২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আজগুবি ভোট

-

নির্বাচনে হার-জিত আছে। কারণ জনমত বদলায়। কোনো রাজনৈতিক দল কোনো গণতান্ত্রিক দেশে চিরকাল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকে না। রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন হয় নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। গণতন্ত্রের পক্ষের একটা যুক্তি হলো, এটা এমন একটা ব্যবস্থা যে, এক দলের হাত থেকে আরেক দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর হতে পারে শান্তিপূর্ণ উপায়ে। ভোটের রাজনীতির সঙ্গে এ দেশেরে মানুষের পরিচয় ঘটে ব্রিটিশ আমলে লর্ড রিপনের (১৮৮০-১৮৮৪) সময় থেকে। লর্ড রিপন ভোটের রাজনীতি প্রথম চালু করেন স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে। ফলে গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে পড়তে পারে ‘ভোটের রাজনীতি’। এরপর আমাদের দেশে ব্রিটিশ শাসনামলে বেশ কিছুটা ক্ষমতা ছেড়ে দেয়া হয় প্রাদেশিক আইনসভাগুলোর কাছে। প্রাদেশিক আইনসভায় জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হয়েছেন ভোটের মাধ্যমে। ভোটের রাজনীতি তাই বলা যায় না খুবই সাম্প্রতিককালের ঘটনা।

এ দেশে এসব ভোট বা নির্বাচন মোটামুটি হতে পেরেছে শান্তিপূর্ণভাবে। গড়ে উঠেছে গণতান্ত্রিক মনোভাব, ব্রিটিশ গণতন্ত্রের আদলে। পাকিস্তান হওয়ার পর ১৯৫৪ সালে হয়েছিল তদানীন্তন পাকিস্তানের পূর্ববঙ্গ প্রদেশের আইনসভার নির্বাচন। এই আইনসভায় তখন ক্ষমতাসীন ছিল মুসলিম লীগ, প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নুরুল আমিন। সে সময় গঠিত হয়েছিল একটা যুক্তফ্রন্ট। তারা নির্বাচন করতে পেরেছিলেন মুক্তভাবে। জিতেছিলেন নির্বাচনে। এই নির্বাচনে কোনো মারদাঙ্গা হয়নি। সে সময় এই যুক্তফ্রন্টের নেতৃত্ব প্রদান করেছিলেন আবুল কাসেম ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। যুক্তফ্রন্ট ঘোষণা করেনি, ফ্রন্ট বিজয়ী হলে পূর্ববাংলার আইন পরিষদে কে হবেন প্রধানমন্ত্রী। মানুষ যুক্তফ্রন্টকে ভোট দিয়েছিল, কে প্রধানমন্ত্রী হবেন সে কথা চিন্তা না করেই।

অন্য দিকে নুরুল আমিন কোনোভাবেই চেষ্টা করেননি নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে। নির্বাচন হয়েছিল অত্যন্ত অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই নির্বাচনের সঙ্গে কিছুটা জড়িত হয়ে পড়েছিলাম। কেননা, আমার সহোদরা এই নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন, ফজলুল হকের কৃষক শ্রমিক পার্টির পক্ষ থেকে। এ দল ছিল যুক্তফ্রন্টের অন্যতম শরিক। আমার সহোদরা নির্বাচিত হয়েছিলেন; হতে পেরেছিলেন একজন এমএলএ। পরে হন পূর্ববাংলা পরিষদের পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি। আমার মনে হয়, সেই মুসলিম লীগ শাসনামলে এ দেশে যে পরিমাণ গণতান্ত্রিক আবহাওয়া বিরাজমান ছিল, এখন আর তা নেই। গণতন্ত্র একটা মানসিক ব্যাপার। মনের দিক থেকে মানুষ গণতান্ত্রিক না হলে রাজনীতির ক্ষেত্রে তার বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না। এটা কেবলই আইন আদালতের ব্যাপার নয়।

এটা হলো সাধারণ জনমতের ব্যাপার, যাকে আরেক কথায় বলা যেতে পারে লোকায়ত সার্বভৌমত্বের অভিব্যক্তি। এসব কথা ভাবছিলাম আমাদের দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে। আমার ধারণা, গণতান্ত্রিক রাজনীতির ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতি হয়নি; হয়েছে অবক্ষয়। একটা দেশে গণতন্ত্রের সাফল্য নির্ভর করে সে দেশের জনমত ও রাজনৈতিক দলগুলো কতটা গণতন্ত্রী, তার ওপর। নির্ভর করে ভোট কতটা অবাধ ও নিরপেক্ষ হতে পারছে তারও ওপর। আগে আমাদের দেশে রাজনীতি একটা ব্যবসা হিসেবে বিবেচিত হয়নি। এর মধ্যে নিহিত থাকত বেশ কিছুটা জনসেবার মনোভাব। কিন্তু এখন রাজনীতিকে বহুলোক গ্রহণ করতে চাচ্ছেন আয়ের একটা উপায় হিসেবে। আরেক কথায়, ব্যবসায় হিসেবে। রাজনীতিকে ব্যবসায় হিসেবে গ্রহণ করার কারণে আমাদের রাজনীতি হয়ে উঠেছে স্বার্থপরতাপূর্ণ। এতে নেই পরার্থপরতার পরিচয়। ফলে রাজনীতি হয়ে উঠেছে দুর্নীতির আখড়া। দেশে এমন একটি দল নেই, যাকে বলা চলে কেবলই আদর্শবাদী। আদর্শহীনতা হয়ে উঠেছে রাজনীতির বুনিয়াদ। রাজনীতি কেবলই হয়ে উঠতে চাচ্ছে ক্ষমতার ব্যাপার।

বিলাতের গণতন্ত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক জন লক (১৬৩২-১৭০৪)-এর মতে, সরকার বা শাসক হলেন একজন ‘উঁচু দরের করণিক’ মাত্র, যাকে আমরা বিশ্বাস করে দিয়েছি রাষ্ট্র প্রশাসনের ভার। তা করার মতো সময় নেই আমাদের হাতে। কিন্তু আমরা যদি দেখি তিনি তার কাজ ঠিকমতো করছেন না, তবে তাকে আমরা চাকরিচ্যুত করতে পারি। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাষ্ট্রচালনা নির্ভর করে জনপ্রতিনিধিদের ওপর। জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হন সর্বসাধারণের ভোটে। সরকার আর রাষ্ট্র সমার্থক নয়। রাষ্ট্র একটা স্থায়ী প্রতিষ্ঠান; কিন্তু সরকার হলো, একটি অস্থায়ী সংস্থা। গণতন্ত্রে ভোটের মাধ্যমে সরকারের পরিবর্তন করা চলে। এটাই হলো অন্য সরকারব্যবস্থার সাথে গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থার মূল পার্থক্য। ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হচ্ছে, আমাদের দেশে গণতন্ত্রের সঙ্কট সৃষ্টি হতে পারার একটা বড় কারণ হলো, রাষ্ট্র ও সরকারকে সমার্থক ভাবা। আমরা যদি এ রকম না ভাবতাম, তবে বর্তমান রাজনীতি সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপ নিতে পারত।

আমাদের গণতন্ত্রে সঙ্কট দেখা দেয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে, রাষ্ট্রসর্বস্বতার মনোভাব। আমরা ভাবছি রাষ্ট্রের মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান করতে; কিন্তু রাষ্ট্র ছাড়াও সমাজজীবনে আরো অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, যেগুলো বাদ দিলে অচল হয়ে পড়ে সমাজজীবন। রাষ্ট্রের কাজ দেশের অর্থনীতিকে পরিচালিত করা হতে পারে না। এ ক্ষেত্রে থাকতে হয় ব্যক্তি উদ্যোগের বিশেষ ভূমিকা। আওয়ামী লীগ এটা না বুঝে চেয়েছিল রাষ্ট্রিক অর্থনৈতিক পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে উন্নন ঘটাতে; কিন্তু দলটি সেটা পারেনি। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান চাননি রাষ্ট্রিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে গতিবেগ সৃষ্টি করতে। তার সময় ব্যক্তিগত মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে তৈরী পোশাক শিল্প। তৈরী পোশাক রফতানি করে বাংলাদেশ অর্জন করছে সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা।

তা দিয়ে আমরা কিনতে পারছি বিদেশে তৈরি করা উৎপাদন-যন্ত্র। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সময় আরম্ভ হয়েছিল বিদেশে শ্রমশক্তি রফতানি। শুরু হয় গলদা চিংড়ি উৎপাদন ও রফতানি। কিন্তু এখন বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন আসতে পেরেছে আওয়ামী লীগের কারণে; ইতিহাস যার সাক্ষ্য দেয় না। দেশে বহু মানুষ এখনো ধানের শীষের পক্ষে। এর কারণ, জিয়ার রাজনীতি। জিয়াউর রহমান চেয়েছিলেন দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করতে। তিনি কখনোই চাননি বংশের রাজনীতিকে প্রশ্রয় দিতে। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তিনি চেয়েছিলেন বাংলাদেশী সংস্কৃতি গড়তে, যাতে থাকবে এ দেশের নিসর্গ ও ঐতিহ্যের ছাপ। অর্থাৎ তিনি তুলে ধরতে চেয়েছিলেন একটা রাজনৈতিক রূপরেখা যার ওপর নির্ভর করে চলতে পারে বাংলাদেশ। বিএনপির তাই এখনো আছে একটা জনসমর্থন; কিন্তু এবারের ভোটে এই জনসমর্থনের প্রতিফলন ঘটতে পারল না। কেন বিএনপির প্রার্থীরা এত বিপুল ভোটে পরাজিত হলেন, এর হিসাব মিলছে না। মনে হচ্ছে এটা একটা আজগুবি ভোট। ভোটের হিসাবে এই বিরাট ব্যবধান নিয়ে তদন্ত হলে অনেক কিছুই উদঘাটিত হতে পারবে। আমরা চাই, সেটা হোক।

সাধারণত দেখা যায় যে, ভোটের পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, তাদের প্রাপ্ত ভোটের হিসাব-নিকাশ করে। যারা জিতে তারা বলে, তারা কেন জিতেছে। আর যারা হারে তারা বলে, তারা কেন হেরেছে। কোনো দিন কোনো জেতা পার্টি বলে না, তাদের প্রতিপক্ষ কেন ভোটে পরাজিত হয়েছে; কিন্তু আওয়ামী লীগ বলতে ব্যস্ত, কেন বিএনপি ভোটে হেরেছে। এটাও একটা স্বাভাবিক ব্যাপার নয়। বিএনপি কেন হেরেছে, সে সমীক্ষা করবেন বিএনপির নেতারা। সেটাই কাম্য। বিএনপির নেতারা বলেছিলেন, তাদের কর্মীরা ভোটকেন্দ্র পাহারা দেবেন, যাতে করে ভোটে কারচুপি না ঘটতে পারে। কিন্তু কোনো ভোটকেন্দ্রের ধারে কাছেই দেখা গেল না বিএনপির কর্মীদের। এটা বিএনপির কর্মী সঙ্কটের কারণে হতে পারল, না ভিন্ন সিদ্ধান্তের কারণে হতে পারল, সেটা জানতে চাচ্ছে দলটির প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন অনেকেই।

মনে হচ্ছে, বিএনপি ভুগছে বিরাট কর্মী সঙ্কটে। আমাদের দেশে ভোটের সময় ভোটারদের নিয়ে আসতে হয় ভোটদানের জন্য। কিন্তু সে রকম কোনো ব্যবস্থা ছিল না বিএনপির পক্ষ থেকে। বিএনপি যেন দোটানায় ছিল নির্বাচন করবে, নাকি করবে না; সেটা নিয়ে। বিএনপির কর্মীদের ওপর, বাইরে থেকে যত দূর জানা যাচ্ছে, কী করতে হবে, ছিল না তার কোনো নির্দেশ। মনে হচ্ছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মধ্যেও ছিল না ঐক্য। কারণ, ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম প্রধান নেতাকে বলতে শোনা গেল, তিনি চাননি জামায়াতে ইসলামীকে ধানের শীষ প্রতীক দেয়া হোক। এ কথা বলা তার সঙ্গত হয়েছে বলে মনে করা যায় না। কেননা, জামায়াতে ইসলামী গণফোরামের মতো সাইনবোর্ডসর্বস্ব দল নয়। তারা বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। ঐক্যফ্রন্ট নীতির দিক থেকে ছিল বিভক্ত। এই বিভক্তি শেষ পর্যন্ত হতে পেরেছে আজগুবি ভোটের একটা কারণ।

বাংলাদেশ একটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশ। এর রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। এখানে ধর্মনিরপেক্ষতার বুলি আওরানো আর যাই হোক সংবিধানসম্মত বলে বিবেচিত হতে পারে না। ইসলাম বর্তমান বাংলাদেশের জাতীয় স্বাতন্ত্র্যের অন্যতম ভিত্তি। কিন্তু ড. কামাল হোসেনেরা এটা বুঝতে অপারগ। তাদের এই বিভ্রান্তি তাদের পরিচালিত করছে ভুল পথে। আর এই ভুলও স্বাক্ষর রাখল বর্তমান নির্বাচনে। বিএনপির উচিত জিয়ার নীতি অনুসরণ করা। জিয়া চাননি মুসলিম চেতনাকে খর্ব করে রাজনীতি করতে। এমনকি ২০১২ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে আমরা দেখতে পাই, শেখ মুজিব বলছেন, আমাদের জাতিসত্তার মধ্যে আছে দু’টি উপাদান। একটি হলো বাংলা ভাষা, আরেকটি হলো ইসলামের স্বাতন্ত্র্যচেতনা। শেখ মুজিব ঠিক কী চেয়েছিলেন ১৯৭০ সালে, তা স্পষ্ট নয়। তিনি কি একান্তভাবেই চেয়েছিলেন সাবেক পাকিস্তান ভেঙে দিতে; না সাবেক পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম অংশের মধ্যে একটি কনফেডারেশন গঠন করতে? কথাটা উঠছে এ জন্য যে, আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী প্রচারে কেবলই বলেছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা। কিন্তু আসলে ঠিক কী ছিল এই চেতনা?

কেননা ২০১২ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের যে আত্মজীবনী বেরিয়েছে, তাতে আমরা দেখছি, তিনি বলেছেন দ্বিজাতিতত্ত্ব ছিল সঠিক। নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের প্রচারণার বিপক্ষে বিএনপির কোনো আদর্শিক প্রচারণা ছিল না। এই না থাকাটাও হলো বিএনপির একটা বড় রকমের দুর্বলতা।

বিএনপি গড়েছিলেন জিয়াউর রহমান। তিনি যেতেন মানুষের কাছে, ঢিল-পাটকেল উপেক্ষা করে। খাল কাটায় অংশ নিয়েছেন নিজ হাতে। কিন্তু বিএনপির নেতারা কেবল বিবৃতি দিয়েছেন পত্রপত্রিকায়। সাধারণভাবে যাওয়ার প্রয়োজন অনুভব করেননি জনমানুষের কাছে। এটাও তাদের হারার একটা বড় কারণ। জিয়ার তুল্য কোনো নেতা বিএনপিতে এখন আর আছে বলে মনে হয় না। বিএনপিকে রাজনৈতিক দিক থেকে উঠে দাঁড়াতে হলে জিয়ার রেখে যাওয়া ঐতিহ্যকে সমুন্নত করতে হবে।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement