২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র

-

যখন থেকে সরকারি দল নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলে আসছে, ঠিক তখন থেকেই নির্বাচনের ধরন-ধারণ ও বিষয়-বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। সরকারি দল যেভাবে সংবিধান সংশোধন করে ক্ষমতায় থাকার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করেছে, তাতে নির্বাচনের আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।

যেমন- ১. তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বিলোপ, ২. সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন করা, ৩. নির্বাচনকালীন সরকারের কোনো অস্তিত্ব না থাকা, ৪. ক্ষমতায় থেকেই নির্বাচন করা, ৫. নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সরকারের পক্ষে ব্যবহার করা ইত্যাদি। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পাঁচ বছর পর আরেকটি নির্বাচন সাংবিধানিকভাবে প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তখন তারা যেমন বলেছিল ‘সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার নির্বাচন’।

এবারো তেমন করেই তারা নির্বাচনের কথা বলছে। কিন্তু আমার বুদ্ধিতে কুলোয় না যে, তারা খামাখা কেন এ নির্বাচনের তামাশা করতে চায়। এর চেয়ে বরং বাকশাল বা এ রকম কোনো ব্যবস্থা তারা বেছে নিতে পারত। দেশটি যখন তাদের, সুতরাং নির্বাচনের দরকার কী? একটি অধ্যাদেশ অথবা জরুরি অবস্থা অথবা চিরস্থায়ী সংসদ করে নিতে পারলে আমজনতা তাদের পৈশাচিক অত্যাচার থেকে রক্ষা পায়।

নির্বাচনী প্রচারণার প্রথম দিনেই সারা দেশে তারা যে তাণ্ডব ঘটিয়েছে, তা তাদের বহুল কথিত নীলনকশার প্রমাণ দেয়। তারা ২০১৪ সালে যেভাবে ভোটারবিহীন, প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন, কারসাজির নির্বাচন করেছিল; সেটিরই মহড়া হয়ে গেল প্রচারণার প্রথম দিনে। গোটা দেশের ৩০০ নির্বাচনী এলাকার এমন কোনো এলাকা বাদ যায়নি, যা আওয়ামী হামলাকারীদের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে।

এ নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত তাদের নিয়ন্ত্রিত চ্যানেলগুলোতে যে সীমিত সংবাদ আসছে, তা অত্যন্ত ভয়াবহ। এসব হামলায় অন্তত দু’জন নিহত, কয়েক শ’ আহত এবং আরো কয়েক শ’ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। নির্বাচনের শুরুতেই তারা এই হামলা-মামলা ও নিপীড়ন-নির্যাতন চালিয়ে নির্বাচন জয়ের রণকৌশল নির্ধারণ করে। আবারো উল্লেখ করা প্রয়োজন, প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠিত সংলাপে আর হামলা ও মামলা হবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সে দিন বলেছেন, এখন নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনায় সরকার চলছে। তাহলে নির্বাচনী প্রচারণার প্রথম দিনে যে হত্যা, নির্যাতন ও হামলার ঘটনাগুলো ঘটেছে তা কি নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে হয়েছে?

অবশ্য নির্বাচন কমিশন এখন পর্যন্ত তাদের কর্তৃত্বের নমুনা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। সিইসি নুরুল হুদা ১১ ডিসেম্বর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের সমাবেশে খুব কঠিন করে আইনের প্রয়োগের কথা বলেছেন। এর আগেও তিনি এ রকম কঠিন কঠিন কথা বলে জাতিকে আশ^স্ত করেছেন।

মনে পড়ে, কয়েক মাস আগে তিনি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের প্রশংসা করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল তার সম্পর্কে বিএনপির নেতিবাচক ধারণার পরিবর্তন করা। তিনি আওয়ামী লীগের এক শ’ গুণ প্রশংসা করে ওই ক্ষত পুষিয়ে নিয়েছিলেন। নির্বাচনী প্রচারণা শুরুর পরপরই সিইসি তার দাঁত বের করতে শুরু করেছেন। ক. তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের নীলনকশা অনুযায়ী সাজানো প্রশাসনিক কাঠামো পুনর্বিন্যাস অস্বীকার করেন।

খ. বিএনপি ৭০ জন দলবাজ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি। গ. তার নির্দেশিত ডিসি তথা রিটার্নিং অফিসারদের আচরণ দেখে মনে হয়, এরা লজ্জা-শরমের মাথা খেয়েছেন। দু’টি নির্বাচনী এলাকায় প্রার্থীর মনোনয়নপ্রত্র গ্রহণে অস্বীকার তার প্রমাণ। তারা ‘ওপরের নির্দেশ’ বলে পার পেতে চেয়েছেন। কিন্তু কোনো দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ এটা করতে পারে ভাবতেও লজ্জা হয়। ঘ. মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই করতে গিয়ে তারা কী প্রমাণ রেখেছেন? তা ব্যাখ্যা করার অবকাশ রাখে না। ঙ. এ দেশের আদালত কী রকম- তা তাদের কাজ দেখেই বোঝা যায়। দুই পক্ষের জন্য দুই ধরনের রায় বিচারকদের নিরপেক্ষতার প্রমাণ দেয় না।

সাধারণ মানুষ যে আশঙ্কা ও আতঙ্কের কথা আঁচ করেছিল তা সত্য প্রমাণিত হয়েছে। প্রচারণার প্রথম দিনেই মির্জা ফখরুলের গাড়িবহরে ক্ষমতাসীন দলের গুণ্ডারা হামলা করেছে। কুমিল্লায় খন্দকার মোশাররফের নির্বাচনী কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়েছে। খন্দকার মোশাররফ পুলিশের মদদে এসব হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন। নোয়াখালীর কবিরহাটে মওদুদ আহমদের নির্বাচনী মিছিলে হামলা হয়েছে। সেখানে হতাহতের খবর পাওয়া গেছে। চট্টগ্রামে আমীর খসরু মাহমুদের মিছিলে হামলা হয়েছে। তিনি অভিযোগ করেছেন সরকার সব এজেন্সি নিয়োগ করে নির্বাচনী ফলাফল নিজের পক্ষে নেয়ার চেষ্টা করছে। রাজশাহীতে মিজানুর রহমান মিনু আক্রান্ত হয়েছেন। দেশের গ্রামগঞ্জের খবরও ভিন্নতর কিছু নয়। পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালিতে বিএনপি প্রার্থী এ বি এম মোশাররফের মিছিলে আওয়ামী রামদাবাহিনী হামলা চালায়। পুলিশের প্রচ্ছন্ন সহযোগিতায় এ হামলা সংঘটিত হয়। বিএনপি প্রার্থী পুলিশের নিরাপত্তা চাইলে বরং বিরূপ আচরণের সম্মুখীন হন।

ঢাকায় বিএনপির নেতাকর্মীদের বাসায় বাসায় পুলিশ হানা দেয়। ঢাকার অন্যতম প্রার্থী মির্জা আব্বাস, মিসেস আব্বাস এবং শামীমা অভিযোগ করেন, তারা এবং তাদের কর্মীরা পুলিশি হয়রানির সম্মুখীন হচ্ছেন। মির্জা আব্বাস মন্তব্য করেন, নির্বাচন থেকে সরে যেতে বাধ্য করার জন্যই এসব করা হচ্ছে। এ ছাড়া, নির্বাচনী প্রচারণার প্রথম দিনেই পুলিশ অনেক নেতাকর্মীর নামে নতুন নতুন মামলা দিয়ে হামলা ও গ্রেফতার করছে। ১১ ডিসেম্বর প্রচারিত সর্বশেষ খবর অনুযায়ী ফরিদগঞ্জ, রাজাপুর, আলমগঞ্জ, কোম্পানীগঞ্জ, বেগমগঞ্জ এবং নড়াইলে মামলা দিয়ে পুলিশ বিএনপির নির্বাচনী নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করেছে। একই সময়ে চ্যানেলে দেখা গেল, গোপালগঞ্জের ডিসি প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী প্রচারণা জনসভার কথা প্রচার করছেন। এই সময়ে তিনি কি তা পারেন?

২০১৪ সালে বিএনপি নির্বাচনে না যাওয়ায় আওয়ামী লীগ খালি মাঠে গোল দেয়। এবারো তাদের মনের আশা ছিল ছলে-বলে, কলে-কৌশলে বিএনপিকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখা। এ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তারা বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ মামলা দিয়ে সাজা দেয়, যাতে তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না পারেন বা বিএনপির নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব না দিতে পারেন। বিএনপির শীর্ষ নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়। যাতে তারা নতি স্বীকার করেন। তাদের কথামতো বিএনপিকে ভেঙে নতুন বিএনপি সৃষ্টি করে নির্বাচনী প্রতারণা সফল করতে পারেন। বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে হাজার হাজার মামলা দেয়া হয়েছে। আসামি লাখ লাখ। আটক রয়েছে কয়েক লাখ। আর শাসক দলের মতলব হাসিলের লক্ষ্য হলো নিপীড়ন ও নির্যাতনের মাধ্যমে বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া।

এত কিছুর পরও বিএনপি মাটি কামড়ে মাঠে থাকছে- এটা আওয়ামী লীগের কাছে বিস্ময়ের ব্যাপার। আগেই খবর ছিল, আওয়ামী লীগ নির্বাচন কেন্দ্রভিত্তিক কাজ শুরু করেছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে জানা গিয়েছিল, পুলিশ প্রিজাইডিং ও পোলিং অফিসারদের বায়োডাটা নিচ্ছে। এদের মধ্যে যারা নিরপেক্ষ অথবা বিরোধী মনা- তাদের বাদ দিয়ে দিচ্ছে। প্রিজাইডিং ও পোলিং অফিসারদের কোনো কোনো ক্ষেত্রে কায়দা করে নগদ অর্থ প্রদান করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া, বিরোধী প্রার্থীদের সম্ভাব্য পোলিং এজেন্টরা যাতে কেন্দ্রে না আসেন, সে জন্য তাদের নামে আগে থেকেই মামলা দিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাদেরকে অর্থের বিনিময়ে হলেও পক্ষপুটে নিতে চেষ্টা করছে সরকারি দলের লোকেরা। স্থানীয় নির্বাচিত ব্যক্তিত্ব চেয়ারম্যানদের ডেকে থানার ওসি বিরোধী পক্ষে কাজ না করার ব্যাপারে শাসিয়ে দিচ্ছে। নির্বাচন কেন্দ্রে যাতে আইন প্রয়োগকারীরা সরকারের এজেন্ট হিসেবে কাজ করে, সে জন্য নির্দেশনার সাথে সাথে অর্থসুবিধা দেয়ার পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে।

তবে এতসব করেও যে পার পাওয়া যাবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই নির্বাচনী প্রচারণার প্রথম দিনেই হিংসা ও হিংস্রতা ছড়িয়ে প্রতিপক্ষকে সাবধান করে দিচ্ছে আওয়ামী লীগ। এর বিপরীতে গ্রেফতার বা মামলার আসামি না হয়ে নীরবে-নিভৃতে কাজ করার কৌশল নিয়েছে বিএনপি। এই কৌশল সাধারণ মানুষকে যেমন আশ^স্ত করছে, তেমনি সবাইকে সাহস দিচ্ছে। বাংলাদেশে ভোটযুদ্ধের একটি সাধারণ স্লোগান হচ্ছে- ‘আমার ভোট আমি দেবো, যাকে খুশি তাকে দেবো’। এখন আওয়ামী লীগের কল্যাণে স্লোগানটি এমন হচ্ছে- ‘আমার ভোট আমি দেবো, তোমার ভোটও আমি দেবো’। ১০ বছর ধরে মানুষ নিজের ভোট নিজে দিতে পারে না। মানুষের ধৈর্য ও সহ্যের সীমা অতিক্রান্ত হয়েছে। এবার যদি মানুষ ক্ষেপে যায় আর নিজের ভোট নিজে দিতে চায়, তাহলেই তাদের সর্বনাশ। তাদের কোনো ফন্দি কাজে আসছে না। বুমেরাং হতে পারে সব কিছু। সে জন্য আওয়ামী লীগ মরিয়া হয়ে সন্ত্রাস-সহিংসতা সৃষ্টি করে নির্বাচনটি বানচাল করে দিতে চায়। আর আগের স্টাইল মতো সব দোষ বিএনপির ঘাড়ে চাপানোর ষড়যন্ত্র করছে। তাই ষড়যন্ত্রকে রুখে দিয়ে সবার উচ্চারণ হোক- ‘যদি ভয় পাও তবে তুমি শেষ, যদি রুখে দাঁড়াও তবে তুমি বাংলাদেশ।’
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement