২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

যৌন অপরাধ এবং হত্যাপ্রবণতা

যৌন অপরাধ এবং হত্যাপ্রবণতা - ছবি : সংগৃহীত

অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, দিনাজপুরে নিজের ছাত্রীকে ধর্ষণ করেছেন এক শিক্ষক। পত্রিকার প্রতিবেদনে ধর্ষিতাকে ‘শিশু’ উল্লেখ করলেও, জানানো হয়নি তার বয়স। সে প্রাথমিক না মাধ্যমিক পর্যায়ে লেখাপড়া করে, সেই তথ্যও নেই। বাংলাদেশের মিডিয়ায় মেয়েদের বয়স নিয়ে লুকোচুরির প্রবণতা লক্ষণীয়। এ ক্ষেত্রে আমাদের মিডিয়া রীতিমতো লাজুক আর রক্ষণশীল।

মানুষের সাবালকত্ব সব সময় বয়সের ওপর নির্ভর করে না। কখনো কোনো মেয়ে অপেক্ষাকৃত অল্প বয়সেই শারীরিক পূর্ণতা পেতে পারে। শারীরিক সক্ষমতা কোন বয়সে আসবে, তা আবহাওয়া ও জলবায়ুর ওপর নির্ভরশীল। বিয়েশাদিতে বয়সের চেয়ে মেয়েদের শারীরিক-মানসিক পূর্ণতা বেশি জরুরি। সন্তান ধারণে বয়সের চেয়ে শারীরিক সক্ষমতা গুরুত্বপূর্ণ।

দিনাজপুরের ছাত্রী ধর্ষণ ঘটনায় শিক্ষকের বয়স ৪৮ বছর জানানো হয়েছে। তিনি একটি ব্যাচে ১২-১৪ জন করে শিক্ষার্থী পড়ান। ঘটনার দিন পড়া শেষ হয়ে যাওয়ার পর সবাইকে ছুটি দিলেও মেয়েটিকে অপেক্ষা করতে বলেন শিক্ষক। মেয়ের বাড়ি ফিরতে দেরি দেখে তার মা শিক্ষকের ডেরায় গিয়ে হাজির হন। ওই বাড়ির বাইরে থেকে মেয়ের চিৎকার শুনে মা দৌড়ে শিক্ষকের ঘরে ঢোকেন। মেয়েকে রক্তাক্ত দেখে চিৎকার করে ওঠেন। তা শুনে আশপাশের বাসিন্দারা এসে ওই শিক্ষককে হাতেনাতে ধরে ফেলেন। তাকে পুলিশে দেয়া হয়। এর মাত্র দুই দিন পর আরেকটি ঘটনা ঘটেছে রাঙ্গামাটিতে। ওই ঘটনাও ঘটিয়েছেন একজন ‘শিক্ষক’। এ ঘটনায় মেয়েটিকে প্রাণ দিতে হয়েছে। তবে ধর্ষণের শিকার হওয়ার আগেই সে প্রাণ হারায়। মেয়েটি তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী। হত্যা করেছেন তারই শিক্ষক এক পাহাড়ি।

মেয়েটি শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়ত। ঘটনার দিন সবাইকে ছুটি দিলেও তাকে যেতে বারণ করা হয়। বিকেল পর্যন্ত মেয়েটি বাড়ি না ফেরায় অভিভাবকেরা খোঁজ করতে যান শিক্ষকের কাছে। তিনি জানান, সবাইকে ছুটি দিয়ে দিয়েছেন। অভিভাবকেরা সম্ভাব্য সব জায়গায় খুঁজেও তার হদিস পাননি। তবে সন্দেহের তীর ছিল ওই শিক্ষকের দিকে। ঘটনাটি জানাজানি হলে প্রতিবেশীরা তার ওপর নজর রাখতে থাকেন। গভীর রাতে তিনি একটি বস্তা কাঁধে বের হন বাড়ি থেকে। স্থানীয় লোকজন তখন তাকে ঘিরে ধরেন। বস্তা খুলে ওই ছাত্রীর লাশ পাওয়া যায়। পরে তাকেও পুলিশে দেয়া হয়।

দেশের রাজধানী থেকে আনাচে-কানাচে পর্যন্ত ঘটছে প্রাইভেট টিউটরদের যৌন অপরাধের ঘটনা। ২০১১ সালে ছাত্রী ধর্ষণের একটি ঘটনায় বিক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল। রাজধানীর নামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বসুন্ধরা শাখার শিক্ষক পরিমল জয়ধর দশম শ্রেণীর এক ছাত্রীকে ধর্ষণ করেন একাধিকবার। বারবার কুকর্ম করতে আগের ধর্ষণের নজিরকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন ধুরন্ধর পরিমল। মেয়েটিকে জানানো হয়, আগের সে ঘটনা মোবাইলে ধারণ করা আছে এবং ‘কথা না শুনলে’ তা ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়া হবে। মেয়েটির অভিভাবক ঘটনাটি কর্তৃপক্ষকে জানান। তদন্ত করে দোষী শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বদলে স্কুল কর্তৃপক্ষ এটি ধামাচাপা দেয়ার অপচেষ্টা চালায়। ছাত্রীদের আন্দোলনের মুখে ওই কুলাঙ্গারকে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়, কর্তৃপক্ষকেও করতে হয় জবাবদিহি। এ দেশে বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে এটি ব্যতিক্রমী ঘটনা।

ওই ঘটনার পর আরো কিছু তথ্য গোচরে আসে। কিছু শিক্ষক আছেন, যারা ছাত্রীদের নিপীড়ন করে বিকৃত আনন্দ চরিতার্থ করেন। এসব করা সত্ত্বেও তারা যে শাস্তি পান, এমন নয়। নারী নির্যাতনের কারণে কারো চাকরি গেছে, এমনও দেখা যায় না। এমনটি পরিমলের বেলায় ঘটতে যাচ্ছিল। জঘন্য অপরাধ করার পরও প্রথমে তার পক্ষ নেয় কর্তৃপক্ষ। ভিকারুননিসা নূন স্কুলের ওই আলোচিত ঘটনা প্রথম পাদপ্রদীপের আলোয় আসে নয়া দিগন্ত পত্রিকায় প্রকাশের পর। এরপর ছাত্রীদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ফলে আন্দোলনের খবর অন্য মিডিয়াতেও প্রকাশ পায়। নানা কারণে যৌন নিপীড়নের ঘটনা চাপা পড়ে যাওয়ায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ থেকে যায়।

এসব ঘটনায় দেশের গণমাধ্যম এক ধরনের সংস্কারে ভোগে। বাস্তবতা হলো, এমন ঘটনা কোনো ‘সংখ্যালঘু’ ঘটালে সাধারণত তা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়। প্রায় সব গণমাধ্যম একই মনোভাব পোষণ করে। বিষয়টি কোনোভাবে সাম্প্রদায়িক ইস্যু হয়ে যায় কি না, সেজন্য হয়তো এমন কৌশল। অথচ সংবাদমাধ্যমের একটা বড় দায়িত্বই হচ্ছে অপরাধ যথাযথভাবে তুলে ধরা। কুকর্মের হোতা মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ নাকি খ্রিষ্টান যেই হোক- তার স্বরূপ সবার সামনে তুলে ধরাই মিডিয়ার কাজ। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে এক কাতারে রাখাই মিডিয়ার ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা। বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিমলের একই চরিত্রের অনেকেই বহাল তবিয়তে আছেন। তাদের অপরাধ আড়াল করলে প্রতিষ্ঠানের কোনো কল্যাণ নেই। বরং এতে অপরাধীকে আশকারা দেয়া হয়। মিডিয়া কোনোভাবে এসব ঘটনা এড়িয়ে যেতে পারে না।

প্রাণিজগতে যৌনতা একটি সহজাত প্রবণতা। এ ক্ষেত্রে মানুষের বেলায় একটি পরিমিতি বোধ থাকার কোনো বিকল্প নেই। মানুষের সেক্স থাকবে। থাকবে সেক্সঅ্যাপিল। কিন্তু সংযত ও আইনসঙ্গত না হলে তা অপরাধ। অবৈধভাবে সংঘটিত হলে সমাজ যৌনতাকে মারাত্মক অপরাধ হিসেবে গণ্য করে। ছাত্রীকে যৌন নির্যাতন করা শিক্ষকের চরম অন্যায়। বিষয়টি শুধু অনৈতিক নয়; এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সবার দায় রয়েছে। যৌন সহিংসতা রোধে পরিবেশ এমনভাবে তৈরি করতে হবে; যাতে এসব অপরাধ ঘটানোর কোনো সুযোগ না থাকে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশ ছাত্রীবান্ধব না থাকার জন্য কর্তৃপক্ষের গাফিলতি অনেকাংশে দায়ী। বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শ্রেণিকক্ষে ঠিকমতো পড়াশোনা হচ্ছে কি না সেই নজরদারি পর্যন্ত নেই। অনেক শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে পড়ানোর চেয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচিতি ব্যবহার করে কোচিং সেন্টারের দিকে বেশি মনোযোগী। শিক্ষার মাত্রাতিরিক্ত বাণিজ্যিকীকরণ এ জন্য দায়ী।

তদুপরি, কোচিং সেন্টারগুলোতে ছাত্রীদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকে না। ফলে টিউটররা দুশ্চরিত্র হলে নিপীড়ন করতে পারেন সহজে। কোনো ছাত্রীর আত্মহত্যা কিংবা ধর্ষণের মতো চরম ঘটনা ঘটলে কথিত শিক্ষকের পাশবিকতার খবর ফাঁস হয়। কয়টি ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে? বিচারের মুখোমুখিই বা কয়জন হচ্ছে? বেশির ভাগ ঘটনা আড়ালেই থেকে যায়। পিতৃপ্রতিম শিক্ষকদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিশীলিত হতে হবে। এ জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দরকার। তাদের ভেতরে উন্নত মানবিক বোধ গড়ে তোলার জন্য কোনো প্রশিক্ষণ দেশে দেয়া হয় কি না, তা আমাদের জানা নেই।

কিছু শিক্ষকের অনাকাক্সিক্ষত আচরণের শিকার ছাত্রীরা। এতে করে শিক্ষাব্যবস্থা কলুষিত হচ্ছে। কেবল উন্নত মৌলিক মানবিক শিক্ষাই পারে এমন জঘন্য ঘটনা রোধ করতে। এমন শিক্ষার প্রচলন কবে দেশে শুরু হবে, এর জবাব সম্ভবত কারো জানা নেই। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার প্রধান লক্ষ্য বৈষয়িক উন্নতি আর যেনতেনভাবে অর্থ উপার্জন। সেই অর্থ দিয়ে ভোগ-বিলাসের জীবনযাপন। তাই সবাই আজ ব্যস্ত সম্পদ উপার্জনে। কোন শিক্ষা অর্জন করলে বেশি অর্থ কামানো যাবে, সবাই ছুটছেন সেদিকে। এ দিকে, মানুষের ভেতর যে পশুপ্রবৃত্তি, তা রয়ে যাচ্ছে অটুট। ফলে যে শিক্ষক আমরা পাচ্ছি, তাদের অনেকে যৌননিপীড়ক হিসেবে দুর্নাম কুড়াচ্ছেন। এটি শুধু তাদের দোষ নয়। আমাদের আর্থসামাজিক কাঠামোও এর জন্য দায়ী।

সাম্প্রতিক সময়ে দুই ছাত্রীর প্রতি শিক্ষক নামের ব্যক্তিরা যে চরম আচরণ করেছেন; সেটিও একই কারণে সম্ভব হয়েছে। যৌন নিপীড়নের অভিযোগ থেকে নিষ্কৃতি পেতে হত্যার মতো ভয়াবহ ঘটনাও ঘটছে। এর মাধ্যমে দোষীরা শাস্তি এড়াতে চান। কিন্তু এভাবে আরো বড় অপরাধ তারা করে ফেলছেন। অপরাধীদের মধ্যে এ ধরনের প্রবণতা সব সময় দেখা যায়। মোট কথা, পশুপ্রবৃত্তির জয়জয়কার। যারা শেখাবেন তারা এমন প্রবণতার ধারক হলে, শিক্ষিত প্রজন্মের কাছে আমরা কী আশা করতে পারি? সমাজে অনাচার ছড়িয়ে পড়ছে মহামারী হয়ে। মানবিকতার অভাব এখন সব ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত। গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে সাড়ে পাঁচ হাজারের বেশি ধর্ষণের ঘটনা রেকর্ড করেছে আইন সহায়তা সংস্থা। এর মধ্যে ধর্ষণজনিত হত্যা ২৭৮টি। যার মধ্যে ৮৬ শতাংশ শিশু ও সদ্য প্রাপ্তবয়স্ক তরুণী।

দোকানদার মাজেদুল সুদে ৫০ হাজার টাকা নিয়েছিল সোনা মিয়ার কাছ থেকে। তিন বছর আগে নেয়া ঋণ পরিশোধ করেনি সে। সোনা মিয়া তার শিশুসন্তানকে নিয়ে তার দোকানে এসেছিলেন। শিশুসন্তানকে দোকানে বিস্কুট নিতে বলে সোনা মিয়া মসজিদে যান। এই সময় লম্পট দোকানদার মাজেদুল শিশুটিকে একা পেয়ে জাপটে ধরে চেতনানাশক দিয়ে অচেতন করে ফেলে। এরপর বস্তায় ভরে দোকানের পেছনে নিয়ে রাখে। রাতে বন্ধু রাব্বিকে সাথে নিয়ে রাব্বিদের বাড়িতে নিয়ে যায় বস্তায় ভরা শিশুটিকে। সেখানে তার মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে দেয় তারা। ওই অবস্থায় শিশুটি মারা গেলে তাকে রাব্বিদের বাড়ির পেছনে পুঁতে ফেলা হয়। এমন কি পরে সোনা মিয়ার কাছে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ চাওয়া হলো। সোনা মিয়া সাথে সাথে থানায় মামলা করেন। দুর্বৃত্তদের দ্রুততার সাথে গ্রেফতার করে পুলিশ। অর্থসংক্রান্ত অন্যায় ঢাকতে মানুষ কতটা বেপরোয়া, এই ঘটনা থেকে তা বোঝা যায়।

শিশুর লাশ মাটিতে পুঁতে ফেলার পরও এই বিকৃত রুচির অমানুষেরা বুঝতে পারছিল না যে, তারা অচিরেই ধরা পড়তে যাচ্ছে। বস্তায় বন্দী করা থেকে মাটিতে পুঁতে ফেলা পর্যন্ত অনেকগুলো লক্ষণ এর ক্লু হিসেবে তৈরি হয়েছে। এর সূত্র ধরে অচিরেই তারা ধরা পড়ে গেল। এই লোকেরা শিশুটির বাবাকে মুক্তিপণের জন্য ফোন দিয়েছে। এই ফোন আসলে হত্যাকারী কে, সেটি শনাক্ত করার নিশ্চিত সূত্র হলো। পুলিশ তাদের ধরে নিজেদের হেফাজতে নিয়েছে। ঘটনাটি ধামরাইয়ের ছোট আশুলিয়া গ্রামের।
jjshim146@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement