২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

জাতি ও জাতীয়তা এক নয়

-

জাতীয়তা নাগরিকত্বের ভিত্তিতে নিরূপিত হয়। জাতীয়তা ও নাগরিকত্ব একটি অপরটির পরিপূরক হলেও নাগরিকত্ব ব্যতীত জাতীয়তা অর্জন সম্ভব নয়। জাতীয়তা একটি দেশের ভূখণ্ডভিত্তিক, কিন্তু জাতি বেশির ভাগ দেশের ক্ষেত্রে অঞ্চলভিত্তিক। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আমাদের পাশের ভারত বহুজাতিভিত্তিক একটি দেশ। ভারতের বিভিন্ন জাতি অঞ্চলভিত্তিক রাজ্যগুলোর সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী। যেমন- বাঙালির ক্ষেত্রে পশ্চিম বাংলা, পাঞ্জাবিদের ক্ষেত্রে পাঞ্জাব, তামিলদের ক্ষেত্রে তামিলনাড়ু, গুজরাটিদের ক্ষেত্রে গুজরাট, নাগাদের ক্ষেত্রে নাগাল্যান্ড প্রভৃতি। ভারতের অঞ্চলভিত্তিক বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ‘আঞ্চলিক জাতি’ হিসেবে অভিহিত হলেও জাতীয়তার ক্ষেত্রে ভারত নামক ভূখণ্ডে বসবাসরত সব জাতিই ‘ভারতীয়’। ভারতে বসবাসরত নাগরিকদের জাতীয়তা ভারতীয় হলেও সেখানে ভারতীয় নামে পৃথক সত্তাবিশিষ্ট জাতি নেই।

কোনো একটি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী একটি জাতির অন্তর্ভ্ক্তু হলে অনেক সময় দেখা যায় জাতিভিত্তিক দেশটির নামকরণ হয় জাতিভিত্তিক। যেমন- বাঙালির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ, ইংরেজদের ক্ষেত্রে ইংল্যান্ড, সিংহলিদের ক্ষেত্রে সিংহল, ফিনিশদের ক্ষেত্রে ফিনল্যান্ড প্রভৃতি। আবার এমনও দেখা যায়, সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে দেশের নামকরণ হলেও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী উপজাতি নামে অভিহিত হয়।

বাংলাদেশে বাঙালিবহির্ভূত যেসব জাতি বসবাস করে, তাদেরকে সংবিধানের ২৩ক অনুচ্ছেদে উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায় উল্লেখপূর্বক তাদের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। তা ছাড়া, সংবিধানের ২৯ নম্বর অনুচ্ছেদে ২৩ক অনুচ্ছেদে বিধৃত জনগোষ্ঠীকে নাগরিকদের ‘অনগ্রসর অংশ’ উল্লেখপূর্বক প্রজাতন্ত্রের কর্মে তাদের উপযুক্ত প্রতিনিধিত্বের বিষয়ে বিশেষ বিধান প্রণয়নের উল্লেখ রয়েছে।

ইংরেজরা তাদের মূল ভূখণ্ড ইংল্যান্ডের বাইরে চারটি রাষ্ট্র যথা- আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড সৃষ্টি করলেও ওই সব দেশের নাগরিকেরা তাদের মূল জাতিসত্তাবহির্ভূত ভূখণ্ডগত জাতীয়তা দ্বারা পরিচিত। যেমন- আমেরিকার ক্ষেত্রে আমেরিকান, কানাডার ক্ষেত্রে কানাডিয়ান, অস্ট্রেলিয়ার ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়ান ও নিউজিল্যান্ডের ক্ষেত্রে নিউজিল্যান্ডার।

আমেরিকা অভিবাসীদের দেশ। সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী ইংরেজবংশোদ্ভূত হলেও বিভিন্ন অঞ্চল বা দেশ থেকে আগতদের অঞ্চল বা দেশভিত্তিক পরিচয় রয়েছে। যেমন- ভারতীয় অভিবাসীদের ক্ষেত্রে ভারতীয় আমেরিকান, বাংলাদেশী অভিবাসীদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশী আমেরিকান, চীনা অভিবাসীদের ক্ষেত্রে চায়নিজ আমেরিকান, আফ্রিকা মহাদেশের অভিবাসীদের ক্ষেত্রে আফ্রিকান আমেরিকান অথবা কালো আমেরিকান প্রভৃতি। ভারত ও বাংলাদেশ উভয় ভূখণ্ডের দু’জন বাঙালি দু’টি ভূখণ্ড থেকে আমেরিকায় অভিবাসী হলে তারা তাদের জাতির পরিবর্তে দেশভিত্তিক জাতীয়তা ভারতীয় আমেরিকান ও বাংলাদেশী আমেরিকান নামেই অভিহিত হয়। আমেরিকায় স্থায়ীভাবে বসবাসরত নাগরিকদের জাতীয়তা ‘আমেরিকান’। সেখানে ভারতীয়দের অনুরূপ আমেরিকান নামে কোনো পৃথক জাতিসত্তা নেই।

পৃথিবীর যেকোনো দেশের নাগরিকত্ব দু’ভাবে অর্জন করা যায়। এর একটি জন্মসূত্রে, অপরটি বসবাসসূত্রে। প্রতিটি দেশের নাগরিকত্ব আইন দ্বারা নির্ধারিত হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে আমাদের দেশও ব্যতিক্রম নয়।

বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ নম্বর ৬ নাগরিকত্ব সংক্রান্ত হলেও অনুচ্ছেদটিতে নাগরিকত্ব ও জাতীয়তা উভয় বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এ অনুচ্ছেদটির নাগরিকত্ব সংক্রান্ত বিধানে সংবিধান প্রণয়ন থেকে অদ্যাবধি কোনো সংশোধনী আনা না হলেও জাতীয়তা সংক্রান্ত বিধান দু’বার সংশোধন করা হয়েছে। ’৭২-এর সংবিধানে জাতীয়তা বিষয়ে বলা হয়ে ছিল- ‘বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাঙ্গালি বলে পরিচিত হবেন।’ দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র (পঞ্চদশ সংশোধন) আদেশ, ১৯৭৮ দ্বারা আগের ৬ নম্বর অনুচ্ছেদ প্রতিস্থাপনপূর্বক জাতীয়তা বিষয়ে দফা (২)-এ বলা হয়- ‘বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলে পরিচিত হবেন।’ অতঃপর সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধন) আইন, ২০১১-এর মাধ্যমে ৬ নম্বর অনুচ্ছেদ পুনঃপ্রতিস্থাপনপূর্বক জাতীয়তা বিষয়ে দফা (২)-এ বলা হয়েছে- ‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙ্গালি এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলে পরিচিত হবেন।’

বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনে জন্মসূত্র ছাড়াও অভিবাসন ও দেশ্যকরণের মাধ্যমে নাগরিক হওয়ার বিধান রয়েছে। নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫১-তে অভিবাসন বা অভিবাসীর কোনো সংজ্ঞা দেয়া না হলেও ওই আইনের ৬ ধারায় অভিবাসনের মাধ্যমে নাগরিকত্ব বিষয়ে বলা হয়েছে- সরকার কোনো ব্যক্তিকে এ আইনের অধীনে নিবাসী সনদ গ্রহণসাপেক্ষে বাংলাদেশের অভিবাসী নাগরিক করতে পারেন, যদি ওই ব্যক্তি এ আইন কার্যকর হওয়ার পর এবং ১৯৫২ সালের ১ জানুয়ারির আগে বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের উদ্দেশ্যে পাক-ভারত উপমহাদেশের কোনো অঞ্চল থেকে বর্তমান বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত কোনো অঞ্চলে প্রবেশ করে থাকেন। ওই ব্যক্তির স্ত্রী এবং তার নাবালক সন্তানেরাও নাগরিক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবে।

দেশ্যকরণের মাধ্যমে নাগরিকত্ব বিষয়ে নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫১-এর ৯ ধারায় বলা হয়েছে, সরকার যেকোনো ব্যক্তি যাকে দেশ্যকরণ আইন, ১৯২৬ (The Naturalization Act, 1926)-এর অধীন দেশ্যকরণ সনদ মঞ্জুর করা হয়েছে, তার এ পরিপ্রেক্ষিতে আবেদন করা সাপেক্ষে তাকে দেশ্যকরণের মাধ্যমে নিবন্ধিত করতে পারেন। এমনকি কোনো ব্যক্তি দেশ্যকরণের কোনো সনদ গ্রহণ না করা সত্ত্বেও সরকার তাকে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে নিবন্ধিত করতে পারেন।

দেশ্যকরণ আইনের ৩ ধারা অনুযায়ী, সরকার যেকোনো ব্যক্তিকে দেশ্যকরণ সনদ মঞ্জুর করতে পারে, যদি তিনি এ উদ্দেশ্যে দাখিলি আবেদনের মাধ্যমে সরকারকে সন্তুষ্ট করেন যে- (ক) তিনি নাবালক নন; (খ) তিনি বাংলাদেশ অথবা অন্য কোনো রাষ্ট্রের নাগরিক নন যে রাষ্ট্রের দেশ্যকরণের মাধ্যমে নাগরিক হওয়া বাংলাদেশের একজন নাগরিকের জন্য আইন দ্বারা বারিত; (গ) তিনি আবেদন দাখিলের দিন থেকে অব্যবহিত পূর্ববর্তী ১২ মাস একাদিক্রমে বাংলাদেশে বসবাস করেছেন এবং উক্ত ১২ মাসের অব্যবহিত পূর্ববর্তী সাত বছরের মধ্যে সর্বসাকুল্যে অন্যূন চার বছর বাংলাদেশে বসবাস করেছেন; (ঘ) তিনি ভালো চরিত্রের অধিকারী; (ঙ) তার বাংলা ভাষায় পর্যাপ্ত জ্ঞান আছে ও (চ) আবেদন মঞ্জুর হলে তিনি বাংলাদেশে বসবাস অথবা প্রবেশ অথবা বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের চাকরিতে অবস্থান করতে ইচ্ছুক। তবে উপদফা (গ) ও (চ)-এ বর্ণিত কোনো কিছু একজন মহিলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না যিনি বিবাহ-পূর্ববর্তী বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশের নাগরিক নন, এমন ব্যক্তির সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন এবং যার স্বামী মৃত্যুবরণ করেছেন অথবা যার বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটেছে।

আমাদের নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫১-তে (The Citizenship Act, 1951) দ্বৈত নাগরিকত্ব বারিত হলেও বাংলাদেশ নাগরিকত্ব (অস্থায়ী বিধান) আদেশ, ১৯৭২ (The Bangladesh Citizenship (Temporary Provisions) Order, 1972)-এর বিধান অনুযায়ী, ইউরোপ অথবা উত্তর আমেরিকা অথবা সরকার কর্তৃক গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নির্ধারিত অন্য যেকোনো রাষ্ট্রের নাগরিককে সরকার বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করতে পারেন। আমাদের সংবিধান অনুযায়ী, একজন সংসদ সদস্য পদে বহাল থাকাকালে কোনো বিদেশী রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করলে বা কোনো বিদেশী রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করলে তিনি সংসদ সদস্য হিসেবে অযোগ্য হয়ে পড়েন। তবে সংবিধানের এ বিধানটিতে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংশোধনী এনে বলা হয়- একজন দ্বৈত নাগরিক বিদেশী রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব ত্যাগ করলে অথবা অন্য ক্ষেত্রে পুনঃবাংলাদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করলে তিনি বিদেশী রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করেছেন বলে গণ্য হবেন না।

জাতীয়তা দেশভিত্তিক না হয়ে জাতিভিত্তিক হলে, তা সে দেশে বসবাসরত অপর জাতি বা উপজাতি বা ক্ষুদ্র জাতিসত্তা বা নৃগোষ্ঠীকে বহির্ভূত করে। আমাদের স্বাধীনতা-পরবর্তী সংবিধান প্রণয়নকালে এ দেশে বসবাসরত সব নাগরিকের জাতীয়তা বাঙালি নির্ধারণ করা হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও নৃগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দেয়, যা পরবর্তীকালে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে রূপান্তরিত হয়েছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামজুড়ে জাতীয়তাকে কেন্দ্র করে যে অসন্তোষ ও বিদ্রোহের সূত্রপাত হয়েছিল, দীর্ঘ ২৩ বছরের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর সরকার ও উপজাতিদের মধ্যে সম্পাদিত শান্তিচুক্তির মাধ্যমে তার অবসান হয়েছে বলা হলেও এখনো মাঝে মধ্যে দু-একটি রক্তক্ষয়ী ঘটনা সমস্যাটির স্থায়ী সমাধান না হওয়ারই ইঙ্গিতবহ।

পৃথিবীর কোনো দেশে জাতীয়তার ক্ষেত্রে জাতি ও নাগরিক-এ দু’টিকে বিভাজন করা হয়নি। আমাদের এ বিভাজনটি অভিনব হলেও তা জাতিগত ও ভূখণ্ডগত জাতীয়তার সীমারেখাকে অতিক্রম করতে পারেনি। এ কথাটি বলতে দ্বিধা নেই যে, ‘জাতীয়তা’ বিষয়ে ’৭২-এর সংবিধানের সিদ্ধান্ত বাস্তবতার বিপরীতে নেয়া হয়েছিল এবং জাতীয়তা জাতিভিত্তিতে নয়, ভূখণ্ড ও নাগরিকত্বের ভিত্তিতে নিরূপিত হলেই তা ভূখণ্ডে বসবাসরত সব জাতি, উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও নৃগোষ্ঠীর পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির বন্ধনে বসবাসের মাধ্যমে দেশ ও দেশের নাগরিক, উভয়ের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে। তাই জাতি ও জাতীয়তা এ দু’টি অভিন্ন নয়, সে নিরিখে জাতীয়তা নিরূপণ সমীচীন।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement