২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

‘রাজা, তোর কাপড় কোথায়?’

-

ছোটবেলায় ‘কমরেড মামা’র কাছে গল্পটি শুনেছিলাম। সে দিন গল্পটি আবার পড়লাম। তবে কবিতার ভাষায়। পশ্চিমবঙ্গের নবতিপর কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর মৃত্যু উপলক্ষে কবিতাটি আবার আমাদের সামনে এলো। গল্পটি এ রকম- এক দেশে এক রাজা ছিলেন। তার ইচ্ছে হলো, এমন অপূর্ব সাজ-পোশাক তিনি পরবেন যা অভূতপূর্ব। কেউ কোনো দিন যে কাপড়, যে সৌকর্য কোনো দিন দেখেনি। যেমন ইচ্ছা তেমন কাজ। রাজ্যময় ঢোল পিটিয়ে দেয়া হলো- অমন অপূর্ব পোশাক যে দর্জি বানিয়ে দিতে পারবে রাজা তাকে দেবেন অঢেল অর্থ। এ সংবাদ রাজ্যময় প্রচার করা হলো তো বটে, আশপাশের রাজ্যগুলোতেও এ খবর ছড়িয়ে পড়ল।

দলে দলে দর্জি এবং পোশাক বিশারদ কোম্পানি রাজদরবারে আসতে শুরু করে। এত লোকজন এলো যে, রাজা ও তার দরবার রীতিমতো হিমশিম খেলেন তাদের সামলাতে। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, রাজার কোনো পোশাকই পছন্দ হচ্ছে না। সব কিছুতে শেষমেশ একটা-না-একটা ত্রুটি বেরিয়ে যাচ্ছে। সভাসদরা হতাশ। মন্ত্রিপরিষদ চিন্তিত। রাজা নিজে বিষম ক্ষুব্ধ। এত দিনেও কোনো সুরাহা হলো না। রাজাকে কেউ দেখাতে পারল না অপূর্ব পোশাক।

এসব কথা রটে যাওয়ার পর একজন অতি ধূর্ত দর্জি রাজাকে ‘উচিত শিক্ষা’ দেয়ার ফন্দি আঁটে। সে রাজসিক দলবল নিয়ে রাজদরবারে এলো। সে বলল, রাজামশাই! আমাদের কোম্পানি সারা বিশ্বে পোশাক তৈরির ক্ষেত্রে সুবিখ্যাত। আমরা আপনাকে এ রকম এক অপূর্ব পোশাক প্রদর্শন করব; কিন্তু এই পোশাক দৈব বরপ্রাপ্ত। কেবল সুসন্তানরাই এটা দেখতে পাবে। জন্ম নিয়ে সন্দেহ আছে, এ রকম ব্যক্তি কখনো এ পোশাক দেখতে পাবে না। রাজা যদি অনুমতি দেন তাহলে আমরা এ পোশাক প্রদর্শন শুরু করতে পারি। রাজা অনুমতি দিলেন।

দর্জি পোশাক প্রদর্শনের ভঙ্গিতে সব কিছু করছে। প্রথমেই রাজাকে শরীরের নিচের অংশের পোশাক দেখানো হলো; তারপর বক্ষ ও শিরস্ত্রাণ ইত্যাদি। অথচ কেউ কিছু দেখছে না। রাজাও দেখছেন না। রাজা মনে মনে প্রমাদ গুনছেন, আমি দেখছি না কেন? তাহলে কি আমার জন্ম নিয়ে কোনো ‘গণ্ডগোল’ আছে? আর রাজা-বাদশাদের ক্ষেত্রে এ রকম তো হতেই পারে! অথচ রাজা লজ্জা, ভয় ও সঙ্কোচে সত্য বলতে পারছেন না। একই অবস্থা চারদিকে। রাজা-উজির, পাত্র-মিত্র সবার মনে একই প্রশ্ন। অথচ প্রকাশ করছেন না কেউ। অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ- যখন রাজা সেই পোশাক পরে রাজ্য ঘুরতে বের হবেন। বাকি অংশ নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতায় শুনতে হয়তো ভালো লাগবে।
‘সবাই দেখছে যে, রাজা উলঙ্গ, তবুও
সবাই হাততালি দিচ্ছে।
সবাই চেঁচিয়ে বলছে; শাবাশ, শাবাশ!
কারও মনে সংস্কার, কারও ভয়;
কেউ বা নিজের বুদ্ধি অন্য মানুষের কাছে বন্ধক দিয়েছে;
কেউ বা পরন্নভোজী, কেউ
কৃপাপ্রার্থী, উমেদার, প্রবঞ্চক;
কেউ ভাবছে, রাজবস্ত্র অতীব সূক্ষ্ম, চোখে
পড়ছে না যদিও, তবু আছে,
অন্তত থাকাটা কিছু অসম্ভব নয়।’

এ অবস্থায় কবি রাজাকে নামিয়ে দিয়েছেন ‘বাস্তবের প্রকাশ্য রাস্তায়’। সে রাজপথেও একই দৃশ্য, একই স্তাবকতা; একই প্রশস্তি। সেই হাজারো মানুষের কেউই নিজেকে জন্মের ব্যাপারে সন্দেহযুক্ত অথবা প্রচলিত ভাষায় ‘জারজ’ ভাবতে রাজি নয়। এদের মধ্যে ছিলেন কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক-আইনজীবী, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী এবং তুখড় বুদ্ধিজীবীও। কিন্তু কেউ ঝুঁকি নিতে নারাজ। কেউ নিজের সুখ-সুবিধা এবং পদ হারাতে চায় না। তাদের সবাই অন্তত গল্পে ‘আপাদমস্তক ভীতু, ফন্দিবাজ অথবা নির্বোধ স্তাবক ছিলেন না। একটি শিশুও ছিল; সত্যবাদী, সরল, সাহসী একটি শিশু। গল্পে আছে, সেই শিশুটি রাজাকে দেখে স্বতঃস্ফূর্তভাবে চেঁচিয়ে উঠল- ‘রাজা ন্যাংটা! রাজা ন্যাংটা!’

কারণ শিশুটি যা দেখছে, তাই বলছে। তার মাথায় কূট বুদ্ধি তখনো গজায়নি। সে ভয়-ভীতি, আইন-কানুন ও জেল-জুলুম তখনো বোঝে না। গল্পে এ রকম বলা হলেও আমাদের কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী এখন এই সময়ে শিশুটিকে কোথাও দেখছেন না। তাঁর প্রশ্ন,
‘শিশুটি কোথায় গেল? কেউ কি কোথাও তাকে কোনো
পাহাড়ের গুহায়
লুকিয়ে রেখেছে?
নাকি সে পাথর-ঘাস-মাটি নিয়ে খেলতে খেলতে
ঘুমিয়ে পড়েছে
কোন দূর
নির্জন নদীর ধারে, কিংবা কোনো প্রান্তরের গাছের ছায়ায়?’
দুই.
গল্প তো গল্প নয়। সে তো আমাদের জীবনেরই অংশ। একই গল্প বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে লিখিত হয় বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে। আর বলা হয়- ‘হিস্ট্রি রিপিটস ইটসেল্ফ’। মানে, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। ইতিহাসের আরেকটি অমোঘ শিক্ষা হচ্ছে, ইতিহাস থেকে কেউ শেখে না। এটা যদি সত্য না হবে, তাহলে আমাদের রাজা-বাদশাহ, নেতা-নেত্রী এবং মালিক-মোখতাররা এত ভুল বারবার কী করে করেন? আবারো একই কথা- তারা ভুল স্বীকার করতে নারাজ। ইতিহাস অনুসন্ধানীরা এমন আচরণের কারণ খুঁজতে যান যদি, তাহলে একটিই উত্তর পাওয়া যাবে। আর তা হলো, ক্ষমতার রাজনীতি। এটি এতটাই কঠিন ও কঠোর যে, পিতা পুত্রকে হত্যা করেন, পুত্র পিতাকে, ভাই ভাইকে। ক্ষমতা বা সিংহাসনের জন্য রক্তপাত, ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতা যেন সাধারণ বিষয়। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় এর ব্যবহারিক অবয়ব পাল্টেছে মাত্র। তবে মৌলিক আচরণের কোনো পরিবর্তন হয়নি। যারা নৈতিকতা ও আদর্শে বিশ্বাস করেন তারা আজো প্রতারিত হচ্ছে, প্রতিপক্ষের বিপরীত চরিত্রের দ্বারা।

আজীবন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামশীল একজন মানুষ প্রভাবিত হতে পারেন ঘনিষ্ঠ মানুষদের দ্বারা। রক্ত দিতে হতে পারে আপন বলয়ের কারো কাছেই। বিশ্বাসী মানুষ বিশ্বাসঘাতক বলে দূরে নিক্ষিপ্ত হতে পারেন। সহকর্মী-সহযাত্রী ক্ষমতার মোহে ষড়যন্ত্রে মেতে উঠতে পারে। রাজনীতিতে ‘শেষ কথা নেই’ বলে- সাপ ব্যাঙের গালে চুমু খেতে পারে। নীতি নয়, ক্ষমতাই যখন লক্ষ্য, তখন স্বৈরাচার হয়ে যায় গণতন্ত্রী। প্রতারণা ও মিথ্যাচার রাজনীতির নিয়ামক হয়ে ওঠে এ অবস্থায়। কথা ও কাজের বৈপরীত্য হয়ে ওঠে পলিটিক্সেপারঙ্গমতার নিদর্শন। ন্যায়নীতি, রীতি-রেওয়াজ, আইন-কানুন, ভদ্রতা-সভ্যতা ইত্যাদি সবকিছু বিসর্জিত হতে পারে অনায়াসে। নিয়ম যখন অনিয়মে পরিণত হয় অথবা দুর্নীতি যখন নীতিতে পরিণত হয় অথবা নিপীড়ন যখন পরিণত হয় প্রথায় তখন তো বলার কিছু অবশিষ্ট থাকে না।

তিন.
গল্পকথা অথবা নীতিকথা দ্বারা কী বলতে চাই, তা হয়তো এতক্ষণে পাঠক সাধারণের বোধগম্য হয়েছে। হ্যাঁ, আমাদের ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৮ এর সংসদ নির্বাচনের কথা বলছি। জানি ‘আমার পূর্বপুরুষের পিঠে রক্তজবার মতো ক্ষত ছিল’। কিন্তু মিথ্যাচার ছিল না। আমি জানি পূর্বপুরুষের জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ সত্য ছিল। তবে অন্যায়-অত্যাচার ছিল না। আমি জানি, আমাদের নেতাদের হৃদয়ে বিচলিত স্নেহ ছিল- রক্ত নেয়ার লালসা ছিল না। আমি জানি, আমার পূর্বপুরুষেরা ‘ক্রীতদাস ছিলেন’। কিন্তু এখনকার মতো স্বাধীনতার নামে নিপীড়ন করতেন না। এটুকু বোধ ৩০ ডিসেম্বরের ঘটনাবলির কথা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, যেখানে ২৩ জন স্বাধীন মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়া হয়েছে। যেখানে আহত হয়েছে বহু মানুষ। কী করে সেখানে স্বাভাবিকতার কথা বলব? টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া আধিপত্যের কালো ছায়ায় ঢাকা পড়েছে মানুষের দেহমন। একচেটিয়া ভোটে উপচে পড়েছে বিশেষ প্রতীকের জয়।

ভোট দিতে পারেননি অসংখ্য সাধারণ মানুষ। ‘অসাধারণ’ লোকেরা রাত থেকে ব্যালট বাক্স ভর্তি করেছে ভোটকেন্দ্রে আসতে দেয়নি সাধারণ মানুষকে। আমার নিজের চোখের সামনে মাস্তানি দেখিয়েছে পুঁচকে কিশোর। নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলছেন, ‘কেমন ভোট হচ্ছে নিজের বিবেককেই জিজ্ঞাসা করুন।’ এ প্রশ্ন শুধু একজনের নয়। কোটি কোটি মানুষের। তবে আহত হয়েছে বিবেক। কিন্তু আজ বিবেক এতটাই কাপুরুষ যে, আমাদের পূর্বপুরুষের মতো প্রতিবাদ করতে জানে না। প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি দল, ক্ষমতারপক্ষ বাদে সবাই বলেছে যে, জনগণের সম্মিলিত আওয়াজকে স্তব্ধ করে দেয়া হয়েছে। তাই পূর্বনির্ধারিত, একচেটিয়া এবং বাহিনী নির্ধারিত এ নির্বাচন বাতিল করা হোক। ‘পূর্বনির্ধারিত রায়’ বলে বিবৃতি দিয়েছে সিপিবি। গণসংহতি আন্দোলন বলেছে, পাতানো নির্বাচন।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ বলেছে, ‘পুলিশ-র‌্যাবের পাহারায় ভোট ডাকাতির মহোৎসব।’ প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির পোলিং এজেন্ট ছিল না প্রায়কোথাও। সারা দেশের ভোটচিত্র একই রকম- নিয়ন্ত্রিত মাঠ, অনিয়ম ও অসঙ্গতিতে পরিপূর্ণ নির্বাচন। তবুও অসত্যকথন, ‘সহিংসতা উপেক্ষা করে ভোট দিয়েছে জনগণ’। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তমের মন্তব্য, সত্য ও ন্যায়ের কবর রচনা করেছে আওয়ামী লীগ। মোটকথা, একাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি কোটি কোটি মানুষের। সুতরাং ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচন এমন প্রহসনই হয়- এ উপলব্ধি সচেতন রাজনৈতিক মহলের। ক্ষমতাসীন বলয়ের বাইরের এমন কোনো নেতা বা সংগঠন নেই, যারা বলছেন এবারের ভোট সঠিক হয়েছে। আর নিজের চোখকে তো মিথ্যাচার করতে দেয়া যায় না। বিনা পর্যবেক্ষণে, ষোলো কোটি মানুষের ভাষায় এক বাক্যে ‘নির্বাচন সর্বতোভাবেই অগ্রহণযোগ্য’, এ সাক্ষ্য দেয়া যায়।

আবারো সেই গল্পের পটভূমিতে আসা যাক। আগেই বলা হয়েছে, কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী (১৯২৪-২০১৮) সেই সত্যবাদী, সরল, সাহসী শিশুকে খুঁজে পাননি। আমরাও বাংলাদেশের ৩০ ডিসেম্বরের পটভূমিতে প্রতীকী অর্থে নাগরিকদের প্রতিভূ সেই শিশুকেই খুঁজছি। কবির আহ্বান,
‘সে এসে একবার এই উলঙ্গ রাজার সামনে
নির্ভয়ে দাঁড়াক।
সে এসে একবার এই হাততালির ঊর্ধ্বে গলা তুলে
জিজ্ঞাসা করুক :
রাজা, তোর কাপড় কোথায়?’

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement