১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ডাকসু নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কি?

ডাকসু নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কি?
ডাকসু নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কি? - ছবি : সংগ্রহ

প্রায় ২৮ বছর পর হতে যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বা ডাকসু নির্বাচন। ২৮ বছর ধরে ‘গণতান্ত্রিক’ সরকারগুলোর শাসনামলে এই গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো আগ্রহ দেখা যায়নি কারো মধ্যে। না বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের, না ছাত্র সংগঠনগুলোর। এর আগে এরশাদ আমলের শেষ বছর, ’৯০-এ ডাকসু নির্বাচন হয়েছিল এবং তখনকার নির্বাচিত ডাকসু তৎকালীন স্বৈরাচারী সরকার বলে অভিহিত অগণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত আন্দোলনে অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছিল। তাই স্বাভাবিকভাবেই ধারণা করা যায়, ডাকসুর মতো একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সংগঠনে বিশেষ করে গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর সময় নিয়মিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং তার কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। কিন্তু তা হয়নি।

ডাকসু গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান কেন? কারণ, এটি রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কর্ণধার তথা দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শেখার এবং চর্চা করার এক সেরা জায়গা। শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক চেতনা ও মনন গড়ে তোলা ও বিকাশের জন্য এর চেয়ে ভালো কোনো প্রতিষ্ঠান হতে পারে না। যদি আমরা আমাদের স্বাধিকারের আন্দোলন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কালের ইতিহাস স্মরণ করি, তাহলে দেখব- ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলন ও সংগ্রামে ডাকসু অনন্য ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে এসেছে। ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’- মুহম্মদ আলী জিন্নাহর সেই ঘোষণার প্রতিবাদে ‘নো, নো’ বলে সোচ্চার হওয়া বা ১৯৫২ সালে একুশে ফেব্রুয়ারির কারফিউ ভঙ্গ করে মিছিল বের করা, ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন পর্যন্ত প্রতিটি ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের তথা ডাকসুর গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা সামনে উঠে আসছে, যা আমাদের জাতীয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। স্বাভাবিকভাবেই ডাকসুকে তাই বলা হয় ‘গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূতিকাগার’। কেউ কেউ ‘দ্বিতীয় পার্লামেন্ট’ও বলে থাকেন।

তাহলে কথিত গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর সময় ডাকসু নির্বাচন হলো না কেন? প্রশ্নটি আপনাআপনিই মনে জেগে ওঠে। আমাদের জন্য একটি বিস্ময় সম্ভবত অপেক্ষা করে থাকবে যদি আমরা স্মরণ করি যে, ’৭৫ থেকে ’৯০ পর্যন্ত কথিত সামরিক স্বৈরাচারের সময়ও ন্যূনতম পাঁচটি ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। স্বাধীনতার আগে ১৯৫৩ সালে প্রথম নির্বাচনের মাধ্যমে ডাকসু গঠনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেই ব্যবস্থায় ১৯৫৩-৫৪ থেকে শুরু করে ১৯৬১ পর্যন্ত ডাকসুর বেশ ক’টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আরো বিস্ময় অপেক্ষা করে, যখন দেখি টানা ১০ বছর ধরে আওয়ামী লীগের মতো একটি ‘গণতান্ত্রিক’ দলের সরকার ক্ষমতায় থাকলেও ডাকসু নির্বাচন হয়নি। প্রশ্ন হতে পারে, তাহলে কি একনায়কতান্ত্রিক এবং সামরিক স্বৈরাচারের চেয়েও আমাদের গণতান্ত্রিক দলগুলো গণতান্ত্রিক চেতনার দিক থেকে অনগ্রসর বা পিছিয়ে আছে? আজকের প্রসঙ্গ অবশ্য সেটি নয়। প্রশ্নটি তোলা থাকল; আমরা ডাকসু নির্বাচন নিয়েই কথা বলি।

এবার যে ডাকসু নির্বাচন হচ্ছে, সেটিও কিন্তু স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নয়। রিট আবেদন করার পর সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই নির্বাচন আয়োজনে উদ্যোগী হয়েছে। এটা গণতন্ত্রকামী বা গণতন্ত্রমনা কারো কাছেই কাক্সিক্ষত ও প্রত্যাশিত নয়। তবুও ভালো যে, শেষ পর্যন্ত ডাকসু নির্বাচন হচ্ছে। আগামী ১১ মার্চ বহু প্রত্যাশিত ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেই লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং ছাত্র সংগঠনগুলোর নানা প্রস্তুতি চলছে বেশ জোরেশোরে।

এবারের ডাকসু নির্বাচন হতে যাচ্ছে এমন এক পরিবেশে, যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের রয়েছে নজিরবিহীন আধিপত্য। ১০ বছর ধরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় তাদের ছাত্র সংগঠনের আধিপত্য এখন একক ও প্রতিদ্বন্দ্বীহীন।

একটি সহযোগী দৈনিকে একজন বিশিষ্ট কলামিস্ট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মন্তব্য করেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের আধিপত্য এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, অন্য সংগঠনের রাজনীতি করা দূরের কথা, ছাত্রলীগ না চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোথাও অবস্থান করারই সাহস বা ক্ষমতা নেই কারো। অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও কমবেশি একই অবস্থা বিরাজমান। অন্য কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ছাত্র হত্যা, ছাত্রের অপমৃত্যু, বিভিন্ন সংগঠন, এমনকি অরাজনৈতিক সংগঠনের ওপর হামলার বহু অভিযোগ রয়েছে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। কিন্তু কোনো ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে অর্থবহ পদক্ষেপ নেয়ার সদিচ্ছা দেখায়নি সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বা অন্য কেউ। হল, ক্যাম্পাস ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ক্ষেত্রেই এখন ছাত্রলীগের রয়েছে নজিরবিহীন একক আধিপত্য।

এ পরিস্থিতিতে যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে তার ফলাফল কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এরই মধ্যে ডাকসু নির্বাচনের সম্ভাব্য ফলাফল নিয়ে বহু রসালো ও কৌতুককর জল্পনা-কল্পনা ছড়িয়েছে। ব্যঙ্গবিদ্রুপও কম ছড়ায়নি। এসব জল্পনা-কল্পনার মূল কথা একটাই। সেটা হলো, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনটি জাতীয় নির্বাচনের মতো একই কায়দায় ফলাফল নিজেদের পক্ষে টেনে নিয়ে যাবে। আর এ কথা কে না জানে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ পদ থেকে শুরু করে প্রতিটি পদেই সরকারের একান্ত অনুগত ও বশংবদ ছাড়া কাউকে নিয়োগ দেয়া হয়নি। ফলে তারা সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের কর্মকাণ্ডে সুষ্ঠুতা নিশ্চিত করার উদ্যোগ কতটা নেবেন, সন্দেহ থেকেই যায়। মানুষ এসব কথাই বলছে।

সামাজিক মাধ্যমে এই যে এতসব আলোচনা-সমালোচনা, তার ভেতরেও কিন্তু একটা গভীর আর্তি আছে মানুষের। মানুষ চায়, আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেন সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয়, কার্যকর হয় এবং জাতির জন্য সুফলদায়ক হয়ে ওঠে।

এটি যে খুব বেশি কিছু চাওয়া, তা কোনোভাবেই বলা যাবে না। সুতরাং ডাকসু নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও কোনো একক সংগঠনের প্রভাবমুক্ত করতে হলে সেটি কিভাবে সম্ভব, তা ভাবতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে। কিন্তু পত্রপত্রিকার রিপোর্ট, কলাম এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র থেকে যেসব খবরাখবর পাওয়া যাচ্ছে, তাতে এখন পর্যন্ত এক ধরনের নেতিবাচক চিত্রই ফুটে উঠছে। এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ক্যাম্পাসে সক্রিয় সব ছাত্র সংগঠন ও সংশ্লিষ্টদের সাথে আলোচনা করেছে। তাতে নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য বেশ কিছু প্রস্তাব, সুপারিশ ও পরামর্শ উপস্থাপন করা হয়েছে। বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ছাত্রলীগের একচ্ছত্র আধিপত্য ও দাপটের কারণে সেখানে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নেই। সেখানে কেউ স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে নিজের কাক্সিক্ষত প্রার্থীকে নির্ভয়ে ভোট দিতে পারবেন না আবাসিক ও অনাবাসিক ছাত্রছাত্রীরা। এ জন্য ছাত্রলীগ ও জাসদ ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য সব সংগঠন একাডেমিক ভবনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব দিয়েছে।

তাদের এই প্রস্তাবের পেছনে যে বাস্তব পরিস্থিতির সমর্থন রয়েছে, তা সবাই জানেন। গত কয়েক বছরে ছাত্রলীগ বিভিন্ন হল থেকে অন্য ছাত্র সংগঠনের অনেক কর্মীকে নানা অজুহাতে বের করে দিয়েছে, হলের আসন বণ্টন নিজেদের কর্তৃত্বে রেখেছে এবং হলের ছাত্রদের জোর করে নিজেদের কর্মসূচিতে অংশ নিতে বাধ্য করেছে। এমন অসংখ্য খবর সংবাদমাধ্যমে নিয়তই প্রকাশিত হয়েছে। বিশেষ করে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের জন্য ক্যাম্পাস যে কোনোভাবেই নিরাপদ নয়, তার সর্বসাম্প্রতিক প্রমাণ হলো, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সাথে দুই দফা আলোচনার জন্য ছাত্রদলের নেতাদের প্রক্টোরিয়াল বডির মাধ্যমে বিশেষ নিরাপত্তা দিতে হয়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতারা বারবার ছাত্রলীগের হামলার শিকার হয়েছেন; এমনকি ডাকসু নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়ার পরও তাদের নেতাদের হেনস্তা করার অভিযোগ রয়েছে।

এত কিছুর পরও উপাচার্য প্রফেসর আখতারুজ্জামান বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে সহাবস্থানের ‘সুষ্ঠু পরিবেশ বিদ্যমান’। বোঝাই যাচ্ছে, কর্তৃপক্ষ সম্ভবত নিজেদের ইচ্ছামতো একটি নিয়ন্ত্রিত পরিবেশের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠানে বদ্ধপরিকর। না হলে উপাচার্য এমন একটি অবাস্তব মন্তব্য করেন কিভাবে?

একটি বিষয় স্পষ্ট, ক্যাম্পাসে সব ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীর জন্য নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশ নিশ্চিত করা না হলে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাড়া অন্য সংগঠনগুলো নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর সুযোগ পাবে না। তেমনিভাবে একাডেমিক ভবনগুলোতে (যেমন ফ্যাকাল্টিভিত্তিক) ভোট নেয়ার ব্যবস্থা করা, সব মতাদর্শের শিক্ষকদের ভোটকেন্দ্রে দায়িত্ব দেয়া এবং ভোটকেন্দ্রে নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা (যেমন মোবাইল ফোন নিষিদ্ধ করে) নিশ্চিত না করা হলে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ভোট দেয়া নিয়ে এক ধরনের ভীতি ও অনীহা থেকেই যাবে। এসব বিষয়ে ছাত্র সংগঠনগুলো যেসব সুপারিশ করেছে, তা গ্রহণ করার কোনো কার্যকর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কর্মকাণ্ডে; বরং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য শিক্ষকদের নিয়ে যে তিনটি কমিটি গঠন করেছে, তার মধ্যে দু-একজন বাদে প্রায় সব সদস্য ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক প্যানেলে নির্বাচন করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিজে যেসব বক্তব্য দিচ্ছেন, তাতে একটি বিশেষ ছাত্র সংগঠনের মতামতেরই যেন প্রতিফলন ঘটছে।

এখনই বলা যাচ্ছে না, ডাকসু নির্বাচন ঘিরেও জাতীয় নির্বাচনের মতো আরেকটি নির্বাচনের মহড়া জাতিকে দেখতে হয় কিনা। আল্লাহ না করুন।


আরো সংবাদ



premium cement