২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`
সময়-অসময়

‘লজ্জার’ লজ্জা যখন লজ্জাহীন

‘লজ্জার’ লজ্জা যখন লজ্জাহীন - নয়া দিগন্ত

লজ্জার সীমাবদ্ধতা থাকলেও লজ্জাহীনতার কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। সীমা লঙ্ঘন শুধু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অপরাধ নয়, বরং রাষ্ট্রীয় আইনের পরিপন্থী, যা সমাজবদ্ধ মানুষ পছন্দ করার পরিবর্তে নিন্দা করে থাকে। কিন্তু অস্ত্রের কাছে মানুষ অসহায় যেমনটি হয়েছিল পাক হানাদারদের সময়, এখন আবার তারই পুনরাবৃত্তি চলছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ এখন নির্বাক, নিঃশব্দে নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছে। কারণ, সাংবিধানিকভাবে যাদের কাছে প্রতিকার পাওয়ার কথা; তাদের মিথ্যাবাণীর সীমা এতই অতিক্রম করেছে, যার প্রতি সাধারণ মানুষ কোনো আস্থা রাখতে পারছে না।

শপথ নিয়ে সাংবিধানিক চেয়ারে বসে একজন মানুষ কতটুকু মিথ্যা বলতে পারে, এ অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের মানুষের চেয়ে অন্য কোনো রাষ্ট্রের নাগরিকদের এত হতে পারে না। একজন মানুষ যখন শপথ নিয়ে একটি সাংবিধানিক চেয়ারে বসে মিথ্যার পর মিথ্যা বলতে থাকে, তখন সাধারণ মানুষ বীতশ্রদ্ধ হওয়া ছাড়া বর্তমান প্রেক্ষাপট অনাস্থা দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। যদি থাকত তবে নিশ্চয়ই জনগণ প্রতিকার পাওয়ার চেষ্টা করত।

দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আগাম জামিনের জন্য প্রতিদিন হাইকোর্টে হাজার হাজার লোকের সমাবেশ হয়। সুপ্রিম কোর্টের এনেক্স ভবনের দোতলায় ১২, ১৬, ১৭, ১৮ ও ১৯ নম্বর কক্ষগুলোতে দ্বৈত ক্রিমিনাল বেঞ্চ বসেন। এ বেঞ্চগুলোর বারান্দা দিয়ে লোকসমাবেশের কারণে হাঁটা যায় না। প্রতিদিনের একই চিত্র। একটা মামলায় আগাম জামিন হওয়ার সাথে সাথেই আরেকটি গায়েবি মামলা রুজু করে। অথচ অসত্য ভাষণে পটীয়সী সাংবিধানিক শপথ প্রাপ্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছিলেন, কোনো রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা দেয়া হবে না বা কোনো গ্রেফতার হবে না। অথচ প্রতিদিনই মামলা ও গ্রেফতার হচ্ছে, কিন্তু নির্বাচন কমিশনের তা চোখে পড়ে না। অনর্গল অসত্য কথা যেন নির্বাচন কমিশনের একটি রেওয়াজে পরিণত হয়েছে।

নির্বাচনের প্রচার চলার সময় ডা: কামাল, মির্জা আলমগীরসহ ঐক্যফ্রন্টের বহু প্রার্থীর গাড়ি আক্রমণ ও ভাঙচুর হয়েছে। একজন প্রার্থী গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে শুয়ে আছেন। অনেক প্রার্থী ও সমর্থক নাজেহাল হয়েছেন। এর পরও নির্বাচনে সহিংসতা সহনীয় পর্যায়ে আছে বলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার দাবি করেছেন। আইজিপি বলেছেন, এখন নির্বাচনের চমৎকার পরিবেশ বিরাজ করছে। কী অসত্য কথন। বিএনপি বা শরিক দলের কতজনকে হত্যা করলে বা হামলা করলে বা নির্বাচনী প্রচার ক্যাম্প পুড়িয়ে দিলে বা গাড়ি ভাঙচুর করলে নির্বাচনী সহিংসতা অসহনীয় পর্যায়ে যাবে, নির্বাচনী পরিবেশকে চমৎকার বলে অভিহিত করা যাবে, তার একটি দিকনির্দেশনা প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও আইজিপির দেয়া দরকার। মানুষ যখন মূর্খের মতো কথা বলে তখন অবচেতন মনেই বলতে থাকে। কিন্তু কারো মনোরঞ্জনের জন্য অসত্য বা মিথ্যা বলতে থাকে তখন প্রমাণিত হয়, সে একজন জ্ঞানপাপী। জ্ঞানপাপীরাই নিজ স্বার্থে অনায়াসে মিথ্যা বা অসত্য কথা বলতে অভ্যস্ত।

একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য, ভয়ভীতিহীন জাতীয় নির্বাচন জাতির দীর্ঘ দিনের দাবি এবং এ দাবি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই জাতীয় সঙ্কট নিরসন হতে পারে। পুলিশ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিচার বিভাগ শেখ হাসিনা সরকারকে পুনরায় ক্ষমতায় বসাতে বদ্ধপরিকর। কারণ, ইতোমধ্যে কথা উঠেছে, শেখ হাসিনা পুনরায় ক্ষমতায় না এলে কারো পিঠের চামড়া থাকবে না।

সরকারি ঘরানার কেউ বলছেন, এক লাখ লোক মারা যাবে। আবার কেউ বলছেন, আরো বেশি। সরকারি ঘরানার এই আতঙ্কের পেছনে নিশ্চয়ই তাদের কৃতকর্ম নাড়া দিচ্ছে এবং এই নাড়া থেকেই সরকারি ঘরানার ভীতি সৃষ্টি হওয়ার ফলে যেভাবেই হোক পুনরায় ক্ষমতায় যাওয়ার প্রবল বাসনা থেকে পুলিশ নগ্নভাবে করে বিরোধী দলকে মামলা-মোকদ্দমার ভীতিসহ বিভিন্ন ধরনের ভয়ভীতি, গাড়িবহরে হামলা প্রভৃতি করে আজ দেশব্যাপী একটি ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছে; যাতে ভোটারগণ ভোটকেন্দ্রে যেতে না পারেন। ভোটকেন্দ্রে যেতে পারলে পরিস্থিতি কী হতে পারে তা নিয়ে নিশ্চয়ই এত দিনে সরকারের বোধোদয় হয়েছে।

জনগণ ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে থেকে লাইন ধরে যাতে কাক্সিক্ষত প্রার্থীকে ভোট দিতে পারে, এর বাস্তবসম্মত ভূমিকা রাখার জন্যই কি নির্বাচন কমিশন শপথ নিয়েছিল? কিন্তু তাদের শপথ কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে তা জনগণ অবশ্যই একটি পাল্লায় মূল্যায়ন করবেন। কিন্তু দৃশ্যত মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ আরো একটি একতরফা নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে। তবে প্রতীয়মান হচ্ছে, এ নির্বাচন হবে আরো রক্তক্ষয়ী। কারণ পুলিশ, সরকারি দল ও অন্যান্য বাহিনী বেপরোয়াভাবে সরকারের পক্ষ নিয়েছে, যা তাদের কর্মকাণ্ডে বোঝা যায়।

আমলাদের একমাত্র ভয় গণবিস্ফোরণ, যা এখনো পরিস্ফুটিত হয়নি। তবে সরকারের বাড়াবাড়ি, বিশেষ করে গায়েবি মামলায় প্রতীয়মান হচ্ছে, সরকার স্বস্তিতে নেই। কারণ, তারা যে গণবিচ্ছিন্ন তা তাদের হালনাগাদ কর্মেই প্রকাশ পাচ্ছে। দেশব্যাপী লাখ লাখ নেতাকর্মীর নামে সরকার উৎখাতের জন্য নাশকতার মামলা। ধরে নেয়া যাক, মামলাগুলো সত্য। তবে এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে, দেশব্যাপী লাখো জনতা এ সরকারকে চায় না। যদি তাই হয়, তবে পুনরায় সরকার ক্ষমতায় যাওয়ার ভরসা পায় কোথা থেকে। তাদের একমাত্র ভরসা নির্বাচন কমিশন এবং পুলিশ বা ম্যাজিস্ট্রেট, যার ওপর ভর করে সরকার গায়েবি মামলার ডালা সাজাচ্ছে। এর কৈফিয়ত সরকারকে একদিন না একদিন জনগণের কাছে দিতে হবে।

এ লেখাটি লেখার সময় (গত ১৮ ডিসেম্বর) ঐক্যফ্রন্টের ১৪ জন প্রার্থী কারাগারে, প্রায় ৭০ জনের প্রার্থিতা (কমবেশি হতে পারে) বাতিল হয়েছে, প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় গায়েবি মামলায় হাজার হাজার নেতাকর্মী অভিযুক্ত। এ অবস্থায় ড. কামালের নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্ট প্রতিদিনই প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নিকট ধরনা দিচ্ছে। প্রার্থীরা ঘুরছেন সুপ্রিম কোর্টের বারান্দায়।

একটি প্রবাদ প্রচলিত রয়েছে, নৈতিকতাবিহীন শিক্ষা (উচ্চ ডিগ্রি হলেও) যেমন শিক্ষিত ব্যক্তির মেরুদণ্ড সোজা রাখতে পারে না, ঠিক অনুরূপ ‘লজ্জা মানুষের ভূষণ’ কথাটিও স্বতঃসিদ্ধ প্রবাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। লজ্জাহীন একজন নরনারী যেখানে যা কিছু করতে বা বলতে পারে। যেখানে মিথ্যা বা অসত্য কথা বলা কোনো কারণেই তাদের বিবেককে দংশন করে না।

কারণ, স্বার্থই তাদের মূলকথা যারা লাজলজ্জাহীন হয়ে পড়ে। অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে মানুষ যার চক্ষুলজ্জা রয়েছে, সে ততটা মিথ্যার আশ্রয় নিতে পারে না যতটা পারে একজন লজ্জাহীন মানুষ। যেমন নির্বাচন কমিশনের অন্যতম কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেছেন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড এখনো তৈরি হয়নি। ইতঃপূর্বেও তিনি কমিশনের অনেক সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে ব্যর্থ হয়েছিলেন, কিন্তু চারিত্রিক দৃঢ়তার কারণে প্রতিকূল অবস্থায় থেকেও এটা মাহবুব তালুকদারের পক্ষে সম্ভব হয়েছে।

৪৭ বছর হলো জাতি স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু এখনো ভোটাধিকার বাস্তবায়নের জন্য জাতিকে যুদ্ধ করতে হচ্ছে। কারণ, সরকার অর্থাৎ যে যখন সরকারে থাকে তাকে তুষ্ট করার জন্য রাষ্ট্রীয় যন্ত্র ব্যস্ত থাকে, হোক তা সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। স্বাধীনতা বা দেশপ্রেম একটি ভিন্ন বিষয়। আলেয়া একজন পতিতা ছিল, কিন্তু তার দেশপ্রেম ছিল, যা ছিল না সেনাপ্রধান মীর জাফরের। গোলাম হোসেন একজন নকর (ভৃত্য) হওয়া সত্ত্বেও দেশপ্রেম ছিল, যা ছিল না সিরাজউদ্দৌলার মন্ত্রিসভার অনেক রথী-মহারথীর।

এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে, পদমর্যাদার সাথে দেশপ্রেমের কোনো সম্পর্ক নেই। এটি নির্ভর করে মেরুদণ্ডের শক্তির ওপর। অন্য দিকে যে নির্লজ্জের মতো মত প্রকাশ করে তার মেরুদণ্ড সোজা থাকতে পারে না। ফলে ভিকটিম হয় জাতি ও জনগণ। মিথ্যা যখন সত্যের সাথে পাল্লা দেয় তখন এর পরিণতির জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া নিরস্ত্র জাতির কাছে তাৎক্ষণিক প্রতিকারের রাস্তা খোলা থাকে না।

লেখক : কলামিস্ট ও আইনজীবী
(অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail: taimuralamkhandaker@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement