২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

কর্তৃত্ববাদের দিকে ধাবিত দেশ

-

রাষ্ট্রবিজ্ঞানে শাসনের মাত্রা ও ধরন নির্ণয়ে বিভিন্ন পরিভাষা রয়েছে। যেমন : গণতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, কর্তৃত্ববাদ, সর্বাত্মকবাদ ইত্যাদি। বাংলা কর্তৃত্ববাদের স্বীকৃত ইংরেজি অনুবাদ হচ্ছে ‘অথরিটারিয়ানিজম’। অক্সফোর্ড ডিকশনারি অব পলিটিক্সে ‘অথরিটারিয়ানিজম’-এর সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে 'A style of government in which the rulers demand unquestioning obedience from the ruled'. গতানুগতিকভাবে এই কর্তৃত্ববাদী সরকার নাগরিকদের বিশ^াস, আচরণ এবং কার্যক্রম সর্বাধিক পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। সে ক্ষেত্রে ব্যক্তির স্বাধীনতা ও অধিকার খুবই সীমিত হয়ে পড়ে। কর্তৃত্ববাদকে নেতিবাচক হিসেবেই গণ্য করা হয় সর্বত্র। কোনো যৌক্তিকতা বা ন্যায়ানুগতা ব্যতিরেকে অসহনশীলতাই কর্তৃত্ববাদী সরকারের বড় বৈশিষ্ট্য। আসলে কর্তৃত্ববাদ স্বৈরাচারের আরেক রূপ। ‘স্বৈরাচার’ শব্দটি সেকেলে; তার আধুনিক কেতাদুরস্ত নাম হচ্ছে কর্তৃত্ববাদ। কর্তৃত্ববাদের চেয়ে আরো খারাপ শাসন হচ্ছে সর্বাত্মকবাদ। পশ্চিমা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা সমাজতান্ত্রিক শাসনকে সর্বাত্মকবাদের উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করে থাকেন। নাৎসিবাদ এবং ফ্যাসিবাদ সর্বাত্মকবাদের নিকৃষ্ট উদাহরণ। আর এসব শুরু হয় গণতন্ত্রের অপপ্রয়োগ থেকে।

হিটলার বা মুসোলিনি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমেই ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। কর্তৃত্ববাদও এরকম। ক্রমেই ক্ষমতার স্বাদ পেতে পেতে তারা গণতন্ত্রকে নিজেদের সুবিধা মতো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেন। গণতন্ত্র যেহেতু একটি জনপ্রিয় শাসনব্যবস্থা, সেহেতু সবাই গণতন্ত্রের নামাবলি গায়ে দিয়ে স্বৈরতন্ত্রকে বৈধ করতে চায়। গণতন্ত্রের আগে পরে যদি কোনো ‘বিশেষণ’ দেখেন তাহলে বুঝতে হবে ‘ডাল মে কুছ কালা হ্যায়’। ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুকর্ন বলতেন ‘নির্দেশিত গণতন্ত্র’ (Guided Democracy), মিসরের নাসের বলতেন ‘নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র’ ((Controlled Democracy), আইয়ুব খান আমাদের দেশে ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ (Basic Democracy) কায়েম করেছিলেন।

এখন আমরা ‘উন্নয়নের গণতন্ত্র’ এর কথা শুনছি। এরকম আরো শব্দযুগল হচ্ছে ‘সর্বহারার গণতন্ত্র’, ‘নয়া গণতন্ত্র’, ‘জনগণতন্ত্র’ ইত্যাদি। বলাবাহুল্য, এসবই হচ্ছে প্রকৃত গণতন্ত্রের বিকৃত রূপ। নিপীড়ন-নির্যাতনই হচ্ছে এসব কথিত গণতন্ত্রের টিকে থাকার মাধ্যম। তারা মানুষের মৌলিক অধিকারকে অস্বীকার করে। তারা ব্যতীত অন্য সবাইকে ‘দেশের শত্রু’ মনে করে। ভিন্ন মত প্রকাশের বিন্দুমাত্র সুযোগও সেখানে নেই বলাই চলে। এরা ক্রমেই বিষদাঁত বের করতে থাকে। একসময় দৈত্যদানবের শক্তি নিয়ে জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফরাসি সম্রাট লুই-১৪ বলতেন ‘আমিই রাষ্ট্র’। এভাবে রাষ্ট্রকে ব্যক্তির সমার্থক বানিয়ে ফেলে কর্তৃত্ববাদের মোসাহেবরা।

সাম্প্রতিক নির্বাচন বিশ্লেষণ এবং ক্ষমতাসীন সরকারের বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বহির্বিবিশ্বে যে শব্দটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে তা হলো, ‘কর্তৃত্ববাদ’। দেশের অভ্যন্তরে এ ধরনের আপেক্ষিক শব্দ ব্যবহৃত না হয়ে বরং আরো কঠিন ও কঠোর শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। উন্নত গণতান্ত্রিক বিশ্ব শব্দ চয়নেও অ্যাকাডেমিক ও সতর্ক হওয়ার চেষ্টা করে থাকে। বিগত নির্বাচনের পর পাইকারি অভিনন্দন আসাটাই কূটনৈতিক শিষ্টাচারের অংশ। নির্বাচন নিয়ে যাদের মাথাব্যথা নেই, শুধু সিংহাসন রক্ষাই যাদের কাজ, তারা প্রথামাফিক তা করেছেন।

আবার নির্বাচনের অশুদ্ধতা ও অগ্রহণযোগ্যতা ঢেকে দেয়ার জন্য যাদের সার্টিফিকেটের প্রয়োজন ছিল- তারা সে সার্টিফিকেট জোগাড় করেছে। বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি দেশ হওয়ায় মক্কা-মদিনার খাদেম এবং ওআইসির সার্টিফিকেট অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তারা এখানে এসেছেন রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে। রাষ্ট্র তাদের যেখানে যেভাবে নিয়ে গেছেন এবং যে ভাষায় সার্টিফিকেট চান- সে ভাষাতেই তারা তা দিয়েছেন। এখানে বিস্ময় বা ব্যতিক্রমের কিছু নেই। আবার ধরুন, আমাদের বিরাট প্রতিবেশীর কথা। সার্টিফিকেটও ক্ষমতায় থাকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেই সাথে উদীয়মান অর্থনৈতিক পরাশক্তির ত্বরিত সার্টিফিকেট তাদের এবং আমাদের পারস্পরিক লাভ-অলাভের প্রমাণ। এ ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যতিক্রম পশ্চিমা বিশ্ব। এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন এবং ইইউ’র মন্তব্যে ও বিশ্লেষণে ‘অভিনন্দন’ শব্দটি উচ্চারিত হয়নি। কূটনীতির ভাষা যারা বোঝেন তাদের কাছে স্পষ্ট, এই নির্ভরশীল বিশ্বে ‘ওয়ার্কিং রিলেশন’ বা কার্যকর সম্পর্ক সবাইকে রক্ষা করতে হয়। প্রত্যক্ষভাবে সরকার যে কথা বলতে পারে না, পরোক্ষভাবে তা ‘থিংকট্যাংক’ বা গবেষণা সংস্থা এবং কোনো কোনো সময়ে গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে তা প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন সম্পর্কে পশ্চিমা বিশ্বের মতামত প্রকাশে একই ধারা লক্ষণীয়।

বাংলাদেশে নির্বাচন সম্পর্কে জাতিসঙ্ঘের সর্বশেষ মন্তব্যে বলা হয়েছে, সেটি ‘অবশ্যই সঠিক ছিল না’। জাতিসঙ্ঘ সদর দফতরে ১৮ জানুয়ারি নিয়মিত ব্রিফিংয়ে উপস্থিত সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে জবাবে মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের পক্ষ থেকে এ কথা জানানো হয়। জাতিসঙ্ঘের তরফ থেকে আরো বলা হয়েছে, ইতিবাচক সমাধান পাওয়ার জন্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক অংশীজনদের মধ্যে অর্থপূর্ণ সংলাপ প্রয়োজন। এর আগে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি পশ্চিমা শক্তি- যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন-ইইউ, নির্বাচনে বিরোধী দলগুলোর অংশগ্রহণকে স্বাগত জানায় এবং যেসব অনিয়মের অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে তা তদন্তের আহ্বান জানায়। ইইউ’র বিবৃতিতে বলা হয়, সহিংসতা নির্বাচনকে নষ্ট করেছে। নির্বাচনের পুরো প্রক্রিয়া সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির ক্ষেত্রে বিরাট প্রতিবন্ধকতা ছিল।

এগুলো নির্বাচনী প্রচারণা ও ভোটের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের মুখপাত্র মন্তব্য করেন, নির্বাচনের আগে হয়রানি, ভীতি প্রদর্শন ও সহিংসতা সম্পর্কে বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদন নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন। আরো বলা হয়, এসবের ফলে নির্বাচনের প্রতি লোকজনের আস্থা হ্রাস পেয়েছে। ব্রিটেন তার বিবৃতিতে নির্বাচনী প্রচারণার সময় ভীতি প্রদর্শন ও সহিংসতার নিন্দা করেছে। নির্বাচনী প্রাণহানিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে তারা। তবে তারা সবাই সতর্কতার সাথে নতুন সরকারকে অভিনন্দন জানানো থেকে বিরত রয়েছে। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলো নির্বাচনে সরকারি দলের বিজয়ের খবর দেয়ার সাথে সাথে বিরোধী দলের উত্থাপিত অভিযোগগুলো তুলে ধরে।

বিবিসি বিজয়কে ‘বিস্ময়কর’ বলে অভিহিত করেছে। ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকা নির্বাচনকে ‘প্রহসন’ বলে আখ্যা দেয়। নিউ ইয়র্ক টাইমস নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ করেছে। ব্রিটেনের দৈনিক টেলিগ্রাফ বিএনপির মাত্র সাতটি আসন পাওয়াকে অসম্ভব বলে মনে করে। তারা মন্তব্য করেছে যে, বাংলাদেশ কার্যত একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। তারা আরো মন্তব্য করে, বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ আওয়ামী লীগকে ঘৃণা ও ভয় করে। বাংলাদেশের নেতৃত্ব কর্তৃত্ববাদের পথে হাঁটছে বলে তারা মনে করে। মার্কিন টিভি চ্যানেল সিএনএনে মাইকেল কুজেলম্যান আশঙ্কা প্রকাশ করেন, এই নির্বাচন বাংলাদেশে আরো তিক্ততা ও সহিংসতা সৃষ্টি করবে। জার্মান পার্লামেন্টের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিশনের প্রধান ড. নরবার্ট রত্তজেন পশ্চিমা দেশগুলো এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের নির্বাচন সম্পর্কে যথেষ্ট শক্ত অবস্থান না নেয়ায় তাদের সমালোচনা করেছেন।

অধ্যাপক আলী রিয়াজ এই ভোটকে নির্বাচনী প্যারোডি বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি মনে করেন, বাংলদেশের ভোট জালিয়াতি প্রশ্নে পশ্চিমা দেশগুলোর যথাযথ অবস্থান নেয়া উচিত ছিল। বাংলাদেশে নির্বাচন-পরবর্তী গবেষণায় টিআইবি প্রশ্ন তোলে, সত্যিকার অর্থে এই সরকার কতটা জনপ্রতিনিধিত্বমূলক? এ প্রতিবেদনের উপসংহারে বলা হয়, ‘যদি এ ধরনের নির্বাচন বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, তাহলে গণতন্ত্রের জন্য এর চেয়ে বড় দুঃসংবাদ আর কিছু হতে পারে না।’ নির্বাচনের পর ব্রিটেনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট’- ইআইইউ যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, সেখানে গণতান্ত্রিক দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নামই নেই। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান মনে করেন ২০১৪ সালের এবং এবারের নির্বাচন এমন হয়েছে যে, আমরা প্রশ্নের সামনে পড়েছি। যদি ভবিষ্যতে একটি ক্রেডিবল ইলেকশন করতে পারি তাহলে আমরা আবার ডেমোক্র্যাসির ক্লাবের মধ্যে ঢুকতে পারব।’


নির্বাচনের পরপরই একটি বিদেশী গণমাধ্যমের পর্যালোচনায় বলা হয়েছে- ৯৬ শতাংশ আসন লাভ এবং যে ব্যবধানে বাংলাদেশে বিরোধীরা পরাজিত হয়েছে তা উত্তর কোরিয়ার মতো দেশেই আশা করা যেতে পারে, বাংলাদেশের মতো গণতান্ত্রিক দেশে নয়। অন্য আরেকটি বিশ্লেষণে বলা হয়, যেভাবে বিরোধী শক্তিকে অগ্রাহ্য করে ক্ষমতাসীন দল আরো পাঁচ বছরের জন্য প্রশ্নসাপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশ শাসনের ক্ষমতা গ্রহণ করল, তা বাংলাদেশকে প্রকারান্তরে একদলীয় দেশে পরিণত করেছে। আলজাজিরা টেলিভিশনের বিশ্লেষণে বলা হয়, এই নির্বাচনের মাধ্যমে কার্যত বাংলাদেশ একদলীয় শাসনব্যবস্থায় প্রবেশ করেছে, যদিও এর একটি বিশেষ ধরন রয়েছে। আরো বলা হয়, নির্বাচন হয়েছে, কিন্তু ভোট গণনা যথাযথ হয়নি। অসংখ্য রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়েছে।

কিন্তু ক্ষমতা বদলের আশপাশেও তাদের ভিড়তে দেয়া হয়নি। বলা হয়, গণমাধ্যম ‘স্বাধীন’ কিন্তু তারা স্ব-আরোপিত বিধিনিষেধ আর সরকারি বয়ান প্রচার করতে বাধ্য। লন্ডনের ইকোনমিস্ট পত্রিকা নির্বাচন-পরবর্তী প্রতিবেদনে বলেছে, ‘ওই নির্বাচনে আসলে বিএনপি পরাজিত হয়নি। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশের গণতন্ত্র।’ বিশ্বে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদনেও উল্লেখ করা হয়েছে, ড. কামাল হোসেনের মতো প্রবীণ নেতাসহ সব রাজনৈতিক মহল আশা করেছিলেন যে, সেনাবাহিনী মোতায়েনের পর অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে এবং জনসাধারণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিতে পারবে। নির্বাচনী সহিংসতায় ২০ জন প্রাণ হারায়, অনেকে আহত হয়েছে, ভোটদানে বাধা দেয়া হয়, নির্বাচন কেন্দ্র দখল করে নির্বিচার ভোট কাটা হলো এবং প্রায় সব ভোটকেন্দ্রে আগের রাতেই ব্যালট বাক্স ভর্তি করে রাখা হয়। সারা দেশে প্রায় সব কেন্দ্রে বিরোধী দলের কোনো পোলিং এজেন্ট ছিলেন না। সরকারি দলের লোকেরা তাদের জোরপূর্বক বের করে দেয়। বিরোধী দলের লোকেরা ভোট কেন্দ্রের বাইরে অবস্থানরত গণমাধ্যমকর্মীদের সাথেও খোলামেলা কথা বলতে পারেনি- সরকারের সন্ত্রাসীদের ভয়ে। বিবিসির একজন প্রতিবেদক চট্টগ্রামের একটি ভোটকেন্দ্রে আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তি করার ভিডিও ধারণ করেছেন।

দৈনিক মানবজমিনের একজন প্রতিবেদক প্রমাণ করেন যে, একটি নির্দিষ্ট ভোটকেন্দ্রে ভোটার সংখ্যার চেয়ে বেশি ভোট গ্রহণ করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদককে সরকার গ্রেফতার করে এবং দু’দিনের রিমান্ডে নেয়। আওয়ামী লীগের বিপক্ষে ধানের শীষে ভোট দেয়ার অপরাধে নোয়াখালীর সুবর্ণচরে আওয়ামী লীগের ক্যাডার এক মহিলাকে তার স্বামী ও সন্তানের সামনে ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ করে। পরের সপ্তাহে একই খবর আসে একই জেলার কবিরহাট থেকে। এসব ঘটনার মাধ্যমে এটা প্রমাণ হলো যে, বাংলাদেশে ভীতির রাজত্ব কায়েম হয়েছে। নির্বাচনী ফলাফল প্রমাণ করেছে, বহুদলীয় গণতন্ত্রের অবশেষ আর টিকে নেই। বরং ১৯৭৫ সালের কায়দায় না হলেও অন্যভাবে বাংলাদেশে একদলীয় শাসন কায়েম হয়েছে। সংসদে নামকাওয়াস্তে জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দলের আসন দেয়া হয়েছে। হাসির ব্যাপার হলো, এই দল, সরকার না বিরোধী দলে থাকবে, তা নির্ধারণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানায়।

তারা গত সংসদে ক্ষমতার স্বাদ ভোগ করার পর এখন আর বিরোধী দলে বসতে রাজি নয়। জাতীয় পার্টি প্রধান গুরুতর অসুস্থ হয়ে এখন সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন। সুস্থ থাকা অবস্থায়ও নানা ষড়যন্ত্র করে তাকে অকার্যকর রাখা হয়েছে। কার্যত ক্ষমতাসীন দলই জাতীয় পার্টি পরিচালনা করেছে। লোকেরা রসিকতা করে একজনকে দুটো দলের প্রধান হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এতদিন ধরে মহাজোটের নামে যেসব রাজনৈতিক ব্যক্তি ও জোটকে নিয়ে ক্ষমতা সুসংহত করে আওয়ামী লীগ গত এক দশক অতিক্রম করেছে- তারা এখন ‘অপাঙ্ক্তেয়’।

মন্ত্রিসভায় তাদের একজনকেও স্থান দেয়া হয়নি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বিরোধী আসনে বসার জন্য তাদের উপদেশ দিচ্ছেন। প্রকাশ্যেই তারা উষ্মা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। শুধুই বিরোধী নেতৃত্বকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেয়া হয়নি, আওয়ামী লীগের ডাকসাইটে নেতা-নেত্রীদেরও বিদায় করা হয়েছে। এরা অনেকেই ১/১১ এর প্রেক্ষাপটে বিরূপ ভূমিকা পালন করেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল অনুমান করছেন, শীর্ষ নেতৃত্ব আওয়ামী লীগেও ভিন্ন মত সহ্য করতে চাইছেন না। তাই নিজের এবং গোষ্ঠীর প্রতি যাতে কোনো চ্যালেঞ্জ না থাকে, তা নিশ্চিত করার জন্য প্রবীণদের বাদ দেয়া হয়েছে।’ এরা এখন নেত্রীবন্দনা করে টিকে থাকতে চাইছেন।

নির্বাচন-পরবর্তী বিজয় উৎসবের জনসভায় মানুষ আশা করেছিল, নতুন কিছু বলবেন এবং ক্ষমতাসীন দল নেত্রী জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস নেবেন। কিন্তু জাতিকে হতাশ হতে হয়। তাদের ভাষায়, এতবড় বিজয়ের পরেও নির্মূল ও নিঃশেষ করার হুঙ্কার দেয়া হয়েছে। প্রশ্ন উঠতে পারে তিনি কাদের নিঃশেষ করবেন? নিঃশেষ করার কী বাকি আছে? দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী, ক্ষমতাসীন সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ বেগম খালেদা জিয়াকে জেলে তিলে তিলে নিঃশেষ করা হচ্ছে। দূরের এক নেতাকে ধরে এনে শাস্তি দেয়ার মুহুর্মুহু ঘোষণা আসছে। জাতীয় সংসদে তাদের মাত্র আটটি আসন। ইসলামী রাজনীতির কোনো প্রতিনিধিত্ব করতে দেয়া হয়নি। বামপন্থীরাও সমান বৈরিতার শিকার। আর এসবই করা হয়েছে নতুন করে ‘বাকশাল’ কায়েমের জন্য। কিভাবে কী করে দীর্ঘ পরিকল্পনা এবং রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যবহার করে এসব করা হয়েছে তা তাদের চেয়ে কেউ ভালো জানে না। কিন্তু কী আশ্চর্য! অবলীলাক্রমে তারা ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ ভোট আর ‘বিপুল’ বিজয়ের কথা বলছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একজন প্রশ্ন তুলেছেন, লজ্জাশরম কি দেশ থেকে উবে গেল; আরেকজন লিখেছেন, একটি মিথ্যা কথা কতবার বললে সত্য হয়? লোকেরা বলাবলি করে, যার এক কান কাটা সে রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটে, কিন্তু যার দু-কান কাটা সে রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটে, এ দেশে এখন ‘রাজা তোর কাপড় কোথায়’ প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করার শিশুটিও কি হারিয়ে গেছে?

অথরিটারিয়ানিজম বা কর্তৃত্ববাদ এবং টোটালিটারিয়ানিজম বা সর্বাত্মকবাদের মধ্যে পার্থক্য ৯০ আর ১০০ এর মতো। আগেই বলেছি, ক্রমে ক্রমে এবং কৌশলে ক্ষমতাসীনেরা বহুদলীয় ব্যবস্থা থেকে দৃশ্যত একদলীয় ব্যবস্থায় উত্তরণ ঘটেছে। ১৯৯৬ সালে সংশ্লিষ্টমহল কিছুটা সংযমী ছিল। ২০০৯ সালে তারা প্যাকেজ ডিলে ক্ষমতাসীন হয়েছেন। যখন তারা বুঝতে পেরেছে জনগণের ভোটে তাদের ক্ষমতাসীন হওয়ার কোনো পথ নেই, তখন তারা ২০১৪ সাল এবং ২০১৮ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচনের ব্যবস্থা করেছেন। এ সময়ে মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও পারিপাশির্^ক অধিকার সঙ্কুচিত হয়েছে।

আইনসভা, বিচার বিভাগ ও আমলাতন্ত্রের মতো রাষ্ট্রের পরিহার্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্পূর্ণ দলীয়করণ করা হয়েছে। মানুষ কথা বলতে ভয় পায়। ভীতির রাজত্ব কায়েম হয়েছে সারা দেশে। মনে হচ্ছে, একটি দল ছাড়া অন্যদের চাকরি, ব্যবসা ও সেবা পাওয়ার অধিকার নেই। এর নামই কর্তৃৃত্ববাদ। বিভিন্ন বিশ্লেষণে প্রমাণ হয়েছে ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮-এর নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশ কার্যত একদলীয় শাসনব্যবস্থা তথা কর্তৃত্ববাদে প্রবেশ করেছে। তবে আশার কথা, বাংলাদেশের মানুষ মজ্জাগতভাবে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। জনগণই যদি ক্ষমতার উৎস হয়, তাহলে সমাজের স্বতঃসিদ্ধ গতি প্রকৃতি অনুযায়ী ক্ষমতা একদিন জনগণের কাছে ফিরে আসবে।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement