২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ভোট যার যার- নির্বাচন সবার

-

৩০ ডিসেম্বর রোববার বহুপ্রত্যাশিত একাদশ সংসদ নির্বাচন। জাতীয়পর্যায়ের এই অতীব গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন যেমন প্রতিশ্রুতি ও প্রত্যাশার, তেমনি উদ্বেগ ও আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠেছে। এমন অনভিপ্রেত অবস্থা কারো কাম্য না হলেও বৈরী বাস্তবতায় অনেকেরই মনোভাব-‘ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি।’ অথচ কথায় আছে, নির্বাচন আমাদের দেশে যেন একধরনের মহোৎসব। তার মধ্যে থাকে আগ্রহ ও আনন্দ, উচ্ছ্বাস ও উল্লাস। গত কয়েক দিনের অবনতিশীল পরিস্থিতির বর্ধমান সহিংসতার কারণে নির্বাচনে মানুষের উৎসাহ ক্রমেই উদ্বেগে পর্যবসিত হওয়ার দায় নিতে হবে ক্ষমতালোলুপ প্রার্থী, নীতিহীন রাজনীতিক, সুবিধাবাদী প্রশাসন, অথর্ব নির্বাচন কমিশন আর বশংবদ মিডিয়াকে। এত কিছুর পরও আমরা আশা করব, এই নির্বাচন সর্বত্র উৎফুল্ল নরনারীর মহোৎসব না হতে পারুক, লুটেরা দুর্বৃত্তদের জবরদখল তাণ্ডবের মচ্ছবে পরিণত হবে না।

আজকের নির্বাচন নিয়ে যতটা আশঙ্কা, তা যেন অপসৃত হয়ে জাতির জন্য নয়া অধ্যায় সূচনার আশা জোগাতে পারে অবাধ ভোটাভুটি। কারণ, অন্যথায় নির্বাচনের নামে যা হবে, তা গণতন্ত্রকে ‘বনতন্ত্র’ আর রাজনীতিকে ‘বাজনীতি’র নামান্তর বানিয়ে দিতে পারে। বাংলাদেশের গণতন্ত্রপ্রেমী, সচেতন, দেশপ্রেমিক ও বিবেকবান নাগরিকেরা আজ ভোটকেন্দ্রে গিয়ে সৎ সাহস ও নীতিনিষ্ঠার প্রমাণ যদি দৃঢ়তার সাথে দিতে পারেন, দায়িত্ববোধের মধ্য দিয়ে বাস্তবায়ন হবে ‘আমার ভোট আমি দেবো, যাকে খুশি তাকে দেবো’। আর কেউ যেন কোনোভাবেই মতলবি দরদি হয়ে আপনার অতি মূল্যবান ভোটটি দিয়ে দিতে না পারে, এ জন্য চাই সতর্কতা ও ত্বরিত পদক্ষেপ।

শীত বাড়ছে, বাড়ছে কুয়াশাও। তেমনি নির্বাচনের অঙ্গনেও যেন ক’দিনে বিভ্রান্তি ও বিষণœতার কুয়াশা সব কিছু ঢেকে দিচ্ছে। আগে থেকেই অব্যাহত হুমকি ও হামলা এবং মামলা-গ্রেফতার-রিমান্ডের সাথে নতুন করে প্রচণ্ড সন্ত্রাস-সহিংসতার ঝড় ভোটারদের বিরাট অংশের মনে একপ্রকার ভীতির সঞ্চার করেছে। নির্ধারিত দিবসে নির্বাচন হওয়ার নিশ্চয়তা পাওয়া গেলেও তা সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ হওয়ার বিষয়টি অনিশ্চিত থেকে গেছে। জনমনে সৃষ্ট এই উৎকণ্ঠা দূর করার দায়িত্ব প্রধানত ইলেকশন কমিশনের। যেহেতু আগের সরকারই বহাল আছে, তাই তাদের ওপরও দায়টা কম বর্তায় না। নির্বাচনকালেও দলীয় সরকার নিয়ে অনেক অভিযোগ ও আপত্তি আছে।

তবুও যদি প্রশাসনের পর্যাপ্ত তৎপরতা থাকে এ নির্বাচন সন্দেহমুক্ত ও গ্রহণীয় করার জন্য, তাহলে এর কৃতিত্বের বড় অংশই পাবে সরকার। তদুপরি, সেনামোতায়েনের পর থেকে শান্তিশৃঙ্খলার ব্যাপারে জনগণের প্রত্যাশা যেমন বেড়েছে অনেক, তেমনি এ সময় কিছু অবাঞ্ছিত অঘটন দেশের মানুষকে মর্মাহত ও শঙ্কিত করে তুলেছে। হিংসা-হানাহানির অমানিশা প্রত্যাশার প্রত্যুষ আর স্বস্তির সকালের আগমন রোধ করতে পারে না। তেমনি আজকের দিনটি হোক এ দেশে একটি অংশগ্রহণমূলক, গ্রহণযোগ্য ও মানসম্মত জাতীয় নির্বাচনের। এর সুন্দর ও নির্বিঘœ আয়োজন মুছে দিক বিগত নির্বাচনের কলঙ্ক। সর্বোপরি, গণতন্ত্র এক দিনের নির্বাচনী অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমিত না থেকে বছরজুড়ে আমাদের সরকার ও সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রতিষ্ঠা পাক- এটাই তো জাতির স্বপ্ন ও আশা।

গণতন্ত্র মানুষের উদ্ভাবিত সিস্টেম। তাই এটাকে শতভাগ নির্ভুল ও ঐশী পন্থা মনে করার হেতু নেই। সময়ের সাথে সব কিছুর পরিবর্তন ঘটে এবং কাক্সিক্ষত বিকাশ ও উন্নতি পরিলক্ষিত হয়। গণতন্ত্রের বেলায়ও এটি সত্য। ‘গণতন্ত্রে দেশের উন্নয়ন দেরিতে হয়’ এবং ‘গণতন্ত্রের নির্বাচনে মানুষের মাথা গোনা হলেও মগজের পরিমাণ হিসাব করা হয় না’- ইত্যাকার সমালোচনা হয়েছে এবং হয়তো হবেও। তবে কথা হলো, যারা গণতন্ত্রকে এক নিঃশ্বাসে ‘মন্দ’ বলে স্বৈরতন্ত্রের দুর্গন্ধ বয়ে যাওয়ার পথ করে দেন, তাদেরকেও মেনে নিতে হবে, গণতন্ত্র অন্তত ‘মন্দের ভালো’। মানুষ শত শত বছরে নানা বাদ-মতবাদ এবং বিধান-ব্যবস্থা উদ্ভাবন ও প্রবর্তন করেছে। কিন্তু গণতন্ত্রের চেয়ে উত্তম কোনো মানবরচিত সিস্টেম চালু করা যায়নি, যা সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের মোটামুটি কল্যাণ নিশ্চিত করতে পারে।

আকর্ষণীয় কথামালায় বিভ্রান্ত করা কিংবা চটকদার বক্তব্যে চমক লাগিয়ে দেয়া অথবা ‘বিপ্লব’ ঘটাতে উত্তেজিত করার মতো ইজম বা মতাদর্শ, থিওরি ও ফর্মুলা এসেছে অনেক। কিন্তু সেগুলো আপসকামিতা কিংবা হঠকারিতার কারণে অথবা সর্বজনীন ও কালোত্তীর্ণ না হওয়ার ব্যর্থতার দরুন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। গণতন্ত্র দেশে দেশে আজো বিদ্যমান। শুধু টিকেই নেই, প্রবল প্রতাপে তার প্রভাব বিস্তার করে আছে বিশ্বের বিভিন্নাংশে। গণতন্ত্রের গুণ ও গৌরব এমন অনস্বীকার্য যে, সাম্যবাদ থেকে ধর্মবাদ পর্যন্ত নানা আদের্শ উদ্বুদ্ধ দলগুলো পর্যন্ত গণতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে পারে না। অপর দিকে, গণতন্ত্রের যা ‘দোষ ও দুর্বলতা’, তার জন্য দায়ী গণতন্ত্রীদের অসচেতনতা ও ব্যর্থতা। তারা কর্তব্যসচেতন হলে গণতন্ত্রের নামে দলবাজি, পরিবারতন্ত্র, অথবা গোষ্ঠী শাসন কোনো দেশে কায়েম হওয়ার কথা নয়।

নির্বাচনকে ক্রীড়াবিদসুলভ উদার মানসিকতায় গ্রহণ করতে উপদেশ দেয়া হয়। কিন্তু এ দেশে বাস্তবে তা একপ্রকার ব্যাধি কিংবা লড়াই অথবা অভিনয়ের রূপ পরিগ্রহ করে থাকে। ‘বিজয় মহান, সংগ্রাম মহত্তর’- ক্রীড়াঙ্গনের এই বাণীর বাস্তবায়ন নির্বাচনেও হলে আমরা স্বস্তি পেতাম। কারণ, তখন সংশ্লিষ্ট সবাই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হার-জিতকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতেন; হাসিমুখে মেনে নেয়া হতো ফলাফলকে। কার্যত নির্বাচনে বিজয়ীর অট্টহাসি দেখে ভয় পাওয়া আর পরাজিতের বুকফাটা আর্তনাদে শোকার্ত হয়ে পড়াই যেন আমাদের ভবিতব্য। বাংলাদেশে (বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেই) নির্বাচনের যে সিস্টেম, তাতে First past the post সব লুটে নেয়। অর্থাৎ প্রার্থীদের মধ্যে যিনি অন্যদের চেয়ে বেশি ভোট পান, তিনিই বিজয়ী। এমনকি, তিনি যদি শতকরা ৪০, ৩০ বা আরো কম ভোটারের সমর্থিত হন; তবুও তার বিজয় বৈধ। অথচ নৈতিকতার দাবি হলো, একজন প্রার্থী অন্তত ৫১ শতাংশ বা বেশির ভাগ ভোটারের সমর্থনধন্য হওয়া উচিত।

তদুপরি, বাংলাদেশে দিন দিন ভোটারের চেয়ে ভোট গণনাকারী যেন বেশি গুরুত্বের অধিকারী হয়ে উঠছেন। এটা কারচুপি বা কারসাজির ইঙ্গিতবাহী এবং সবার জানা, ইলেকশন রেজাল্ট এভাবে ডক্টরিং বা ইঞ্জিনিয়ারিং করার সুযোগ দেয় ক্ষমতার অপব্যবহার। এটা একধরনের প্রতারণা ও মিথ্যাচার মাত্র। এতে জনগণের বিশ্বাসভঙ্গের ঘটনা ঘটে যায়। ‘নির্বাচনী যুদ্ধ’ কথাটি বহুলপ্রচলিত। তবে এর মানে এটা নয় যে, ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্রমেদিনী’ পণ করে Do or die রক্তশপথ গ্রহণ করতে হবে। বরং ‘দশে মিলে করি কাজ/ হারি জিতি নাহি লাজ’ কথাটিই বেশি অনুসৃত হতে হবে। ‘রাজনীতির রঙ্গমঞ্চ’ কথাটির সাথে সবাই পরিচিত। পার্লামেন্ট নির্বাচন জাতীয় রাজনীতির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক। এ জন্য কিন্তু নিছক অভিনয়ের মতো ইশতেহার আউড়ে গেলে হবে না। এর প্রতিটি অঙ্গীকার ভোটে জিতে কার্যকর করার আন্তরিকতা ও দায়িত্বশীলতা এবং সর্বোপরি দৃঢ় অঙ্গীকার থাকা জরুরি।

নির্বাচনে প্রার্থীর কাছে ভোটার-ক্যাডার উভয়ই খুব দামি। অবশ্য অনেক সময় দেখা যায়, ক্যাডারদের সার্ভিস ঠিক সময়ে ঠিক মাত্রায় মিললে ভোটারদের দাম পড়ে যায়। তবে মনে হয়, নির্বাচনের বাজারে সবচেয়ে কম দাম ইশতেহারের। তবে এটা কথার কথা মাত্র নয়; বরং জনগণের কাছে প্রার্থী বা নেতা (অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট দল ও জোটেরও) অতি মূল্যবান প্রতিশ্রুতি। ইশতেহার নিছক আশ্বাস নয়, অঙ্গীকার। তা পূরণ করা বিজয়ী প্রার্থীর দায়িত্ব। এমনকি অনেক সময় তার নৈতিক দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায় প্রতিপক্ষের ইশতেহারের গুরুত্বপূর্ণ ওয়াদাগুলো বাস্তবায়ন করা।

নির্বাচনী মওসুমে ইশতেহার এবং বক্তৃতায় বয়ে যায় প্রতিশ্রুতির প্লাবন। বাস্তব-অবাস্তব নানান টাইপের ওয়াদার ঢলে ভোটারদের ভাসিয়ে নিলেই যেন অমুক তমুক মার্কার কেল্লাফতে।

এমন এক চাপাবাজ ও গলাবাজ (আসলে ধান্ধাবাজ) প্রার্থী এক সমাবেশে ঘোষণা দিলেন, ‘ভাই-বোনেরা, যদি আমারে ভোট দেন, জিতে গেলে আপনাগো গেরামে দারুণ একটা বিরিজ (সেতু) বানাইয়া দিমু।’ শ্রোতাদের একজন উঠে বললেন, ‘লিডার, এখানে তো কোনো নদী বা খালই নাই; বিরিজ অইব কেমনে?’ প্রার্থী একমুহূর্তও দেরি না করে বললেন, ‘অসুবিদা নাই। আগে নদী বানাইয়া নিমু। হের বাদে বিরিজ কইরা দিমু। ঠিক আছে?’ ভোটপ্রার্থী এই নেতার জবাব শুনে সব ভোটার লা-জবাব।

নির্বাচন মানে স্বাধীনভাবে প্রতিনিধি পছন্দ করার ব্যবস্থা। এটা কোনো সদাশয় সরকার কিংবা সমাজসেবী সংগঠন অথবা মহানুভব নেতা-নেত্রীর কৃপা ও করুণা নয়। সুষ্ঠু নির্বাচনব্যবস্থা জনগণের অবিচ্ছেদ্য বা মৌলিক অধিকার। জনপ্রতিনিধি অবাধে ও স্বাধীনভাবে নির্বাচনের নিশ্চয়তা বিধান করা সরকারের একটি বড় দায়িত্ব। এ জন্য নির্বাচন কমিশনকে সাংবিধানিক গুরুদায়িত্ব দিয়ে তাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিতে সরকারকে সংবিধান নির্দেশ দিয়েছে। গণতন্ত্রের যে প্রাসাদ গড়ে ওঠে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য, এর ভিত্তি হলো সুন্দর একটি নির্বাচন।

নির্বাচনই গণতন্ত্রের সব কিছু নয়। তবে নির্বাচনে জাল-জোচ্চুরির সুযোগ ও প্রশ্রয় থাকলে ফলস্বরূপ যে ‘গণতন্ত্র’ পাওয়া যাবে, তাতে থেকে যাবে বিরাট ভেজাল। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নির্বাচন হয়ে থাকে নির্দিষ্ট সময়ে ও নির্ধারিত পন্থায়। এই নির্বাচন হতে হবে সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য। পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষের সততা ও দায়িত্ববোধ, সেই সাথে বৈধ ক্ষমতা প্রয়োগের সাহস ও দৃঢ়তা ছাড়া নির্বাচন নিরপেক্ষ হতে পারে না। যে দেশে নির্বাচন কমিশন যত স্বাধীন, সাহসী ও শক্তিশালী, সেখানে গণতন্ত্র ততটা পাকাপোক্ত।

দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশের নির্বাচনব্যবস্থা সেই ব্রিটিশ আমল থেকে কলুষিত। হয়তো তখন এই রাজনৈতিক ও সামাজিক দূষণের মাত্রা ছিল কম। ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়ে এখন তা চরমে। ব্রিটেনকে বলা হয় ‘গণতন্ত্রের সূতিকাগার।’ তারা বিশেষ করে সংসদীয় গণতন্ত্রের মডেল। কিন্তু অতীতে অন্য সব উপনিবেশবাদী ও আধিপত্যকামী রাষ্ট্রশক্তির মতো তারাও তাদের উপনিবেশগুলোতে গণতন্ত্রের বিকাশ চাননি। যতটা গণতন্ত্র ‘দান’ করা হয়েছিল এসব দেশে, তা-ও জনগণের আন্দোলনের চাপে এবং তাদের মেজাজ ঠাণ্ডা করে ও পিঠ চাপড়ে ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ প্রলম্বিত করাই ছিল ‘বিদেশী প্রভু’দের মতলব। আমাদের এ অঞ্চলে প্রধানত ১৯১৯-এর পরে, স্থানীয় সরকারে জনপ্রতিনিধিত্বের সীমিত সুযোগ দেয়ার পথ ধরে নির্বাচনী ব্যবস্থার বিকাশ ঘটেছে। এ জন্য পার হতে হয়েছে নানা বাধা-বিপত্তি ও প্রতিবন্ধকতা। ব্রিটিশ আমল দূরের কথা, তাদের বিদায়ের ২৪ বছর পরে ১৯৭০ সালে পাকিস্তান আমলে এখানে যে প্রথম ও শেষ সাধারণ নির্বাচন হয়েছিল, এর আগে Adult Franchise বা Universal Suffrage (সার্বজনীন ভোটাধিকার) আমাদের দেশে কায়েম হয়নি।

অথচ ‘এক ব্যক্তির এক ভোট’ নীতিকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে অপরিহার্য বলে গণ্য করা হয়। এটাই ভোটের সার্বজনীন অধিকারের বিষয়।
এবার কিছু কথা অতীতের প্রেক্ষাপটে। এগুলো এ দেশে গণতন্ত্রের নামে গলদের নজির মাত্র। সময় থাকতে নেতারা নীতিবান না হয়ে বরং নিজের বা দলের ক্ষমতাকে প্রাধান্য দেয়ার পরিণামে এসব গলদ পরগাছা থেকে মহীরুহে পরিণত হয়েছে। আজ অবস্থা এত চরমে যে, নির্বাচন নিয়ে উৎসব দূরের কথা, কোনো মতে কেন্দ্রে পৌঁছে নিজের ভোট নিজে দেয়ার সুযোগ পাওয়াকে সবচেয়ে বড় সাফল্য মনে করছে গণমানুষ।

যা হোক, অতীত দিনে ফিরে যাই। গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকের কথা। আমার এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় স্মৃতিচারণ করে বলেন, ইউনিয়ন বোর্ডের নির্বাচন উপলক্ষে তার গ্রামের এক মোড়লকে প্রতিপক্ষের লোকজন একটা প্রভাবশালী পরিবারের বাড়িতে আটকে রেখেছিল। ধরে নেয়া যায়, তিনি যাতে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ বা পেশ করতে না পারেন, সে উদ্দেশ্যেই একটি নির্দিষ্ট সময় তাকে আটকে রাখা হয়েছিল। সেই ‘ট্র্যাডিশন’ বাংলাদেশ আমলেও দেখা গেছে। ষাটের দশকে তৎকালীন পাকিস্তানে আইয়ুব খানের শাসনামলে পার্লামেন্ট ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দেয়ার যোগ্যতা ছিল কেবল ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য ও চেয়ারম্যানদের। তাই ভোট বেচাকেনা সহজ হয়ে যায়। বিশেষ করে ১৯৬৫ সালের ২ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত, প্রশ্নবিদ্ধ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ক্ষমতার অপব্যবহার করে আইয়ুব-মোনেম সরকার ইউপি মেম্বার-চেয়ারম্যানদের ভোট কিভাবে বাগিয়েছিল, তা সবার জানা। এর কিছু দিন আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থীদের অনেকে ভোটারের মনোরঞ্জনের জন্য নানা কুপন্থা অবলম্বন করেন। ফলে বহু সৎ ও যোগ্য প্রার্থী পরাজিত হয়েছিলেন।

১০-২০ টাকায় ভোট কেনার বহু অভিযোগ অতীতে বিভিন্ন নির্বাচনে পাওয়া গেছে। নিকট অতীতে ও সাম্প্রতিককালে ক্ষমতার বলে এবং সন্ত্রাস ও কারচুপিতে পারদর্শী ‘ক্যাডার’দের ব্যবহার করে নির্বাচনে ‘বিজয়’ নিশ্চিত করার নজির অনেক। স্বৈরাচারের আমলে এ জন্য ‘হোন্ডা-গুণ্ডা-ডাণ্ডা’কে যথেষ্ট মনে করা হতো। পরবর্তী সময় নির্বাচনী অপকর্মের কৌশল বদলে গেছে অনেকটা। দেখা গেছে, Doctoring আর Engineering -এর অনন্য অপকৌশলে ফলাফল উল্টে দিয়ে গণরায় পাল্টে ফেলা সম্ভব হয়েছে। তখন ভোটকেন্দ্রে দৃশ্যত শান্তিপূর্ণ পরিবেশের মধ্যে যাবতীয় কারসাজি স্বল্প সময়ে সম্পন্ন হয়ে গেছে।

দেশের মানুষ কিছুতেই এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি চায় না। মানুষ চায়, নিজের পছন্দের প্রার্থীকে নির্বিঘেœ ভোট দিতে। নির্বাচন সুষ্ঠু হলে যিনিই জিতুন, তিনি সবার কাছে হবেন গ্রহণযোগ্য। তখন দেশের ভেতরে নিন্দার ঝড় আর বাইরে সমালোচনার বন্যা সৃষ্টি হবে না। কষ্টার্জিত বাংলাদেশের সুনাম নিশ্চয়ই নাগরিকদের

কেউ নষ্ট করতে চান না। সব দল ও সব প্রার্থী বলছেন, তারা গণতন্ত্রের সপক্ষে। তাহলে আর চিন্তা কী? ‘ভোট যার যার- নির্বাচন সবার।’


আরো সংবাদ



premium cement