২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ভোটের আগে বিবিধ প্রসঙ্গ

ভোটের আগে বিবিধ প্রসঙ্গ - ছবি : সংগৃহীত

আজকের পৃথক রাষ্ট্র বাংলাদেশের উদ্ভব হয়েছে সাবেক পাকিস্তান রাষ্ট্র বিভক্ত হয়ে। সাবেক পাকিস্তান রাষ্ট্রের উদ্ভব হতে পেরেছিল মুসলিম জাতীয়তাবাদকে (Muslim Nationalism) নির্ভর করে। মুসলিম জাতীয়তাবাদের উদ্ভব হয়েছিল এই উপমহাদেশের হিন্দু জাতীয়তাবাদ তথা হিন্দুত্বের প্রতিক্রিয়া হিসেবে। এই হিন্দুত্ববাদ এই উপমহাদেশে বিশেষ শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল ব্রিটিশ শাসনামলে। মুসলিম শাসনামলে এই হিন্দুত্ববাদ যে ছিল না, তা নয়। কিন্তু যেহেতু রাষ্ট্রক্ষমতা ছিল মুসলিম নৃপতিদের হাতে, তাই মুসলমানকে হিন্দুরা কিছু সমীহ না করে পারতেন না। কিন্তু যেহেতু ব্রিটিশ শাসনামলে রাষ্ট্রক্ষমতা চলে যায় মুসলমানদের হাত থেকে ইংরেজদের হাতে আর ইংরেজরা চাচ্ছিলেন হিন্দুদের বিশেষ সহায়তায় এ দেশ শাসন করতে, তাই হিন্দুত্ববাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এখন ব্রিটিশরাজ আর নেই।

এখন ভারতে হিন্দুত্ববাদ আরো তীব্র আকার ধারণ করেছে। কারণ রাষ্ট্রক্ষমতা এখন হিন্দুদের হাতে। বিজিপির নেতারা হুমকি দিচ্ছেন বাংলাদেশে নাকি হিন্দুদের ওপর অত্যাচার করা হচ্ছে। ভারত প্রয়োজনে বাংলাদেশে হিন্দুদের রক্ষা করার জন্য সৈন্য পাঠাতে বাধ্য হবে। এ ছাড়া ভারতের আসাম প্রদেশ থেকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত বিজিপি সরকার বলছে, ১৩ লাখ বাংলাভাষী মুসলমানকে বাংলাদেশে তাড়িয়ে দেয়ার কথা। যেটা করলে বাংলাদেশের সৃষ্টি হবে বিরাট এক মানবিক বিপর্যয়। এ রকম অবস্থায় হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন। বাংলাদেশে আবার হতে যাচ্ছে মুসলিম জাতীয়তাবাদের উদ্ভব; এই হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রতিক্রিয়া হিসেবে।

একে কোনোভাবেই বলা চলে না একটি ধর্মভিত্তিক আবেগ। একে বলতে হয় বাংলাভাষী মুসলমানের আত্মরক্ষার এক বিশেষ প্রয়াস। আসলে যাকে এই উপমহাদেশে বলা হয় মুসলিম জাতীয়তাবাদ, তা কখনই ছিল না একটি ধর্মভিত্তিক আবেগ। ১৯০৯ সালে তখনকার বিলাতের প্রধানমন্ত্রী হার্বাট হামফ্রে অ্যাস্কুইথ ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাউজ অব কমন্সে বলেন, ভারতের মুসলমানেরা হলেন একটি স্বতন্ত্র জাতি। এর ভিত্তি হলো একটি পৃথক ইতিহাসের ধারা। কেবল ধর্মবিশ্বাস নয়। ১৯০৯ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট যে Indian Councils Act পাস করে, তাতে মুসলমানদের দেয়া হয় স্বতন্ত্র নির্বাচনের অধিকার। এর ফলে তখনকার বাংলাদেশের আইন পরিষদে মুসলমানেরা পান পাঁচটি স্বতন্ত্র আসন। যাতে কেবল মুসলমানেরাই দাঁড়াতে পারতেন এবং মুসলমান ভোটারদের ভোটে নির্বাচিত হতেন। এ ছাড়া মুসলমানেরা অন্য আসনেও দাঁড়াতে পারতেন এবং সেখানে নির্বাচনে তাদের পেতে হতো অমুসলমানদেরও ভোট। এভাবে ব্রিটিশ শাসনামলে রাজনীতিতে আসতে পারে মুসলিম জাতীয়তাবাদের ধারণা এবং পেতে পারে রাষ্ট্রনৈতিক স্বীকৃতি।

হিন্দু মুসলমান বিরোধ সৃষ্টির একটি বিশেষ কারণ ছিল। মুসলমানদের হিন্দুরা ভাবতেন ম্লেচ্ছ বা অশূচি। তাদের ছোঁয়া লাগলে তারা গঙ্গার পানিতে স্নান করে নিজেদের শূচিতা ফিরে পেতে চাইতেন। খ্রিষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীতে ইব্নে বতুতা এসেছিলে ভারত পর্যটনে। তিনি এসেছিলেন সুদূর মরোক্কো থেকে। তিনি তার ভ্রমণবৃত্তান্তে লিখেছেন, তৃষ্ণার্ত মুসলমান পথিক পানি পান করতে চাইলে হিন্দুরা তা দেন না। কেননা তারা ভাবেন এর ফলে তাদের বাসন অপবিত্র হবে। বতুতা বাংলাদেশেও এসেছিলেন। বাংলাদেশের অনেক প্রগতিশী বুদ্ধিজীবী এখন প্রমাণ করতে চাচ্ছেন না, মুসলমানদের ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণে এই উপমহাদেশে সৃষ্টি হতে পেরেছিল হিন্দু-মুসলমান বিরোধ। কিন্তু তারা হিন্দু ধর্মের গোঁড়ামিকে মনে হয় চাচ্ছেন না বিবেচনায় নিতে। ১৯৯২ সালে ভারতে উত্তর প্রদেশে হিন্দুরা ভাঙলেন বাবরি মসজিদ। সেটা নাকি ছিল একসময় রামমন্দির। সেটা একসময় রামমন্দির ছিল, তার প্রমাণ হিসেবে বলা হলো, মাটি ফুঁড়ে মসজিদের মেহেরাবের কাছে উঠেছে রামমূর্তি।

কাহিনীটা বিশ্বাস করলেন উচ্চশিক্ষিত হিন্দুরাও। কিন্তু তথাপি বাংলাদেশে এমন বুদ্ধিজীবী আছেন যে, তারা মনে করেন হিন্দুদের তুলনায় মুসলমানেরা অনেক বেশি ধর্মান্ধ। কথাগুলো বলতে হচ্ছে আরো এই জন্য যে, যেসব বুদ্ধিজীবী এসব কথা বলে থাকেন, আওয়ামী লীগে ভিড় জমিয়েছেন তারা। এদের মাধ্যমে প্রভাবিত হতে পারে আগামী নির্বাচনের বেশ কিছুটা ফলাফল। আওয়ামী লীগের বিরোধী জোটে এ ধরনের বুদ্ধিজীবীরা প্রশ্রয় পেতে পারছেন না। ভোট তাই হবে হিন্দুত্ববাদী ঘেঁষা আওয়ামী লীগের সাথে মুসলিম জাতীয়তাবাদী বলে কথিতদের। বাংলাদেশ একটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশ। মুসলিম জনমত ঝুঁকে পড়তে চাইতে পারে মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের অনুকূলে। এ রকমই ধারণা হচ্ছে আমার। ২০১২ সালে শেখ হাসিনা তার পিতার লিখে যাওয়া ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ প্রকাশ করেছেন। এতে কিন্তু শেখ মুজিব বলেছেন, দ্বিজাতিতত্ত্ব ঠিক ছিল। সঠিক ছিল পাকিস্তান আন্দোলন করা। তিনি তার জীবনকথায় লিখেছেন, ‘তখন রাজনীতি শুরু করেছি ভীষণভাবে। সভা করি, বক্তৃতা করি। খেলার দিকে আর নজর নাই। শুধু মুসলিম লীগ, আর ছাত্রলীগ।

পাকিস্তান আনতেই হবে, নতুবা মুসলমানদের বাঁচার উপায় নাই।’ তিনি তার এই বিখ্যাত জীবনীর এক জায়গায় বলেছেন, “আমাদের বাঙালির মধ্যে দুইটা দিক আছে। একটা হলো ‘আমরা মুসলমান, আর একটা হলো, আমরা বাঙালি।” এ থেকে বোঝা যায় যে, শেখ মুজিব বিশুদ্ধ বাঙালি জাতীয়তাবাদে আস্থাশীল ছিলেন না। তার মধ্যে বিরাজমান ছিল একটি মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবোধ। কিন্তু শেখ মুজিবের এই চেতনার সাথে মিল ঘটতে পারছে না বর্তমান আওয়ামী লীগের বহু বুদ্ধিজীবীর। তাদের সাথে মিল থাকতে দেখা যাচ্ছে কংগ্রেসের বিখ্যাত নেতা ও ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওয়াহের লাল নেহরুর চিন্তা-চেতনার সাথে। আওয়ামী লীগের বর্তমান ভাবধারার মধ্যে ফুটে উঠছে একটা দ্বৈধতা। যা সৃষ্টি করছে বিরাটভাবে মতবাদিক অসঙ্গতি। বোঝা যাচ্ছে না আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রিক পরিণতি ঠিক কী দাঁড়াবে। তার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সুরক্ষিত থাকবে কি না?

আসন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জিততে চাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আওয়াজ তুলে। কিন্তু কী ছিল আসলে এই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূলে? শেখ মুজিবুর রহমান ও ড. কামাল হোসেন ১৯৭১ সালে ভারতে যাননি। অথচ ইচ্ছা করলেই তারা যেতে পারতেন খুব সহজেই। কেন তারা ভারতে যেতে চাননি, তা এখনো হয়ে আছে অনুক্ত। ড. কামাল হোসেনকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বলা হয়েছিল, পাকিস্তানের এজেন্ট। কিন্তু পরে আমরা দেখলাম, ড. কামাল হোসেন হতে পারলেন স্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রিসভায় শেখ মুজিবের সবচেয়ে বিশ্বাসভাজন মন্ত্রী। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছিল কলকাতায় ৫৭/৮ বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে অবস্থিত। এই বেতার কেন্দ্র পরিচালিত হতো একজন ভারতের উচ্চ সরকারি কর্মচারীর তত্ত্বাবধায়নে। ভারত সরকারই চেয়েছিল কামাল হোসেনকে পাকিস্তানের এজেন্ট বলে চিত্রিত করতে। শেখ মুজিব আজ আর জীবিত নেই। কিন্তু কামাল হোসেন আছেন। তিনি তার ৮২ বছর বয়সে এগিয়ে এসেছেন বাংলাদেশে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে।

১৯৭১-এর পরিস্থিতি ছিল খুবই জটিল। শেখ মুজিবুর রহমান এ সময় ঠিক কী চেয়েছিলেন, তা আমাদের কাছে মোটেও পরিচ্ছন্ন নয়। এখন যত দূর অনুমান করা যায়, তাতে মনে হয় তিনি কোনো স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে গিয়েছিলেন না। কেননা, ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭১ সালের ৬ নভেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যে বক্তৃতা দেন, তাতে বলেন যে, শেখ মুজিব বাংলাদেশের কোনো স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যাননি। তার নামে অন্যরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। যেহেতু শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি, তাই তার সাথে আলোচনা করে শান্তিপূর্ণ উপায়ে পূর্ববঙ্গে উদ্ভূত রাজনৈতিক সমস্যার একটি সমাধানে আসা যেতে পারে।

শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর এই বক্তৃতাটি ভারত সরকার India Speaks নামক বক্তৃতা সঙ্কলনে প্রকাশ করে। যা দিল্লি থেকে প্রকাশিত হয় ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে। প্রশ্ন আসে কে প্রথম শেখ মুজিবুর রহমানের নামে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিল। এই নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। তবে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর প্রথম ১৯৭৭ সালের ১৯ ডিসেম্বর দিল্লি সফরে যান। নয়া দিল্লি বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানান ভারতের তখনকার প্রেসিডেন্ট সঞ্জীব রেড্ডি। তিনি তার স্বাগত ভাষণে জিয়াউর রহমানকে বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম ঘোষক। ২০১৪ সালে তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা শারমিন আহমদ বই লিখেছেন ‘তাজউদ্দীন আহমদ : নেতা ও পিতা’ নামে। এতে তিনি বলেছেন, তাজউদ্দীন শেখ মুজিবকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে বলেন।

কিন্তু শেখ মুজিব রাজি হন না। শেখ মুজিব বলেন, এর ফলে পাক কর্তৃপক্ষ তাকে দেশদ্রোহী বলবার যুক্তি পেয়ে যাবে। অর্থাৎ শেখ মুজিব তখনো নিশ্চিত ছিলেন না যে, বাংলাদেশ একটা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে সক্ষম হবে। অনেকে বলছেন শারমিন আহমদের কথা নির্ভরযোগ্য নয়। কারণ শারমিন আহমদের বয়স তখন ছিল মাত্র ৭ বছর। কিন্তু যেহেতু শেখ মুজিবের সাথে একপর্যায়ে ছিল খুবই ঘনিষ্ঠতা, তাই শারমিন আহমদের পক্ষে পারিবারিক সূত্রে সেই সময়ের অনেক কথা অবগত হওয়া সম্ভব। আমরা স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে বিতর্কের মধ্যে যাবো না। তবে আশা করব ড. কামাল হোসেন সেই সময়ের ইতিহাস সম্পর্কে হয়তো কিছু লিখে যাবেন আমাদের জ্ঞাত করবার জন্য। কেননা জীবিতদের মধ্যে একমাত্র তিনিই সেই সময়ের ঘটনাবলি সম্বন্ধে ব্যক্তিগতভাবে আছেন অবগত। সেই সময়ের কাহিনী বলবার আর কেউ জীবিত নেই।

শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিত্ব বেশ কিছু ভোট আকর্ষণ করবে। শেখ মুজিব জীবিত নেই। কিন্তু আওয়ামী লীগের বিশেষ রূপ দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। ব্যক্তি ইতিহাসে ভূমিকা পালন করে। শেখ মুজিব যে কিছু করেননি, এমন নয়। তবে তার ব্যক্তিগত ভাবমর্যাদাকে আর আগের মতো অত বড় করে দেখার সুযোগ নেই নির্বাচনী প্রচারণায়। কেননা, নানা কারণে ব্যক্তি শেখ মুজিবকে নিয়েও হতে পারছে অনেক বিতর্ক। যেমন ইন্দিরা গান্ধী তার জীবনীগ্রন্থ My Truth-এ এক জায়গায় বলেছেন, ‘তিনি (শেখ মুজিব) ছিলেন একজন অত্যন্ত ভাবপ্রবণ, উষ্ণ হৃদয়ের লোক, যিনি একজন আইন প্রণেতার চেয়ে পিতৃসুলভ ব্যক্তিত্বের বেশি অধিকারী ছিলেন। উপরন্তু তিনি সংগ্রামের বেশির ভাগ সময় দূরে অবস্থান করেছিলেন। আমি বলতে চাচ্ছি, মুক্তিযুদ্ধ, নির্বাচন ইত্যাদি বিষয়ে তার চিন্তাধারা, জনগণের দৃষ্টিকোণ থেকে স্বতন্ত্র ছিল, যারা এসব বিষয়ে অংশ নিয়েছিলেন।

আমি মনে করি না, তিনি তাদের পুরোপুরি বিশ্বাস করেছিলেন কিন্তু তারা তার প্রতি অত্যন্ত বিশ্বস্ত ছিলেন। তাই তারা যা কিছু করেছিলেন, তার (মুজিব) নামে ও তার জন্য করেছিলেন। কিন্তু তিনি এসব লোকদের গুরুত্ব দেননি। বরঞ্চ তাদের গুরুত্ব দিয়েছিলেন, যারা তার বিরুদ্ধে ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিল। এতে একটি প্রতিকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি অবশ্যম্ভাবী ছিল।’ (My Truth বইটি বাংলা অনুবাদ করেছেন স্কোয়াড্রন লিডার (অব:) মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম, ‘আমার সত্যকথন’ নামে। (উদ্ধৃতিটি তার অনুবাদ থেকে নেয়া) এই উদ্ধৃতিতে আমরা দেখছি ইন্দিরা গান্ধী ভাবতে আরম্ভ করেছিলেন যে, শেখ মুজিব আসলে ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী। ইন্দিরার বক্তব্য আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকে প্রভাবিত করবে। তারা তাই হয়তো আর চাইবেন না নির্বাচনী প্রচারণায় শেখ মুজিবকে খুব বড় করে তুলতে।

আওয়ামী লীগ বলছে তার সময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি আর্থিক উন্নয়ন ঘটেছে। কিন্তু বাস্তব ইতিহাস এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশ ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর মেতে ওঠে রাষ্ট্র পরিচালিত অর্থনীতির দিকে। এর ফলে দেশের অর্থনীতিতে দেখা দেয় বিরাট বিপর্যয়। কিন্তু জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে বাদ দেন রাষ্ট্র পরিচালিত অর্থনীতি। তিনি উৎসাহ দেন ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের। তার সময়ে আরম্ভ হয় শ্রমশক্তি রফতানি। ব্যক্তিগত উদ্যোগে আরম্ভ হয় তৈরী পোশাক স্থাপনের কারখানা ও তৈরী পোশাক রফতানি। তার সময়েই শুরু হতে পারে ব্যক্তি উদ্যোগে বাংলাদেশ থেকে গলদা চিংড়ি প্রজনন ও রফতানি। ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি পেতে পারে বিশেষ গতিবেগ। বাংলাদেশ আর থাকে না তলাবিহীন ঝুড়ি হয়ে। যেমন হয়ে উঠেছিল শেখ মুজিবের শাসনামলে। আর হেনরি কিসিঞ্জার করেছিলেন এই মন্তব্য। যা খুবই খ্যাত হয়ে আছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ এখন দাবি করছে কেবল তার সময়েই অর্থাৎ বিগত দশ বছরে বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে তলাবান ঝুড়িতে পরিণতি পেয়েছে। যেটা সত্য নয়। যেহেতু বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটছে ব্যক্তি উদ্যোগে, তাই যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক, উন্নয়নপ্রক্রিয়ায় ছেদ ঘটবার কোনো কারণ দেখা দেবে না।

যেমন শঙ্কা প্রকাশ করছে আওয়ামী লীগ। কারণ নির্বাচনের মাধ্যমে কেবলই বদলাতে যাচ্ছে সরকার। ব্যক্তি উদ্যোক্তারা নয়। কোনো উদ্যোক্তা ব্যবসায়ে লোকসান দিয়ে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিতে পারেন, কিন্তু তাদের স্থলে আসবেন নতুন উদ্যোক্তারা। অর্থনীতি হবে না উদ্যোক্তাশূন্য। অনেকে বলছেন, বাংলাদেশে ধনিকের সংখ্যা বাড়ছে। এর মাধ্যমে দরিদ্র জনসমষ্টি হতে পারছেন না উপকৃত। কিন্তু আজকের দিনে বড়লোকেরা টাকা পয়সা আগের দিনের মতো মাটিতে পুঁতে রাখেন না; রাখেন ব্যাংকে। ব্যাংক থেকে টাকা ধার নিয়ে অন্যরা অবাধেই খাটাতে পারেন ব্যবসা বাণিজ্যে। হতে পারে একটি দেশের সাধারণ আর্থিক শ্রীবৃদ্ধি। তাই বড়লোক বাড়া মানেই হয়ে দাঁড়ায় না একটি দেশে গরিবের গরিবি বেড়ে যাওয়া।

আওয়ামী লীগ একদিন গড়েছিল বাকশাল। যার ভিত্তি ছিল বামচিন্তা। কিন্তু এখন সারা বিশ্বেই বামচিন্তায় নেমেছে দারুণ ধস। আমাদের সংবিধানে সমাজতন্ত্র কথাটা এখনো আছে। কিন্তু এখন এ কথা অনেকের কাছেই সহজ সত্য হয়ে উঠেছে যে, আমলাতান্ত্রিক জটিলতায়ই সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে উৎপাদন না বেড়ে কমে যেতেই চায়। যেহেতু আওয়ামী লীগের মধ্যে এখনো বামচিন্তকেরা অনুপ্রবিষ্ট হয়ে আছেন, তাই আওয়ামী লীগ আবার গড়তে চাইতে পারে বাকশালের মতো একটা কিছু, যদি সে আগামী নির্বাচনে জিতে যেতে পারে। নানা প্রসঙ্গে চিন্তা করেই নির্বাচকমণ্ডলীরা দিতে যাবেন ভোট।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement