২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

‘সম্রাজ্ঞী’ অ্যাঞ্জেলা মার্কেল এবং উদ্বাস্তুরা

অ্যাঞ্জেলা মার্কেল -

মার্কেল যে শুধু পার্টি প্রধানের পদ থেকে সরে দাঁড়ালেন তা নয়; তিনি জার্মানির চ্যান্সেলর পদেও আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না। তবে জার্মানির রাজনীতি খুবই বিচিত্র। আগেও কোয়ালিশন ও অন্য দলের সমর্থন চ্যান্সেলর পদে চমক এনেছিল। মার্কেলের বেলায় এমন ঘটার সম্ভাবনা বেশি। কেননা মার্কেল এই পদে ২০২১ সাল পর্যন্ত থাকছেন

বিশ্বের ১০০ ক্ষমতাবান নারীর তালিকায় জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল সবার ওপরে। দ্বিতীয় স্থানে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে। ‘ফোবর্স’ ২০১৮ সালের এক জরিপে এ ফলাফল প্রকাশ করেছে। মার্কেল জার্মানির প্রথম মহিলা চ্যান্সেলর। এক যুগের চেয়েও বেশি সময় তিনি জার্মান রাজনীতির হাল ধরে রয়েছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ইইউ বলতে গেলে জার্মানির কাছ থেকে নির্দেশনা পায়। কেননা জার্মানির অর্থনীতির ভিত এখন ইউরোপের প্রেক্ষাপটে বেশ শক্ত। ১৩ বছর ক্ষমতায় থাকার পর মার্কেল ঘোষণা দিলেন, চ্যান্সেলর হিসেবে তিনি আর নির্বাচনে অংশ নেবেন না। পার্টির নেতৃত্ব থেকেও তিনি সরে গেলেন। জার্মানের লোকজন তাকে জার্মান ভাষায় ‘মুট্রি’ বা মা বলে ডাকেন। তাকে জার্মানির ‘রানী’ আবার কেউ ‘ইউরোপের সম্রাজ্ঞী’ বলে থাকেন। তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মতো কোনো ব্যক্তিত্ব আবির্ভূত হয়নি এ সুদীর্ঘ সময়ে। তিনি বলেছেন, অনেক হয়েছে, অন্যদের সুযোগ দেয়া দরকার।

ইউরোপের সমস্যা এবং এর সমাধান মূলত জার্মানিকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে। জার্মানির নিজের সমস্যাও অনেক আছে; তাকে প্রায়ই ইউরোপের নেতৃত্বের কাতারে দাঁড়াতে হয়। জার্মানির জাতীয় স্বার্থ ও ইউরোপের মহাদেশীয় স্বার্থ দেখতে গিয়ে তাকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে অনেক বিষয়ে দরকষাকষি করতে হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে মার্কেলের চিন্তাভাবনায় স্বকীয়তা রয়েছে। আন্তর্জাতিক বড় বড় ইস্যুতে মার্কেলবিরোধী মনোভাব চাঙা হতেও দেখা গেছে।

২০১৫ সালে উদ্বাস্তু বা অভিবাসী ইস্যুতে পদক্ষেপ নিয়ে মার্কেল ঘরে বাইরে নানা প্রতিবন্ধকতা ও সমালোচনার শিকার হন। সংসার জীবনে অসুখী, সন্তানহীন এ মহিলা লাখ লাখ উদ্বাস্তুর জন্য জার্মানির সীমান্ত খুলে দিয়েছেন। উদ্বাস্তুদের জন্য ‘খোলা দ্বার’ নীতি গ্রহণ এবং এত উদ্বাস্তুর ঢল সামাল দেয়ার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো সরাসরি তার সমালোচনা করেছে।

কিন্তু মার্কেল তার নীতির জন্য প্রশংসা কুড়াতে কোনো প্রপাগান্ডার আশ্রয় নেননি। জার্মানির ভিশন প্রচারের জন্যও তিনি কোনো পদক্ষেপ নেননি। সবসময় তিনি তার অনুসৃত নীতি ও রাজনৈতিক পদক্ষেপের যথাযথ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। যুক্তি দিয়ে তার কাজকে জনসমক্ষে তুলে ধরেছেন। এমন কর্মতৎপরতার ফলে তিনি নিজেকে বিশ্ব নেতৃত্বের অঙ্গনে বড় পারঙ্গম ব্যক্তিত্ব হিসেবে তুলে ধরতে পেরেছেন। আরব বসন্তের সময়ে তিনি বেশি উচ্চবাচ্য করেননি। মিসরে স্বৈরাচারী মোবারকের পতনের পর তিনি আরব বসন্তের ব্যাপারে নিজ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি লিবিয়ার ন্যাটো মিশনে যোগদান থেকে বিরত থাকেন। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান যখন জার্মানিতে জনপ্রিয়তা হারালেন এবং বিরোধী পক্ষ সোচ্চার হয়ে ওঠে তার সমালোচনায়, তখন তিনি সিরিয়ায় তুরস্কের অভিযানের সমালোচনা করেছিলেন মাত্র। মার্কেল বড় মাপের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দেখিয়েছেন আরব বসন্তের সময়। এর পরিণতি ও ভবিষ্যৎ রূপরেখা যেন তিনি আগেই আঁচ করতে পেরেছিলেন। সিরিয়ায় রাসায়নিক অস্ত্র নিয়ে তদানীন্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার সাথে তিনি একমত হননি। কঠিন ব্যক্তিত্বের কারণে ওবামা মার্কেলকে প্রভাবিত করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।

উদ্বাস্তু সমস্যা নিয়ে একজন সত্যিকারের দরদি নেতার মতো মার্কেল আচরণ করেছেন। জার্মানির বিরোধী দল তাকে বারবার চেষ্টা করেছে অপদস্ত করতে। তিনি বলেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ এত বড় ধরনের উদ্বাস্তু সমস্যার সম্মুখীন হয়নি। ইউরোপে এই সমস্যার ভয়াবহ প্রভাব তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। একইভাবে, উদ্বাস্তুর বিশাল স্রোতে থাকা অসংখ্য অসহায় মানুষের প্রতি মানবিক দায়িত্ব তিনি ভুলে যাননি। অথচ পশ্চিমা বিশ্ব এ জন্য তাকে কোনো বাহবা দেয়নি, আজো দিচ্ছে না। তার দলের লোকজনও এ জন্য তার বিরোধিতা করেছে। সামান্য কিছু মানবিক সংগঠন তার অনুকূলে ছিল।

উদ্বাস্তু বিষয়ে ইউরোপীয়দের বিরোধিতা, খ্রিষ্টান-মুসলমান ইস্যু বা ধর্ম প্রসঙ্গ, সাদা-কালো, ধনী-দরিদ্র, চরম ডানপন্থী গ্রুপের প্রবল চাপ এসব বিষয়ের সম্মুখীন হয়েছেন তিনি। ওই সময়েই টলে উঠে তার চ্যান্সেলরের আসন। সমালোচনা করা হলেও উদ্বাস্তু সমস্যার সহজ সমাধান করার উপায় ছিল না। এখনো নেই।

‘মুক্ত বিশ্ব ধারণা’র বড় নেত্রী হিসেবেও মার্কেল পরিচিত। তিনি সব মানুষের জন্য সুন্দর ও বসবাসযোগ্য পৃথিবী গড়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করেছেন। সন্ত্রাসবাদ, বর্ণবাদ ও ইসলামোফোবিয়া তাকে পেছন থেকে টেনে ধরেছে। চলার পথে সাথে সমমনা কোনো বৈশ্বিক নেতা পাননি একসাথে এগিয়ে যাওয়ার মতো। তা হলে হয়তো তার ইতিহাস অন্যরকম হতে পারত। তিনি কোনো চাওয়া পাওয়ার বৃত্তে আবদ্ধ ছিলেন না। এক দশক আগে সৃষ্ট, জার্মানির অথনৈতিক সমস্যার জন্য মার্কেলকে দোষারোপ করা হয়। এমনও বলা হয়েছিল, জার্মানির ভবিষ্যতের জন্য কোনো কাজ তিনি করছেন না।

পাশ্চাত্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর আচরণ দেখে মনে হয়, উদ্বাস্তু সমস্যাকে জিইয়ে রেখে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে নতুন কোনো বিভক্তি ও মেরুকরণের কাজ চলছে, যা এখনো প্রকাশ পায়নি। মার্কেল এই বিষয়টি পছন্দ করেননি। তিনি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে উদ্বাস্তু সমস্যার সুরাহা করতে গিয়ে চরম দক্ষিণপন্থী, উগ্রপন্থী ও ইউনিয়ন প্ল্যানারদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে ফেলেছেন। তিনি উদ্বাস্তু বিষয়ে যেভাবে কাজ করেছেন সেটি যদি কোনো মার্কিন নেতা করতেন তাহলে বিশ্ব হয়তো তাকে প্রশংসা করে এক ধরনের রাজার আসনে বসাত। অথচ উদ্বাস্তুদের শ্রোতকে স্বদেশে আশ্রয় দিয়ে মার্কেল প্রশংসার আসনে বসতে পারেননি।

১০ লাখেরও বেশি উদ্বাস্তু অ্যাঞ্জেলা মার্কেল দেশে আশ্রয় দিয়েছেন। অনেকেই মনে করছেন, এটিই ‘কাল’ হয়েছে তার রাজনৈতিক জীবনে। জার্মানির সাপ্তাহিক দেই জেই সম্প্রতি বলেছে ২০০০ সাল থেকে সম্রাজ্ঞীর মুকুট মাথায় নিয়েছেন যে নারী তিনি উদ্বাস্তুদের আশ্রয়দানের কারণে ‘মুকুটহীন’ হয়েছেন। তার রাজনৈতিক দল ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন যেন তাকে আর বরদাশত করতে পারছে না। হাঙ্গেরিতে যেসব উদ্বাস্তু আটকা পড়ে যায়, তাদের জন্য ত্রাতা হিসেবে তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন। উদ্বাস্তুরা অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সীমান্তে গাড়ি ও ট্রেনে করে এসে জমায়েত হয়। অনেকে টাকার অভাবে যানবাহনে চড়তে না পেরে হেঁটে ওখানে পৌঁছেছে। জার্মানিতে এসব উদ্বাস্তুকে ফুল, পানি ও খাবার দিয়ে গ্রহণ করা হয়েছে।

সিরিয়া ইরাক থেকে যারা গিয়েছে সে দেশে, তারাও সেখানে যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন। তারা মার্কেলকে আরবিতে ‘মামা মার্কেল’ বলে ডেকেছেন। অপর দিকে, ইউরোপের অনেক দেশে উদ্বাস্তুদের জিমনেশিয়াম এবং পরিত্যক্ত ব্যারাকে রাখা হয়েছে। সিরিয়া ও ইরাকি উদ্বাস্তুরা নিজ দেশে অসহায়, দরিদ্র ও ছিন্নমূল নন, বরং সম্পদশালী ও গণ্যমান্য ছিলেন। পাশ্চাত্যের বাধানো যুদ্ধে জীবন বাঁচাতে তারা নিরাপত্তার জন্য বিদেশে পাড়ি দিতে বাধ্য হয়েছেন। সিরিয়া ও ইরাকি উদ্বাস্তুরা ওরকম জায়গায় থাকতে চাননি। তারা মার্কেলের প্রশংসা ও সমালোচনা দুটোই করেছেন। যদি আরো উন্নতভাবে তাদের দেখভাল করা হতো, মনে হয় মার্কেলকে ২০১৬ সালেই বিদায় নিতে হতো বিরোধিতার মুখে। উদ্বাস্তুদের মার্কেল শুধু যে আশ্রয় দিয়েছিলেন তা নয়; মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য তাদের জরুরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করেছিলেন। এরই ফলে গত ৭০ বছরের ইতিহাসে ২০১৭ সালের নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি খারাপ ফল করেছে মার্কেলের ঐতিহ্যবাহী দল। তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নেন রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানোর। এ দিকে, উদ্বাস্তুদের কাছ থেকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ আসতে থাকে এবং চরমপন্থী গোষ্ঠী হামলা চালালে মার্কেল এ ইস্যুতে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন।

মার্কেলের ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন (সিডিইউ) দলের নতুন নেতা যিনি, তিনিও এক মহিলা। সবাই তাকে এ কে কে বলে ডাকেন। তার জার্মান নাম এনগ্রিট ক্রাম্প কারেনবো ‘বিদঘুটে’ বলে সবাই এভাবে তাকে ডাকে। আর তাকে পছন্দ করেছেন মার্কেল নিজেই। পার্টির নির্বাচনী দৌড়ে হেলমুট কোলের মতো প্রবীণ ও প্রভাবশালী নেতাও ছিলেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে ‘পার্টি ফাইন্যান্সের দুর্নীতি’র অভিযোগ ছিল।
মার্কেল যে শুধু পার্টি প্রধানের পদ থেকে সরে দাঁড়ালেন তা নয়; তিনি জার্মানির চ্যান্সেলর পদেও আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না। তবে জার্মানির রাজনীতি খুবই বিচিত্র। আগেও কোয়ালিশন ও অন্য দলের সমর্থন চ্যান্সেলর পদে চমক এনেছিল। মার্কেলের বেলায় এমন ঘটার সম্ভাবনা বেশি। কেননা মার্কেল এই পদে ২০২১ সাল পর্যন্ত থাকছেন। এই সময়টি কম নয়। একেকে কতটুকু পার্টিকে সামাল দেবেন সেটি স্পষ্ট নয়।

তিনি তো আর মার্কেল নন। শুধু জার্মানি নয়, ইউরোপের ইতিহাসেও মার্কেল যেন এক জীবন্ত কিংবদন্তি হয়ে উঠেছেন। এ কে কে একজন ক্যাথলিক খ্রিষ্টান আর মার্কেল প্রটেস্ট্যান্ট। এই দুই খ্রিষ্টান গোষ্ঠীর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সঙ্ঘাত ইউরোপ অতীতে দেখেছে বছরের পর বছর। এ কে কে কনজারভেটিভ ইউরোপীয় নীতির প্রবক্তা। সুযোগ পেলেই তিনি একক সিদ্ধান্ত দিয়ে চমকে দিতে পারেন। অন্য দিকে, মার্কেল খুবই বাস্তববাদী এবং ‘পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে’ পথ চলেন না। নতুন নেত্রী মার্কেলের মতো চুপচাপ থাকবেন না এবং জার্মানি ও ইউরোপের নেতা হিসেবে প্রকাশের জন্য পিছপা হবেন না বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা তা মনে করেন। সুযোগ পেলে তিনি মার্কেলের পথ থেকে সরেও যেতে পারেন।

ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ এনচ পাওয়েল বলেছেন, ‘রাজনীতিবিদরা চলার পথে সুখের সময়ে যদি কেটে না পড়েন, তবে তাদের শেষ পরিণতি হয় দুঃখের।’ মার্কেল সুখের সময়ই সরে দাঁড়ালেন।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব, বাংলাদেশ সরকার ও গ্রন্থকার


আরো সংবাদ



premium cement