২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

সংবাদমাধ্যমের হালচাল

-

সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের বলা হয় ‘সমাজের দর্পণ’। রাষ্ট্র ও সমাজের আয়নাও বলা যেতে পারে। অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি-দুরাচার, অনাচার-অসঙ্গতি পাঠক-দর্শকের সামনে তুলে ধরাই সংবাদমাধ্যমের প্রধান দায়িত্ব। এ দায়িত্ব তারা কতটা পালন করতে পারছেন, তাও পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের দাবি রাখে। বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় গণমাধ্যম কী করছে, সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোরইবা কী হাল, তার ওপর নজর রেখে নমুনা স্বরূপ গত এক মাসের চিত্র এখানে তুলে ধরা হলো।

২০১৯ সালের জানুয়ারিতে হামলা, মামলা ও হুমকির শিকার হয়েছেন ১১ জন সাংবাদিক। সন্ত্রাসী হামলায় আহত হয়েছেন ৯ জন। ডিজিটাল আইনে গ্রেফতার হয়ে জেল খেটেছেন দুইজন। গায়েবি মামলায় কারাভোগ করেছেন একজন। দুইজন জামিনে মুক্তি পেলেও একজন এখনো জেলে। দুর্ঘটনার শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন দুইজন সাংবাদিক।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে খুলনার সিনিয়র সাংবাদিক হেদায়েত হোসেনের গ্রেফতার ও রিমান্ড দিয়ে শুরু হয় ২০১৯ সালের প্রথম মাস। ১ জানুয়ারি খুলনা প্রেস ক্লাব থেকে বের হলে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে থানায় নিয়ে যায়। মোট ভোটারের চেয়ে প্রদত্ত ভোট বেশি হওয়ার খবর পরিবেশন করে খুলনার দুই সিনিয়র সাংবাদিক প্রশাসনের রোষে পড়েন। রিটার্নিং কর্মকর্তার ঘোষণার ভিত্তিতেই রিপোর্ট করেন রাশিদুল ইসলাম ও হেদায়েত হোসেন। কিন্তু বেকায়দায় পড়ে দুই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেন ইউএনও। গ্রেফতার ও রিমান্ডের মুখোমুখি হন বাংলাট্রিবিউনের সাংবাদিক হেদায়েত হোসেন মোল্লা। আত্মগোপনে যেতে হয় রাশিদুল ইসলামকে। জেল-রিমান্ডের পর এখন সাময়িক জামিনে আছেন হেদায়েত। পক্ষকাল পর ২১ জানুয়ারি হাইকোর্ট থেকে জামিন পান মানবজমিনের খুলনার স্টাফ রিপোর্টার মো: রাশিদুল ইসলাম। তাকে চার সপ্তাহের আগাম জামিন দেয়া হয়েছে। এতে প্রায় তিন সপ্তাহের ফেরারি জীবন থেকে মুক্ত হলেন খুলনা প্রেস ক্লাবের সহসভাপতি রাশিদুল ইসলাম। মামলা, গ্রেফতার ও রিমান্ডের এ খবর আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় গুরুত্বসহকারে স্থান পায় এবং সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো প্রতিক্রিয়া জানায়।

সুনামগঞ্জে দৈনিক ডেসটিনির ছাতক উপজেলা প্রতিনিধি মোশাহেদ আলীকে ৫ জানুয়ারি জেলে পাঠানো হয়। একটি ‘গায়েবি’ মামলায় বিরোধী নেতাকর্মীদের সাথে হাজিরা দিতে আদালতে গেলে জামিন নামঞ্জুর করে জেলে পাঠানো হয়। ১৪ জানুয়ারি এসএটিভির খাগড়াছড়ি জেলা প্রতিনিধি ও খাগড়াছড়ি সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি নুরুল আযমকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এক শিক্ষক নেত্রীর ডিজিটাল আইনের ২৯ ও ৩১ ধারায় করা মামলায় তিনি গ্রেফতার হন। ১৫ জানুয়ারি ধামরাইয়ে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন দেশ টিভি ও দৈনিক ভোরের কাগজের ধামরাই প্রতিনিধি দীপক চন্দ্র পাল। অর্পিত সম্পত্তি দখল ও বিক্রি নিয়ে রিপোর্ট করায় এ হামলা হয় বলে জানা গেছে।

১৬ জানুয়ারি পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বরিশালে হামলার শিকার হয়েছেন যুগান্তরের ফটোসাংবাদিক শামীম আহমেদ। জেলের খাদ্য পাচারের সময় ছবি তুলতে গেলে কারারক্ষীরা তার ওপর হামলা করে। হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কয়েক দিন পর বিভাগীয় মামলা হয়েছে। ১৭ জানুয়ারি বগুড়ায় আক্রান্ত হন যমুনা টেলিভিশনের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন নির্ভর অনুষ্ঠান ৩৬০ ডিগ্রির প্রতিবেদক এস এম জিয়া ও তার টিমের অন্তত তিন সদস্য। তাদের আটকে রেখে নির্যাতন চালানো হয়। বগুড়ার রিয়াল লাইফ মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রের ওপর প্রতিবেদন তৈরি করতে গেলে ৮-১০ জন দুর্বৃত্ত তাদের ওপর হামলা চালায়। দুর্বৃত্তদের কয়েকজনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে।

২৮ জানুয়ারি এসএটিভির সাংবাদিক ও ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য বাতেন বিপ্লবকে প্রাণনাশের হুমকি দেয় সন্ত্রাসীরা। ঢাকা ওয়াসার দুর্নীতি ও অনিয়ম নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করায় এই হুমকি দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাতেন। ৩০ জানুয়ারি রাজধানীর মুগদা সরকারি জেনারেল হাসপাতালে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হামলার শিকার হন আরটিভির সাংবাদিক সোহেল রানা ও ক্যামেরাপারসন নাজমুল হাসান সায়মন। হাসপাতালের অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও রোগীদের ভোগান্তি নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করতে গেলে ওয়ার্ড বয় আসিফের নেতৃত্বে সন্ত্রাসীদের হাতে নাজেহাল হন এই দুই সাংবাদিক। হামলাকারীদের বিরুদ্ধে মুগদা থানায় অভিযোগ দায়ের করা হলেও পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করেনি।

এদিকে, ১৪ বছর আগে সন্ত্রাসীদের হামলায় নিহত ফরিদপুরের সাংবাদিক গৌতম দাস হত্যা মামলার আপিলের রায়ে বিচারিক আদালতে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ৯ আসামির মধ্যে পাঁচজনের সাজা বহাল রেখে এবং চার আসামিকে খালাস দিয়ে ৩০ জানুয়ারি রায় দেন হাইকোর্ট। ফরিদপুর শহরের মুজিব সড়কের সংস্কার ও পুনর্নির্মাণ কাজের অনিয়ম ও দুর্নীতির সংবাদ পরিবেশন করায় দৈনিক সমকালের ফরিদপুর ব্যুরো প্রধান গৌতম দাসের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে ঠিকাদার গোষ্ঠী ও তাদের সহযোগী সন্ত্রাসী চক্র। সন্ত্রাসীরা ২০০৫ সালের ১৭ নভেম্বর ভোরে সাংবাদিক গৌতমকে নির্যাতন ও শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। পরে চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডে ২০১৩ সালের ২৭ জুন ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নুর উদ্দিন ৯ আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। রাজনৈতিক সাংঘর্ষিক অবস্থার অবসানে সাংবাদিকদের বিরাট ভূমিকা রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। ২৩ জানুয়ারি সাংবাদিকদের আবাসন সমস্যা সমাধানে ফ্ল্যাট দেয়ার কথাও বলেন তিনি। এদিন ওয়েজ বোর্ড নিয়ে সাংবাদিকদের সাথে বৈঠক করেন তথ্যমন্ত্রী। ২১ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠকে নবম ওয়েজ বোর্ড পর্যালোচনায় মন্ত্রিসভা কমিটি পুনর্গঠন করা হয় সেতু মন্ত্রী ওয়াবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে।

একই দিন দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম স্বাধীন গণমাধ্যমের ভূমিকাকে সরকার ভুল চোখে দেখে বলে মন্তব্য করেছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগের সপ্তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় তিনি এ মন্তব্য করেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘২৫ বছরের সম্পাদনার জীবনে আমি এখনো সরকারকে বোঝাতে পারিনি- স্বাধীন সাংবাদিকতা সরকারের নিজস্ব স্বার্থেই কতটা প্রয়োজন। এখনো সরকার আমাদের সন্দেহের চোখে দেখে। মনে করে স্বাধীন সাংবাদিকতা একটা বিরক্তিকর ব্যাপার; এক ধরনের উৎপাত। সরকারের ভুল ধরিয়ে দিয়ে সমালোচনা করলে তারা মনে করে, আমরা তাদের ভাবমূর্তি নষ্ট করছি। অথচ তারা বুঝতে চায় না আমরা তাদের ভালোর জন্যই এই কাজ করি। এই আস্থাটাই আমরা সাংবাদিকেরা এখনো পর্যন্ত অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছি।’

২২ জানুয়ারি দৈনিক প্রথম আলোতে ‘জাতীয় নির্বাচন : সংবাদমাধ্যমের নির্বাচনী পরীক্ষা’ শিরোনামে এক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। সিনিয়র সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক কামাল আহমেদের লেখা এ নিবন্ধে ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন ও পূর্বাপর ঘটনা প্রবাহে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের ভূমিকার তুলনামূলক বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়। প্রবন্ধে কামাল আহমেদ বলেন, নির্বাচনের আসল চিত্র তুলে ধরতে দেশী সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যর্থতা প্রকটভাবে ধরা পড়েছে দুটো মাধ্যমে, ১. সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম- ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটারে; ২. বিদেশী সংবাদমাধ্যমে। তিনি আরো লিখেছেন- বিবিসি, আলজাজিরা, ডয়েচে ভেলে, গার্ডিয়ান, ইন্ডিপেন্ডেন্ট, ওয়াশিংটন পোস্টের নির্বাচনসংক্রান্ত প্রতিবেদন ও বিবরণের বিপরীতে দেশীয় সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা রীতিমতো হতাশাজনক। ব্যতিক্রম হিসেবে দু-একটি পত্রিকা কিছুটা চেষ্টা করেছে।

তিনি নিবন্ধের ইতি টানেন এভাবে- ‘বাংলাদেশে অভূতপূর্ব বিকাশ লাভ করা গণমাধ্যমের জন্য একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল একটা বড় পরীক্ষা। সেই পরীক্ষায় নিজেদের অবস্থান পাঠক-দর্শক-শ্রোতার কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য হয়েছে, সেই আত্মজিজ্ঞাসা অতীব জরুরি। কেননা, সাধারণ মানুষ যদি আবারো বিদেশী গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়াকে শেষ ভরসা মানে, তাহলে শুধু গণমাধ্যমই যে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা নয়, সাংবাদিকতা পেশাও বড় ধরনের সঙ্কটের মুখে পড়বে।

তার আগে ১৯ জানুয়ারি বিবিসি বাংলায় ‘সংসদ নির্বাচন-২০১৮ : কারচুপি আর বিবিসি বাংলা’ শিরোনামে এক অনুষ্ঠান ও অনলাইন প্রতিবেদনে শ্রোতা ও পাঠকের মতামতে বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ পায়। প্রতিবেদনে রাজশাহীর হাসান মীরকে উদ্ধৃত করে বলা হয়- ‘বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের একটা বড় অংশ দলবাজি ও মালিকপক্ষের স্বার্থ রক্ষায় নিবেদিত বলে তারা নিরপেক্ষ মত প্রকাশে অনেক ক্ষেত্রেই অক্ষম। বিবিসি বাংলার কর্মীদের সেই সীমাবদ্ধতা না থাকায় তারা সাম্প্রতিক সাধারণ নির্বাচনের সময় সংবাদ, সংবাদ পর্যালোচনা, স্পট রিপোর্টিং ও সাক্ষাৎকার প্রচারে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি নিরপেক্ষতার পরিচয় দিতে পেরেছেন।’ যুক্তরাষ্ট্র থেকে মোহাম্মদ উল্লাহ বলেন, আজকাল বিটিভি আর ব্যক্তিমালিকানাধীন টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর মধ্যে পার্থক্য করা বেশ কঠিন হয়ে গেছে। দৈনিক পত্রিকাগুলোর ক্ষেত্রেও সমস্যাটা একই, তবে এখানে ডেইলি স্টার বা প্রথম আলোর মতো কিছু ব্যতিক্রমী প্রতিবেদন আছে।’

জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে গঠিত আওয়ামী লীগের নতুন সরকারের উপদেষ্টা ও মন্ত্রিসভায় স্থান পেয়েছেন ৮টি গণমাধ্যমের মালিক। তারা হলেন, ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভি ও পত্রিকার সালমান এফ রহমান, গাজী টিভির গোলাম দস্তগীর গাজী, দৈনিক প্রতিদিনের সংবাদ-এর তাজুল ইসলাম, মোহনা টিভির কামাল আহমেদ মজুমদার, বিজয় টিভির মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, দৈনিক আজকের দর্পণ পত্রিকার শ ম রেজাউল করিম, রংধনু টিভির খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ও দুরন্ত টিভির শাহরিয়ার আলম। অন্যদিকে, বাদ পড়েছেন সময় টেলিভিশনের মালিক কামরুল ইসলাম।
লেখক : সাংবাদিক


আরো সংবাদ



premium cement