২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

আত্মহত্যা পাপ হলেও অপরাধ নয়

-

আত্মহত্যাকে ইংরেজিতে বলা হয় ‘সুইসাইড’। ল্যাটিন শব্দ ‘সুইসাইডিয়াম’ থেকে ইংরেজি ‘সুইসাইড’ শব্দটির উৎপত্তি। সুইসাইডিয়াম অর্থ নিজেকে হত্যা করা। আত্মহত্যার প্রতিশব্দ হলো আত্মহনন। ল্যাটিন সুইসাইডিয়াম শব্দটির ন্যায় ইংরেজি সুইসাডাড ও বাংলা আত্মহত্যা শব্দ একই অর্থ প্রকাশ করে। একজন ব্যক্তির স্বেচ্ছায় নিজের প্রাণনাশের প্রক্রিয়া হচ্ছে আত্মহত্যা। এ প্রক্রিয়ায় একজন ব্যক্তি নিজের ইচ্ছায় নিজের জীবন বিসর্জন দেয়।

আত্মহত্যার মাধ্যমে একজন ব্যক্তির প্রাণনাশ ঘটলে তার সাথে ইহজগতের কোনো কিছুর সম্পর্ক থাকে না। আর এ কারণে আত্মহত্যাজনিত কারণে যে ব্যক্তির মৃত্যু ঘটে তাকে বিচারের আওতায় এনে শাস্তি দেয়া যায় না। যেকোনো অপরাধীর অপরাধ সংশ্লেষে বিচার চলমান থাকাবস্থায় তার মৃত্যু ঘটলে মৃত্যুর সাথে সাথে তার অপরাধেরও মৃত্যু ঘটে। এরূপ মৃত্যুপরবর্তী একজন অপরাধীর নাম অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেয়া হয়।

চিকিৎসাশাস্ত্র মতে, আত্মহত্যা মানসিক অবসাদজনিত একধরনের উপসর্গ। আমাদের ইসলাম ধর্মসহ অপরাপর কিছু ধর্মমতে আত্মহত্যা পাপ। আত্মহত্যা অপরাধ না হলেও আত্মহত্যার চেষ্টা বা আত্মহত্যায় প্ররোচনা অপরাধ।
মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল-কুরআনের সূরা নিসার ২৯ নম্বর আয়াতে আত্মহত্যা বিষয়ে বলা হয়েছে- ‘নিজেকে হত্যা করো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমার প্রতি অসীম দয়াশীল।’

আত্মহত্যা বিষয়ে বুখারি শরিফের হাদিসে বর্ণিত হয়েছে- ‘যে নিজেকে গলাটিপে হত্যা করে সে চিরতরে দোজখের আগুনে নিজেকে হত্যা করতে থাকবে এবং যে ছুরিকাঘাতে নিজেকে হত্যা করে সে দোজখের আগুনে নিজেকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করতে থাকবে।’
ইহুদিদের ধর্মমতে আত্মহত্যা একটি জঘন্য ধরনের পাপ। এটি এমন একটি কাজ যা মানবজীবন যে স্বর্গীয় দান তা অস্বীকার করে এবং মনে করা হয় এটি সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত জীবনকালকে সংক্ষিপ্ত করার জন্য তার মুখমণ্ডলে চপেটাঘাত।

খ্রিষ্টানদের বাইবেল আত্মহত্যা নিষিদ্ধ বিষয়ে স্পষ্টভাবে কোনো কিছু বলা না হলেও রোমান ক্যাথলিক চার্চের ধর্মতত্ত্ব মতে, আত্মহত্যা নিরপেক্ষভাবে একটি পাপ যা নিজেকে হত্যা না করার নৈতিক আদেশের লঙ্ঘন।
বৌদ্ধদের ধর্মমতে আত্মহত্যাকে নেতিবাচক কাজ গণ্যে জীবননাশ হতে নিজেকে বিরত রাখতে বলা হয়েছে।

হিন্দু ধর্মমতে আধ্যাত্মিকভাবে আত্মহত্যা অগ্রহণযোগ্য। সাধারণভাবে ধর্মটিতে আত্মহত্যাকে অহিংস আচরণের লঙ্ঘন বিবেচনা করা হয় এবং সে কারণে আত্মহত্যাকে অপরকে হত্যা করার মতো সমধরনের পাপ বিবেচনা করা হয়। তাদের কিছু ধর্মশাস্ত্রে আত্মহত্যার মাধ্যমে মৃত্যুর পরিণতি হলো দানবরূপে আবির্ভাব।

আমাদের মূল ‘দণ্ডআইন’ দণ্ডবিধি, ১৮৬০ এর ধারা নং ৩০৫ এ বলা হয়েছে- কোনো শিশু বা উন্মাদ বা বিকারগ্রস্ত বা জড় বুদ্ধিসম্পন্ন বা নেশাগ্রস্ত ব্যক্তিকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা বা সহায়তা করলে ওই ব্যক্তি (প্ররোচনাকারী বা সহায়তাকারী) মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে বা অনধিক ১০ বছর মেয়াদি কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবে।

দণ্ডবিধির ধারা নং ৩০৬ এ বলা হয়েছে- একজন ব্যক্তির প্ররোচনা বা সহায়তায় অপর কোনো ব্যক্তি আত্মহত্যা করলে ওই ব্যক্তি (প্ররোচনাকারী বা সহায়তাকারী) অনধিক ১০ বছর মেয়াদি কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে।
দণ্ডবিধির ধারা নং ৩০৯ আত্মহত্যার চেষ্টা বিষয়ক। এ ধারাটিতে বলা হয়েছে- কোনো ব্যক্তি আত্মহত্যার চেষ্টায় অনুরূপ অপরাধ সংঘটনের অভিপ্রায়ে কোনো কাজ করলে ওই ব্যক্তি অনধিক এক বছর মেয়াদের বিনাশ্রম কারাদণ্ডে বা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে।

চিকিৎসাশাস্ত্রে আত্মহত্যাকে মানসিক উপসর্গ বলা হলেও মনোবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, আত্মহত্যার নানাবিধ কারণ রয়েছে। দরিদ্রতার কারণে পিতা বা মাতা পৃথকভাবে বা সন্তানসহ আত্মহত্যা করার ঘটনা সংঘটিত হতে দেখা যায়। অপমান, অভিমান ও বিফলতা অনেক সময় আত্মহত্যার কারণ হিসেবে দেখা দেয়। অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে এমন ঘটনা সব যুগ ও সমাজে প্রত্যক্ষ করা যায়। অভিমানের কারণে আত্মহত্যা বিরল ঘটনা নয়। মনের আশা বা চাহিদা পূরণ না হলে অভিভাবকের ওপর অভিমান করে আত্মহত্যা করার প্রবণতা লক্ষণীয়। বিফলতা অনেক সময় আত্মহত্যার কারণ হিসেবে দেখা দেয়। বিফলতার কারণে বর্তমানে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা বেড়ে গেছে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা কাক্সিক্ষত ফলাফল অর্জনে ব্যর্থ হয়ে, যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও চাকরি না পেয়ে, অভিভাবকের আশানুযায়ী ফলাফল দিতে না পেরে, অভিভাবকের শাসন, ভর্ৎসনা ও তিরস্কারের ভয় প্রভৃতি কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়ার এমন ঘটনা পত্রপত্রিকার পাতা খুললে বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সুবাদে জানার সুযোগ ঘটে।

শিশু ও তারুণ্যে উপনীত শিক্ষার্থীরা আবেগপ্রবণ হয়ে থাকে। একটি শিশু ও তরুণ-তরুণী বাব-মায়ের মানসিক চাপের পর নিজের শত চেষ্টা সত্ত্বেও যখন তাদের আশানুযায়ী ফলাফল দিতে ব্যর্থ হয় তখন এ ধরনের শিশু ও তরুণ-তরুণীদের আত্মহননের মাধ্যমে নিজের জীবননাশের পথ বেছে নেয়ার এমন ঘটনার তীব্রতা ইদানীংকালে বেড়ে চলেছে।

প্রতিটি শিক্ষার্থীর মেধা, যোগ্যতা ও দক্ষতা সমমানের নয়। এমন অনেক শিক্ষার্থী রয়েছে যারা প্রকৃতিগতভাবেই মেধাবী। এদের কোনো বিষয়ে ভালো ফলাফল করতে হলে খুব বেশি পরিশ্রম করতে হয় না। আবার অনেককে দেখা যায় শত পরিশ্রম করেও ভালো ফলাফল দিতে পারে না। পিতা-মাতা, অভিভাবক, গুরুজন বা শিক্ষকদের একজন শিক্ষার্থীর কাছে এমন কিছু প্রত্যাশা করা উচিত না যা শত চেষ্টা সত্ত্বেও সে দিতে অক্ষম। চেষ্টা করার জন্য একজন শিক্ষার্থী প্রশংসার দাবিদার কিন্তু চেষ্টার পর বিফলতায় প্রশংসার বিপরীতে তিরস্কার বা ভর্ৎসনা শুনতে হলে তা তার উদ্যমের মধ্যে ভাটার সৃষ্টি করে। এ ভাটা ক্রমান্নয়ে তাকে হতাশার দিকে নিয়ে যায়। এরূপ হতাশ অবস্থায় নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললে জীবননাশের মাধ্যমে পরিত্রাণ পেতে চায়।

একটি শিশু পারিবারিক গণ্ডির মধ্যে নীতি ও নৈতিকতার শিক্ষা লাভ করে। পারিবারিক পরিমণ্ডলেই শিশুরা ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান লাভ করে। প্রতিটি ধর্ম তো একজন মানুষকে সত্য ও ন্যায়ের পথে চলার দিকনির্দেশনা দেয়। পরিবার, সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একটি অপরটির পরিপূরক। একটি শিশুকে প্রকৃত অর্থেই নীতি, নৈতিকতা ও মানবিক গুণাবলি সম্পন্ন নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হলে পরিবার, সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এ তিনটির কোনোটির অবদানকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাঁধের ওপর মানুষ গড়ার দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে অভিভাবক ও সমাজপতিরা তাদের দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারেন না।

বর্তমানে মাধ্যমিক পূর্ববর্তী শিক্ষা বোর্ডের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণে যে দু’টি গণপরীক্ষার প্রবর্তন করা হয়েছে তা শিশুদের চেয়ে তাদের অভিভাবকদের অধিক প্রতিযোগী করে তুলেছে। এ দু’টি পরীক্ষার যেকোনো একটিতে একটি শিশু অভিভাবকের আকাক্সক্ষা অনুযায়ী ফলাফল অর্জন করতে না পারলে অভিভাবকরা হতাশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। তাদের এ ধরনের হতাশা শিশুর কোমল মনে দাগ কাটে যা পরিণামে তার বিকাশে অন্তরায় হয়ে দেখা দেয়। কিন্তু আমাদের অভিভাবকরা এ বিষয়টিকে কখনো গুরুত্বের সাথে না দেখে যেকোনো পন্থায় শিশু যেন তাদের কাক্সিক্ষত ফলাফল দিতে পারে তা গ্রহণের প্রয়াস নেয়। এ প্রয়াসের অংশ হিসেবে দেখা যায় পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে অভিভাবকদের অনেকেই তা সংগ্রহে অর্থব্যয়ে কখনো দ্বিধাগ্রস্ত হন না।

শিশুদের হাতে মোবাইল দিলে তাদের বিপথগামী হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে এ বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে মাধ্যমিক অবধি এবং ক্ষেত্রবিশেষে উচ্চ মাধ্যমিক অবধি শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে অবস্থানকালীন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে মোবাইল ফোন ব্যবহারে বিধিনিষেধ রয়েছে। এর পরও দেখা যায় অনেক শিক্ষার্থী লুকিয়ে বা গোপনে মোবাইল নিয়ে স্কুলে প্রবেশ করে। এ মোবাইলের মাধ্যমে নগণ্যসংখ্যক শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের সুযোগের পথ বেছে নেয়। বিভিন্ন সময় দেখা যায় স্কুল কর্তৃপক্ষের নজরে আসামাত্রই এগুলো জব্দ করে দায়ী শিক্ষার্থীর কৈফিয়ত চাওয়া হয়। দেশের প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কঠোরতার সাথে মোবাইল নিয়ে না আসার নির্দেশনা যেন সঠিকভাবে প্রতিপালন হয় তা প্রয়োগে প্রত্যয়ী হলেও মাঝে মাঝে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মোবাইল আটকের ঘটনা কার্যক্রমটি শতভাগ বাস্তবায়ন না হওয়ার বার্তা দেয়। এ কার্যক্রম বাস্তবায়নে অভিভাবকদের ভূমিকা অপরিসীম। একজন শিশু শিক্ষার্থীর কাছে স্কুলের অভ্যন্তরে অবস্থানকালীন বা স্কুলের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করাকালীন অসদুপায়ের অবলম্বন হিসেবে মোবাইল পাওয়া গেলে তার দায়িত্ব অভিভাবকেরা এড়াতে পারেন না।

অনেক অভিভাবক তাদের অতিরিক্ত প্রত্যাশার চাপে সন্তানের জীবন দুর্বিষহ করে তুলছেন এবং এ প্রত্যাশা পূরণে সন্তানকে অনৈতিক পথে পা বাড়াতে বাধা দেয়ার পরিবর্তে উৎসাহ জুগিয়ে থাকেন। মোবাইল বা মোবাইলের আগমন পূর্ববর্তী অন্য কোনোভাবে পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন করলে যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কার করা হয় এটি দীর্ঘ দিনের অনুসৃত নীতি। এটি জানার পরও কোনো অভিভাবক তাদের সন্তানের অসদুপায় অবলম্বনের দায় শিক্ষকদের ওপর যদি চাপানোয় ব্রতী হন তা গভীর দুঃখ ও মর্মবেদনার বিষয়। এ ধরনের ঘটনায় কখনো দুঃখজনকভাবে কেউ যদি আত্মহননের মাধ্যমে নিষ্কৃতি চায় তবে তার দায়ভার যতটুকু না অভিভাবকের ওপর এর অত্যল্প অংশ অন্য সবার।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
iktederahmed@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement
আওয়ামী লীগকে ‘ভারতীয় পণ্য’ বললেন গয়েশ্বর দক্ষিণ আফ্রিকায় সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে দাগনভুঞার যুবক নিহত কাশ্মিরে ট্যাক্সি খাদে পড়ে নিহত ১০ অবশেষে অধিনায়কের ব্যাপারে সিদ্ধান্তে পৌঁছল পাকিস্তান জাতিসঙ্ঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থাকে আবার অর্থায়ন শুরু করবে জাপান শেখ হাসিনার অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি বিএনপিকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে : ওবায়দুল কাদের রাশিয়া সমুদ্র তীরবর্তী রিসোর্টে ১৬.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে সিরিয়ায় ইসরাইলি হামলায় নিহত ৩৬ সেনা সদস্য দৌলতদিয়া ঘাটে পন্টুন থেকে নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু অ্যানেসথেসিয়ার পুরনো ওষুধ বাতিল করে কেন নতুনের জন্য বিজ্ঞপ্তি! বাইডেনের মেয়াদে রুশ-মার্কিন সম্পর্কের উন্নতির কোনো আশা নেই : রুশ রাষ্ট্রদূত

সকল