারিখে সেমিনার চলাকালে ঢাকা সিরডাপ মিলনায়তনে। আমার ওই ১০ এপ্রিলের আহ্বানটিই ১১ এপ্রিল ১৯৯৯ সালে বড় পত্রিকাগুলো তাদের সংবাদে হুবহু উদ্ধৃত করেছিল। আমার এই আহ্বানটিই আমি ১৪ ডিসেম্বর ২০০১ সালে ইনকিলাব পত্রিকার বিজয় দিবস ও ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত কলামে পুনরায় উদ্ধৃত করেছিলাম। আমার ১০ এপ্রিলের আহ্বানটিই ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সালে উদ্ধৃত করেছি। আমি অগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলাম, তাই আমার আহ্বানের মূল্য বা তাৎপর্য কম। প্রধানমন্ত্রী সমগ্র দেশের দ্বিতীয় অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, তার আহ্বানের মূল্য অপরিসীম। কিন্তু সেই আহ্বানটি বাস্তবসম্মত প্রেক্ষাপটে, বাস্তবসম্মত ভাষায় এবং বাস্তবসম্মত লক্ষ্য সামনে রেখে করতে হবে।

আমজনতার গল্প
এতক্ষণ শুধু দু’জন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বকে নিয়ে আলোচনা করলাম। কিন্তু সাধারণ জনগণ তথা সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা ও তৎকালীন রাজনৈতিক কর্মীদের নিয়ে কিছু বলা হয়নি। এখন সেটি বলছি। এ দেশের শত-সহস্র শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত যুবক, কৃষক, শ্রমিক মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। আওয়ামী লীগ নামক রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হলেও রাজনৈতিক দল ও মত নির্বিশেষে (মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম, পিডিপি ব্যতীত) সব মতাদর্শের বাঙালি জনগোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। মুক্তিযুদ্ধ চলেছে ৯ মাস। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রণক্ষেত্র ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিন্যাস ছিল নি¤œরূপ : সমগ্র বাংলাদেশের ভূখণ্ডকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। প্রত্যেক সেক্টরে একজন সেক্টর কমান্ডার ছিলেন এবং সাব-সেক্টরগুলোতে ছিলেন সাব-সেক্টর কমান্ডার। সেক্টরে যেসব মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তাদের বলা হতো সেক্টর ট্রুপস এবং তাদের কর্মের ভিত্তিতে দুই রকমের ভাগ করা ছিল। এক দলকে বলা হতো নিয়মিত বাহিনী, আরেক দলকে বলা হতো মুক্তিফৌজ বা গেরিলা। মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে সনাতন পদ্ধতিতে যুদ্ধ করার জন্য মুক্তিবাহিনীর একটি অংশকে ব্যাটালিয়ন, ব্রিগেড ইত্যাদি আকারে পুনর্গঠিত করা হয়।

অতীতের দু’টি সঙ্কট বা সঙ্কোচ বা বিভক্তি
একই সময়ে, অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি তৎকালীন ভারতীয় সরকারের আগ্রহে ও পৃষ্ঠপোষকতায় মুক্তিবাহিনীর সমান্তরালে, মুজিবনগরে অবস্থিত প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে, মুক্তিযুদ্ধের তৎকালীন প্রধান সেনাপতি ওসমানীর কমান্ডের বাইরে, আলাদা একটি বাহিনী গঠন করা হয়। এই বাহিনীর নাম ছিল ‘বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স’ বা সংক্ষেপে বিএলএফ। সাধারণ লোকের মুখের ভাষায় এটার নাম ছিল ‘মুজিব বাহিনী’। এই বাহিনীর সর্বোচ্চ কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন চারজন (সবাই তখন ছিলেন প্রখ্যাত ছাত্রনেতা)। এই বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য বা মনোনীত হওয়ার অন্যতম প্রধান শর্ত ছিল, প্রার্থীদের খাঁটি ছাত্রলীগ কর্মী হতে হবে এবং নেতৃত্বের প্রতি থাকতে হবে নিঃশর্ত আনুগত্য। সর্বশেষ কাঙ্ক্ষিত শর্ত ছিল, প্রদত্ত পৃষ্ঠপোষকতা ও সহায়তার জন্য সহায়তাকারীর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতে হবে।

বিএলএফ তথা মুজিব বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সক্রিয় হয়েছিল। তাদের সব সামরিক পরিকল্পনা এবং কমান্ড নিয়ন্ত্রণ করতেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল এস এস ওবান। এখানে যে কথাটি বলতে চাই সেটি হলো, মুক্তিযুদ্ধকালেই এই ধরনের বিভক্তি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একধরনের শঙ্কা বা সঙ্কট বয়ে আনে। ১৯৭২-এর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ছিল শতকরা ৯৯ ভাগ মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে গঠিত। এর বিপরীতে দাঁড় করানো হয়েছিল জাতীয় রক্ষীবাহিনীকে, যারাও ছিল শতকরা ৯৯ ভাগ মুক্তিযোদ্ধা। এই বিভক্তি থেকে উদ্ভূত সঙ্কট বা সঙ্কোচ আমরা প্রায় ৪৭ বছর যাবত বহন করে চলেছি। এটা আর বহন করতে চাই না। বিভক্তি আর কাম্য নয়। এই বিভক্তির সঙ্কট বা সঙ্কোচ থেকে মুক্ত হতেই হবে। এখন মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রজন্মের দিন শেষ এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন পরবর্তী প্রজন্মের তারুণ্য চলছে; এবং এই তারুণ্য অতীতের ওই বিভক্তি বা সঙ্কট বা সঙ্কোচে প্রভাবিত নয়। অতএব, মনে করি, জাতীয় ঐক্যের আহ্বানের প্রতি সাড়া দেয়া, বর্তমান প্রজন্মের জন্য সহজ।

একজন ব্যক্তির পরিচয়ের বহু আঙ্গিক
ওই প্রসঙ্গে আমি একটু বিস্তারিত বলছি। সমঝোতার প্রধান বিষয়গুলো কিন্তু বস্তুগত নয় বা অভ্যাসগত নয়। এগুলো বিশ্বাস ও অনুভূতি সম্পর্কিত। আমরা চার পরিচয়ের কথা বলি- যথা ‘একের ভেতর চার’। সেই এক হচ্ছে আমি আর চার হচ্ছে আমার চার পরিচয়। সেই পরিচয় কী? আমি মুসলমান, আমি বাঙালি, আমি মুক্তিযোদ্ধা এবং আমি বাংলাদেশী। আমার কোনো একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী বন্ধু হলে বলতেন : আমি হিন্দু, আমি বাঙালি, আমি মুক্তিযোদ্ধা এবং আমি বাংলাদেশী। আমার প্রজন্মের অনেকেই এবং পরবর্তী প্রজন্মের সবাই মুক্তিযোদ্ধা নয়। তাদের জন্য প্রযোজ্য তিন পরিচয়। যথা হিন্দু অথবা মুসলমান, বাঙালি অথবা চাকমা, মার্মা ইত্যাদি এবং বাংলাদেশী। আমাদের জাতীয় জীবনে সমঝোতার অন্যতম অন্তরায় হচ্ছে বাঙালি না বাংলাদেশী- এই নিয়ে বিতর্ক, যেটা কয়েক বছর আগে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের মাধ্যমে মোটামুটি ফয়সালা হয়েছে। কিন্তু সব বিষয়ে ফয়সালা আদালত থেকে আসবে না। আরেকটি অন্যতম পরিহার্য অন্তরায় হচ্ছে, হিন্দু এবং মুসলমান শব্দ দু’টি বা পরিচয় দু’টি বলা যাবে কিনা বা ব্যবহার করা যাবে কিনা, এই নিয়ে বিতর্ক। অতএব, পরিচয়গুলোর ব্যাখ্যা প্রয়োজন; কিন্তু এই কলামে স্থানাভাবে বিস্তারিত লিখব না, সংক্ষেপে লিখব।

ধর্মীয় ও ভাষাগত পরিচয় সক্রিয়
আমার জন্ম চট্টগ্রামের এক গ্রামে। তখন ছিল নিভৃত অনগ্রসর বর্তমানে বর্ধিষ্ণু। যখন জন্মগ্রহণ করি তখন রেওয়াজ মোতাবেক বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে আজান দেয়া হয়েছিল এবং কানের মধ্যে ফুঁ দিয়ে আজানের বাণী ও কলেমা পড়া হয়েছিল। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমাজকে ও আমাকে জানিয়ে দেয়া হয়েছিল যে, আমি মুসলমান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি। জন্মের ব্যাপারে আমার কোনো হাত ছিল না। সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ তায়ালার হুকুমেই আমি আমার পিতা-মাতার ঘরে জন্মেছি এবং আনন্দের সাথে এ পর্যন্ত ওই বিশ্বাস নিয়ে আছি। বুদ্ধি হওয়ার পর, লেখাপড়া করার পর বিশ্বাসের গুণগত পরিবর্তন হয়েছে। মুসলমান হিসেবে আমি আনন্দিত ও গর্বিত এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বী আমার একজন ভাইও নিশ্চয়ই হিন্দু হতে পেরে আনন্দিত ও গর্বিত। যে জনপদে জন্মগ্রহণ করেছিলাম, বহু শতাব্দী ধরেই সে জনপদটি বা সেই ভূখণ্ডটি বঙ্গ বা বাংলা নামে পরিচিত। বঙ্গ বা বাংলা নামক ভূখণ্ডে জন্মগ্রহণ করার কারণে এবং মাতৃভাষার কারণে আমি বাঙালি। জন্মগতভাবেই আমি বাঙালি; এটা হওয়ার জন্য আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়নি। সৃষ্টিকর্তাই আমাকে বাঙালি বানিয়েছেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে, যেটাকে আমরা ধর্মীয় বিশ্বাস বলি সেটা (মুসলমানদের পরিভাষায় ঈমান) এবং মাতৃভাষা এই দুটির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার কিছু ছিল না এবং এই দুটির ওপর আমার জন্মগত অধিকার আছে। অতএব, এই দু’টি নিয়ে কোনো বিবাদের অবকাশ নেই।

মুক্তিযোদ্ধা ও বাংলাদেশী পরিচয় দু’টি অর্জিত
হিন্দু, মুসলমান, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ- এসব বাঙালি এবং কিছু অবাঙালি মিলে এক সময়ে ছিলাম পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসরত পাকিস্তানি হিসেবে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোতে আমরা সুবিচার পাইনি। এই পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, বেদনা এবং প্রতিবাদের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে ঘটতে ২৩ বছর পেরিয়ে যায়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা ভাষাভাষী জনগণ সঙ্ঘবদ্ধ হতে থাকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং অধিকার আদায় করতে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের আহ্বান, ২৬ মার্চ বিভিন্ন স্থানে সশস্ত্র বিদ্রোহ এবং ২৭ মার্চ তৎকালীন মেজর জিয়ার কণ্ঠে স্বাধীনতা ঘোষণায়, ইত্যাদির প্রেক্ষাপটে শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করাটা কারো জন্য বাধ্যতামূলক ছিল না। পাকিস্তানিদের প্রতি ক্ষোভ ও প্রতিবাদের অংশ হিসেবে হাজার হাজার তরুণ মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন।

দেশের মানুষের ও মাটির টানেও মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন হাজার হাজার তরুণ ও তরুণী। মুক্তিযোদ্ধারা অনেক ধরনের। যথা- রাজনৈতিক মুক্তিযোদ্ধা তথা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা তথা রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা, রণাঙ্গনের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা, পরোক্ষ মুক্তিযোদ্ধা, সমর্থক মুক্তিযোদ্ধা ইত্যাদি। কয়েক লাখ লোক যেমন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, এর বহু গুণ বেশি লোক মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার অবকাশ থাকার পরেও তাতে যোগ দেননি। তাদের মধ্যে অনেকেই এখন খুব সোচ্চার। অতএব মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া বা না যাওয়াটা ছিল কোনো ব্যক্তির ইচ্ছাধীন এবং আংশিকভাবে পরিস্থিতি ও পরিবেশের ওপর নির্ভরশীল। আমি মুক্তিযোদ্ধা- সেটা আমার জন্য আনন্দের ও গৌরবের বিষয়; যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন তাদের জন্য এটা গ্লানির বিষয় ও অপরাধ। অনুরূপ একটি বড় কথা হলো, মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হওয়া অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা।
মুক্তিযুদ্ধ আমরা কেন করেছিলাম?

মুক্তিযুদ্ধ আমরা কেন করেছিলাম? এই প্রশ্নের তত্ত্বীয় ও দার্শনিক (ইংরেজিতে থিওরিটিক্যাল ও ফিলোসফিক্যাল) উত্তর সহজেই দেয়া যাবে। এসব উত্তর পাঠকসমাজে অতি পরিচিত। কোনো গুরুগম্ভীর উত্তর দিতে চাই না। সাদামাটা ভাষায় উত্তর দিতে চাই। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসের নির্বাচনের ফলাফলকে যদি পাকিস্তানের সামরিক সরকার, ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে এসে সম্মান করত, তাহলে ১৯৭১-এর মার্চ মাসে নিশ্চয়ই বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতেন। ভোটের মাধ্যমে প্রদত্ত জনগণের রায়কে পাকিস্তানের সামরিক সরকার সম্মান করেনি বিধায়, জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়া অবশ্যম্ভাবী ছিল। অতএব আমরা এটাই বলতে পারি, জনগণের রায়ের মাধ্যমেই সরকার গঠিত হবে এবং জনগণের রায়ের মাধ্যমে দেশ পরিচালিত হবে। এটার নামই গণতন্ত্র, এটাই গণতান্ত্রিক চেতনার উজ্জ্বলতম আঙ্গিক। ২০১৯ সালের বাংলাদেশে এই চেতনা মারাত্মকভাবে আহত ও প্রশ্নবিদ্ধ।

অতএব, প্রধানমন্ত্রীকে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করতে হলে বা রাষ্ট্রপতির মতে উন্নয়নকে স্থিতিশীল করতে হলে যেরূপ প্রয়োজনীয় ঐক্য দরকার সেরূপ ঐক্য সৃষ্টি করতে হলে ২০১৯ সালের বাংলাদেশে জনগণের রায় নিতে হবে এবং সেই রায়কে সম্মান করতে হবে। ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখের নির্বাচন যেটা ২৯ ডিসেম্বর শুরু হয়ে যায়, সেটা কোনোমতেই জনগণের রায়ের প্রতিফলন নয়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যদি এটাকে স্বীকার করেন এবং যদি এর সংশোধনের ব্যবস্থা নেন, তাহলে তার আহ্বান জানানো, জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা সহজ হবে।

জাতীয় ঐক্যের অন্যান্য যোগসূত্র
২৫ জানুয়ারি ২০১৯ সালে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আহ্বান রেখেছেন : ভেদাভেদ ভুলে যেন জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা হয়। এই ঐক্যের জন্য তিনি পাঁচটি যোগসূত্রের উল্লেখ করেছেন। প্রথম যোগসূত্রের নাম, প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় : মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এই চেতনা সম্পর্কেই আলোচনা করেছিলাম গত বুধবারের কলামে এবং করেছি আজ বুধবার ১৩ ফেব্রুয়ারির কলামে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আরো কিছু আঙ্গিক আছে যেগুলো ১০ এপ্রিল ১৯৭১ প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার রচনা, গ্রহণ ও প্রকাশ করেছিল; এবং স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে কিঞ্চিৎ সংশোধিত আকারে এর উল্লেখ করা হয়েছে। অতএব ওই আঙ্গিকগুলো নিয়ে আলোচনা করতেই হবে। সেটি হবে আগামী দিনের কলামের সারাংশ।
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
ই-মেইল : mgsmibrahim@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement