১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`
সময়-অসময়

পোস্টমর্টেম : জাতীয় নির্বাচন-২০১৮

চট্টগ্রামের একটি কেন্দ্রে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন সকালে ব্যালট ভর্তি বাক্স দেখতে পান বিবিসির সাংবাদিক - সংগৃহীত

‘দশ চক্রে ভগবান ভূত’ অবস্থা চলছে সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে। বুদ্ধিজীবী মহল, দেশব্যাপী বিভিন্ন সংগঠন, বিভিন্ন রাষ্ট্র সিরিজ আকারে এই নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিয়ে অভিনন্দন জ্ঞাপন প্রভৃতি মিলিয়ে বোঝার উপায় নেই যে, নির্বাচনী পরিবেশের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষতার কথামালা ও অভিনন্দন বার্তার সাথে বাস্তবতার সামঞ্জস্য কতটা?

বিএনপি বা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অনেক ব্যর্থতা থাকতে পারে; কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, এ জাতি ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হতেই থাকবে। ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের দিন সকালে ঠাকুরগাঁওয়ে নিজ এলাকায় নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া সম্পর্কে বিএনপির মহাসচিবের বক্তব্য এবং ধানের শীর্ষ প্রতীকে জামায়াতের নির্বাচনে অংশগ্রহণ সম্পর্কে ড. কামাল হোসেনের ‘অজ্ঞতা’র সংবাদ ভারতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়া সরকারের কোর্টে একটি ‘যুক্তি’ দাঁড়ানোর উপাদান তুলে দিয়েছে।

তবু নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিয়ে সরকারের উচ্চ মহল সত্যের যে অপলাপ করছে এর মূল্য জাতিকে কতটুকু দিতে হবে জানি না। তবে কালের বিবর্তনে কাউকে না কাউকে জবাব অবশ্যই দিতে হবে। যুদ্ধাপরাধ যেমন অপরাধ, রাষ্ট্রীয় খরচে সত্যের অপলাপ করাও তেমনি অপরাধ। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা কিংবা শপথ গ্রহণ করে শপথ ভঙ্গের জন্য একদিন জাতির মুখোমুখি দাঁড়াতে হতে পারে, যার নজির পৃথিবীর সর্বত্র রয়েছে। রাজনীতি একটি কৌশল।

এ কৌশলে বিএনপি বা ঐক্যফ্রন্ট সফল না হওয়ার অর্থ এই নয় যে, অনৈতিক সূত্র যারা ব্যবহার করে জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগে পরিবেশ নষ্ট করল তাদের কোনো দিন জবাবদিহি করতে হবে না। জবাবদিহির হাত অনেক দীর্ঘ, এর আওতায় অনেককেই আসতে হয়েছে; যদিও বিষয়টি সময়, কাল, ক্ষেত্র বিশেষে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। উৎসবমুখর পরিবেশ ও নির্বাচনের সুষ্ঠুতার জয়গান যতই হয়ে থাকে হতে থাকুক না কেন, পরিবেশ সচেতন কিছু সংগঠন (রাজনৈতিক/অরাজনৈতিক) নির্বাচনী পরিস্থিতি ও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অবস্থান জাতির কাছে তুলে ধরছে। জাতি আজ একান্ত অসহায়, দাঁড়ানোর কোনো জায়গা নেই। তবে ধ্বংসস্তূপ থেকেই অনেক আশাবাদের সৃষ্টি হয়। ভোটাধিকারের প্রশ্নে জাতিকে সে দিকেই তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে। তবে এ জন্য সময় কত দীর্ঘ হবে তা অনুমান করা যাচ্ছে না।

ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে এবারের গণশুনানি অনুষ্ঠানে বাম গণতান্ত্রিক জোট বলেছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন একটি কলঙ্কিত নির্বাচন। এমন নির্বাচন দেশের ইতিহাসে আর হয়নি। নজিরবিহীন ভুয়া ভোটের এই নির্বাচনের আগের দিনই বিভিন্ন কেন্দ্রে প্রশাসনের সহায়তায় ভোট ডাকাতি করে ব্যালট বাক্স ভর্তি করা হয়েছে। প্রশাসন এসব অনিয়ম ঠেকাতে সক্রিয় ছিল না। ১১ জানুয়ারি আয়োজিত ‘ভোট ডাকাতি, জবরদখল ও অনিয়মের নানা চিত্র’ শীর্ষক গণশুনানিতে এসব অভিযোগ করেন বাম দলগুলোর প্রার্থীরা। তারা শুনানিতে তাদের অভিজ্ঞতা ও নানা অভিযোগ তুলে ধরেছেন।

এবার ১৩১টি আসনে বাম গণতান্ত্রিক জোটের ১৪৭ জন প্রার্থী অংশ নেন। দিনব্যাপী এই গণশুনানিতে বাম দলের ৮০ জন প্রার্থী নিজেদের নির্বাচনী এলাকায় ভোটের সময়কার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। ‘সংসদ নির্বাচনে অনিয়মের নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে’ বলে অভিযোগ করেছেন এই জোটের প্রার্থীরা। তাদের অভিযোগ, ভোট হয়ে গেছে ২৯ ডিসেম্বর রাতেই। শুনানিতে ১৩১ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীরা তাদের বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেছেন।

তারা জানান, ভোটের আগের দিন, ভোটের দিন ও পরের দিন অনেক অনিয়ম হয়েছে। এর পক্ষে সুনির্দিষ্ট উদাহরণও দেন তারা। গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি ঢাকা-১২ আসন থেকে কোদাল মার্কায় দাঁড়িয়েছিলেন। গণশুনানিতে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের আগের রাতেই কেন্দ্রভেদে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ ভোট সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরে ফেলা হয়েছে। আমরা প্রার্থী যারা ভোট দিতে গিয়েছিলাম, দেখেছি- একটা ভোটকেন্দ্রে ভোটারের তেমন কোনো ভিড় নেই’ (সূত্র : জাতীয় পত্রিকা তাং- ১২-০১-২০১৯ ইং)।

অনুরূপ কথা ডানপন্থী দল যারা সরকারের লেজুড়বৃত্তি করেনি তারাও বলে যাচ্ছে, যেমনÑ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাক ১১ জানুয়ারি বলেছেন, ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের নামে জাতির সাথে প্রতারণা করা হয়েছে। নির্বাচনে বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের স্বাধীনভাবে প্রচারণার ন্যূনতম সুযোগও দেয়া হয়নি। উপরন্তু সরকারি দল ও পুলিশ প্রশাসনের হামলা, মামলা, গ্রেফতার নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বহু সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী ও তাদের কর্মী-সমর্থকেরা।

তিনি বলেন, ভোটের দিন অধিকাংশ ভোটকেন্দ্রে বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের এজেন্টদের কেন্দ্রে বসতে দেয়া হয়নি। যেসব কেন্দ্রে কিছু এজেন্ট গিয়েছিল পরে তাদেরও জোর করে কেন্দ্র থেকে বের করে দিয়ে মহাজোটের নৌকা ও লাঙ্গল মার্কায় সিল মারা হয়। খেলাফত মজলিস মনোনীত সংসদ সদস্য প্রার্থীদের নিয়ে আয়োজিত, নির্বাচনোত্তর মতবিনিময় সভায় তিনি এ কথা বলেন (সূত্র : জাতীয় পত্রিকা)।

এবারের নির্বাচন ছিল পুলিশ নিয়ন্ত্রিত এবং এ জন্য জনগণের পক্ষ থেকে না হলেও সরকারের পক্ষ থেকে সর্বাগ্রে পুলিশকেই কৃতজ্ঞতা জানানো বাঞ্ছনীয় এবং সরকার তাই করছে। জাতীয় পত্রিকার খবরে প্রকাশ, একাদশ সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সম্পন্ন করার পুরস্কার হিসেবে পুলিশ কর্মকর্তাদের পদক দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

এ পদক দেয়া হচ্ছে পুলিশের রেঞ্জ ডিআইজি, পুলিশ কমিশনার ও পুলিশ সুপারদের। এ ব্যাপারে একটি প্রস্তাব যাচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। সরকার তা অনুমোদন করলে পুলিশ সপ্তাহের অনুষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের হাতে এ পদক তুলে দেয়া হবে। ‘সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে’ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় দেশের সব জেলার পুলিশ সুপারকে ইতোমধ্যে প্রশংসাপত্র দিয়েছে পুলিশ সদর দফতর (সূত্র : জাতীয় পত্রিকা)।

কোনো কোনো বিষয় কারো জন্য উৎসব, আবার কারো জন্য হৃদয়বিদারক। ইঁদুর যখন টিকটিকিকে আক্রমণ করে তখন ইঁদুরের জন্য উৎসব হতে পারে। কিন্তু বিড়াল যখন ইঁদুরকে আক্রমণ করে তখন উৎসবটি হয়ে যায় ইঁদুরের পরিবর্তে বিড়ালের জন্য। ‘উৎসব’ শব্দটি আপেক্ষিক। বাংলা প্রবাদ রয়েছে যে, কোনো বিষয় ‘কারো জন্য সর্বনাশ এবং কারো জন্য ভাদ্রমাস’। ফলে উৎসবটি আঠারো কোটি মানুষের না শুধু একটি গোষ্ঠীর তা অবশ্যই ইতিহাসের পাতা থেকে বাদ যাবে না।

৫ জানুয়ারি প্রতিটি থানায় পুলিশের প্রীতিভোজ ও সাস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। ছিল খাওয়াদাওয়া এবং গান বাজনার আয়োজন। পুলিশ সদর দফতরের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে প্রতিটি থানায় নির্দেশ জারি করা হয়েছে। প্রতিটি থানায় সদর দফতর থেকে বরাদ্দ পাঠানো হয়েছে। মাঠপর্যায়ের একাধিক সদস্য বলেছেন, এই আয়োজনে তারা খুশি। ৬ জানুয়ারি পুলিশ সদর দফতরে প্রীতিভোজ ছিল। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রীতিভোজের খাবারের তালিকা ছিল- পোলাও, মোরগের রোস্ট, গরু ও খাসির রেজালা, মুরগির গিলা-কলিজা দিয়ে বুটের ডালের ‘লটপটি’, বোরহানি, পায়েস ও সফট ড্রিংকস। পুলিশ সূত্র জানায়। এটি শুধু পুলিশবাহিনীর সদস্যদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কর্মরত সব পুলিশ সদস্য ছাড়াও থানায় কর্তব্যরত আনসার বাহিনীর সদস্যরা অংশ নেয়ার কথা (সূত্র : জাতীয় পত্রিকা ০৫-০১-২০১৯ ইং)।

এখানে উল্লেখ্য যে, ইতঃপূর্বে কোনো জাতীয় নির্বাচনের পর পুলিশকে প্রীতিভোজ দেয়ার কোনো প্রকার নিয়মনীতি বা অনুষ্ঠান লক্ষ করা যায়নি। জনগণ মনে করে, ভোটারবিহীন কথিত শান্তিপূর্ণ অর্থাৎ কোনো প্রতিবাদহীন নির্বাচন করার জন্য সরকারপক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ এই প্রীতিভোজের উপঢৌকন। পুলিশের দায়েরকৃত গায়েবি মামলা, ম্যাজিস্ট্রেট ও জজদের ভূমিকা ভোটারহীন একতরফা নির্বাচন করতে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে বলে অভিযোগ।

গায়েবি মামলা মিথ্যা জেনেও বিএনপি সমর্থকদের জামিন না দিয়ে তাদের ঘরে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে দেশের বিভিন্ন জেলার থানা থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষকে হাইকোর্টের বারান্দায় আগাম জামিনের শুনানির জন্য ঘুরপাক খেতে হচ্ছে। দেশব্যাপী গায়েবি মামলাগুলোতে যত মৃত ব্যক্তির নাম এসেছে, এ ধরনের বিরল দৃষ্টান্ত কোথায় আছে।


লেখক : কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)

E-mail: taimuralamkhandaker@gmail.com

বি:দ্র: তৈমূর আলম খন্দকার প্রণীত ‘মিথ্যার কাছে জাতি পরাজিত’ এবং ‘নিশি রাত্রির দ্বিপ্রহর’ একুশে গ্রন্থমেলা-২০১৯-এ পাওয়া যাবে। তা ছাড়া আগে প্রকাশিত ‘মীরজাফর যুগে যুগে’, ‘সময়-অসময়’ ও ‘রাজনীতির ভগ্নাংশ’ বইগুলোও একুশে গ্রন্থমেলাতে পাওয়া যাবে।


আরো সংবাদ



premium cement
ইরানে হামলা : ইস্ফাহান কেন টার্গেট? মাত্র ২ বলে শেষ পাকিস্তান-নিউজিল্যান্ড প্রথম টি-টোয়েন্টি জেলে কেজরিওয়ালকে হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ দলের ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশের জেরে সাংবাদিকসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা তোকে যদি এরপর হলে দেখি তাহলে খবর আছে, হুমকি ছাত্রলীগ নেতার বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে কোনো রাজনৈতিক মামলা করা হয়নি : প্রধানমন্ত্রী দাওয়াতী ময়দানে সকল নেতাদের ভূমিকা রাখতে হবে : ডা. শফিকুর রহমান চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গেল শ্রমিকদের মাঝে ইসলামের আদর্শের আহ্বান পৌঁছাতে হবে : ডা. শফিকুর রহমান ঢাকা শিশু হাসপাতালের আগুন নিয়ন্ত্রণে বিমানবন্দরের টার্মিনালে ঢুকে গেলো বাস, ইঞ্জিনিয়ার নিহত

সকল